মহাভারতের
মহারণ্যে
সপ্তর্ষি
বিশ্বাস
ব্যাস বনাম ব্যাসদেব পর্ব
প্রথম প্রকাশ 'আবহমান', ওয়েব সংস্করণ
১।
যদিও রবীন্দ্রনাথ
বলেছেন “ আর্যসমাজের যত কিছু জনশ্রুতি ছড়াইয়া
পড়িয়াছিল তাহাদিগকে তিনি এক করিলেন। শুধু জনশ্রুতি নহে, আর্যসমাজে প্রচলিত সমস্ত বিশ্বাস,
তর্কবিতর্ক ও চারিত্রনীতিকেও তিনি এই সঙ্গে এক করিয়া একটি জাতির সমগ্রতার এক বিরাট
মূর্তি এক জায়গায় খাড়া করিলেন। ইহার নাম দিলেন মহাভারত। “ তথাপি এই হয় সত্য, যে,
এই যে “বিরাট মূর্তি”, তা, হয় একটি কাব্য। তাই মাঝে মাঝেই ভাবি শুধুমাত্র “জনশ্রুতি
, আর্যসমাজে প্রচলিত সমস্ত বিশ্বাস, তর্কবিতর্ক ও চারিত্রনীতি”কে একসূত্রে গ্রথিত করে
রাখবার জন্য এমন একটি কাব্য, কাব্যই রচনার প্রয়োজন কেন পরেছিল বেদব্যাস বা বেদব্যাসদের?
আর শুধুমাত্র সেইহেতু রচিত হয়ে থাকলে এই মহাগ্রন্থ কি কোনোদিনই পারতো পৃথিবীর উৎকৃষ্টতম
শিল্পবস্তু হয়ে উঠতে? নিশ্চিত সত্য এই যে এমন শিল্পবস্তু রচনার গহনে থেকে যায় অপর কোনো
প্রেরণা, অন্য কোনো কল্পনা-প্রতিভা। এই প্রেরনা, এই “ কল্পনা-আভা কোথা থেকে আসে? কেউ
কেউ বলেন আসে পরমেশ্বরের কাছ থেকে। সে কথা যদি স্বীকার করি তাহলে একটি সুন্দর জটিল
পাক কে যেন হীরের ছুরি দিয়ে কেটে ফেললাম। … আমি বলতে চাইনা যে, কবিতা সমাজ বা জাতি
বা মানুষের সমস্যা খচিত অভিব্যক্ত সৌন্দর্য হবেনা। তা হতে বাধা নেই। অনেক শ্রেষ্ঠ কাব্যই
তা হয়েছে।” - সে সকল শ্রেষ্ঠ কাব্যের শ্রেষ্ঠতম যে মহাভারত, অতএব, তার শ্রস্টা কিংবা
শ্রস্টাদেরও নিশ্চিত টের পেতে হয়েছে, “অনুভব করতে হয়েছে, যে, খন্ড-বিখন্ডিত এই পৃথিবী,
মানুষ ও চরাচরের আঘাতে উত্থিত মৃদুতম সচেতন অনুনয়ও এক এক সময় যেন থেমে যায়, - একটি
পৃথিবীর অন্ধকার-ও-স্তব্ধতায় একটি মোমের মতন যেন জ্বলেওঠে হৃদয়, এবং ধীরে ধীরে কবিতা
জননের প্রতিভা ও আস্বাদ পাওয়া যায়”। - আর সেই অন্তর্গত মোমবাতিটি জ্বলে না উঠলে, অন্তরে,
“কবিতা রচিত সৃষ্ট হয়না -পদ্য লিখিত হয় মাত্র “। - আর মহাভারত যদি 'পদ্য' হতো তাহলে
এদ্দিনে গো-বেশক ও ধর্মব্যবসায়ী ছাড়া আর কেউ ফিরেও তাকাতো তার দিকে। বাংলার নানা অঞ্চলে
নেহাৎই “আম্” মানুষ যতোটা আপনার করে রেখেছে “পদ্মপুরাণ”কে - ততোটাও বেঁচেথাকা সম্ভব
নয় নেহাৎই পদ্যের।
মহাভারত'কে,
অতএব, যদি কাব্য বলেই স্বীকার করে নিই তাহলে আমরা তার কাছে কেন যাব ধর্মাধর্মের, যাগযজ্ঞের,
ঈশ্বরের মহিমা ও কৃপার কিংবা দৈনন্দিনতার কূ্টকচালের সন্ধানে, সমাধানে? “আমরা জিজ্ঞাসা
ও চিন্তার জন্য কেন পতঞ্জলীর কাছে যাব না , বেদান্তের কাছে যাব না মাঘ বা ভারবির কাছে
না গিয়ে?” আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলি, 'Isaiah Berlin' এর 'The Hedgehog and the Fox' ভরসা করে - যাব 'ঋষি' বঙ্কিম বা 'ঋষি'
টলস্টয়ের কাছে ঔপন্যাসিক বঙ্কিম বা ঔপন্যাসিক টলস্টয়ের কাছে না গিয়ে? - দ্বৈপায়ন ব্যাসের
কাছেও আমার আমার বার বার ফিরে আসার, তাঁকে নানা ভাবে পরিক্রমা করার হেতুও নয় কোনো তত্ত্বের
সন্ধান, নয় ঋষিবাক্য শ্রবণেচ্ছা কিংবা কোনো মহামানবের যাপনগাথা'র মণিকনার বিশেষ সন্ধান।
আমার নতি, প্রণতি - সকলই দ্বৈপায়ন ব্যাসের কবি প্রতিভার কাছে, অন্তর্দৃষ্টির কাছে।
মহাভারতকার দ্বৈপায়ন ব্যাসের অন্তর্দৃষ্টির কাছে - তাঁর রচিত ‘ চরিত্র ‘ কৌরব-পান্ডব
বংশের জন্মদাতা ব্যাসের কাছে নয়।
'ডন কুইক্সোট' এ, ২য় পর্বে আবিষ্কৃত হল, যে, কেউ একজন 'ওস্তাদ' কুইক্সোট'কে নিয়ে লিখে ফেলেছে এক থান ইঁট সাইজের বই। সেই সংবাদে উতলা হতে দেখাগেলো সার্ভেন্টিস্ কে। কে এই সার্ভেন্টিস্? ইনিই কি গ্রন্থকার নিজে না'কি ইনি গ্রন্থকারের রচিত এমন একটি ‘ চরিত্র ‘ যার বলা কাহিনীর টীকাকারই হলেন গ্রন্থকার সার্ভেন্টিজ?
