কুসুমের লাশ
সপ্তর্ষি
বিশ্বাস
প্রথম প্রকাশ, ট্রাপিজ, ২০২২ বইমেলা সংখ্যা
"শরীর
! শরীর !
তোমার মন
নাই কুসুম?"
যদি এই
'কুসুম', যে হয়, শশী ডাক্তারের, তাকে মুহুর্তের জন্য ভেবে নিই, আক্ষরিক অর্থে, 'ফুল'
বলে, 'পুষ্প' বলে, তাহলে এই বিদ্দ্যুচ্চমকহেন খন্ডবাক্য দুটি কি ক্রান্তদর্শী হয়ে ওঠে
মর্মে নিয়ে আসে না মহাবিশ্বের, বহুবিশ্বের বহু আকাশের ব্যাপ্তি? ইঙ্গিত? 'কুসুম', যা
'পুষ্প', তার 'শরীর' আছে, 'দেহ' আছে। কিন্তু 'মন' আছে কি? ... 'শরীর' বা 'দেহ' তা'তে
'প্রাণ' থাকলেই যে থাকবে 'মন' এমন বলেনা বিজ্ঞান। অতএব বিজ্ঞানের পথে হেঁটেই তবু পথিপার্শ্বের ঘাসজমিতে দাঁড়িয়ে কল্পনার দুঃসাহসে
ফুলের, পুষ্পের, কুসুমের সৌরভকে, ঘ্রাণকে তার 'মন' বল্লে বলাও যায়। তথাপি প্রশ্ন থেকে
যায়, যে, কুসুমের শরীরই যদি না থাকে তাহলে সৌরভ কিসের? ঘ্রাণ কিসের? মন কিসের? বর্ন,
রঙ্গই বা কিসের? কাজেই কুসুম, কুসুম চয়ন, কুসুমোদ্যানে ভ্রমণের আমন্ত্রণ -- এই সকলের
কোথাও যে শরীরের স্বরলিপি থাকে, থাকবেই সুস্পষ্ট কিংবা অস্পষ্ট সে'তো ব্লেইকের 'গোলাপ'
যুগ থেকেই প্রমাণিত, রিল্কের লিখিত গোলাপ বিষয়ে কবিতাগুলি, যা তিনি ফরাসী ভাষায় লিখেছিলেন,
তা থেকে বিনয়ের 'অঘ্রাণের ...' 'বকুল' হয়ে -- প্রমাণিত। তাই যখন শুনি কবির আমন্ত্রণ,
নিম্মরূপ, তখন প্রাধাণ্যের নিমিত্ত শরীর-মনের, দেহের-সত্তার দ্বন্দ্বকে পাশ কাটিয়ে
শরীরী উৎসাহেই আমাদের সাড়া দিতে হয় সে আমন্ত্রণেঃ
" ... ... ... ... ... ... । আজিকে তো কুসুমের মাস।
মোর হাতে হাত দাও, চলো যাই কুসুম-বিতানে।"
তার আগে,
কবি মানসীকে কিংবা পাঠক-পাঠিকাকেই বলা হয়েছে, যেন বা এই আমন্ত্রণের ভূমিকা হিসাবেইঃ
"তুমি ফুল ভালোবাসো? লাল ফুল? চোখে
যাহা লাগে?
কঠিন সৌন্দর্যে যার নয়ন সে হয় প্রতিহত?
তুমি ভালোবাসো ফুল? শেফালিকা সৌরভ আনত?
... ...
আমিও কুসুমপ্রিয়।" ... অতঃপরই
"মোর হাতে হাত দাও, চলো যাই কুসুম-বিতানে"।
যেন বিয়াত্রিচে
নয়, যেন দান্তেই আহ্বান করলেন বিয়াত্রিচে'কে। কুসুম-বিতানে। কিন্তু কেমন সে কুসুম-বিতান?
