তোমার সৃষ্টির পথ
একটি জীবন ফুরিয়ে এলো না’কি আরম্ভ হলো আরেক জীবন? –এই প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে পথ হেঁটে চলেছেন সেই নচিকেতা থেকে অদ্যকার প্রতিটি প্রকৃত মানুষ। বিগ্ ব্যাং থেকে রিলেটিভিটি হয়ে হিগ্স্ বসন্ সে’ও সেই অন্বেষারি আরেক পথ। কিন্তু এইসব ভাবনার সূত্রে জড়িয়ে পরার অনেক অনেক আগে এও রাত্রে বসেছিলাম সামনের বারান্দায়। সিঁড়িতে। ভরা গ্রীষ্মের লোডশেডিং রাত। সন্ধ্যা মিলিয়েছে অনেকক্ষন। আকাশে মেঘ নেই। ধু ধু তারা। খেয়াল করিনি বাবাও কখন এসে বসেছে বারান্দায়। মোড়াতে। যখন খেয়াল করলাম তখন বাবার স্বর অন্ধকারে ছড়িয়ে দিচ্ছে এই শব্দগুলি, বাক্যগুলিঃ
রূপনারানের কূলে
জেগে উঠিলাম ,
জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয় ।
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
আপনার রূপ ,
চিনিলাম আপনারে
আঘাতে আঘাতে
বেদনায় বেদনায় ;
সত্য যে কঠিন ,
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম ,
সে কখনো করে না বঞ্চনা ।
আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন ,
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে ,
মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে ।
পাঠশালার গন্ডি পার হয়ে হাই ইস্কুলের দ্বিতীয় বা বড়জোর তৃতীয় বছে ছিল সেটা। কাজেই এই শব্দ, বাক্য গুলির ইঙ্গিত অনুভবের বয়স সেটা ছিলনা। তবু একটি নদীর তীরে, অন্ধকারে হঠাৎ জেগে উঠবার যে ছবি তা আমাকে নিলো জাদু করে। যেন ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ই বলে দিলো এই কবিতা রবীন্দ্রনাথের। সঞ্চয়িতার পেছনের ‘প্রথম ছত্রের সূচী’ খুঁজে বার করলাম কবিতাটি। সে’ই প্রথম জানলাম রবীন্দ্রনাথের ‘শেষ লেখা’ গ্রন্থের নাম, জানলাম আরো একটি কবিতা, বাবা যেটা প্রায়ই বলে, এ’ও সেই ‘শেষ লেখা’ গ্রন্থেরঃ
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে ,
হে ছলনাময়ী ।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে ।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত ;
জীবনের প্রায় মধ্য পর্যায়ে এসে পেছন ফিরে তাকালে ভেসে ওঠে যতো ছবি, যতো স্মৃতি তাদের ভিড় থেকে শুধু একটি বা দুটি ছবিকে আলাদা করে ‘প্রিয় স্মৃতি’ বলে চিহ্নিত করা যেমন অসম্ভব তেমনি আমার মতো যাদের বেড়ে ওঠা, বেঁচে থাকা নিজের মতো করে রবীন্দ্রনাথকে জড়িয়ে জড়িয়ে তাদের পক্ষে, জীবনের প্রায় মধ্য পর্যায়ে এসে কিংবা জীবনের শেষ দিনেও, রবীন্দ্রনাথের ‘একটি’ বা ‘কয়েকটি’ লেখাকে ‘প্রিয়’ বলে চিহ্নিত করা তেমনি কঠিন। আজ যখন ‘হাজার শব্দের মধ্যে ১ এপ্রিলের মধ্যে ' আমার পড়া রবীন্দ্রানাথের সেরা বই' লেখা চাই।‘ – বন্ধুর এই আদেশ মান্য করতে গিয়ে বসলাম লেখার টেবিলে তখন মনের গহনে জেগে উঠলো ঐ নিদাঘ-সন্ধ্যা, বাবার কন্ঠ, ঐ কথা আর শব্দ গুলি ...
