ঘাতক
সপ্তর্ষি
বিশ্বাস
মেলা!
হ্যাঁ, মেলা'ই বটে!
টিলা-শরীর বেয়ে উঠে যেতে যেতেই নিশ্চিত হলাম যে মেলা'ই
চলছে। নাহয় বড়সড় হাট। সে'ও আমার কাছে এখন মেলা। মহামেলা।
জোর পা চালিয়েও জলামাঠের মাঝামাঝি পৌঁছতেই সন্ধ্যা হয়ে
গেলো। অন্ধকারের মধ্যে আলাদা করে চেনা গেলো টিলার অস্তিত্ব তার গায়ে, মাথায় আলোর ফুলকি
দেখে। দিনের আলোয় একেও মনে হচ্ছিল দিগন্তে, আকাশের সঙ্গে মিশেথাকা পাহাড় শ্রেণীই। হাঁটুজল
ভেঙ্গে শুকনায় পৌঁছতে পৌঁছতে অন্ধকার নামলো গাঢ় হয়ে। এদিকে নদী আছে জানি। টিলাশরীরের
কোটরে, গর্তে ডাকতে থাকা ঝিঁঝিঁশব্দের আড়ালেও নদীধ্বনি টের পেয়েছি। টিলা পার হয়ে এগোতে
থাকলে গ্রাম পাওয়া যানে জানি। রাঢ়দেশ এটা। কাছাকাছিই কোথাও আছে সোনাবীথি গ্রাম।এখানে
এলে আমাদের দেশগ্রামে ফেরার পরে প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো। কেজানে, হয়তো এখনো হয়।
আমি পথের মানুষ। আমার জাত টাত কিছু থাকলে সেসব যে কবে
গিয়েছে ধুয়ে মুছে নিজেও জানিনা। আমার কাছে রাঢ়দেশ যা বিন্ধ্যাচল আর ব্রহ্মদেশও তা'ই।
আমার শুধু যাওয়া আছে। ফেরা নেই। কোথায় যাবো তাহলে? গ্রামের খোঁজে হাঁটতে থাকবো নদীর
জলধ্বনি লক্ষ্য করে না'কি উঠে যাবো টিলায়? মেলায়? বহুদিন, বহু বহু দিন মেলা দেখিনি,
করিনি কোনো আনন্দ-ফুর্তি। অথচ কোথাও বাঁধা না পড়ে আমরণ আনন্দ-ফুর্তি কবো ভেবেই না একদিন
নেমেছিলাম পথে। ছেড়ে ছিলাম জাত-পেশা।...
আনন্দ-ফুর্তি,যাকে হালে বলে 'মস্তি' -- সেসব ছিলো আমাদেরো।
ভরপুরই ছিল। তবে ছিল যুদ্ধের আগে। যুদ্ধের পরে মস্তি দেবে কারা আর নেবেই কারা? রাজায়
রাজায় যুদ্ধে প্রাণ গিয়েছে সব শালা উলুখড়েদের। যেদিকে যাও, যে গ্রামে, যে নগরে -- শ্মশান
আর চিতা আর গোর দেওয়ার তোড়জোড়।
তাই বা কি মিলছে সবার? যে অঞ্চলে নদী আছে, নদীতীরে লাশের
পাহার-পর্বত। যেখানে নদী নেই, নেই কোনো বহতা জলস্রোত, সেসব স্থানে লাশ মাঠে ময়দানে।
মেলা'ত দূরস্থান, না বসে বাজার, না'ত চাষবাস। পথের দুপাশে ধুধু মাঠ জোড়া শূন্যতা ।
দিনে চিল,শকুন,কাক আর রাত্রে শেয়াল। পথ খাঁখাঁ। এই সকল খাঁ খাঁ পথ ধরে কোথায় চলেছি
কেজানে।
আমার এই কয়েক বছরের যা সম্বল, তেমন সাত রাজার ধন নয়, অবশ্যই,
তবে সাধারন জীবন, এই অর্থ দিয়ে, চালিয়ে নেওয়া যাবে অন্ততঃ পাঁচ সাত বছর। সেই সবই আছে
আমার বোঁচকায়। তথাপি প্রায় বছর ধরেএই পথচলায় দেখা মিল্লো না চোর ডাকাতের। মিলবেই বা
কিকরে? জোয়ানমদ্দ সবই তো মরেছে যুদ্ধে। যে সব জোয়ানমদ্দ পালিয়ে ছিল যুদ্ধের ভয়ে কিংবা
ঘেন্নায় কিংবা যে কোনো কারনে -- এক সময় তাদেরো খুঁজে আনতে লোক লাগলো। বন জঙ্গল ঢুঁড়ে
তাদেরো এনে জুতে দেওয়া হলো কোনো এক পক্ষে। বাস্। এখন ব্যাটামানুষ বলতে বুক আর মাথা
থাবড়ানো বুড়ো'র দল। স্থানে স্থানে দেখেছি মাঝ বয়সী আর কম বয়সী মহিলারা মিলে চুরি চামাড়ির
ধান্দা করছে। ধান্দা বলতে আমার মতন একলা পথিক কিংবা কোনোভাবে যুদ্ধ থেকে নিস্তার পাওয়া
পরিবার । যারা কোনোভাবে এই যুদ্ধে বেঁচে গিয়ে নিজেদের যা কিছু ছিল সঙ্গে নিয়ে চলেছে
অন্যত্র। তবে 'অন্যত্র' কোথায় কেজানে। এমনি সব পরিবারকে নয়তো একা-দোকা পথিকদের ভুলিয়ে
