“রঞ্ঝিস হি সহি”
সপ্তর্ষি বিশ্বাস
“রঞ্ঝিস হি সহি, দিল দুখানে কে লিয়ে আ” – “যাতনাই সই, দুঃখদায়িনী হয়েও আসো”। যদি অভিজ্ঞতার দ্বারা ব্যবহৃত হয় মেধা সেইক্ষেত্রে এই উক্তি এক ব্যথিত মানব অথনা মানবীর তার ইপ্সিতের প্রতি। গজলের আপাতসংজ্ঞাও সমর্থন করে এই ভাবনাকে। কিন্তু অভিজ্ঞতার দ্বারা ব্যবহৃত নাহয়ে মেধা যদি ব্যবহার করে অভিজ্ঞতাকে, তবে, এই ইপ্সিত বা ইপ্সিতাটি, তার মানুষীভাবটি বজায় রেখেও, “রঞ্ঝিস” আর “দুখ” এই শব্দদ্বয়ের মহিমায়, তা অতিক্রমও করে যেতে পারে অনর্গল। - “আ ফির মুঝে ছোড়কে যানে কে লিয়ে আ” – “আসো, পুনরায় ত্যাগ করে চলে যেতে এসো” – গানটির দ্বিতীয় এই পংক্তি আমাকে মনে পড়ায়ঃ “ওহে নিষ্ঠুর, ফিরে এসো,
আমার করুণকোমল এসো,
আমার সজলজলদস্নিগ্ধকান্ত সুন্দর ফিরে এসো,
আমার নিতিসুখ ফিরে এসো,
আমার চিরদুখ ফিরে এসো” ...
এই যে গজলের “রঞ্ঝিস” আর কীর্তনে বাঁধা এই রবীন্দ্রগানের যে “নিষ্ঠুর” তারা মিলেমিশে যেখানে একাকার সেখানেই তারা পার হয়েযায় তাদের মানুষিয়ানাকে । রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন “ওহে জীবনবল্লভ”, “হে মোর দেবতা” হেন শব্দবন্ধ, তখন এই শন্দগুলি – “দেবতা”, “জীবনবল্লভ”, “জীবনদেবতা” – অভিজ্ঞতাদ্বারা ব্যবহৃত মেধার সার্থক সামান্য পরিধি পার হয়ে – দেবদেবীর মূর্তিবিগ্রহ, নিরাকার ব্রহ্মের হরবোল্ সাধনা, যিশু ভজনা, নামাজশুদ্ধতা – সমস্ত পারহয়ে চলেযায় – একাধারে – মহাজগতের, বহুব্রহ্মান্ডের অনন্তে। আবার শরৎ চাটুজ্জের গপ্পের বাতায়নে অপেক্ষারতা বিরহিনী নায়িকার মুখে কিংবা ব্যাক্গ্রাউন্ডে চালিয়ে দিলেও শব্দগুলি নিজে সংকুচিত নাহয়ে বরং কোনো এক নির্দিষ্ট রাজলক্ষীকে ব্যাপ্ত করে তোলে মহানীলে।
“এসো” আর “ফিরে এসো” এই দুই অন্তহীন আর্তি। মানুষের। “মানুষের মৃত্যু হলে” “মানবের”। যখন রামপ্রসাদ বলেনঃ “নয়ন থাকতে দেখলে না মন, কেমন তোমার কপাল পোড়া। মা ভক্তে ছলিতে তনয়ারূপেতে, বেঁধে গেলেন ঘরের বেড়া” – তখনো তাঁর সেই কল্পমায়ের ফিরে আসার নিমিত্ত তাঁর আকুতিও অনুরূপ। ভাবোন্মাদ শ্রীরামকৃষ্ণ বিষয়ে প্রচলিত যে গল্পে তিনি “দেখা দে, মা, দেখা দে” ক্রন্দনে নিজ কন্ঠনালীতে খড়্গস্থাপন করেন সে’ও এই “এসো”র আর্তি। কবি আহমেদ ফারাজ লিখলেন, একই গানে “কুছ্ তো মেরে পিন্দার-এ-মুহব্বৎ কা ভরম রখ্, তু কভি মুঝকো মনানে কে লিয়ে আ”, “যৎসামান্য মূল্য দাও আমার এ প্রেমের, অন্তর একবার এসো আমাকে বোঝাতে”। গায়ক মেহেদী হাসান এই অংশের বিশ্লেষণ করেছেন এইভাবে, যে, যদি আমার প্রতি তোমার প্রীতি আর না’ও থাকে তবু শুধুমাত্র আমার এই প্রেমের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একবার এসো, যদি তা লোকদেখানো আসা হয় তাহলেও”। যদি বলি এই “আসা”র আশাতেই “ভবে আসা” প্রত্যেকের – কোনো “আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে” – সাধকের, প্রেমিকের, পাগলের – তবে খুব বিঘ্ন হয় কি, “বিদ্বজ্জনের”, মেনেনিতে? যদি হয় তাহলেও আমি বলতে বাধ্য যে, আদতে সেই “রঞ্ঝিস্” কে সন্ধান করে বেড়ানোই প্রকৃত মানুষের আমরণের অভিযানঃ “তুমি কাহার সন্ধানে, সকল দুখে আগুন জ্বেলে বেড়াও কেজানে” – সেই “রঞ্ঝিস্”, সেই “দিল দুখানে কে লিয়ে” যে আছে, তার সন্ধান, সেই “নিষ্ঠুর”, সেই “আমার চিরদুখ ফিরে এসো” –
