‘আলোকিত সমন্বয়’
সপ্তর্ষি বিশ্বাস
‘সাধারণত বাস্তব বলতে আমরা যা বুঝি তার সম্পূর্ণ পুনর্গঠন তবুও কাব্যের ভিতর থাকেনা; আমরা এক নতুন প্রদেশে প্রবেশ করেছি। পৃথিবীর সমস্ত জল ছেড়ে দিয়ে যদি এক নতুন জলের কল্পনা করা যায় কিংবা পৃথিবীর সমস্ত দীপ ছেড়ে দিয়ে এক নতুন প্রদীপের কল্পনা করা যায় – তাহলে পৃথিবীর এই দিন, রাত্রি, মানুষ ও তার আকাঙ্ক্ষা এবং সৃষ্টির সমস্ত ধূলো সমস্ত কঙ্কাল ও সমস্ত নক্ষত্রকে ছেড়ে দিয়ে এক নতুন ব্যবহারের কল্পনা করা যেতে পারে যা কাব্য’ - জীবনানন্দ দাশের এই ধারনাটি, অন্ততঃ আমার কাছে , কাব্য বিচারের অন্তিম না হলেও একটি অতি প্রয়োজনীয় কষ্টিপাথর। জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে প্রতিজন প্রকৃত কবিই তাঁর কবিতায় নির্মাণ করে নিতে চান এমনি এক নতুন জল, নতুন প্রদীপ যা প্রকারান্তরে নির্মাণ করে নিতে চায় তার নিজস্ব মূল্যবোধের নিরিখে নিজস্ব আদর্শবাদ। তথাপি খুব কমই অন্তিমে সফল হতে পারেন, পেরেছেন, পারবেন - “ সৃষ্টির সমস্ত ধূলো সমস্ত কঙ্কাল ও সমস্ত নক্ষত্রকে ছেড়ে দিয়ে” সেই এক নতুন ব্যবহারকে প্রতিষ্ঠিত করতে” তাঁদের কাব্যে। উদাহরন হিসাবে যদি রবীন্দ্রকাব্যকেই নেওয়া যায় তাহলে “গীতবিতান” এর প্রায় প্রতিটি ‘গান’ কিংবা কবিতার মধ্যে আমি পাই ঐ নতুন জল, নতুন ব্যবহার। রবীন্দ্রনাথ যখন বলেনঃ ‘দূরদেশী সেই রাখাল ছেলে...’ তখন সেই “দূর দেশ” এই চক্রবাল-পরিধির বহির্গত কোনো চক্রবালের মানচিত্র হয়েওঠে। এই “হয়ে ওঠা”র মধ্যে সুরের ভূমিকাটিকেও অবশ্যই যাবেনা অস্বীকার করা। এই ছবিটি যেমনঃ ‘যেন জনহীন নদীপথটিতে
কে চলেছে জলে কলস ভরিতে অলস পায়ে
বনের ছায়ে’
যদিও এতে যে “নদী”, যে “পথ”, “যে” যাচ্ছে কলস ভরে নিতে – সবই এই পৃথিবীর এই মৃত্তিকার, সবই দৈনন্দিনতার । তবু যেন ঠিক তা’ও নয়। অলস, মন্থর এই চলা, এই পথ সমস্তই যেন অনন্তকালের অথবা অনাগত কালের। এই ছবিতে
“ সৃষ্টির সমস্ত ধূলো সমস্ত কঙ্কাল ও সমস্ত নক্ষত্র” যেন নবজন্ম নেয় প্রতিবার পঠনে, শ্রবনে।
আবার নিজের রচনার যে অংশকে “গান” না বলে “কবিতা” বলেছেন রবীন্দ্রনাথ সেখানে, আমার মনেহয়, যদিও সেখানেও তিনি অনন্তের বা অনাগতের বার্তাবহ তথাপি যেন “ সৃষ্টির সমস্ত ধূলো সমস্ত কঙ্কাল ও সমস্ত নক্ষত্রকে” নিয়েই কারবার করেছেন তিনি। যেমন এই কবিতাটিঃ
চৈত্রের মধ্যাহ্নবেলা কাটিতে না চাহে।
তৃষাতুরা বসুন্ধরা দিবসের দাহে।
হেনকালে শুনিলাম বাহিরে কোথায়
কে ডাকিল দূর হতে, “পুঁটুরানী, আয়।”…
অথবা
ওগো মা , রাজার দুলাল যাবে আজি মোর