ভালিয়ে, নয়তো না শরীরের লোভ দেখিয়ে আর কিচ্ছুতে কিছু না হলে গায়ের জোরে যা পাওয়া যায়
তা'ই কেড়ে নেওয়া। তবে মুদ্রা, গয়নার চেয়ে এদের দরকার পেটে ভাত। খাদ্য। এই সকল পথিকদলের
ঝুলিতে অনেক সময় মেলে চালডাল। ওই সবে পেট ভরিয়ে, গায়ে কিছুটা জোর করে নিয়ে, এই 'ডাকাত'রাও
পথে নামে। নামে 'অন্যত্র'র খোঁজে। বুড়োবুড়ি – যারা চলতে অক্ষম তাদের মেরে ফেলে যায়
তারা, যাদের শরিলে দয়ামায়া আছে আর নয়তো গ্রাম ভরা লাশের সঙ্গে এমনি ফেলে চলে যায় একদিন
লাশ হয়ে যাওয়ার জন্য।
আমি ভাগ্যান্বেষী। ভাই,বাপ ঠাকুরদাদা,পরদাদা,বৃদ্ধ পরদাদা,
তস্য পরদাদা -- সবাই ছিল গোয়ালা, ছিল রাখাল। ভাই,বাপ ঠাকুর্দার পেশা ছেড়েছি সেই আঠারো
উনিশ বছরেই। তারপর প্রথম প্রথম পদাতি দলের তল্পী বাহক হয়ে ঘুরে বেড়ানো। পরে, ক্রমে,
'যুদ্ধ'তে হাত, মাথা একটু পাকলে এখানে ওখানে যুদ্ধ খুঁজে বেড়ানোই হয়ে গিয়েছে কাজ। জীবিকা।
কাজেই আমার মতন লোককে, গায়ের জোরে, মহিলা-ডাকাতরা অন্ততঃ পারবেনা হারাতে। হয়তো এটা
টের পেয়েই অনেক মেয়েরা শরীর স্ব-ইচ্ছায় দিয়ে দাম নিয়েছে। অনাহারে, অভাবে, শোকে, ভীতিতে,অনিশ্চিতিতেও
অনেকেরই শরীর এখনো উর্বর, অনেকেরই চেহারা, চোখ আছে বুকে গেঁথে।
কিন্তু তাদের সবারই বুকের কোথাও পেয়েছি মৃত্যুর ঘ্রাণ।
তাই খোঁজ করেছি পেশাগত যারা বারবণিতা, তাদের। তাদেরো, ওই জোয়ান মদ্দদের মতো, নিয়ে যাওয়া
হছে, শুনেছি, বড় বড় সেনাপতি আর বাছা বাছা সৈন্যদের যুদ্ধকালীন 'মনোরঞ্জন'হেতু। যুদ্ধকালেও
কানে কথা এসেছে। কিন্তু আমি তো তেমন সৈন্যজন নই যাকে তুষ্ট রাখতে রাজা রাজড়ার দল মেয়ে
যোগান দেবে।
আমার মতো নেহাৎই সৈনিক পালাতেও পারবেনা। পালাতে চাইলে
প্রথমে দলের লোকই গিয়ে চুকলি কাটবে। তা যদি না'ও হয় যুদ্ধ অঞ্চলের দশদিক ঘিরে আছে চরেরা,
পাহারাদারেরা -- মাঠ-পালানো সৈন্য ধরবার নিমিত্ত। যে পক্ষ ছেড়ে তুমি পালাচ্ছিলে সে
পক্ষের চর কিম্বা পাহারাদারের হাতে ধরা পড়লে হুজ্জতির একশেষ । বিপক্ষের হাতে ধরা পড়লে
হুজ্জতি কম। তবে মাঠ পালানো সৈন্যরা সব দলেই অবজ্ঞার পাত্র। হাসি ঠাট্টার খোরাক।
"এট্টু ইদিক ধেঁষে আসোতো ভাইয়া, কেমন যেন চেনা চেনা
লাগছে"... গাছ গাছালির আবডাল থেকে শুনলাম স্বরটা। স্বরটা চেনা চেনা ঠেকলো আমারো।
আনমনে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে টিলার উপরে, মেলার ভিতরে চলে এসেছি টেরই পাইনি। আদতে ভাবছিলাম
মেলা যখন, তখন গণিকা থাকলে থাকতেও পারে। এতাবৎ নেহাৎই দেহের ধর্মে কিংবা কখনো দেহ বেচতে
আসা মেয়ের প্রতি দয়া পরবশ হয়ে যে কয়েকটি নারী সঙ্গ করেছি সেই সবগুলিতেই যেন মৃত্যুর
ঘ্রাণ আরো গাঢ় হয়েছে শরীরে, শোণিতে। এদের কারো স্বামী মরেছে যুদ্ধে, কারো বা মরেছে
বাগদত্ত পুরুষ। কারো বাপ, ভাই, স্বামী, দেওড় , নাগর ...যেন ওই সব মৃতদের শ্বাস মিশে
গিয়েছে, তাদের প্রিয়জনাদের সঙ্গে সঙ্গমের দ্বারা, আমারো গহনে। তাই খাঁটি গণিকার সন্ধান
ছিল আমারো গহনে।
গণিকা, খাঁটি, হয়ে ওঠা নয় খুব সহজ কাজ। খাঁটি গণিকাদেরও
থাকে বাপ-মা-ভাই-বোন-নাগর-প্রেমিক। তারাও মরে। রোগে মরে। যুদ্ধে মরে... কিন্তু খাঁটি
গণিকাকে শিক্ষা নিতে হয় সেই ছলা'র কলায় যার দ্বারা এই সমস্ত বিয়োগ, দুঃখ, হাহাকার তার