মহাভারতকার দ্বৈপায়ন ব্যাস আর তাঁর রচিত ‘ চরিত্র ‘ কৌরব-পান্ডব বংশের জন্মদাতা ব্যাসদেব যে একই ব্যক্তি নন তা প্রমাণ করবার মতো কোনো তত্ত্ব বা তথ্য আমার হাতে নেই শুধুমাত্র বারংবার মহাভারত পাঠকালে ও পাঠান্তে আমার নিজস্ব অনুভুতি ছাড়া। এই অনুভবের প্রথম সূত্রটি আমার মর্মে ক্রমে গড়ে উঠেছে অম্বিকা ও অম্বালিকা নামক দুই যুবতীর প্রতি ‘ চরিত্র ‘ ব্যাসের এবং সুমহান পিতামহ ব্রহ্মচারী ভীষ্মের অলিখিত যৌন প্রতিযোগিতাকে অনুভব করে - যা অব্যবহিত পরে বিস্তারে জানাবো আমি। এখানে এইটুকু শুধু বলে রাখি, যে, এই ভাবনা-সূত্রের “ক্লু” কিন্তু দিয়ে রেখেছেন মহাভারতকার দ্বৈপায়ন ব্যাস স্বয়ং।
পূর্বে উল্লেখ
করেছি জীবনানন্দ দাশ কথিত “ কবিতা জননের প্রতিভা ও আস্বাদ” এর কথা। মহাভারতও যেহেতু
এই আস্বাদেরই ফসল অতএব তা 'বিষবৃক্ষ' না'কি 'গৃহে গৃহে অমৃত ফল ফলানো'ই তার কাজ সে
কথা মহাভারতকার দ্বৈপায়ন ব্যাসের কাছে শুনতে চাওয়া নিতান্ত বাতুলতা। বরং তাঁর রচিত
‘ চরিত্র ‘দিগের একজনের দৃষ্টিকোণ থেকে অন্যজনকে দেখলেই সম্ভবতঃ সুবিচার করা হয় মহাকবির
প্রতি এবং এই বিচার বিশ্লেষণের প্রস্থানভূমিটি তিনি নির্মাণ করে গিয়েছেন নিজেই।
উদাহরণ হিসাবে
মহামতি কৃষ্ণের কথাই ধরা যাক। ‘ চরিত্র ‘ ব্যাসও এই মহাকাহিনীর অন্যান্য সব ‘ চরিত্র
‘দিগের মতোই সেলাম দিচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণকে আর সেই সেলাম-খবর আমরা পাচ্ছি নানান পর্বে নানান
কথকজনের, সূত্রধারের মুখে। কৃষ্ণ প্রথমবার 'পাব্লিকলি' 'বিশ্বরূপ' দেখাচ্ছে কৌরবসভায়।
কথক মুখে আমরা শুনছি সেই দৃশ্য দেখে সভাশুদ্ধ সক্কলে হয় ভক্তি গদগদ নতুবা ভীত। এই দৃশ্য
প্রমাণ করে দিচ্ছে যে কৃষ্ণই স্বয়ং ঈশ্বর আর আর এই জগত কৃষ্ণতেই জাত, পালিত এবং বধ্য।
- যদি ধরে নিই যে মহাভারতকার নিজেও তা'ই বিশ্বাস করেন তাহলে প্রশ্ন ওঠে 'উদ্যোগপর্ব'
মধ্যে উলুকের দূতীগিরির কাহনটি কেন সন্নিবেশিত হল এমন বিস্তারে? কালীপ্রসন্নতে দেখতে
পাচ্ছি অধ্যায় ১৫৬ থেকে অধ্যায় ১৬১ অব্দি এই দৌত্য কাহিনী যাতে দুর্যোধন উলুকের মুখে
যুধিষ্ঠির কে 'বিড়াল তপস্বী (ডিন্ডিকমূষিক-কথা)' ইত্যাদি বলানো ছাড়াও শ্রীকৃষ্ণের
“বিশ্বরূপ” বিষয়ে বলছে তার মতামত বা বিশ্লেষণঃ ' মায়া, ইন্দ্রজাল বা অতি ভীষণ কুহক
সকল সমরে অস্ত্রধারী বীরপুরুষকে কদাচ বিভীষিকা
প্রদর্শন করিতে সক্ষম হয়না'।
সভামধ্যে চ যদ্রূপং মায়যা কৃতবানসি।
তত্তথৈব পুনঃ কৃৎবা সার্জুনো মামভিদ্রব
॥ ৫-১৬০-৫৪(৩৭৩১৩)
ইন্দ্রজালং চ মায়াং বৈ কুহকা বাপি ভীষণা
।
আত্তশস্ত্রস্য সঙ্গ্রমে বহন্তি প্রতিগর্জনাঃ
॥ ৫-১৬০-৫৫
কৃষ্ণের
সুমহান “বিশ্বরূপ” - যা সত্যই কৃষ্ণ পরেও ব্যবহার করবে যুদ্ধক্ষেত্রে - অবশ্যই সমবেত
যুযুধানদের ভক্তি ও ভীতি উদ্রেকেরই নিমিত্ত – তা'কে বৈজ্ঞানিক চোখে 'কালাযাদু' বা গণ
সম্মোহন ছাড়া আর কিছুই বলতে পারছেনা দুর্যোধন আর এই ব্যাখ্যা, 'বিশ্বরূপের' নিশ্চয়ই
একদিনের বা একজনের নয়। এটিও আরেকটি মতবাদ কিংবা মতামত। - তাহলে আমরা কি এই মত বা মতবাদকে
স্রেফ অস্বীকার করে অবনত হবো “বিশ্বরূপের” আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যায়? কেন হবো? কেনই বা
মেনে নেবো যে ‘ চরিত্র ‘ ব্যাস বা অপর ‘ চরিত্র ‘রা যা'ই বলে, যা'ই ভাবে তা'ই মহাকবি
কৃষ্ণদ্বৈপায়নের নিজের কথা? শেক্ষপীরের বা দস্তয়েভস্কির সৃষ্ট সব ‘ চরিত্র ‘গুলিই কি
তাঁরা নিজে? এখানে এসে আমার মনেহয় গ্রন্থকার সার্ভেন্তিজ যেমন ‘ চরিত্র ‘ সার্ভেন্তিজের
টীকাকার ঠিক তেমনি কবি দ্বৈপায়ন ব্যাসও ‘ চরিত্র ‘ ব্যাসের বলা গল্পের টীকাকার। আর
তাই যদি হইয় তবে একথা মানতেই বা ক্ষতি কোথায় যে কৃষ্ণের এই বিশ্বরূপের খেল্টিতে জনতার
মুগ্ধতার আর দুর্যোধনের দ্বারা এই মূল্যায়নের মূল্যে কবি দ্বৈপায়ন ব্যাস বেশ একচোট
হেসে নিলেন কৃষ্ণ আর তৎকালে কৃষ্ণভীত বা ভক্তদের উপর? এখানে এসে উদ্ধার করতে বাধ্য
হই কবি গৌতম বসু'র পত্রাংশটিঃ
"তোমার পাঠ এমন একজনের পাঠ … যিনি ফরাসী বিপ্লবের পরে জন্মেছেন, শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে যিনি রাসপুটিনের ছায়া দেখতে পান, এবং বনপর্বের অর্জুনের মধ্যে হয়তো একজন ক্যাসানোভা ( সদর্থে) । এগুলি সবই প্রাসঙ্গিক । আমার কথা একটাই - এইভাবে নিজেকে বোঝা যায় , নিজের সময়কেও হয়তো বোঝা যায় , কিন্তু মহাভারতের স্থপতিদের বোঝা যাবে না । তাঁরা ahistorical.”