১৯৪১ সাল। রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ বছর। সেই শেষ বছরের ক’টি মাসে লেখা কবিতার সঙ্গে ১৯৩৯ সালের একটি কবিতা। সব মিলিয়ে ঠিক পনেরোটি কবিতায় পূর্ণ এই গ্রন্থ ‘শেষ লেখা’ – যার অনেক কবিতাই অসুস্থ কবিকে বলতে হয়েছে মুখে মুখে, অন্যেরা টুকে নিয়েছে। পরে অনেকগুলির সংশোধন, পরিমার্জন রবীন্দ্রনাথ নিজ হাতে করলেও ‘তোমার সৃষ্টির পথ...’ কবিতার সংশোধন, পরিমার্জন করতে পারার আগেই ফুরিয়ে এলো একটি জীবন ... একটি জীবন ফুরিয়ে এলো না’কি আরম্ভ হলো আরেক জীবন? –এই প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে পথ হেঁটে চলেছেন সেই নচিকেতা থেকে অদ্যকার প্রতিটি প্রকৃত মানুষ। বিগ্ ব্যাং থেকে রিলেটিভিটি হয়ে হিগ্স্ বসন্ সে’ও সেই অন্বেষারি আরেক পথ। সেই অন্বেষাই রবীন্দ্ররচনা-মানচিত্রের একটি পরিধিরেখার ইঙ্গিত। প্রথম কবিতা গ্রন্থ ‘সন্ধ্যা সঙ্গীত’এ’র প্রথম কবিতাতে আমরা পাই যে অচেনার উল্লেখ, এইভাবেঃ
অয়ি সন্ধ্যা , তোরি যেন স্বদেশের প্রতিবেশী
তোরি যেন আপনার ভাই
প্রাণের প্রবাসে মোর দিশা হারাইয়া
বেড়ায় সদাই ।
‘প্রাণের প্রবাসে’র সেই ‘দিশাহারা’ কে অনেক খুঁজে, অনেক রূপে দেখে, না দেখে, আভা দেখে অনুমান ক’রে জীবনের অন্তিমে এসেও তারি কথা তাঁর শেষ লেখাগুলিতেঃ
প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে —
কে তুমি ,
মেলে নি উত্তর ।
বৎসর বৎসর চলে গেল ,
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিমসাগরতীরে ,
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় —
কে তুমি ,
পেল না উত্তর ।
এখানে এসে রবীন্দ্রনাথ আরো নিরাভরন, আরো নিরাবরণ। নিরাভরন-নিরাবরণ’এর পথে যে নতুন যাত্রার আরম্ভের ইশারা নিহিত ছিল ‘প্রান্তিক’ (১৯৩৭) এ, তা’ই, ক্রমে, ‘রোগশয্যায়’, ‘আরোগ্য’ হয়ে সম্পূর্ণ নিরাবরণ হয়ে উঠতে চাইলো ‘শেষ লেখা’য়। ‘এ মোহ আবরণ খুলে দাও হে’র যে আর্তি তাই তাঁর জীবন ও রচনার যাত্রা পথে অর্জন করে নিতে নিতে এ যেন এক বাঁক। এই বাঁকের পরে যা তা’কি? এই প্রশ্নেরো সরল, নিরাবরণ উত্তর এবার শোনালেন কবি, জানালেনঃ উত্তর নেই। তবু প্রশ্ন আছে। থাকবে। ‘কে তুমি?’ ... তিনি কি নিরাকার ব্রহ্ম না’কি ব্ল্যাক্ হোল্? জানানেই। তবু সেদিকে যাওয়াই জীবনঃ
হয় যেন মর্ত্যের বন্ধন ক্ষয় ,
বিরাট বিশ্ব বাহু মেলি লয় ,
পায় অন্তরে নির্ভয় পরিচয়
মহা-অজানার ।