বুকের গভীর থেকে কখনোই, গ্রাহকের সম্মুখে, উঠে আসেনা, তার স্তনে, তার নৃত্যগীতে। খাঁটি
গণিকা, যদি হয়ে উঠতে চায় কূলবধূরাও, তবে তাদেরো শিখে নিতে হবে এসব বিদ্যা। যুদ্ধান্তের
এই অবস্থা যদি আরো স্থায়ী হয়, আরো মানচিত্র-প্রসারী হয়, তবে, পথে পথে পার হয়ে আসা ওই
সব অনাথিনীদেরো অনেকেই, জীবনে টিঁকে থাকবার সহজাততায়, শিখে নেবে, নৃত্যগীতাদি নাহোক,
ওই ভুলে থাকবার, ভুলিয়ে রাখবার কলাটি যাকে পন্ডিতেরা বলে 'ছলা','ছল', 'চাতুরী'। ভাবি
'ছলা','ছল', 'চাতুরী' ভিন্ন আরো কিছু আছে কি সত্যই এই যাপনকে অর্থবহ করে তুলবার? আবার
ভাবি ভাই,বাপ ঠাকুরদাদা,পরদাদা,বৃদ্ধ পরদাদা, তস্য পরদাদা দিগের মতন যদি গোয়ালা হয়ে
গ্রাম আঁকড়ে পরে থাকতাম তাহলে ভাবতাম কি এভাবে? কিন্তু আদপেই যেতো কি গোয়ালা হয়ে থিতু
হয়ে থাকা? এই যুদ্ধ কি আমার গ্রামের, আমার অঞ্চলের গোয়ালা, তাঁতি,কামার, কুমোড় ...
সব্বাইকে এনে ফেলতোনা, ফেলেনি, এই যুদ্ধে? কোনো না কোনো ভাবে? অছিলায়? কোনো না কোনো
পক্ষে? আমার বিপক্ষের শিবিরে দেখিনি কি একটি দুটি চেনামুখ? চেনামুখ খুঁজেছি নিজের দলে,
শিবিরে। মেলেনি। কেন কে জানে। আমাদের দেশগ্রামেই কেউ কি যোগ দেয়নি এই পক্ষে? কেন দেয়নি?
...
মেলায় তাঁবু পড়েছে কয়েকটা। মশাল জ্বালিয়েই আলোর ব্যবস্থা।
মূলত। এক ঝলকে চারদিকটা দেখে নিয়ে বুঝলাম মেলা ঠিক নয়। নিশ্চয় আজ এখানে ছিল বাজারবার।
বাজারের কেনাকাটার শেষে এবার আমোদের পালা। একদল নাটুকে 'আলকাপ' গোছের কিছু একটা করবার
তোড়জোড় করছে। মশালের আলোর নিচে। কয়েকজন খুলেছে খাবারের দোকান। কয়েকজন গল্প ফেঁদেছে
পট দেখিয়ে। সঙ্গে বিক্রি করতে চেষ্টা করছে কিছু পট। রামায়ণের পটগুলি চিনলাম। আছে সদ্য
হয়ে যাওয়া যুদ্ধের পটও। সঙ্গে আছে রাঢ়দের দেব-দেবতার পটও। দেব দেবতা বলতে এক দেবীই
শুধু। সাপের দেবী মনেহলো দেখে। রাঢ়কথা মোটামোটি বুঝলেও পটকথা, তা'ও অচেনা দেবীর, শুনে
বুঝে নেওয়া সহজ হলোনা। পা চালালাম আর দেখলাম টিলার ওই প্রান্তে ঢালুর দিকে, কম সংখ্যক
মশাল, দুটি তাঁবুর ইশারা।
মেলায় খরিদ্দার বলতে এখন মূলতঃ যুবা পুরুষ আর বুড়োবুড়ির
দল। যুবাপুরুষের সংখ্যা দেখলাম এখানে বেশী। বুঝলাম এখানে যুদ্ধের ঢেউ আছড়ে পরেনি তেমন
তোড়ে যেমন পড়েছে আমাদের দিকে। রাঢ় বাংলার দক্ষিণ দিক এটা। রাঢ় দেশে এসে আমাদের দেশগ্রামে
ফিরলে পরে এক সময় প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো। হয়তো এখনো হয়। তাই হয়তো সৈন্য খুঁজতে আসা
ঠিকাদারদেরো ভয় ছিল এদিকপানে আসতে আর এখানের লোকও খুব যায়নি ওদিকে। যুদ্ধে।
টিলার উঁচু থেকে দেখাযায় অঘ্রাণের দামোদর রেখা। কাছাকাছিই
কোথাও আছে সোনাবীথি গ্রাম। মেলায় পসরা নিয়ে আসা কিম্বা মেলা ঘুরতে আসা লোকেরা নিশ্চয়ই
কাছেপিঠেই থাকে। তবে যুবাপুরুষদের
গতি, টিলার অপর প্রান্তের দিকে ওই আবছা তাঁবুগুলির দিকেই।
বুঝলাম মধুচক্র ওই পথেই। দেখেশুনে আমিও ওই দিকে পা বাড়ানো মাত্র কাছের আবডাল থেকে কে
যেন বলে উঠলোঃ "হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছি মনে হচ্ছে। চেহারা তেমন কিছু পাল্টায়নি হে!
তা'ও আসো তো, দেখি ওই মশালের আলোয় একবার দেখেনি ভালো করে ..."