হ্যাঁ, রাসপুটিন।
কৃষ্ণের মধ্যে যার ছায়া কিংবা যার মধ্যে কৃষ্ণের ছায়া সবচেয়ে স্পস্ট সে লোক রাসপুটিন।
তথাপি নামটি আমার মাথায় আসতো না, গৌতমদা উল্লেখ না করলে।
এই পর্বের
অন্তিমে বলার কথা একটিই কৃষ্ণকে ঈশ্বার ভাববার সূত্রের পাশাপাশি তাকে রাসপুটিন ভাববার
সূত্রও যেহেতু কবি দ্বৈপায়ন ব্যাস গিয়েছেন রেখে সুতরাং তাঁকে ‘ চরিত্র ‘ ব্যাস থেকে
আলাদা করে দেখতেই হয় আর এই ‘ চরিত্র ‘ ব্যাসের মুখে যুধিষ্ঠিরের প্রতি 'ধর্মরাজ' সম্বোধনের
হেতু তৎকালীন রেওয়াজের কবি দ্বৈপায়ন ব্যাস অঙ্কিত চিত্র বলেই ধরে নিতে হয়।
কথায় কথায়
খেই হারিয়ে ফেলার আগেই বলে রাখি ক'টি কথা, যেগুলি, অন্তিমে হয়তোবা কথার কথাই শুধু।
বলে রাখি,
যে, রামায়ণে যেমন রাবণ তেমনি মহাভারতে আমার পক্ষপাত কৌরব পক্ষের দিকেই। যতদূর মনে পড়ছে
"পথের পাঁচালী " র অপুর ফিরে ফিরে মনে পড়ত মহাভারতের যে দুটি দৃশ্য তার একটি
রথচক্র উদ্ধারে অক্ষম মৃত্যুমুখী কর্ণ আর অসহায়, পলাতক, ভগ্নউরু দুর্যোধন। বিভূতির
দিনলিপিতে অভাবী দ্রোণের ছেলেকে দুধ বএ পিটুলি গোলা খাওয়ানোর কথা এসেছে বেশ কয়েকবার।
- হ্যাঁ এরা সকলেই কৌরব পক্ষীয়। ধৃতরাষ্ট্র ‘ চরিত্র ‘টি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সবুজ,
করুণ অনুভুতির কথা তো সর্বজনবিদিত। - এই সকল ভেবে মনে জোর পাই, আরো খানিকটা, কৌরব দেরকে সমর্থন করতে।
বলে রাখি
আরেকটি কথাও এখানে। মহাভারত বিষয়ে পত্রালাপে
যে একটি কথা লিখেছেন গৌতমদা, গৌতম বসু, যা অনতিপূর্বেই উদ্ধার করেছি, তা’ই পুনরিদ্ধার
করতে হয়, মানতে হয়, যে,এই সকল আলোচনা, অন্বেষণ - সমস্তই আত্ম আবিষ্কার। আপনাকে আর আপনার
কালকে নতুন করে আবিষ্কার করা। - মহাভারতের স্থপতিরা থেকে যান, থেকে গিয়েছেন, যাবেন এই সকল মানুষী প্রয়াসের থেকে বহু বহু বহু
আলোকবর্ষ দূরে।
২।
১।
মহাভারতে
নিবিড়নিতম্বিণীদের ছড়াছড়ি। দ্রৌপদী অবশ্যই সেই সকল নিবিড়নিতম্বিণীদের অন্যতমা যাকে
তার গণতান্ত্রিক নিয়মে যে পয়লা স্বামী, 'ধর্মরাজ', সে, দ্যূতসভায় সর্ব সমক্ষে বিজ্ঞাপন
দেয় এই ভাবেঃ
নৈব হ্রস্বা ন মহতী ন কৃশা নাতিরোহিণী।
নীলকুঞ্চিতকশী চ তয়া দীব্যাম্যহং ৎবয়া॥
শারদোৎপলপত্রাক্ষ্যা শারদোৎপলগন্ধয়া।
… …
যাদৃশীং ধর্মকামার্থসিদ্ধিমিচ্ছেন্নরঃ
স্ত্রিয়ম্॥
“যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে সুবলনন্দন! যিনি
নাতিহ্রস্বা, নাতিদীর্ঘা, নাতিকৃশা ও নাতি স্থুলা; যাঁহার রূপ লক্ষীর ন্যায়, কেশকলাপ
দীর্ঘ, নীল ও আকুঞ্চিত … ধর্মার্থকামসিদ্ধির হেতু … মধ্যদেশ বেদীর ন্যায়; সেই সর্নাংগসুন্দরী
দ্রৌপদীকে পণ রাখিলাম “। ( ৬৪ অধ্যায়, সভাপর্ব, কালীপ্রসন্ন সিংহ)
তবে দ্রৌপদী নয়, এখানে ধর্মার্থকামসিদ্ধির
হেতু অন্য দুই নিবিড় নিতম্বিণীর দিকে আমি একটু গভীর ভাবে তাকাতে বাধ্য হই যখন দেখি
কৌরব-পান্ডব যুদ্ধ নিশ্চিত হয়ে উঠলে কৃষ্ণভ্রাতা বলরাম পর্যন্ত বলে, যে, সে এই যুদ্ধে
থাকবেনা। যুদ্ধ ব্যাপারেও না। সে চলেযাচ্ছে সরস্বতীতীরে তীর্থ পর্যটনে অর্থাৎ সে 'বয়কট'
করছে এই যুদ্ধকে অথচ কৌরব-পান্ডবের দুই পিতামহ – ‘ চরিত্র ‘ ব্যাস আর মহামতি ভীষ্ম
– কিন্তু বয়কট করেনা যুদ্ধকে। একজনকে দেখি কৌরব পক্ষের সেনাপতি রূপে আর অন্য জন পান্ডবের
হিতচেষ্টক। আমার মনে প্রশ্ন ওঠে, কেন? কেন এরা 'বয়কট' করেনা এই যুদ্ধকে? - এই প্রশ্নের
জন্ম এবং উত্তর সন্ধান দুয়ের জন্যই যেতে হবে, প্রথমে, সেই স্থানে যেখানে এইমাত্র অভিমন্যু
আর উত্তরার বিবাহ কার্য সমাধা হলো, সেই বিরাট রাজ্যে।
২।
অভিমন্যু-উত্তরার
বিবাহে নিমন্ত্রিত হয়ে হাজির হয়েছে সারা দেশের সমস্ত প্রধান ব্যক্তিরা। বিবাহকার্য
সমাধা হতে আলোচনা আরম্ভ হয়েছে কৌরব-পান্ডবের ‘যুদ্ধ ও শান্তি' বিষয়ে। সেখানে শান্তি
প্রস্তাবের প্রবল সমর্থক কৃষ্ণভ্রাতা বলরাম জানালেনঃ
প্রিয়াভ্যুপেতস্য যুধিষ্ঠিরস্য দ্যূতে
প্রসক্তস্য হৃতং চ রাজ্যম্ ॥
নিবার্যমাণশ্চ কুরুপ্রবীরঃ সর্বৈঃ সুহৃদ্ভির্হ্যমপ্যতঞ্ঝঃ।
স দীব্যমানঃ প্রতিদীব্য চৈনং গান্ধাররাজস্য
সুতং মতাক্ষম্ ॥
হিৎবা হি কর্ণং চ সুয়োধনং চ সমাহ্বয়দ্দেবিতুমাজমীঢঃ।
দুরোদরাস্তত্র সহস্রশোঽন্যে যুধিষ্ঠিরো
যান্বিষহেত জেতুম্ ॥
উৎসৃজ্য তান্সৌবলমেব চায়ং সমাহ্বয়ত্তেন
জিতোঽক্ষবত্যাম্।
স দীব্যমানঃ প্রতিদেবনেন অক্ষেষু নিত্যং
স্বপরাঙ্ভুখেষু ॥