এই গানটি কবি লিখেছিলেন ১৯৩৯ সালে। ‘ডাকঘর’ নাটকে ব্যবহারের জন্য লিখিত হলেও এই গান অবশেষে স্থান পেলো ‘শেষ লেখা’র প্রথম কবিতা হিসেবে। ( মনেহয় প্রকৃত প্রস্তাবে ‘শেষ লেখা’ তাঁর ‘আরোগ্য’ পর্যায়েরি লেখা যা তিনি লিখেছিলেন ‘আরোগ্য’ গ্রন্থ প্রকাশের পরে।) এই কবিতায় আছে তাঁর নিজের যাত্রার কথা সম্মুখের ‘শান্তি পারাবার’এর দিকে, এই গ্রন্থেরি অন্য কবিতায় আছে অজানা মহামানবের আগমনের বার্তা, যে আগমনের আবহ এই রকমঃ
উদয়শিখরে জাগে মাভৈঃ মাভৈঃ রব
নব জীবনের আশ্বাসে ।
জয় জয় জয় রে মানব-অভ্যুদয় ,
মন্দ্রি উঠিল মহাকাশে ।
মনেহয় যেন রবীন্দ্রজীবনের সমস্ত আবিষ্কৃত সত্য এখানে উঠেছে সারাংশ হয়ে। ব্রহ্ম আছে কি নেই থেকে বড় কথা হয়ে উঠছে এই বাঁক পার হয়ে যা’ই আছে তাকে নির্ভিক ভাবে মেনে নেওয়ার প্রস্তুতি। মনেপড়ে ‘সমুখে শান্তি পারাবার’ গানটি প্রথম রেডিওতে শুনেছিলাম আকাশবানী শিলিগুড়ি থেকে প্রচারিত রবীন্দ্রসংগীতের অনুরোধের আসরে। শিল্পী ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস। পরে কণক দাশ ( বিশ্বাস ) এর কন্ঠে গানটি শুনে আরো অভিভূত হয়েছিলাম। সে সবই দশ থেকে বারো কেলাসের কথা। ঐ মুগ্ধতার মর্মে নাচিকেত প্রশ্ন না থাকলেও ঐ মুগ্ধতার আড়ালে আড়ালে যেন অবয়ব নিচ্ছিল প্রশ্নগুলি...
সমুখে শান্তিপারাবার ,
ভাসাও তরণী হে কর্ণধার ।
তুমি হবে চিরসাথি ,
লও লও হে ক্রোড় পাতি ,
অসীমের পথে জ্বলিবে জ্যোতি
ধ্রুবতারকার।
এক পারাপারহীন সমুদ্রের ছবি সে’ই যে আঁকা হয়ে গিয়েছিল মর্মে তারি মূল্যে, তারি আশীর্বাদে অদ্যাপি জীবনের ছোটো ছোটো নদী নালা পার হওয়ার সাহস পাই। পেয়েছি। নিজের মর্মে ‘অসীম’ এর প্রথম সংজ্ঞা হয়ে এসেছে এক পারাপারহীন অন্ধকার সমুদ্র আর তার শিয়রে জ্বলে থাকা একটি তারা। ধ্রুবতারা ...
এখন অনেক রাত। খোলা জানালা দিয়ে আসা জ্যোৎস্নায় দেখতে পাচ্ছি ঘুমন্ত মুখ। খোকার, খুকির। হায়, এই খোকা সে’ও মাত্র ক’দিন আগেই ছিল ঐ খুকির মতোই অবুঝ। বায়না ধরতো দোকান থেকে পক্ষীরাজ ঘোড়া কিনে দেওয়ার। আজ সে ‘হাই ইস্কুল’এ যায়। সে জানে পক্ষীরাজ ঘোড়া টোরা সব ফাঁকি! হায়, একদিন খুকিও জানবে। বড় হয়ে যাবে খুকিও। তারপর একে একে তারা ... আর ভাবতে পারিনা। টের পাই ব্রহ্ম আছে কি’না, ঈশ্বর আছে কি’না এই সমস্ত হয়ে ওঠে অর্থহীন। টের পাই মায়া। টেরপাই ঐ এক জালে আমরা সকলে বাঁধা। ঐ জালই ভয়, মৃত্যু, ব্যথা। আমি যেন শুনতে পাই অন্ধকার থেকে ভেসে আসছে বাবার কন্ঠ। বাবা আবৃত্তি করে চলেছেঃ
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে ,
হে ছলনাময়ী ।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে ...
২৬/০৩/২০১৩
বেঙ্গালোর