হয়তো চিনতামই না। হয়তো চিনতে দেরী হতো। কিন্তু চিনে যে
ফেললাম তার হেতু ওই কোনাকুনি দাগটা। বাঁ চোখের নিচ থেকে, নাক বেয়ে, নেমে গেছে কণ্ঠনালী
অব্দি। প্রায় বারো বছরের অতিক্রান্তি ওই দাগের কিনারে, মুখের, কপালের আরো অনেকাংশেই
এঁকে দিয়েছে আরো অনেক বেঁকা তেরা দাগ। তবু একদা কোনো মানুষের করে দেওয়া দাগটিকে যায়
চিনে নেওয়া। পরে, উজ্জ্বলতর মশাল আলোয় দেখলাম যে তার কন্ঠনালী বরাবরও একটি নতুন, মানুষে
করা দাগ। আগে চুল ছিলনা এমন লম্বা। দাড়ি'ত ছিলই না।
"ভায়া, কতটা বছর ঘুরে দেখা হল বল... তা'ও দেশবাড়ির
কাছেপিঠে নয়। রাঢ় দেশের এই ম্লেচ্ছ দূরান্তে... " আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরলো। আপ্লুত
আমিও বটে। ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পরার পরে, ক্রমে যখন কড়ির মুখ দেখতে লাগলাম, তখন ভাবতাম
আর এই বিরাট যুদ্ধের পরেও ভেবেছি, ফিরে যাই দেশগ্রামে। ভাই,বাপ ঠাকুরদাদা,পরদাদা,বৃদ্ধ
পরদাদা, তস্য পরদাদা দিগের মতন যদি গোয়ালাগিরি না'ও করি, যদি একটা দোকান দাকান খুলে
বসি... ঘর বাঁধি... কিন্তু যুদ্ধ থামলে ভয় লাগলো। যুদ্ধে তাকে তাকে থাকতাম দেশগ্রামের
কাউকে কোনো শিবিরে চোখেপড়ে কিনা...। চোখে পড়েনি যে একেবারে, তা নয়। তবে সবই ভিন শিবিরে।
দুয়েকজনের চোখ, ওই হানাহানি খুনাখুনির মধ্যেও, স্থির হয়েছে আমার চোখেও। কিন্তু পর মুহুর্তেই
হয় ভেসে গেছে ভিড়ের নয়তো রক্তের স্রোতে।
যুদ্ধ থামলে যখন আবার নামলাম পথে তখন সমস্ত দেখেশুনে মনে
হল কিজানি কি দেখব দেশগ্রামে গিয়ে। কি আর দেখব? নিশ্চিত দেখব আর গ্রামে যা যা দেখছি,
দেখেছি।... সামনে দাঁড়ানো 'খসানে-ভানু'র স্পর্শে যেন টের পেলাম দেশগ্রামেরই স্পর্শ,
ঘ্রাণ। তাই কোনো কুশল প্রশ্নাদির পরিবর্তে জিগিয়ে বসলামঃ আমার বাড়ির খবর বল। মা, বাবা,
দাদা... "
" না রে ভায়া। আমিওত দেশ ছেড়েছি আজ প্রায় আট বচ্ছর।
তা ভায়া এদ্দিন ঘুরে দেখা, সব কথাই কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হবে? চলো কোথাও বসিগে। চল আমার
গরিবতাঁবুতেই চল.. "
আমার হাত ধরে টান দিলো 'খসানে ভানু'।
*****
"তা ভায়ার ঠিক কি করা হয় আজকাল"? পোড়া মাটির
কল্কেতে বড় একটা টান দিলে বল্লাম।
আমার হাত থেকে কল্কেটা নিয়ে আমার চেয়েও লম্বা এক টান দিলো
ভানু। তারপর মুচকি হাসলো। কিনারের তাঁবু চলকে আসা মশাল আলোয় তার মুখ এক রহস্য। নাক,
মুখ, কান দিয়ে বার হয়ে আসা নীলচে ধোঁয়ায় সে রহস্য হল গাঢ়তর। ভানু যে ঠিক কোথা থেকে
এসে জুটেছিলো আমাদের গ্রামে তা জানেনা কেউ। ভাই,বাপ ঠাকুরদাদা,পরদাদা,বৃদ্ধ পরদাদা'রাও
না। গ্রামসীমার ওধারে, জঙ্গলে, যেখানে লোকে যেতোনা গরু বাছুর নিয়েও, সেখানেই একদিন
দেখা গিয়েছিল ভানু আর এক বুড়িকে। ভানু বলতো "দাদি"। শব্দটা আমাদের ভাষায়
ছিলনা। সে নাকি ভালো জানতোনা আমাদের ভাষাও। পরে নিশ্চয় শিখে নিয়েছিল। আমরা তো তার সঙ্গে
পাক্কা বরজো'তেই কথা বলতাম। ওই "দাদি" শব্দের অর্থ পিতামহী কিংবা মাতামহী।
তবে বৃদ্ধা যে তার কোনজন সে খবর আজো আমাদের অজানা। আমাদের জ্ঞান হয়ে মাঠে গরু নিয়ে
যাওয়া কালেই ভানুর বয়স আমাদের চেয়ে ঢের বেশী। তার মুখের কাটা দাগটা আমরা দেখছি তারো
আগে থেকেই। তবে ভানুর সত্যি বয়স যে কত, তা জানা ছিলনা, বোঝাও যেতোনা। তাহলেও সময় কাটাতো
বন্ধুর মতো। আমাদের সঙ্গে, আমাদের চেয়ে বড় রাখলদাদা,গোয়ালামামাদের সঙ্গে, একই অবলীলতায়।
বয়সে বড় রাখলদাদা,গোয়ালামামা,গোয়ালকাকা'রা সামনাসামনিই ওকে 'খসানে ভানু' বলতো। পরে
জানলাম তার আদত কাজ পেট খসানো। গ্রামের মেয়ে-বৌ'দের। তার নিজের 'কাজ' ঠিক নয়। 'কাজ'টা
করতো তার দাদি। সে ছিল দাদি'র জুগালি। দাদি'র দরকার আর আদেশমতো জুগিয়ে দিতো পাতালতা,
শিকড়বাকড়। তবু তাকেই সবাই বলতো 'খসানে', 'খসানে ভানু'। পরে, বয়স খানিক বাড়লে তার সাহায্য,
তার দাদির সাহায্য করকার পড়েছিল... ... সে যাই হোক। আসর জমিয়ে গল্প করা ছাড়াও 'খসানে
ভানু'র হাতের গাঞ্জা ছিল স্বর্গীয়। সে গুণ যে তার বজায় আছে তা কল্কেতে প্রথম টান দিয়েই
টের পেয়েছি।
নাক, মুখ, কান দিয়ে বার হয়ে আসা নীলচে ধোঁয়ায় চালচিত্রের
রহস্যকে গাঢ়তর করে ভানু হাসলো। বল্লোঃ আগের যা করতাম, তা'ই করি...।
একটু থামলো ভানু। আরেকটা জোর দম লাগালো কল্কেতে। কল্কে
দিলো বাড়িয়ে। আমার দিকে। তারপর আবার নাক, মুখ, কান দিয়ে বার করে দিলো ধোঁয়া। হাল্কা
নীল ধোঁয়া। তারপরে বল্লোঃ ওই তোমরা যা বলতে, 'খসানে', সেই 'পেট খসিয়ে'ই পেট চালাই
...”