সংরম্ভমাণো বিজিতঃ প্রসহ্য তত্রাপরাধঃ
শকুনের্ন কশ্চিৎ।
তস্মাৎপ্রণম্যৈব বচো ব্রবীতু বৈচিত্রবীর্যং
বহুসাময়ুক্তম্ ॥
(৫-২-৮ থেকে ৫-২-১২)
কালীপ্রসন্ন'র
সাহায্য নিয়ে এই অংশটির মর্মোদ্ধার করলে এই রকম দাঁড়ায়, যে, যুধিষ্ঠির সম্পদশালী রাজা
হওয়া সত্ত্বেও তার মারাত্মক জুয়াড়ি প্রবৃত্তিই তার এবং তার পরিবারের এই সর্বনাশ ডেকে
এনেছে। জুয়ার প্রবল আসক্তি থাকলেও পাশা খেলায় যে যুধিষ্ঠিরের দক্ষতা নেই তা যুধিষ্ঠির
নিজেও জানে আর অন্যরা তো জানেই। তথাপি, সেই দ্যূত সভায় সর্বজনবিদিত জুয়াড়িকূলশিরোমণি
শকুনির সঙ্গেই প্রতিদ্বন্দীতায় নামলো যুধিষ্ঠির যদিও সেই সভায় যুধিষ্ঠিরের সমমানের
পারদর্শী জুয়াড়িরাও হাজির ছিল যাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দীতা হলে যুধিষ্ঠিরের এই হাল না'ও
হতে পারতো। কিন্তু অপারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও তার অহং এতোই প্রবল যে, সে প্রতিদ্বন্দীতায়
আহ্বান করে বসলো খোদ জুয়াড়িকূলশিরোমণি। তারপরেও, যখন হারতে হারতে নিঃস্ব হয়ে সে আপন
পত্নীর রূপ বর্ণনা করে তার দড় বাড়াচ্ছে পণ হিসেবে, তখনো উপস্থিত প্রবীণ ও শুভানুধ্যায়ীরা
তাকে ক্ষান্ত করবার চেষ্টা নিয়েছেন। সে ক্ষান্ত হয়নি। সে হারবে জেনেও খেলে গেছে। -
সুতরাং এই খেলায়, যুধিষ্ঠিরের এই পরাভবের নিমিত্ত যুধিষ্ঠির নিজে। শকুনিকে অনর্থক দোষী
সাব্যস্ত করবার কোনো হেতু নেই।
যুধিষ্ঠির ‘ চরিত্র
‘টিকে এইভাবে, স্পস্ট করে মহাভারতের আর কোথাও কেউ বুঝিয়ে দেয়নি পাঠককে। কবি দ্বৈপায়ন
ব্যাস নিজে যদি বিশ্বাস করতেন যুধিষ্ঠির সত্যই 'ধর্মরাজ' তাহলে বলরামহেন একটি নিরপেক্ষ
অথচ প্রধান চরিত্রের মুখে, সর্ব সমক্ষে এই ভাষণ টি কি তিনি যোগ করতেন তাঁর কাব্যে?
প্রশ্নটি পাঠকের চিন্তার নিমিত্ত
রেখে দয়া যাক এখন। এখন দেখি বলরামের এই ভাষণের পরে বিরাট রাজ্যের মজলিশে ঠিক কি প্রতিক্রিয়া
হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে বলরামের এই ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে এমনই তর্কাতর্কি বেধে উঠেছে, যে,
মনে হয় এখানেই না লেগে যায় একটি যুদ্ধ। এমতাবস্থায় কৃষ্ণ যথারীতি প্রয়োগ করলো তার পাটোয়ারি
বুদ্ধি। সমবেত জনতাকে নমস্কার জানিয়ে বল্লো, বিবাহকার্য মঙ্গলমতো সমাধা যখন হয়েগেছে
তখন প্রত্যেকের নিজগৃহে ফিরে যাওয়াই এখন বিধেয়। যুদ্ধ বিষয়ে আলোচনার উপযুক্ত সময় এটি
নয়। সভা সেদিন ভঙ্গ হল ঠিকই কিন্তু মাত্র কয়েকটি অধ্যায় পার হতে না হতেই দেখাগেলো যুদ্ধ
অবশ্যম্ভাবী। সেই সময়ে আবার মঞ্চে প্রবেশ করলেন বলরাম।
মঞ্চে প্রবেশ করলেন এবং এবারে প্রবেশ করলেন সদলে। সেদিন কৃষ্ণসহ পান্ডবদের উপস্থিতিতে বলরামের সঙ্গে ছিল অক্রূর, কৃষ্ণপুত্র শাম্ব যে আবার দুর্যোধন-দুহিতা লক্ষণার স্বামী এবং কৃষ্ণকূলের অনেকেই। বলরাম জানালেন যে, তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা এই যুদ্ধে থাকবেন না। যুদ্ধ ব্যাপারেও না। তাঁরা চলেযাচ্ছেন সরস্বতীতীরে তীর্থ পর্যটনে অর্থাৎ তাঁরা সকলেই 'বয়কট' করছেন এই যুদ্ধকে। কিন্তু আশ্চর্য কৌরব-পান্ডবের দুই পিতামহ – ‘ চরিত্র ‘ ব্যাস আর মহামতি ভীষ্ম – কিন্তু বয়কট করেনা যুদ্ধকে। করেনা, কেননা, আমার মনেহয় এই দুইজনের মধ্যে একটি শোধবোধের ব্যাপার ছিল ফলে একজন যুদ্ধ 'বয়কট' না করলে অন্যজনের পক্ষেও তা করা অসম্ভব।
৩।
এই শোধবোধ
অবশ্যই দ্বিপাক্ষিক ছিল কেননা মহাকবি দ্বৈপায়ন ব্যাস ঠিক কেমন মানুষ ছিলেন তা জানা
না থাকলেও তাঁর সৃষ্ট ‘ চরিত্র ‘ ব্যাসদেব যে বিস্তর রসিক ছিলেন তা আমরা দেখেছি। মাতৃপক্ষীয়
সৎভ্রাতার অপুত্রক অবস্থায় মৃত্যুর পর বংশরক্ষাহেতু যখন মাতা সত্যবতী বধূদের গর্ভ নিষিক্ত
করবার নিমিত্ত ডাক পাঠালেন ‘ চরিত্র ‘ ব্যাস'কে, সেই ডাক, সেই যুগে একটি যজ্ঞ পরিচালনা
করবার মতনই স্বাভাবিক এবং পবিত্র কাজের ডাক। তাছাড়া ‘ চরিত্র ‘ ব্যাস নিজেও সাধুপুরুষ।
ফলতঃ 'কাজ'টি করে দিয়েই সেই কক্ষ থেকে বার হয়ে আসাই হয়তো ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ‘নাগর’
ব্যাস ঠিক দেখলেন, অভিসার কক্ষের অত্যল্প আলোকেও ঠিক দেখলেন যে একজন নিতম্বিনী তাঁকে
দেখেই ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। এতে কি বিন্দুমাত্র আহত হয়নি ‘ চরিত্র ‘ ব্যাসের নাগর-ইগো?