যাত্রারম্ভের পরে, হয়তো এ প্রথম রাত্রি যুগল-গমনের পথেঃ
এখন বাহিরে চলো। ...।
...। কাছে আসিবার। (দুর্লভ রাত্রি)
'দুর্লভ
রাত্রি' নেমেছে উদ্যানে। 'কুসুম-বিতানে'। স্বর্গের বিতান এ নয়। এখানে তারাই আসতে পারে
যারা স্বর্গের অভিশাপে স্বর্গবাসীদের চেয়েও
মহিমান্বিত। যারা 'মর্ত্যের করুণা' দিয়ে 'স্বর্গের অভিশাপ' কে মুছে দিয়ে নির্মাণ
করে সুন্দরের। অস্বীকার করে, স্বর্গকে, পুনরায়, এইভাবেঃ
"জানুক সকল লোকে, এতটুকু করি না
কেয়ার,
কত ভালো লাগে আর ঔদাস্যের মিথ্যা অভিনয়!"
এ ছাড়াও
"জোনাকির
ছায়াগুলি পরীদের মতো অবিকল" বাক্যটি লক্ষণীয়। লক্ষণীয় তার নিজস্ব সৌন্দর্যহেতু
তো বটেই তদ্ভিন্ন পংক্তিটির "জীবনানন্দীয়তা"হেতুও। এই "জীবনানন্দীয়তা"
প্রভাব হতে পারে আবার না'ও হতে পারে। তথ্য হিসাবে বলে রাখতে হচ্ছে, যে, জীবনানন্দের
যে সকল কবিতা "ধূসর পান্ডুলিপি"তে গ্রন্থিত, তার অনেক গুলিই লিখিত ও প্রকাশিত
হয়ে গিয়েছে ১৯২৯ সালে আর 'কুসুম-বিতানে'র এই কবিতাগুলির প্রকাশ ১৯৩০। যাইহোক, এ সকল
'প্রভাব' ইত্যাদির সন্ধান তাঁরাই করুণ যাঁদের জীননানন্দ বলেছিলেনঃ "বরং নিজেই
তুমি ..." । আমরা আবার যাই সেই 'কুসুম-বিতানে' যার প্রবেশের আমন্ত্রণ থেকেই নিখুঁত
সনেটে চলেছে যাত্রা 'দুর্লভ রাত্রি' পার হয়ে, 'একটি স্বপ্ন', 'স্বপ্ন' হয়ে 'গুরুজনদের
মাঝে'। এই 'গুরুজনদের' আমার মনেহয় ওই বিকৃতকাম দেবতার মতো যে আদম-ইভ'কে দিয়েছিল অভিশাপ।
'কুসুম-বিতানে' নিমন্ত্রণের কবিতা 'কুসুমের মাস' থেকে 'গুরুজনদের মাঝে' পর্যন্ত এই
প্রেমিক-কবি নিঃশঙ্ক। দ্বিধাহীন। 'তুমি'তে আস্থাশীল। নিমগ্ন। তবু মাঝখানে 'স্বপ্ন'
কবিতার একটি পংক্তি 'খটকা নিয়ে আসে'। ... "কখন আসিবে তুমি? রজনী, সে আরো কতোদূর! /
এ মোর ভোরের স্বপ্ন -- এ কি কভু মিথ্যা হ'তে পারে?" ... সঙ্গিনীর 'আসা',
এমন কি রাত্রি'র আসা নিয়েই সংশয়। এখানে। কিন্তু পরের কবিতা 'গুরুজনদের মাঝে'তে গুপ্ত
সম্পর্ক আবার নিজ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এর পর থেকেই এই প্রেমিক-কবিটি, ক্রমে,
কবি-প্রেমিক হওয়ার দিকে যাত্রা করেন কি? কেননা এই কবিতাটির আরম্ভ ও বিস্তার 'বুদ্ধের
বচন', 'চার্বাকের তিক্ত বাণী', 'গীতা'র ইঙ্গিতে।
নাহি জানি তথাগত বুদ্ধের বচন সত্য কিনা
--
...
...