এক্ষণে মেলার আন্ধার প্রান্তের দুই রহস্য-তাঁবুর কাছ ঘেঁষে
তার নিজস্ব তাঁবু'র হেতু স্পষ্ট হলো মোটামোটি। কিন্তু ভানু'ত একা। দাদি কোথায়?
“দাদি মরেছে। ভাগ্যে মরার আগে সব বিদ্যে শিখিয়ে গেছে।
… অনেকটা অবশ্য শিখে নিয়েছিলাম দাদি'র জুগালী দিতে দিতেই ...”
একটা দীর্ঘশ্বাসের ইশারা কি পেলাম না ভানুর উচ্চারণে?
অথচ আমার বারো বচ্ছর বয়েস থেকে আঠেরো উনিশ বচ্ছর অব্দি দেখা ভানু'র কোনো মন খারাপ,
কোনো দীর্ঘশ্বাসের স্মৃতি আমার মর্মে নেই। টিলার ঢালুতে ভানুর তাঁবু আর দুটো তাঁবু
ছেড়ে। তাঁবুতে তার সঙ্গে থাকে আরো দুটি লোক। কথায় কথায় ভানু জানালো ওরাই মেয়ে দল নিয়ে
ঘুরে বেড়ায়। দু চারটে মেয়ে, যারা কিছু কিছু গান, নাচ পারে তারা গানের আসরেও যায় আবার
পরে এখানেও গ্রাহক সামলায়।
“এখুনি যাবে ভায়া? খুব জোর তলব লেগেছে নাকি? আরেকটু বসো
না। সূর্যমুখী গাইয়ে মেয়ে। ওই গানের গলে ভিড়ে আছে। বেশী রাতে আসবে। … আমার তাঁবুতেই
হবে নাহয়। না'কি এখুনি যাবে"?
ভানুর কথায় 'তলব'হেন আরো বেশ অচেনা শব্দ পড়েছে ঢুকে। আগে
হলে আমিও বুঝতাম না। কিন্তু ওই মস্ত যুদ্ধে দেশটার শত দিকের শত লোকের ভাষা শুনে আর
এই এক বছর ধরে পথচলায় অনেক অ-বরজ বুলি, কথা এখন আমার আয়ত্তে। 'তলব' আমার লাগেনি বল্লে
মিছে কথা হবে। হ্যাঁ, মৃত্যুর, মৃতের ঘ্রাণ, চালচিত্র, ছায়াতে ঢাকা নারী শরীরের বিস্বাদ
ভুলতে একটি ঠিক ঠাক গণিকাশরীর আমার দরকার। ওই দরকারের মানসিক দিকটা মিটেছে। ভানু নিশ্চয়
করে দিয়েছে। তাই এখন তলব নিয়ে অপেক্ষায় থাকতে মন্দ লাগছেনা। টুকরো কথাবার্তার আবডালে
একটা কল্পনা, সিক্ত, আমাকে চাঙ্গা রেখেছে। সঙ্গে মিশে আছে একটা মন খারাপ, একটা দুশ্চিন্তা।
দেশগ্রামের মানুষ ভানুকে পেয়েও জানা হলোনা দেশগ্রামের অবস্থা। মা,বাবা, দাদা, ছোট বোনটা,
অন্য অন্য গোয়ালা-মেয়েরা … কে কেমন আছে? আছে কি আদৌ এই কাল যুদ্ধের শেষে? ভানু'র দাদি'র
কি স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে না'কি …
“তলব আছে। থাকিক তলব। মেটাবো তোমার ওই সূর্যমুখীকে দিয়েই
… আচ্ছা ভানু, তুমি দেশগ্রাম ছাড়লে কেন বলোতো? তা'ও বলছো সাত-আট বচ্ছর আগে। তখন তো
যুদ্ধও ...”
“ না'রে ভায়া যুদ্ধে কিচ্ছু হয়নি। তবে জানে যে বেঁচেছি
...। দাদি'কেতো পারলাম না বাঁচাতেই। ক্ষুর চালিয়ে ছিল আমাকেও। আমি শালা তা'ও ওই কাটা
গলা ধরে ...”