পরবর্তী নিতম্বিনীটি চোখ বন্ধ না করলেও তাঁকে দেখে ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। এ'ও নাগর-ইগো'তে
আঘাত লাগার মতনই। তথাপি চোখ বন্ধ করে ফেলবার চেয়ে কম অবশ্যই। অতঃপর এই দ্বিতীয় নিতম্বিনীর
সঙ্গে দ্বিতীয়বার সঙ্গমের মাতৃ আদেশ হলে সেই নিতম্বিনী নিজেতো গেলোই না। বরং তার বসন,
অলঙ্কার ইত্যাদি দিয়ে সজ্জিত করে পাঠিয়ে দিলো এক দাসীকে। দাসীর মর্মে যেহেতু ছিল শ্রদ্ধাভাব
তাই সে 'সেবাযত্ন' করলো, মনেহয়, ষোড়শ উপচার দিয়েই। তাতে ‘ চরিত্র ‘ ব্যাসের ক্রোধ,
নাগর-ইগো' - কিছুটা শান্ত হয়েছিল নিশ্চিত নাহলে বিদুর কেন তাঁর প্রিয়তম হতে যাবে?
অর্থাৎ অম্বিকা-অম্বালিকা
নামক দুই নিতম্বিনী, যাদের বর্ণনা মহাভারতে এইরূপঃ
তে চাপি বৃহতীশ্যামে নীলকুঞ্চিতমূর্ধজে।
রক্ততুঙ্গনখোপেতে পীনশ্রোণিপয়োধর়ে॥
(১-১১১-৩)
অথচ এই যে 'কাজ', যা এই
ভিখারীটি করে গেলো, ব্রহ্মচারীত্বের সঙ্গে এর কোনো বিরোধ নেই। এই “কাজ”টুকু করেও তো
ব্যাসদেব “ব্রহ্মচারী”ই রয়েগেলো। সে যুগে এ'ই ছিল রীতি। তথাপি ব্রহ্মচর্যের দোহাই দিয়ে
দেবব্রত'র এই নিতম্বিনীদ্বয়ের সঙ্গ প্রত্যাখ্যান করা কে কেমন সাজানো বলেই মনে হয়। আর
যদি এ সাজানোই হয় তাহলে ভীষ্মের যে ‘ চরিত্র ‘ ব্যাসের উপরে ক্ষোভ থাকবে আমরণ তা আর
বিচিত্র কি?
আর যদি সত্যই ব্রহ্মচর্য-পালনহেতু
দেবব্রত এই নিতম্বিনীদ্বয়ের সঙ্গ প্রত্যাখ্যান করে থাকে তাহলেও তার অবচেতন যে বিষিয়ে
ওঠেনি এই প্রত্যাখানের মূল্যে বিশেষ করে যখন তার চোখের সামনেই ‘ চরিত্র ‘ ব্যাস আসতে
লাগলো রোজ রোজ, তেমন বিশ্বাস করবার কিংবা মেনে নেওয়ার কোনো হেতু আছে কি?
যেহেতু অম্বিকা ছিল সঙ্গমকালে চোখ বন্ধ করে সেই হেতু তার গর্ভে জাত সন্তানটির প্রতি ‘ চরিত্র ‘ ব্যাসের প্রশ্রয়, ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েও রতিকালে চোখ খুলে রাখা অম্বালিকার সন্তানদের তুলনায় যে কম হবে স্বাভাবিক তা আমরা অনুমান যেমন করতে পারি তেমনি আমরা কোনো গাইনোকোলজিস্ট আর সাইকিয়াট্রিস্ট অথবা সাইকোলজিস্টের কাছে গিয়েও বুঝে আসতে পারি।
হয়তো সেই
কারণেই ‘ চরিত্র ‘ ব্যাস নিলো পান্ডবদের পক্ষ – যদিও সে জানতো এই পান্ডবেরা আদত কুরু
বংশের কেউই নয় আর এটা জানতো বলেই সে হয়তো আরো বেশী করে ঝুঁকে ছিল পান্ডবদের দিকে কেননা
আদত কুরু বংশের সে নিজেওতো কিছুই নয়। ‘ চরিত্র ‘ ব্যাসের এই মনস্তত্ত্ব অন্ততঃ পান্ডবদের
প্রতি তার দরদ, টেরপেতে অসুবিধা হয়না কোনো মহাভারত পাঠকেরই সুতরাং ভীষ্ম যে তা টের
পেয়েছিল এবং পেয়েছিল বলেই মুখের সহস্র উপদেশ, সদুপদেশ সহ সে কিন্তু যোদ্ধা ছিল কৌরব
পক্ষেরই। দ্রোণও ছিল কৌরবপক্ষেরই। কিন্তু দ্রোণ মূলতঃ একজন বেতনভোগী। সে স্ব ইচ্ছায়
পক্ষ অবশ্যই নিতে পারেনা। কিন্তু ভীষ্ম তো কুরুপ্রধানদের একজন সে কেন 'বয়কট' করেনা
যুদ্ধ অথবা “যতো ধর্মস্ততো জয়ঃ “ ফর্মুলায় যোগ দেয় না পান্ডবপক্ষে? থেকে যায় কৌরব শিবিরেই
? যুদ্ধে ভীষ্মের হাতে নিহত হলো অসংখ্য সাধারন সৈন্য যারা যুদ্ধে এসেছিল, হয় পেটের
দায়ে নতুবা বান্ডব কিংবা কৌরবপক্ষের চাপে পড়ে,
বাধ্য হয়ে। এরাই বধ হলো ভীষ্মের হাতে। অথচ ভীষ্ম তার নিজেকেবধ করবার ফন্দিটি নিজেই
বাৎলে দিলো পান্ডবদের। … মনেহয় এই ‘চরিত্র’ ব্যাসের প্রতি অন্তর্গত যৌন ঈর্ষা বশতই
ভীষ্ম সরাসরি পান্ডবপক্ষে যোগ দেয়নি যেহেতু সে টের পেয়েছিল ‘চরিত্র’ ব্যাসের নিগূঢ়
পক্ষপাত পান্ডবদের প্রতিই।
পক্ষান্তরে জতুগৃহ পর্বের অন্তে কুন্তীসহ পান্ডবেরা
যখন আক্ষরিক অর্থেই পথের ভিক্ষুক তখন তাদের কে ক্ষমতার সমীকরনে ফিরে হাজির করবার বিশল্যকরণীটি
তাদের হাতে কিন্তু তুলে দিয়েছিল এই ‘ চরিত্র ‘ ব্যাসই। দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে যাওয়ার এবং
অংশ গ্রহন করবার আদেশ এই ‘ চরিত্র ‘ ব্যাসেরই। সময়মতো দ্রুপদের সহায়তা না পেলে পান্ডবেরা
কি আদৌ কোনো দিন ফিরে আসতো তৎকালীন রাজনীতির ক্ষমতা সমীকরণে?