এ জীবনে তুমি থাকো -- তারপর মরণের পরে
মোর কাব্যে অনশ্বর হয়ে থাক্ এ-জন্মের
দেহ। ( আকাঙ্ক্ষা)
এই পংক্তিগুলি
পাঠ করতে করতে আমার মনে পড়েযায়, মনে পড়েছিল প্রথম পাঠেওঃ
But
thy eternal summer shall not fade,
Nor
lose possession of that fair thou ow’st;
Nor
shall death brag thou wander’st in his shade,
When
in eternal lines to time thou grow’st:
So long as men can breathe or eyes can see,
So long lives this, and this gives life to
thee.
যার অন্তিম
পংক্তি দু'টি সুধীন দত্ত'র অনুনাদেঃ
'মানুষ নিঃশ্বাস নেবে, চোখ মেলে তাকাবে
যাবৎ,
আমার কাব্যের সঙ্গে তুমি রবে জীবিত তাবৎ'।।
অথবাঃ
...do
thy worst, old Time! Despite thy wrong
My
love shall in my verse ever live young.
রবীন্দ্রনাথের
সুরূপা-চিত্রাঙ্গদা অর্জুনকে একদা প্রশ্ন করেছিলঃ "নারীর ললিত লোভন লীলায় এখনই কেন এ ক্লান্তি? এখনই কি সখা, খেলা হল অবসান
..."
নিজকাব্যের
দ্বারা দয়িত অথবা দয়িতাকে অমর করবার এই আকাঙ্ক্ষা শেক্ষপীরের অনেক সনেট জুড়ে হলেও বর্তমান
আলোচনার কেন্দ্রস্থ এই বঙ্গ কবি কিন্তু এই উচ্চারণের ঠিক পরেই, 'নাস্তিক' নামের কবিতায়
বলে ওঠেন অন্য কথা । আরও একটি তথ্য এই, যে, এই গ্রন্থে 'নাস্তিক' এর পূর্ব কবিতা 'আকাঙ্ক্ষা'ই
শেষ কবিতা যেখানে দয়িতাকে অনশ্বর করে যাওয়ার, রাখবার ইচ্ছা এমন সুস্পষ্ট, সোচ্চার।
'নাস্তিক'ও উন্মোচিত হয়,'আকাঙ্ক্ষা' কবিতারই মতন, দার্শনিক
উপলব্ধিতেঃ
"ঈশ্বর মানি না আমি, মানি শুধু মনের
আদেশ;
অস্তিত্ব-বিহীন সেই আস্তিকের মস্তিষ্ক-নিবাসী
মোর বিভীষিকা নহে"। -- অর্থাৎ 'ঈশ্বর' এক অনস্তিত্ব যা অস্তি
পায় শুধুমাত্র তাদেরই মস্তিষ্কে, ভাবনায়, যারা ভীরু। এরপরেই আসে অমোঘ দৈবের মতো ঘোষনাঃ
"জীবনেরে
জানি আমি মরণের পাত্র অবশেষ"। ... এখানে
কোথায় সেই স্বঘোষিত কুসুম-বিলাসী কবি? কোথায় সেই কুসুম-বিতান? বরং ভাষার ও ভাবনার সান্নিধ্য,
এখানে, তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে, খুবই বেশী 'নিরাশাকরোজ্জ্বল' সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে।
তবু সুধীন্দ্রনাথও নন এই কবিজন। নশ্বরতাকে অবিনশ্বর জেনেও তাঁর মনেহয়, অন্তিমেঃ
"পৃথিবীর অপূর্ব আকাশে
প্রেম ছাড়া কিছু নাই;" আবার এই মনে আসারও অন্তেঃ
"সেদিন নিশীথ-রাত্রে আসে
আমার কঠিন প্রাণে সুশীতল, মধুর বিষাদ"।
এই
"মধুর-বিষাদ" শব্দবন্ধই তাঁকে আলাদা করে নেয় সুধীন্দ্রনাথ থেকে। স্থাপন করে,
তাঁকে, এক ভিন্ন ব্যক্তিত্বে। নশ্বরতাকে অবিনশ্বর মেনে তাকেই আলিঙ্গন করতে চান এই কবিঃ
একদিন স্বর্গ হ'তে নামিলাম পাখা ভর করি'
...