আগে না দেখা গলার যে ক্ষতটা মেলায় ঢুকেই চোখে পড়েছিল সেদিকে
ইঙ্গিত করে বল্লো ভানু।
ভানুর তাঁবুতে, তাঁবুর বাঁশে হেলান দিয়ে বসে আছি। ভানুর
তাঁবুর মশাল নেভানো। সামনাদিক খোলা। টিলাশরীরে তাল-খেজুরের, আঁশ-শ্যাওরা আর অর্জুন
আর শালের গায়ে জমে উঠেছে অঘ্রাণের কুয়াশা। শিশির ঝরছে । ভেসে আসছে গানের আসরের কলিহারানো
সুর, পটকথকদের স্বর, কিনারের তাঁবুগুলি থেকে শীৎকারের আওয়াজ। হাসি। নূপুরের ধ্বনি।
গঞ্জিকার নীল ধোঁয়া কুয়াশার সঙ্গে মিলেমিশে নির্মাণ করেছে আরেক আস্তর। তাঁবুর আশপাশ
দিয়ে মশাল হাতে চলে যাচ্ছে এক দু'জন বা মেয়েরা আসছে 'কাজ' শেষে ধোয়ামোছা সাড়তে। দলের
বুড়ির স্বর শোনা যাচ্ছে। হাতে মশাল নিয়ে সে'ও আসছে কখনো। কখনো করছে হাঁক ডাক। এই সমস্ত
আলোয় কাঁপছে তাঁবুর পেট ভরা অন্ধকার। তার সঙ্গে কাটা দাগ, ক্ষুর চালানো, জান নিয়ে পালিয়ে
বাঁচা এই সকল শব্দ মিলে গিয়ে ভানু এখন প্রায় অলীক। কল্কের হাত বদল হচ্ছে দ্রুততায়।
“আরে লোক লাগিয়ে দিয়েছিল হে। খুনী। যাকে বলে গুপ্ত ঘাতক।
টের পেয়েই গ্রাম ছাড়লাম। তবু পারলাম না শেষ রাখতে। যমুনা পার হলাম ঠিকই। আর সেই রাতেই
...”
কিছু একটা মিলছেনা। আমাদের দেশগ্রামের সঙ্গে ক্ষুর চালানো,
জান নিয়ে পালিয়ে বাঁচা, খুনী, গুপ্ত ঘাতক এই শব্দগুলি মিলছেনা, আমার মর্মে, কোনোভাবেই।
অথচ ভানুর স্বরের বিষাদ আমাকে নিরস্ত করছে প্রশ্ন করতেও।
অথচ আমার বন্ধ চোখে আমার যে দেশগ্রাম তা যমুনা তীরবর্তী
এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম। শাল তমালে ঘেরা গোয়ালাদের গ্রাম। লবঙ্গলতায় ঘেরা কুটীরগুলি। সেই
লবঙ্গলতাগুলি ললিত দুলে যায় ক্ষণে খণে। কোকিল-কূজন ধ্বনি ওঠে থেকে থেকেই। গোচারণ, গোরক্ষা,
গোদুগ্ধ বিক্রি, গোদুগ্ধ থেকে দই, খীর, ননী ছেঁকে তোলা, গ্রামান্তরে যাওয়া সে সব পসরা
নিয়ে। মাঠে মাঠে গোচারণ। সেই সঙ্গে গ্রামসীমা পার হয়ে বনে বনে খুঁজে বেড়ানো গোচারণের
যোগ্য পরিসর। প্রতি যুবার হাতেই প্রায় বাঁশি। বাঁশি বালকদের এমন কি বালিকাদের হাতে
হাতেও। যখন তখন যেখান সেখান থেকে ওঠে বাঁশির সুর। ওঠে গান। বরজ ভাষায়। কখনো রাতের রাত
কেটে যায় বাঁশিতে, গানে, নাচে। কখনো হয় ষাঁড়ের লড়াই। কখনো আকাশ ঘিরে আসে মেঘ। বনে,
শাল-তমালে, ঘনায় মেঘের ছায়া। বিষ্টিবাদলের আশংকায় পথিকদল, গোপিনীদল তাকায় আকাশে। বলে
'তাড়াতাড়ি চল্, তাড়াতাড়ি চল্"। যারা তখনো নৌকায় তারা মাঝিকে তাড়া দেয় ' জোর
টানো হে মাঝি। বিষ্টি এলো বলে"। কোনো কোনো ফাজিল, ছোকরা মাঝি তাড়া দেওয়া যুবতীকে
বলেঃ " যাবো জলদি। তবে শর্ত আছে"। মেয়ে বলে "কি শর্ত আবার? তুমি মাঝি,
নাও বাওয়া, নাও বেয়ে আমাদের পারাপার করা তোমার কাজ। তাতে আবার শর্ত কি?” ছোকরা মাঝি
বলেঃ "ঠিক আছে। তবে যেমন বেগে যাচ্ছি, তেমনি যাই। আসুক বিষ্টি। ভিজুক তোমাদের
দামী শাড়ি কাপড়। নষ্ট হোক ফিরিয়ে আনা উদ্বৃত্ত দুধ, দই, ঘি, মাখন। তা, গো তাড়া দেওয়া
মেয়ে, তোমরা নির্ঘাৎ দুধে জল মেশাও নাহলে দিনের বিকিকিনির পরেও ...” তাড়া দেওয়া মেয়ে
বলেঃ "হুঁ। অনেক হয়েছে। এবার তোমার শর্ত বলে ফেলো হে, ওই বিষ্টি নেমেই গেলো বুঝি