৪।
প্রশ্ন, এস্থানে , উঠতেই পারে, যে, অম্বিকা কিংবা
অম্বিকাপুত্র ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি এই ‘চরিত্র’ ব্যাসের মর্মে কোনো বৈরীভাব থেকে থাকলে
সে কেন ধৃতরাষ্ট্র-পত্নী গান্ধারী’র গর্ভ-বিড়ম্বনা কালে সহায়তা করেছিল, আদপে পালন করেছিল
অতি নিপুণ এবং স্নেহময় এক ধাত্রীর ভূমিকা? যদিবা নিজমাতা’র আহ্বান সে পারেনি প্রত্যাখ্যান
করতে তাহলেও অন্তিমে সে ‘ চিকিৎসা ব্যর্থ হয়েছে’ বলে খালাস নিতেই পারতো দুর্যোধনাদির
জন্মটি না ঘটিয়েই। সে ক্ষেত্রে পান্ডু’র তথাকথিত ‘পুত্র’দের সিংহাসন লাভের পথে আর থাকতোনা
কোনো বাধাই। কিন্তু তা না করে এই ‘চরিত্র’ টি গান্ধারীকে সহায়তা করলো শতপুত্রের জন্ম
দিতে। কেন তা করলো এই ‘চরিত্র’ ? মনেহয়, প্রথমতঃ, ‘চরিত্র’টি নয় ততোদূর ‘হাতে কলমে’
‘ভিলেন’ যতোটা হলে হালের অনেক ‘চিকিৎসক’হেন প্রসবের নামে ঘটানো যায় গর্ভপাত। দ্বিতীয়ত
এমন ঘটালে, বিশেষতঃ রাজবাড়িতে, জনতা সমক্ষে তার ‘চিকিৎসক’ কিংবা ‘দৈব বলে বলীয়ান’ ইমেজটি
যেতো মুহুর্তে বিগড়ে। সুতরাং ‘সার্জারী’ ক্ষেত্রে সে করলো না কোনো রকম গাফিলতি। বরং
তার থেকে শতগুন বেশী, শতগুন গভীরতর আঘাতটি হানলো পরে। ভারতযুদ্ধের কালে। যুদ্ধারম্ভে
সে চাইলো অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে দিব্য দৃষ্টি দিতে যাতে ধৃতরাষ্ট্র স্বচক্ষেদেখতে পায় নিজ
পুত্রদের বিনা। একে একে। ‘বিনাশ’ কেননা ভারতযুদ্ধের পূর্বেই, পক্ষ বিপক্ষ, শত্রু মিত্র,
অক্ষ-শক্তি মিত্র-শক্তি’র যে সমীকরন গিয়েছে লিখিত হয়েতাতে কৌরবদের জয়ের আশা বহু কৌরবপক্ষীয়
রাজন্যবর্গও করেনি।
ভারতযুদ্ধের আরম্ভে ‘চরিত্র’ ব্যাস চাইলো অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে দিব্য দৃষ্টি দিতে। এখানেও এই ‘চরিত্র’টিকে একজন চিকিৎসক হিসেবেই ধরে নিতে হয়। এখানেও সে ‘সার্জন’। এবারে তার ক্ষেত্র ‘গাইনোকোলজি’ নয়, ‘আই’। আজন্মের অন্ধত্বের পরে ‘লেসার সার্জারী’ কিংবা আরো উন্নত কোনো প্রযুক্তিতে দৃষ্টি ফিরে পেয়েনিজ পুত্রদের বিনাশ দর্শনের মতো ‘পারভার্ট’ ছিলনা ধৃতরাষ্ট্র। সুতরাং সে প্রত্যাখ্যান করলো ‘আই সার্জারী’র এই প্রস্তাব এবং এই প্রত্যাখ্যানের মূল্যে আবারো প্রমাণিত হলো ধৃতরাষ্ট্রের মানবিকতা আর নিজ পুত্রদের বিনাশ-দর্শনের এই নিমন্ত্রণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হলো ‘চরিত্র’ ব্যাসের অবচেতন কিংবা সচেতন জিঘাংসা। দুই’ই প্রতিষ্ঠিত হলো কবি দ্বৈপায়ন ব্যাসের দ্বারা।
দূর-অদূর
পর্ব
হেঁটে আসছে
একজন।
একজন মানুষ।
হেঁটে আসছে
আলোয়, হেঁটে আসছে অন্ধকারে।
হেঁটে আসছে
ঝড়ে, জলে, বৃষ্টিতে, খরায়, বন্যায়, দুর্যোগে, শ্যামলে, শান্তিতে।
আদতে সে
পালিয়ে আসছে। পালিয়ে আসছে একটি প্রাসাদের থেকে।
শুধুমাত্র
একটি প্রাসাদের থেকে কি? শুধুমাত্র একটি মানচিত্র থেকে কি?