...
নিভে গেল দেবত্বের জ্যোতিশ্চক্র দীপ্তানন
ঘিরে"। (প্যারাডাইজ্ লস্ট)
এই পংক্তিটির সোন্দর্য আমাকে বার বার মুগ্ধ করেঃ "তোমার
দু চোখের তিমিরে
লোষ্ট্র-সম সপ্ত স্বর্গ ভুবে গেল মুহুর্ত কাঁপিয়া" ...। হ্যাঁ, এখানে এসে মনেপড়তেই পারেঃ
" হে
অপ্সরী,
তোমার নয়নজ্যোতি প্রেমবেদনায়
কভু না হউক ম্লান-- লইনু বিদায়।
তুমি কারে কর না প্রার্থনা, কারো তরে
নাহি শোক। ধরাতলে দীনতম ঘরে
যদি জন্মে প্রেয়সী আমার, নদীতীরে
কোনো-এক গ্রামপ্রান্তে প্রচ্ছন্ন কুটিরে
অশ্বত্থছায়ায়, সে বালিকা বক্ষে তার
রাখিবে সঞ্চয় করি সুধার ভাণ্ডার
আমারি লাগিয়া সযতনে"।
যদিও 'প্যারাডাইজ্"
কে মানবীদেহের মাধুর্যের পদতলে ছুঁড়ে দিয়ে মনুষ্যত্বে আপনাকে বিলীন করে দিলেন কবি তথাপি
পরের কবিতা "জ্বরে"তেই আবার আসে অনিশ্চিতি। এই যে 'তুমি' সে কি চোখ-ঠোঁট-চিবুক-স্তন-নাভি-যোনি-উরু'তে
জীবন্ত রমণী নাকি এ মর্মের "নন্দনবাসিনী
উর্বশী" যে কখনোই "নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ, সুন্দরী রূপসী ..."? যদিও "মূর্ছার মতন তুমি মনোহর
আমার নয়নে" তথাপি 'এলিজি' নামক কবিতা থেকে কুসুম-বিলাস, পুষ্পানুরাগের পরিবর্তে
আমাদের দেখা হতে থাকে দ্বন্দ্ব-নিপীড়িত-মর্মের এক সিসিফাসের সাথে। 'এলিজি' নামের কবিতাটিকে
আমার মনেহয় এই কবিতা গ্রন্থের একটি টার্নিং পয়েন্টঃ
আমি ডাকিলাম তারে নিশান্তের হাওয়ার ভাষায়,
...
...
তাহারে দেখিছে আজ একমাত্র মহান মরণ।
গ্রন্থে
কবি-কৃত কোনো পর্য্যায় ভাগ না থাকলেও এটা স্পষ্ট, যে, 'এলিজি' পরবর্তী সনেটগুলি আরেকটি
পর্য্যায়। সেখানে কিছু কিছু না-সনেট মিশে আছে যাদের চরিত্র এই গ্রন্থ চরিত্রের সঙ্গে
ঠিক মেলেনা। সেই না-মেলা কবিতাগুলিকে এই রচনার যাত্রাপথের বাইরেই রাখলাম।
'এলিজি'তে
যে দয়িতার মৃত্যু হল, 'এলিজি' পরবর্তী কবিতাগুলি সেই মৃত দয়িতার কিংবা কোনো বা অনেক
মৃত দয়িতার দিকে ধাবমান। এই 'মৃতা'কে আমার কখনো মনে হয়েছে মৃত্যুর, কখনো 'প্রেম' শব্দের
মরণের প্রতিমা। এই মৃত্যুর অথবা মৃত প্রেমের অভিঘাত কবিতাযাত্রার এই 'প্রেমিক'জনের
মর্মে এতোই অরুন্তুদ, যে, তাঁকে বলতে হয়, 'এলিজি'র পরবর্তী কবিতার প্রথম পংক্তিতেইঃ
"আজিকে শরৎ বুঝি?......" -- অর্থাৎ আত্মনিমগ্নতা হয়ে উঠেছে এমনই এক সামগ্রিক বিস্মরণ
যে কবি-প্রেমিক বিস্মৃত হয়েছেন ঋতুচক্রহেন অবলীলকেও। পরবর্তী কবিতা জানান দেয়ঃ
জীবনে বৈচিত্র্য
নাই, বৈরাগ্যে ভরেছে মোর হিয়া,
... ...