...” তখন সেই ছোকরা মাঝি, যে ফাজিলও বটে, বলেঃ "সব সখীকে পার করতে নেবো এক আনা
করে ...” মেয়েরা বলেঃ "তা নাও, তেমন তো কথা'ই ঠিক করা আছে"। ছোকরা তখন ওই
তাড়া দেওয়া মেয়েটিকে দেখিয়ে বলেঃ "তবে তোমাকে পার করতে এক আনায় তো পারবো না। তোমাকে
দিতে হবে তোমার কানের সোনা ...” … আর সেই মেয়ে, সেই মেয়েরা ...তাদের কলসহেন স্তনের
ভারে যেন তাদের মেরুদন্ড না বেঁকে যায় তারই জন্য তাদের গুরু নিতম্বগুলি গঠিত। সেই স্তনযুগের
উপরে এলিয়ে আছে পুষ্পমালা, রত্নমালা, মণিহার। তাদের দৃষ্টিতে কুহক। তাদের গলায়, বুকে
সততই বিন্দু বিন্দু ঘাম … যেনবা অন্তর্গত কামেরই পত্রলেখা।
এই মেয়েকে হয়তো এই মাঝির সঙ্গেই দেখা যেতে পারে, অনতি
বিলম্বেই, মিলনে নিরত কোনো বনে, কোনো ঝোপঝাড়ের আবডালে। হতে পারে সে মেয়ে বিবাহিতা,
হতে পারে কুমারী। রাখালযুবারাও তেমনই রমণীমোহন। কোনো কোনো পূর্নশশীর বৈকালে আয়োজন হয়
ষাঁড়ের লড়াইএর, কুস্তি ও হয়। হয় গরুকে ছুটিয়ে দিয়ে তাদের দৌড়ে গিয়ে ধরে আনার খেলা।
গোপগৃহগুলির বাতায়ন-আড়াল থেকে সেই সব যুবকের প্রতি নিজ নিজ মন আর শরীরের কামনার বর্শা
ছুঁড়ে দেয় এই গোপিনীরা। তারপর, ক্রমে রাত্রি, পরিণয়ে নত হয়ে আসা নয়ন-ছায়ার মতো নেমে
এলে ছেলের দল, যুবার দল ছড়িয়ে যায়, বাঁশি হাতে হাতে, গোচারণ মাঠের যে সব স্থানে অন্ধকার
– সেসব স্থানে। ক্রমে উঠে আসে চাঁদ। মেয়েগুলি, বৌগুলি ভয়ে ভয়ে কিংবা ভয়, লজ্জা ছেড়ে
দিয়েই চলে যায় যে যার নাগরের কাছে, পূর্ব নিদ্ধারিত সঙ্কেতে। … পরের দিন আবার এমনি
ভোর, সকাল, গাই দুয়ে আনা, দই, দুধের কলসী কাঁখে করে বার হয়ে যাওয়া, সেই মাঝি, সেই নদী,
সেই গোচারণ ভূমি, অরণ্য, সেই যাওয়া, জল আনতে, সন্ধ্যায়, সেই তমালবৃক্ষের কিনারে কিনারে,
যমুনার ঘাটে কিংবা আঘাটায়। এই তো ছিল আমাদের জীবন। ভানুর হাতের গঞ্জিকায় হয়তো স্মৃতি
চারণে মিশে গিয়েছে অশিক্ষিত কবিত্ব। তবে এমনই ছবি চোখে করে আমি ছেড়ে ছিলাম গ্রাম। হ্যাঁ,
গোপ বালিকা, গোপ যুবতী দুয়েকজনের সঙ্গে দেহের, মনের লেনদেন যে হয়নি আমারো তেমন নয়।
এমনি একটি মেয়েকে নিয়েই বিপদে পড়তে পড়তে পড়িনি এই 'খসানে ভানু' আর তার 'দাদিমা'র কল্যাণে।
তথাপি ওই গ্রাম, ওই শান্ত যাপনের একঘেয়েমি আমাকে তিষোতে দেয়নি গ্রামে। পালিয়ে গিয়েছি।
তবে এদিককার রাজা আমাদের গ্রামটিকে দেখেন না খুব ভালো চোখে – এরকম একটি কানাঘুষা শুনেছি।
এর বেশী কিছু নয়। ওই 'খুব ভালো চোখে না দেখা' থেকেই কি ভানুর জীবনের এই রক্তাক্ত অধ্যায়ের
সূত্রপাত? কিন্তু তাহলে ভানু আর তার দাদি কেন? কেন নয় গ্রামের সর্দার গোছের লোকেরা?
...কে এই ঘাতক? কে লাগিয়ে দিয়েছিল গুপ্তঘাতক ভানু আর তার দাদি'র মতো নিতান্ত সহজ, সাধারণ
মানুষদের পিছে? …
বেশ খানিকটা সময় নীরব কাটলে এসে হাজির হলো তাঁবুর মাসীজনা।
ইঙ্গিতে কিছু জানালো ভানুকে। ভানু চোখ তুল্লো। বল্লোঃ "আচ্ছা, ঠিক আছে, তুমি যাও
হে। গিয়ে দেখো সব ব্যবস্থাদি ...” মাসি চলে গেলো।
“সূর্যমুখী আসছে। তবে ভায়া তোমাকে যেতে হবে ওর তাঁবুতেই
...আমি ভেবেছিলাম ...। যাইহোক। খুব ভালো মেয়ে মানুষ। সব পাবে ...। তোমার তো অভিজ্ঞতা
আছেই" মুচকি হেসে "আর তেমন হলে খসানোর দায় আমার হে...”