না। সে পালিয়ে
আসছে, পালাতে চাইছে একটি নিয়তির থেকে যে নিয়তি তাকে বলেছে, যে, সে একদিন হবে পিতৃহন্তা,
বলেছে যে একদিন নিজ মাতার গর্ভে সে জন্ম দেবে সন্তানের … সেই অভিশাপ থেকে, সে মাতা-পিতার
থেকে পালিয়ে আসছে সে। হেঁটে আসছে সে।
হেঁটে আসছে
সে। হেঁটে আসছে একা। সে ভেবে নিচ্ছে যে সে হেঁটে আসছে একা। অথচ তার নিয়তিও তার সঙ্গে
সঙ্গেই যে আসছে তা সে জানেনা। জানেনা আদতে এই হেঁটে আসা, এই হাঁটতে থাকাই তার নিয়তি
…
আমরা জানি
অয়দিপাউসের গল্প। আমরা জানি তার হাঁটতে থাকার মাঝখানে, পালাতে থাকার পথেই, পালাতে পালাতেই
সে এসে পৌঁছেছিল তার নিয়তির দ্বারা নির্দিষ্ট আরেক প্রাসাদে যেখানে আসার পথে সে অজান্তেই
খুন করে এসেছে তার প্রকৃত পিতাকে আর এই পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়ার এই প্রাসাদেই সে তার
প্রকৃত মাতার গর্ভে জন্ম দিয়েছে সন্তানের।
অতঃপর?
অতঃপর সেই
প্রাসাদের থেকে স্বেচ্ছায় বিতাড়িত হয়ে সে হাঁটে। আবার পথ হাটে। হাঁটতেই থাকে। এবার
সে অন্ধ। নিজহাতে নিজেকে সে করেছে অন্ধ। হয়তো তার আজন্ম চক্ষুষ্মান-অন্ধতার প্রতিপক্ষে
তার এই স্বেচ্ছা অন্ধত্ব যেন তার জেহাদ। ‘ অন্তরে আজ দেখবো যখন আলোক নাহি রে’ …। দ্বিতীয়
পর্বের এই পথচলায় তার সঙ্গী তার কন্যা আন্তিগোনে। এতদ্ভিন্ন প্রথম পর্বের তার চলা
ছিল ‘পলায়ন’ এই পর্বের তার চলা যেন ‘প্রব্রজ্যা’।
মনেপড়ে যায় সেই 'শুনঃশেপ'কে যাকে তার মাতাপিতা
বিক্রি করে দিয়েছিলো রাজপুত্র রোহনের কাছে - শতটি গোধনের বিনিময়ে - বরুনদেবের কাছে
বলী দেওয়ার নিমিত্ত। অতঃপর আরো শতটি গোধনের বিনিময়ে শুনঃশেপ'র পিতা অজীগর্ত রাজি হল
পুত্রকে যূপকাষ্ঠে বন্ধনের এবং আরো শতটি গোধনের বিনিময়ে উদ্যত হলো বলী দিতেও।
পিতা তাকে বরুনদেবের কাছে বলীদানে শর্তবদ্ধ
– এই সংবাদ পাওয়ামাত্র রাজপুত্র রোহিত গেলো অরণ্যে পালিয়ে। পালাতে পালাতে পালাতে পালাতে
… যেন গোদারের 'ব্রেথলেস্' এর সেই প্রোটাগোনিস্ট … এক সময় অন্তর্গত শ্রান্তিতে থেমে
গেলো সে। তখনই সে পিতার অসুস্থতার সংবাদটিও পেলো। সুতরাং সে স্থির করলো ঘরেই ফিরেযাবে।
আমাদের অভিজ্ঞতা-ব্যবহৃত চিন্তা-নিয়মে রোহিতের এই সিদ্ধান্তকে সঠিক মনে হতেই পারে।
কিন্তু তক্ষুনি তাকে ছদ্মবেশী ইন্দ্র এসে জানালো যে “চরৈবেতি”। জানালো, যে, একমাত্র
পরিভ্রমণকারীর কাছেই মহাবিশ্ব প্রকাশ করে আপনাকে - সহায়'এ, সম্পদে। পক্ষান্তরে বীরজন
বলো, মেধাবীজন বলো, গুনীজন বলো - আলস্যে আপনাকে আটকে রাখলে ক্রমে পরিণত হয় নির্জীবে।
অতএব “হে রোহিত, চরৈবেতি'।
নানা শ্রান্তায় শ্রীরস্তি ইতি রোহিত শুশ্রুম।
পাপো নৃষদবরো জন ইন্দ্র ইচ্চরতঃ সখা চরৈবেতি চরৈবেতি।।
আরো কিছুকাল ঘুরে বেড়ালো রোহিত। আবারো
সে শ্রান্ত বোধ করলো স্বাভাবিক নিয়মেই। বাঁক ঘুরে সে আবার নিতে চাইলো ঘরের পথ। এবারেও
সেই ব্রাহ্মণ, ছদ্মবেশী ইন্দ্র, এসে দাঁড়ালো পথিপার্শ্বে। আবারো বল্লোঃ 'চরৈবেতি'।
বল্লোঃ একমাত্র ভ্রাম্যমানেরই কোনো পাপ হয়না, সে অশুচি হয়না। তার সমস্ত শ্রান্তি ধুয়ে নেয় পথ।আমার গহনে
বেজেওঠেঃ পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে, পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া। যাত্রাপথের আনন্দগান
যে গাহে তারি কণ্ঠে তোমারি গান গাওয়া।
পুষ্পিণ্যৌ চরতে জঙ্ঘে ভুষ্ণুরাত্মা ফলগ্রহিঃ
।
শেরেহস্য সর্বে পাপ্মানঃ শ্রমেণ প্রপথে
ততশ্চরৈবেতি চরৈবেতি।।
তারপর আরো
তিনবার, রোহিতের গৃহাভিমুখ-যাত্রা'র পক্ষান্তরে আমরা শুনি সেই একই উপদেশঃ 'ভ্রমো! ভ্রমণ
কর! চরৈবেতি'
আস্তে ভগ আসীনস্যোর্ধবস্তিষ্ঠতি তিষ্ঠতঃ।
শেতে নিপদ্য মানস্য চরাতি চরতো ভগশ্চরৈবেতি,
চরৈবেতি।।
… হে রোহিত যাওয়াহীন যে মানুষ তার জন্য সমস্ত কালই
কলিকাল...