... ...
... ব্যর্থপ্রেমে
যেথা তীক্ষ্ণ ছোরা
প্রিয়ের বুকের রক্তে লাল হয়, সেথা চলো ফিরে। (জীবনে বৈচিত্র্য নাই)
"সেথা
চলো ফিরে"? তাহলে সেখানে কি আগেও ছিলেন কবি? ছিলেন প্রেমিক? তিনিই কি পোরফেরিয়ায়
হত্যাকারী প্রেমিক কিংবা লাস্ট ডাচেস্ এর গৃহকর্তা? না'কি 'ইডিয়ট'এর রোগোজিন? অথচ
কুসুম-বিতানে ভ্রমণের আমন্ত্রণ যে জানিয়েছিল সে'ত আরেকজন। সে বরং অনেক বেশী 'প্রিন্স
মিশকিন'।... নাকি 'ওথেলো'? ... আর এখানেঃ
"তুমি কি কহিতে পারো সে-অদ্রির পথের
বারতা
যেখানে তুষার-মরু, ফুল যেথা কভু নাহি
ফোটে?" ... এ'তো
'ক্লেদজ কুসুমে' বোদলেয়ার বর্ণিত সেই রাজা'র দেশঃ
I
am like the king of a rainy land,
Wealthy
but powerless, both young and very old,
Who
contemns the fawning manners of his tutors
And
is bored with his dogs and other animals.
Nothing
can cheer him, neither the chase nor falcons,
Nor
his people dying before his balcony.
সেখানে যেতে
চান এই কবি। কবি-প্রেমিক আর এখানে এসেই, তাই, আমাকে চেষ্টা নিতে হয় তাঁর কুসুম-বিতানের
চরিত্রটিকে কিঞ্চিত তলিয়ে দেখবার, গ্রন্থটির প্রকাশের (১৯৩০) প্রায় 'শতবর্ষ 'পেরিয়েও
(২০২১-২২)। চেষ্টা নিতে হয়, কেননা সনেটের নৈপুণ্য, তৎসম শব্দের অবলীল ব্যবহার ... এই
সকল আমরা পেয়ে যাই এই কবি-প্রেমিকের সমকালীন সুধীন্দ্রনাথে সম্পূর্ণ, আরো অনেকের রচনায়
হয়তো অংশত। সুধীন্দ্রনাথের চেতনার বিস্তারের যে মানচিত্র তার তুলনায় বা আরো তাঁরই অন্য
আরো বেশ কয়েকজন সমসাময়িকের তুলনায় এই কবি-প্রেমিকের বিস্তার সীমিত। তাঁর কবি-জীবনের
মতোই। তথাপি তাঁর এই বিশেষ কবিতাগ্রন্থের বিশেষ কবিতাগুলি তাদের স্বমহিমায় এতোই উজ্জ্বল,
যে, প্রকাশের প্রায় শতবর্ষ পরেও, অন্ততঃ তৃতীয়বারপাঠেও, আমি আক্রয়ান্ত হই রচনাগুলির
দ্বারা এবং বই পুঁথি ঘেঁটে এই কবিজনের এবং এই গ্রন্থের উল্লেখের 'কোয়ান্টিটি' এবং
'কোয়ালিটি' অনুধাবন করে বলতে বাধ্য হই, যে, এই কবি অদ্যাপি 'আন্ডার-রেটেট'। তাই আমার
এই চেষ্টা, অনুভব করবার, যে যাত্রার আরম্ভ "মোর হাতে হাত দাও, চলো যাই কুসুম-বিতানে"র
মতো সহজে সে'ই বিতান-ভ্রমণেই, কিভাবে এবং কেন, বেজে ওঠে -- কখনো বোদলেয়ারিয় 'নাস্তি'র
সুর, কখনো ব্রাউনিঙ্গের ঘাতক-নায়কেরা? ...তাহলে এই 'কুসুম' নয় ঠিক ততোটা 'ফুল' যতোটা
মনে হয়েছিল প্রথম পাঠে? রিলকে লিখেছেনঃ'...in a way nobody sees a flower really-—it