ঝট করে বল্লাম "ভানু, কে লাগালো তোমাদের পিছনে ঘাতক?
কেনই বা লাগালো … আমি মানে ...”
“আরে তুমি সখা মানুষ আমার হে। দেশের ভায়া। তোমাকে এমনিতেও
বলতাম। আরে ছোকরা ছিল আমাদের গ্রামেই। মাসে অন্ততঃ দুটো করে পেট করে পেট করিয়ে নিয়ে
আসতো খসাতে। … তারপর কিছুদিন গ্রাম থেকে বেপাত্তা হে। … হঠাৎ শুনলাম সে নাকি কিকরে
বসেছে রাজা হয়ে। … ঠিক রাজাও নয়। রাজার পরামর্শদাতা। শুনেতো আমি খুশি। দাদিমাও খুশি।
ভাবলাম এখন রাজগৃহে খসানোর কাজ পাবো আমরা। কিন্তু আদতে হলো ঠিক উল্টা। সে'ই চাইলো আমাদের
সরিয়ে দিতে ...”
“সেটা কেন ভায়া"?
“আরে ভায়া হে, আমাদের সেই বুড়ো সুদাম জ্যাঠা, মনে আছে
ত?”
“আরে সুদাম জ্যাঠাকে মনে থাকবেনা, হতে পারে...”
“প্রথম বার গুমখুনের চেষ্টা হলে আমি গিয়েছিলাম তার কাছে।
সব শুনে বল্লো পালাতে। বল্লো ওই ছোকরা রাজবাড়িতে কেউকেটা হয়েছে। আমি বল্লাম তাতে কি?
তাতে ও আমাদের খুন কেন করাবে? সুদাম জ্যাঠা বল্লো প্রমাণ। সে তার এসব কাজের প্রমাণ
রাখতে চায়না। এখন ওর নাকি মস্ত মস্ত পরিকল্পনা মাথায়। সে এখন এক বিরাট লোক। আমরা বেঁচে
থাকলে … জানোই তো সুদাম জ্যাঠা'র যাতায়াত মোড়লবাড়ি থেকে রাজবাড়ি...”
“হ্যাঁ, সুদাম জ্যাঠা বল্লে ভুল বলেনি । আমি নিশ্চিত
...”
এমন সময় তাঁবুর মাসি এসে দাঁড়ালো আবার। এবার ওর হাতে ছোটো
একটা মশাল।
“ভায়া, যাও। সূর্যমুখী অপেক্ষা করছে। লেনদেন নিয়ে তুমি
কিছু ভেবোনা। তুমিও আমার মানুষ … যাও আনন্দ করোগে। রাতে ওর তাঁবুতে থেকে যাবে তো? সকালে
দেখা হবে তাহলে ...”
আমি পা বাড়ালাম মাসির পিছু পিছু। কয়েক পা এগোতেই
"ভায়া, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি ...” তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়েই হেঁকে বল্লো ভানু।
আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। "ওই যে ছোকরা ওকে তুমি চেনো হে ভায়া...”
“আমি? চিনি? কিকরে জানলে তুমি...”
“আরে এখন মনে পড়ছে তোমাদের দলের সঙ্গে তাকে অনেকবার দেখেছি
গরু নিয়ে মাঠে যেতে, বাঁশি বাজাতে, গঞ্জিকা টানতে ...”
“সে তো ভায়া কতো ছেলেরাই ...”
“আরে নাহ্। ওর বাবা ছিল মোড়ল গোছের। মনে নেই? আমরা বলতাম
'গাঁয় মানেনা মোড়ল" ...আরে কি যেন ছিল নামটা ...”
“কার?”
“ওই ছোকরার … হ্যাঁ মনে পড়েছে নন্দ!নন্দ! নন্দগোপের ছেলে
… এখন চিনলে ...”
আমি স্মৃতির থলেতে হাত ভরে দিলাম কিন্তু নন্দ বা নন্দগোপ
ধরনের কোনো নাম মনে এলোনা। ভানু তখনো দাঁড়িয়ে আছে দেখে বল্লামঃ "না ভায়া, মনে
করতে পারলাম না ...”
“আরে ছোকরাটার নাম তো আমিও মনে করতে পারছিনা। হ্যাঁ, তবে
ছোকরার ওর মামী না'কি কাকী'র সঙ্গে লটঘট, বেশ বড় রকমের লটঘটই ছিল। ওকে নিয়েই এসেছে
দাদির কাছে কয়েকবার। মনে পড়ছে কিছু ...” … এমন টা আমাদের গ্রামে অনেকেরই ছিল। মামী-মাসী-বিধবা
তুতো বোন নিয়ে লীলা অনেকেই করেছে। আলাদা করে কাউকে মনে এলোনা। বল্লামঃ ' না ভায়া, চিনলাম
না...'
সূর্যমুখী তখন তোলপাড় তুলেছে আমার কামে, আমার কল্পনায়।
ভানুকে বল্লাম, হেঁকে, “না ভায়া চিনলাম না...” তারপর হাঁটতে লাগলাম মাসিমাটির পিছু
পিছু। এটা ভেবে খুশি হলাম যে, ছোকরা যে'ই হোক, শেষ পর্যন্ত মারতে পারেনি 'খসানে ভানু'কে
আর যমের মুখ থেকে ফিরেও 'খসানে ভানু 'বেশ আছে, ওর হিল্লে হয়েগেছে একটা।
১৪/১০/২০২১ –১৭/১০/২০২১, বেঙ্গালোর
সপ্তর্ষি বিশ্বাস