ঘরের সমুখপথে ,
আজি এ প্রভাতে গৃহকাজ লয়ে
রহিব বলো কী মতে ।
যদিও অন্তিমে মর্মে এরা নিয়ে আসে সেই “অন্য চক্রবাল” এর ইঙ্গিত, “অন্য নদীর জল” তথাপি এই কবিতাগুলির অন্তর্গত যে “চৈত্রের মধ্যাহ্নবেলা”, যে “রাজার দুলাল”, যে “ঘরের সমুখপথ” - সমস্তই এই চক্রবালের, এই মানচিত্রের। তবে এখানে তাদের জন্ম হলেও তাদের গমনপথ চলেগেছে এই মানচিত্রকে পার হয়ে। বলা ভালো এরা কবির জন্য নির্মাণ করে দিয়েছে সেই পথ যা “পৃথিবীর সমস্ত জল ছেড়ে দিয়ে এক নতুন জলের কল্পনা”। তাই কবির কাছে এরা সিঁড়িমাত্র যাতে করে কবি কখনো নেমে যান জলের অতলে সেই পাতালপুরীতে যেখানে ঘুমিয়ে আছে অনন্তের নাগ-রানী অথবা এই সিঁড়ি বেয়ে কবি উঠে আসেন দুর্গের সেই উচ্চতম কক্ষে যেখান থেকে চোখেপড়ে অপর চক্রবালের ইশারাটি। অর্থাৎ কবিতাশরীরের প্রতিটি রোমকূপই এখানে অনন্ত বা অনাগতের ইঙ্গিতবহ নয়। সমস্ত মিলেমিশে রচিত সেই ইঙ্গিত।
একই কথা কমবেশী খাঁটে অমিয় চক্রবর্তী বা সুধীন্দ্রনাথের কাব্য-বিশ্ব নিয়েও। “সৃষ্টির সমস্ত ধূলো সমস্ত কঙ্কাল ও সমস্ত নক্ষত্রকে” দিয়ে নির্মীত তাঁদেরো সিঁড়িটি।
না, এতে তাঁদের কাব্যের কোন ক্ষতি হয়নি।
তবু যখন জীবনানন্দ বলেনঃ
ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল,-
ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার রাঙা, আপেলের মতো লাল যার গাল,
চুল যার শাঙনের মেঘ, আর আঁখি গোধূলির মতো গোলাপী রঙিন,
আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে, স্বপ্নে-কত দিন!
মোর জানালার পাশে তারে দেখিয়াছি রাতের দুপুরে-
তখন শুকনবধু যেতেছিল শ্মশানের পানে উড়ে উড়ে!
অথবাঃ
সুরঞ্জনা ,অইখানে যেয়োনাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনাঃ
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;
তখন ঐ “রাজার দুলাল”, ঐ “সুরঞ্জনা”, এমন কি ঐ “ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট” এর “ডালিম” টিও কিন্তু আর হয়না এই পৃথিবীর কোনো বৃক্ষের ফল। এই “ডালিম”ও যেন পৃথিবীর “ডালিম” এর অন্য, নতুন ব্যবহারে উজ্জ্বল। এরা নয়
“সৃষ্টির সমস্ত ধূলো সমস্ত কঙ্কাল ও সমস্ত নক্ষত্র” দের সন্ততি। বাচনভঙ্গী না’কি ভাষার প্রয়োগ না’কি অন্য আরো কিছুর স্পর্শে এরা সকলেই হয়ে যায় সেই “অন্য” নদীর সহোদর-সহোদরা যা “পৃথিবীর সমস্ত জল ছেড়ে দিয়ে এক নতুন জলের কল্পনা”? জানিনা। তবে টের পাই , পাঁচালী ও পদাবলীর কবিদের বাদ দিলে,বাংলা ভাষার প্রথম কবি অবশ্যই জীবনানন্দ দাশ অনন্তের বা অনাগতের পথে গমনের যাঁর সিঁড়িটিও “সৃষ্টির সমস্ত ধূলো সমস্ত কঙ্কাল ও সমস্ত নক্ষত্রকে ছেড়ে দিয়ে এক নতুন” স্থাপত্যে নির্মীত। বাংলা কবিতায়, জীবনানন্দের পরে, এতাবৎ আর যে একজন কবির সিঁড়িটিও আদ্যন্ত সেই নতুন স্থাপত্যে নির্মীত” তিনি আলোক সরকার।