is so small—we haven’t time—
and
to see takes time, like to have a friend takes time' আর 'গোলাপ' বিষয়ে ফরাসীতে লিখিত তাঁর
কবিতাগুলির ইংরেজি অনুবাদকজন বলছেনঃ 'Rilke’s roses bring together physical
desire and spiritual longing—two opposing realms which, in his day, were kept
safely apart.' অন্যত্র
দেখছি উইলিয়াম ব্লেইকের কবিতায় ফুলের অনুষঙ্গে বলা হচ্ছে 'Female genitals
are traditionally symbolized by the queen of flowers, from the medieval Mystic
Rose of Mary to the rock classic, “Sally, Go Round the Roses.” ... এই 'বলা' গুলির ভরসায় নয়, আদতে ব্লেইক,রিলকে
থেকে 'অঘ্রাণের ...' পাঠকালে, আমার নিজের, একই রকমের অনুভুতি হওয়া কে ভরসা করেই এই
সকল 'বলা'র উদ্ধৃতি। কুসুম-বিতানে ভ্রমণাহ্বান জানানো, আমার এই বঙ্গ কবিজনের মধ্যেও
দেখি একই রকমের প্রতিমা। কখনো প্রতীক।
কুসুম-বিতানে
এই আহ্বান আদতে 'প্রেম' শব্দের শরীরী উদ্যাপনের দ্বিধাহীন আমন্ত্রণ। 'দ্বিধাহীন' কথাটি
বিশেষ করে উল্লেখ করা এই হেতু, যে, প্রায় সমসাময়িক মোহিতলালের কবিতাও মূলতঃ 'শরীরের','দেহের'
কবিতা। কিন্তু সেখানে দেহ আর দেহাতীতের দ্বন্দ্ব প্রায় সতত বিদ্যমান। কিন্তু কুসুম-বিতানের
আহ্বান পর্বে কোনো দ্বিধা নেই। 'কুসুমের মন' আছে কি'না এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। মনেহয়,
যদি না'ও বা থাকে তাহলেও কিছু এসেযায়না। জ্বরের ঘোরেও প্রেমিক-কবি দয়িতার স্পর্শ,শারিরীকতাকেই
খুঁজেছেন। অথচ শুধু ওই শারিরীকতা এবং তাতে বিশ্বাস ও আস্থা যদি হতো, প্রকৃতই, এই বিতানে
আমন্ত্রণের একমাত্র সত্য তাহলে কি ... মনে আসে হাইনের একটি কবিতাঃ
I
Love this white and slender body,
These
limbs that answer Love's caresses,
Passionate
eyes, and forehead covered
With
heavy waves of thick, black tresses.
You
are the very one I've searched for
In
many lands, in every weather.
You
are my sort; you understand me;
As
equals we can talk together.
In
me you've found the man you care for.
And,
for a while, you'll richly pay me
With
kindness, kisses and endearments--
And
then, as usual, you'll betray me.
এটি যেন
হতে পারতো আমাদের এই বঙ্গ কবিজনেরো শুধুমাত্র অন্তিম পংক্তিটি ছাড়াঃ
"And
then, as usual, you'll betray me."