কলিঃ শয়ানো ভবতি সংজিহানস্তু দ্বাপরঃ
।
উত্তিষ্ঠংস্ত্রেতা ভবতি কৃতং সংপদ্যতে
চরংশ্চরৈবেতি চরৈবেতি।
চরন্ বৈ মধু বিন্দতে চরন্ স্বাদুমুদুম্বরম্ ।
সূর্য্যস্ব পশ্য শ্রেমাণং যো ন চন্রয়তে
চরংশ্চরৈবেতি চরৈবেতি।।
যে সতত ভ্রাম্যমান
সে'ই শুধু লাভ করতে সক্ষম হয় মধু। অতএব …
এই ভ্রমণ আদতে এক প্রতীক। এই ভ্রমণ মনোজ ভ্রমণ।
এই ভ্রমণ মর্মের অন্তর্গত দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াটিকে সতত সজাগ, সবাক রাখবার মনোগত-গৃহযুদ্ধ।
এই ভ্রমণের তলে তলেই একজন পলাতক হয়ে ওঠে, উঠতে পারে পরিব্রাজক। এই ভ্রমণের আবডালে আপনিই
ক্ষয় হতে থাকে সমস্ত বন্ধন – যা বাহিরের, যা নির্মীত, যা বেনিয়ম, যা বিশ্বনিয়মের বিপরীত
… যেন শুনতে পাইঃ বিপদ বাধা কিছুই ডরে না সে,
রয় না পড়ে কোনো লাভের আশে, যাবার লাগি মন তারি উদাসে--যাওয়া সে যে তোমার পানে
যাওয়া …' মনেহয় যেন এই ভাবেই, দ্বিধায়, দ্বন্দ্বে,
বিস্ময়ে এগিয়ে যেতে যেতেই আমাদের সমস্ত বাধাবিঘ্নগুলি ক্ষয়ে যাবে, আমরা উত্তীর্ণ হব
মানবতার সেই স্তরে যেখানে “বন্ধন ছাড়া হারাবার আর থাকেনা কিছুই ...” …
‘চরৈবেতি’র মন্ত্রটির ছায়াপাত ঘটতে দেখি
পান্ডবদের যাপনেও। কিন্তু তাদের ‘যাত্রা’গুলির
সমস্তই কি ‘প্রব্রজ্যা’ নাকি ‘পলায়ন’ নাকি দুয়ে মিলেমিশে একাকার? সেই একাকারের নাম
টি কি? ‘পলায়ন’ নাকি ‘প্রব্রজ্যা’? মর্মপথে বেরিয়ে পড়ি উত্তরের সন্ধানে।
২।
প্রাসাদ
থেকে ‘পলায়ন’ বা ‘প্রব্রজ্যা’র সূচনা পান্ডুর বনগমনের মুহুর্তেই। পান্ডুর এই ‘যাওয়া’
কে ‘প্রব্রজ্যা’ বলতে পারিনা আমি। কি করে বিশ্বাস করি যে বনগমনের পূর্বে পান্ডু জানতো
যে সে সন্তানোৎপাদনে অক্ষম? আর তা যদি জানতোই তাহলে কেন সে প্রয়োগ করলো না ‘নিয়োগ’
প্রথার? তাহলে রাজসংসারে ( বা তার বাহিরেও ) অনেকেই জানতো পান্ডুর এই দূর্বলতার কথা
আর তথাপি পান্ডু একদিন আবিষ্কার করেছিল যে কুন্তী অথবা মাদ্রী অন্তঃসত্ত্বা? সুতরাং
অন্যত্র গিয়ে গর্ভপাত অথবা দৈব-কাহনের আমদানীই কি হতে পারেনা পান্ডুর সস্ত্রীক বনগমনের
হেতু? … এ’ও কি অসম্ভব, যে, ‘নিয়োগ’ প্রথা অবলম্বন করলে ‘নিয়োজিত’ পিতাটি যদি কোনোদিন
এসে হাজির হয় পিতৃত্বের দাবী নিয়ে – সেই ভীতিবশেই এই বনগমন? ( ঠিক যে কারণে ‘স্পার্ম
ডোনার’এর পরিচয় গোপন রাখা হয় গ্রহীতার কাছে ) । অরণ্যবাস কিংবা ভ্রমণকালে কুন্তী ও মাদ্রীর গর্ভসঞ্চার ধর্মদেব না ‘ধরম্
সিং’ নামের কোনো ব্যক্তির দ্বারা তা’ই বা কে জানে? … সুতরাং পান্ডু’র বনগমন এবং স্থানে
থেকে স্থানান্তরে গমন কে ‘প্রব্রজ্যা’ না বলে পলায়নই বলতে বাধ্য হচ্ছি। ওই পলায়নছায়া
শিশু পান্ডবদের যাপনেও ছায়া ফেলে যতোক্ষণ না পান্ডুর মৃত্যু ও তার সঙ্গে মাদ্রীর সহমরণের
অন্তে কুন্তী তাদের এনে হাজির করে কুরুপ্রাসাদে।
সেই প্রথম তারা চরে বেড়ানোর
বিকল্প যে স্থিতি তার সম্যক পরিচয় পেতে আরম্ভ করলো আর একই সঙ্গে আরম্ভ হলো ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রদের
দ্বারা তাদের হেনস্থা। ক্রমে এই ‘হেনস্থা’র বিপ্রতীপে ভীম ও প্রতি-হেনস্থায় নিরত হলে
পরিস্থিতি হতে লাগলো জটিলতর। ভাবি, যদি ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রদের দ্বারা কুন্তী-মাদ্রীর
পুত্রদের এই হেনস্থা না হতো, যদি তাদের নিধনহেতু না পাঠানো হতো বারানাবতে, যতুগৃহে
– পান্ডবেরা কি স্ব ইচ্ছায় কখনোই বার হয়ে পরতো ‘চরৈবেতি’ মন্রের অন্তর্গত ‘দেবত্ব’
কে সম্বল করে? রাজপ্রাসাদের মৌজ-মস্তি ছেড়ে দিয়ে? – অতএব, জতুগৃহ থেকে ‘জান বাঁচিয়ে’
পলাতক পান্ডবদের মা কুন্তী সহ যে স্থান থেকে স্থানান্তরে গমন তা’ও প্রব্রজ্যা নয়। এই
স্থান থেকে স্থানান্তরে গমন কে তুলনা করা যায় নিয়তির ভয়ে করিন্থাস থেকে পলাতক অয়দিপাউসের।
অতঃপর পান্ডবেরা আবার থিতু হলো, দ্রৌপদীসহ, নিজেদের
রাজধানী নির্মাণ করে, ইন্দ্রপ্রস্থে। এই পর্বেও তাদের মর্মে কোনো ‘সুদূরের আহ্বান’
বেজে উঠতেশুনিনা যতক্ষণ না জুয়াড়ী যুধিষ্ঠিরের মূর্খামির মূল্যে তাদের বনবাসী হতে হয়
বাধ্য হয়ে। … ভারতযুদ্ধের পূর্বে আর একবারই পান্ডবেরা থিতু হতে পেরেছিল, যদিও ছদ্মনামে,
ছদ্মবেশে তবু অজ্ঞাতবাস কালে, বিরাট রাজত্বে।
অতঃপর ভারতযুদ্ধের
অন্তে …হ্যাঁ, সে আরেক কাহিনী। সেখানে যাওয়ার আগে পান্ডবদের ‘পলায়ন’ আর ‘প্রব্রজ্যা’র
পর্বগুলি দেখাযাক একটু সার্জারী করে।