২।
সেই কবেকার ‘উতল নির্জন’। সেই কবেকার ‘উতল নির্জন’ এ তাঁর ঘোষনাঃ ‘তা আমি নেবো বা কেন আমার যা নয়?’ প্রথমতঃ ‘উতল নির্জন’ শব্দবন্ধটিই এক অনাগত সাম্রাজ্যের সিংহ দুয়ার। দ্বিতীয়তঃ ঐ ঘোষনা ‘তা আমি নেবো বা কেন আমার যা নয়?’ তাই তাঁর যে ‘রাজকুমার’ সে রবীন্দ্রনাথের রাজকুমারের মতো স্বপ্নে দেখা রাজবালাকে মালা পরানোর প্রতিজ্ঞায় যাযাবর নয়, জীবনানন্দের রাজকুমারের মতো সে উত্তর সাগর পারে কোনো কঙ্কাবতী, শঙ্খমালাকে দেখেনি। সে’যে কেন রাজকুমার তা’ও জানা যায়না। শুধু জানা যায় সে ‘রাজকুমার’ কেননা আলোক তাঁকে এইমাত্র ঘোষনা করলেন ‘রাজকুমার’ বলেঃ
‘অন্য এক পরিচয় আছে।
জানবে না কোনোদিন বিকেলের মায়াবী আলোয়
রাজারকুমার হয়ে আমি পথ হাঁটি। কত কাছে
পেয়েছি চিন্ময় সুর, মনে-মনে জড়ানো ভালোয়
গিয়েছি আলোর দেশে – সোনার গাছের হীরা-ফুল
এমন সহজ আসে নিভৃত চাওয়ায়।‘ – সহজ, (সূর্যাবর্ত)
এই রাজকুমার লালকমল-নীলকমল নয়। তাকে যুদ্ধ করতে হয়নি, রাক্ষস মারতে হয়নি শুধু চিন্ময় সুরের সাম্পানে সে পেয়েছে ‘সোনার গাছের হীরা-ফুল’ – যা পায় অন্য রাজকুমারেরা যুদ্ধশেষে। অর্থাৎ তার এই চিন্ময় বিশ্ব তারি ঘোষিত নির্মাণ এবং যে জাদুকর নিজের প্রাসাদ শুধু নয়, নিজের সাম্রাজ্যও নিজে নির্মাণ করে তার আর যা’ই থাক সেই সঙ্গে থাকতেই হবে এক দৈব একাকীত্ব। ঐ একাকীত্বই সেই রাজকুমারের ‘ফিরে যাওয়ার’ পথ ঢেকে তাকে দিয়ে বলায়ঃ ‘প্রতিধ্বনি চাই আমার প্রতিধ্বনি চাই’ ... এই যে রাজকুমার সে যেন বোদ্লেয়ারের সেই মরনোন্মুখ রাজকুমারের আলোকিত সহোদর কেননা বিশ্ব সাহিত্যে বোদ্লেয়ারো আরেক জাদুকর যাঁর গমনপথের প্রতিটি নুড়িই তাঁর নিজের হাতে রচে তোলা।
আলোক সরকারের কবিতাযাত্রা মূলতঃ ঐ চিন্ময় বিশ্বের রাজকুমারটিরি যাত্রা। যে রাজকুমারটি ঘোষনা করেঃ
‘বিপক্ষে ঈশ্বর তবু কিছুতেই হার মানবো না’ ( রাজপুত্র, অন্ধকার উৎসব)
আর শুধু ঐ ঘোঢনার নিরিখেই নির্দিষ্ট হয় তার রাজ্যপাট। অদ্যাবধি। তাই আলোকের রচিত বিশ্বের প্রতিটি নুড়িও তাঁর নিজ হাতে নির্মীত। স্থাপিত। সেই বিশ্বে রূপকথিকা ছায়া ফেলে নানাভাবে। কখনো কবিতার অন্দরে নিম্নরূপ আবহ নির্মাণেঃ
‘মাঠের মধ্যে মস্ত বড়ো দরজা, রাজপ্রাসাদ।
কালো বেণী?