যেহেতু যাকে ডাকা সে “রঞ্ঝিস্”, সে “দিল দুখানে কে লিয়ে”ই আছে, সে“নিষ্ঠুর”, সেই “আমার চিরদুখ” তাই “আসা”টিও নয় খুব সহজ কোনো আসা। হয় সে আসে দুয়ারভাঙ্গা ঝড়ের রাত্রে নয়তো তার আসার উপলক্ষ্যেই ওঠে ঝড়, ভাঙ্গে দুয়ার। তার আসবার ইঙ্গিত জানাযায় তখনই যখন “আকাশ কাঁদে হতাশসম” ... অতএব তার আসা হতে পারেনা “অ্যান্ড দেন্ দে লাইভড্ হ্যাপিলি এভার আফটার” এর জীবনহীন যাপনইঙ্গিত। তাই “ ইক উম্র সে হুঁ লজ্জত্-এ-গিরিয়া সে ভি মহরুম / ইয়ে রাহত্-এ-জাঁ মুঝ কো রুলানে কে নিয়ে আ” –“ এক যুগ ধরে আছি কামনার দুঃখতাপহীন / এসো প্রিয়, মর্মে শুধু দুঃখ দিতে এসো” ... আমার ক্ষুধিত তৃষিত তাপিত চিত, নাথ হে, ফিরে এসো।
ওহে নিষ্ঠুর, ফিরে এসো,
শায়ের রয়েছেন কামনার দুঃখতাপহীন। অর্থাৎ বেঁচে নেই টিঁকেই রয়েছেন শুধু। তিনি চান মর্মে তাঁর ইপ্সিত-ইপ্সিতা এসে “তীব্র দহন জ্বালুক”। কেননা তাঁকেও, কবির মতো উপলব্ধি করতে হয়েছে, যে, “আমার ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে/ আমার এ দীপ না জ্বালালে দেয়না কিছুই আলো”। তাই শারেরের চৈতণ্যও, প্রকৃত প্রস্তাবে, “ক্ষুধিত তৃষিত তাপিত”। ওই তাপেই দগ্ধ হয়ে জীবনানন্দ লিখেনঃ “ফিরে এসো প্রান্তরের পথে;
যেইখানে ট্রেন এসে থামে
আম নিম ঝাউয়ের জগতে
ফিরে এসো” -
কবি বিনয় মজুমদারও তাঁর ইপ্সিতা “চাকা”কে নিয়ে যান তেমনি এক বিরাট চক্রের ব্যাপ্তিতে যে চক্র মহাকালের রথচক্রের মতোই অমোঘ। অমোঘ “রঞ্ঝিস্”- “ফিরে এসো ফিরে এসো চাকা
রথ হয়ে, জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো”।
মীর্জা গালিবের কাল ১৭৯৭ থেকে ১৮৬৯ । “রঞ্ঝিস্ হি সহি”র কবির কাল ১৯৩১ থেকে ২০০৮। স্থানিক দূরত্বও বিপুল।
কাল পরিসরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিনয় মজুমদারেরো দূরত্ব অনেক। যাপন প্রণালীর দূরত্ব আলোকবর্ষের। বাচনভঙ্গীরো। তথাপি বিনয়ের “চাকা”, অন্তিমে সেই নীহারিকাপথের ইঙ্গিতে উড়েযায় যেদিকে ধাবিত রবীন্দ্রগানের-কবিতার “তুমি”। কথাগুলি ভাবি, ভাবতে বাধ্য হই, আকৈশোর শোনা “রঞ্ঝিস্ হি সহি” গানটি সেদিন আবার শুনতে শুনতে। টেরপাই এটির কবিতাসত্তার বিস্তারের ইঙ্গিত। আবারো উপলব্ধ হয় “ফর্ম” শব্দটির সীমাবদ্ধতা। মনে আসে যুগান্তর চক্রবর্তী “অভিজ্ঞতা যেন ব্যবহার না করে আমাকে”। অনুভব হয়, প্রকৃত সমূহ শিল্প, আপনার অজানিতেই “দেবতারে প্রিয়” করে, “প্রিয়েরে দেবতা”। অনুভব হয় সুরা আর সাকি’ প্রকৃত গজলে কেবল আবহমাত্র, বড়জোর এলিয়টকথিত “অবজেক্টেইভ কোরিলেটিভ”।
এই কথা স্মরণ করে ভরসা পাই,যে, গালিব ও তাঁর গজল বিষয়ে লিখতে গিয়ে বিশ্লেষণ করেছিলেন আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁর “গালিবের গজল থেকে” গ্রন্থের ভূমিকার, অন্তর্গত আলোচনায়। ১৯৬০ সালে।