অবিশ্বাসের
কিংবা বিশ্বাসঘাতের কোনো অস্পষ্ট ইঙ্গিতও নেই কুসুম-বিতানে ভ্রমণ পর্বের কোনোখানে।
তবু অকস্মাৎই দয়িতার মৃত্যু এবং তারপরেই ব্যররথ-প্রেমিকদিগের দ্বারা খুন হওয়া প্রেমিকাদিগের
রক্তাক্ত বিদেশে যাওয়ার বাসনা আমাকে সন্দিহান করে। মনেহয় ওই কামোজ্বলতা যেন 'নিরাশাকামোজ্বলতা'।
আবারো মনে আসেন হাইনেঃ
I
don’t believe in Heaven,
Whose
peace the preacher cites:
I
only trust your eyes now,
They’re
my heavenly lights.
I
don’t believe in God above,
Who
gets the preacher’s nod:
I
only trust your heart now,
And
have no other god.
I
don’t believe in Devils,
In
hell or hell’s black art:
I
only trust your eyes now,
And
your devil’s heart.
...
"ঈশ্বর মানি না আমি, মানি শুধু মনের আদেশ" ... 'নাস্তিক' নামক কবিতাটি লিখিত
হতে পারতো হাইনের দ্বারাও, মনেহয়। তবু এই যাত্রার কেন্দ্র বঙ্গ কবিজন কি লিখতেন
'your devil’s heart'? সম্ভবতঃ না। কুসুম-বিতান ভ্রমণের এই কাহনে বারবারই মনে আসেন
হাইনে তবে ওই উচ্চারিত আর অনুচ্চারের নিরিখে বিভিন্ন রয়ে যান, স্বাভাবিক ভাবেই, দুই
যুগের, দুই মেজাজের কবিদ্বয়।
কুসুম-বিতানের
প্রেমিক-কবি ক্রমে কবি-প্রেমিক হয়ে অতঃপর দয়িতার মৃত্যু কিংবা হত্যাতে বিবাগী হয়ে অতঃপর
দেখি চলেছেন সেই ক্লান্তির দিকে যে ক্লান্তি, হয়তো টের পেয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের অর্জুন,
চিত্রাঙ্গদাতে, সুরূপা-চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে কামনার এক ঋতু শেষ না'হতেই। সে গেয়ে উঠেছিলঃ
" কেন রে ক্লান্তি আসে আবেশভার বহিয়া
দেহ মন প্রাণ দিবানিশি জীর্ণ অবসাদে।"
প্রার্থনা
করেছিল, তারপরঃ
" ছিন্ন করো এখনি বীর্যবিলোপী
এ কুহেলিকা;
এই কর্মহারা কারাগারে রয়েছ
কোন্ পরমাদে"
কুসুম-বিতানে,
বর্তমানে একাকী, ভ্রাম্যমান কবি বলে উঠছেনঃ
"এই মৃত্যু, হে ঈশ্বর,আর কত? আর
কতদিন?
...
...
আলস্য-নিষ্ফল চিত্ত, প্রাণ-পন্থা বৈচিত্র্যবিহীন,
হেন পুষ্প কারাগারে আর কত রুধিয়া কঠিন
খেলিবে আমার সনে তুচ্ছ পণে জীবনের আশা?
...
...
নয়নে ফোটেনা তারা মেঘকৃষ্ণ বন্ধ্যা অন্ধকারে,
উন্মুক্ত আকাশ ছাড়া সঙ্গীত আসেনা কন্ঠ
ভরি'। (প্রার্থনা)
... যদি
মনে আসেন শঙ্খ ঘোষঃ আমাকে আকাশ দাও, আমি দেব
সমস্ত অমিয়' ( 'কলহপর') ... খুবই কি অবান্তর?