নাকি সুদূর শীতল স্থির সাপ।
ঈশান কোণে মেঘ, কিন্তু ঝড় এখনো আসেনি।
প্রহরীটা ম’রে গিয়ে কী-যে সর্বনাশ!’ (‘ সোনার ঘন্টা’, আলোকিতসমন্বয়)
কখনো কবিতার নামে ‘অরুন বরুন কিরণ’এর উল্লেখ। অতঃপর গাছের সঙ্গে কথাবলা, পাখির সঙ্গে কথাবলা। এ সমস্তই রূপকথিকার রাজপুত্রের দ্বারা সম্ভব। ঐ ইঙ্গিতগুলি মনে পড়ায় দক্ষিনা রঞ্জন মিত্র মজুমদারকে। হ্যাঁ, বাংলা গদ্যে দক্ষিনারঞ্জনও সেই ‘সৌন্দর্য তান্ত্রিক’ যাঁর নিজ পৃথিবীর দিকে যাত্রাপথ থেকে শীর্ণতম ঘাসফুলটিও তাঁর স্বহস্তনির্মীত। দক্ষিণারঞ্জনের রূপকথিকার একমাত্র না হলেও একটি বিশেষ মাহাত্ম্য এই, যে, তাঁর রূপকথিকার কথন নির্ণয় করেছে তাঁর ভাষাযাত্রার পথ। -এইখানেও আলোক তাঁর সহগামী। দক্ষিণারঞ্জনের কাহিনীর ‘রূপকথাত্ব’ অনুভব করতে গেলে পাঠকের যেমন সম্পূর্ণ আখ্যানটি পাঠ না করলেও চলে, যে কোনো একটি বাক্যের শব্দ ব্যবহার থেকেই চিনে নেওয়া কাহিনীর ‘রূপকথাত্ব’কে, ঠিক তেমনি আলোকের কবিতা সম্পূর্ণ পাঠ করবার আগেই দীক্ষিত পাঠক টের পান, যে, “আমরা এক নতুন প্রদেশে প্রবেশ করেছি। পৃথিবীর সমস্ত জল ছেড়ে দিয়ে যদি এক নতুন জলের কল্পনা করা যায় কিংবা পৃথিবীর সমস্ত দীপ ছেড়ে দিয়ে এক নতুন প্রদীপের কল্পনা করা যায় – তাহলে পৃথিবীর এই দিন, রাত্রি, মানুষ ও তার আকাঙ্ক্ষা এবং সৃষ্টির সমস্ত ধূলো সমস্ত কঙ্কাল ও সমস্ত নক্ষত্রকে ছেড়ে দিয়ে এক নতুন” সাম্রাজ্যে প্রবেশ করছেন তিনি।
৩।
‘রূপকাহিনী’ নামক তাঁর কবিতাটিতে আলোক বলেনঃ
‘রূপকাহিনীর গল্প মা তুমি কখনো শেষ ক’রো না।
ব’লো না সময় হলো ঘুমিয়ে পড়বার।
আমি আরো দূরে যাবো তেপান্তর পার হয়ে গহিন জ্যোৎস্নায়
সাদা শাড়ি-পরা মেয়ে যেখানে লুটিয়ে আছে মরুময় প্রান্তরের বুকে
দুঃখ-বেদনায়। আমি একটুও ভয় করবো না।
দু পাশের বাঁশবনে যত বৃষ্টি হোক যত দস্যু লাল চোখ
পুরোনো গল্পকে যেন বিকেলবেলার সেই নদীর মতন মনেহয়,
যেন এক রহস্যের রাত্রির আকাশ কিংবা অন্ধকার মাঠের আলোক
যেন তাকে কোনোদিনই জানবো না। শুধু সাত সমুদ্রের বিশাল বিস্ময়।
ময়ূরপঙ্খির নায়ে আমি সেই তরঙ্গের একাকী নাবিক
চিরদিন আরও দূরে চলে যাবো। আমি ঘুমিয়ে পড়বো না।‘
অর্থাৎ মা’র বলা গল্পের গহনে তাঁর যাত্রা। তাই ঐ যাত্রা ‘চিন্ময়’, তাই ঐ যাত্রা শুধু ‘বিস্ময়’। তাই তাঁর ‘রাজপুত্র’ ঘোষনামাত্র ‘রাজপুত্র’। তার পিতা রাজা ছিলেন কি’না, সে যুদ্ধ করে রাজ্য জিতে নিয়েছে কি’না – জানার কোনো প্রয়োজন নেই। - ঐ ‘রাজপুত্র’ ঈশ্বরের মুখোমুখি শব্দে শব্দে নির্মাণ করে নিচ্ছে তার সাম্রাজ্য আর ঐ নির্মাণের বিস্ময়ে বিভোর হয়ে ভেসে চলেছে কোনো এক মোহানার দিকে। যে মোহানা “পৃথিবীর সমস্ত জল ছেড়ে দিয়ে যদি এক নতুন জলের কল্পনা করা যায় কিংবা পৃথিবীর সমস্ত দীপ ছেড়ে দিয়ে এক নতুন প্রদীপের কল্পনা করা যায় – তাহলে পৃথিবীর এই দিন, রাত্রি, মানুষ ও তার আকাঙ্ক্ষা এবং সৃষ্টির সমস্ত ধূলো সমস্ত কঙ্কাল ও সমস্ত নক্ষত্রকে ছেড়ে দিয়ে এক নতুন” মহাপৃথিবীর মহাসমুদ্র ...
১৫-জানুয়ারী-২০১৪
বেঙ্গালোর