প্রকৃত প্রস্তাবে
কুসুম-বিতানে আমন্ত্রণের দেহজতা পার হয়ে আসে দেহজ শ্রান্তির পর্ব আর তারপরে প্রেমিক-কবি,
কবি-প্রেমিক, ক্রমে , শুধুমাত্র 'কবি' হয়ে, আমার মননকে অন্ততঃ, নিয়ে টানদেন এমন এক
নিরীশ্বর মুক্তির, মোক্ষের দিকে যেখানে ঈশ্বরও এক বিড়ম্বনা, বন্ধন। 'কুসুমের মাস',
ক্রমে, পার হই, কুসুমের লাশটি ডিঙ্গিয়ে। টের পাই শোশী ডাক্তারের 'কুসুমের' মন যদিবা
ছিল বা থাকতো তাহলেও, অন্তিম প্রস্তাবে'উন্মুক্ত আকাশ ছাড়া সঙ্গীত আসেনা কন্ঠ ভরি'।
এই গ্রন্থের শেষ কবিতা 'মালতী' প্রকৃতই 'লাশ' এর কবিতা। মনে পড়ায় ব্রাউনিং দম্পতীর
নানান কবিতা ও রবীন্দ্রনাথের 'কঙ্কাল' ছোটোগল্পটিকে।
এতদ্ভিন্ন
এই সান্ধ্য-যাত্রায়, পথের কিনারের জোনাকিগুলি হয়ে ওঠে একটি একটি তারা, এই সকল পংক্তিতেঃ
তোমার প্রিয়ার শুভ্র বাহু-ঘেরা সোনার
কঙ্কণে
তাহারে মানালে ভালো, কত বহ্নি দহিল সে
সোনা --
সে খোঁজে কী কাজ? (সে খোঁজে কী কাজ?
)
ফাল্গুনে তব দীপ্ত আঁখিতে ফেলিবে কি আর
ছায়া
বরষার স্রোতে ভেসে-যাওয়া শত মৃত জোনাকির
মায়া? (আমি কি লুপ্ত হ'বো)
আমি নহি সেই কবি , যার স্নিগ্ধ নয়ন-আসারে
ধরণী জুড়াল হিয়া, অশ্রু নহে আমার পসরা।
(ব্যর্থ কবি)
মনে আসেন
বোদলেয়ার, আবারোঃ
It's
not with smirking beauties of vignettes,
The
shopsoiled products of a worthless age,
With
buskined feet and hands for castanets —
A
heart like mine its longing could assuage.
I
leave Gavarni, poet of chloroses,
His
twittering flock, anaemic and unreal.
I
could not find among such bloodless roses,
A
flower to match my crimson-hued ideal.
... এই মনে
আসা গুলি, অজিত দত্ত'র 'কুসুমের মাস' গ্রন্থের নানা কবিতার আবহে, হতে পারে আমারই নিজস্ব
বিভ্রম আবার যেহেতু পেশায় কবি অজিত দত্ত এক দীর্ঘ সময় ছিলেন অধ্যাপক ফলতঃ , হতে পারে,এই
কবিতাগুলি সেই সকল কবিদের সারাৎসার নিংড়ে রচিত। তা'ও যদি হয় তবু এইগুলি স্বয়ং কবিতাই।
অজিত দত্ত ছিলেন বুদ্ধদেব বসুর বাল্যবন্ধু, ঠিক। এক সময় একই বাড়ির দুটি তলায় তাঁরা
বাসও করেছেন। এ'ও ঠিক। সেই সঙ্গে এ'ও ঠিক যে বকলমে বুদ্ধদেব বসু'ই লক্ষ্য অজিত দত্ত'র
এই কবিতাটিরঃ
আশ্চর্য! হলে না মুদি, হ'তে তুমি যাহার সর্দার,
(বাল্যকাল হ'তে তুমি ভালো করে করিতে যদি তা)
প্রাচীন লেখকদের আধুনিক হে হুঁকোবর্দার,
তুমিও বিখ্যাত হলে সেই দুঃখে লিখিনা
কবিতা।।
(পুরুষস্য ভাগ্যম্, ০৪ জানুয়ারী ১৯৩৪,পাতালকন্যা)
০৯/১২
-- ১২/১২/২০২১
বেঙ্গালোর