প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Sunday, February 27, 2022

মুক্তধারা

 মুক্তধারা

সপ্তর্ষি বিশ্বাস

কথামুখ

একদা এক বন্ধু তথা নাট্যকর্মীর দ্বারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "মুক্তধারা" নিয়ে লিখতে আদিষ্ট হয়েছিলাম। আদেশের কেন্দ্রে ছিল রবীন্দ্রনাঠকের যুগোপযোগী মঞ্চায়ন।

এতাবৎ কাল রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে কিছুই লেখার ইচ্ছা, অনুরোধ, উপরোধ, আদেশ প্রায় এড়িয়ে গেছি এই হেতু, যে, ঐ মহাসমুদ্রের গহনজাত একটি নুড়ির সৌন্দর্যের কথা বলতে গেলেও গহনে এতো হেউ ঢেউ ওঠে, যে, নুলিয়ার নাও নিয়ে ঐ ঢেউ এর সাগরে পাড়ি দিতে সাহস যায়না।

তবু বন্ধুর আদেশ। তাই চেষ্টা করব ভাবনাকে যথাসম্ভব সংহত রেখে আবর্তন করতে কেবল "মুক্তধারা"কেই। তবু যে সব কথা না বলে নিস্তার নেই সেগুলো প্রাঞ্জল করতে কিছুটা বিস্তার আমার প্রয়োজন।



আমার রবীন্দ্রনাথ

আমার অনুভবে যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমস্ত সৃষ্টির ধ্রুবপদ মাত্র দু'টি পংক্তিঃ

"যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি বিশ্বতানে

মিলাব তাই জীবন গানে..."

বিশ্বতানের যে ধ্রুবপদটিকে  রবি ঠাকুর তাঁর জীবনে, সাহিত্যে মেলাতে চেয়েছেন সে এক অন্তহীন মুক্তির ইঙ্গিত। 'আকাশ ভরা সূর্য তারা, বিশ্ব ভরা প্রাণের' সঙ্গে আপনার প্রাণটিকে মিলিয়ে দেওয়ার সাধনার আনন্দ, বেদনা, হাহাকার। তাঁর দেবতা তাই জীবনদেবতা যাঁকে বাঁধা যায়না কোনো বিশেষ পূজাবিধির, মন্ত্রের, ধর্মের আঙ্গিকে। বাঁধা যায়না কেননা বিশ্ব নিয়মে কোথাও কোনো বাঁধা নেই, বাধা নেই। তাই অন্তরের গতি যেখানেই রুদ্ধ সেখানেই তাঁর আপত্তি। আর অন্তরের গতি রুদ্ধ হলে সমাজ-সভ্যতার গতিও বাধ্য রুদ্ধ হতে।অতএব তাঁকে গেয়ে উঠতেই হয়ঃ  'হারে রে রে রে রে,  আমায়  ছেড়ে দে রে, দে রে–

           যেমন ছাড়া বনের পাখি মনের আনন্দে রে॥

                      ঘনশ্রাবণধারা   যেমন বাঁধনহারা,

           বাদল-বাতাস যেমন ডাকাত আকাশ লুটে ফেরে॥"

আর যেখানেই ঐ বনের পাখিহেন মনের আনন্দে বিচরন অসম্ভব সেখানেই, তাই, ভেঙ্গে যায় ঐ "বিশ্বতান"। লাঞ্ছিত হয় ধ্রুবপদঃ 'পৃথিবী মৃত্যুকেও কোলে করিয়া লয় জীবনকেও কোলে করিয়া রাখে, পৃথিবীর কোলে উভয়েই ভাইবোনের মতো খেলা করে। এই জীবনমৃত্যুর প্রবাহ দেখিলে, তরঙ্গভঙ্গর উপর ছায়া-আলোর খেলা দেখিলে, আমাদের কোনো ভয় থাকে না; কিন্তু বদ্ধ-মৃত্যু রুদ্ধ-ছায়া দেখিলেই আমাদের ভয় হয়। মৃত্যুর গতি যেখানে আছে, জীবনের হাত ধরিয়া মৃত্যু যেখানে একতালে নৃত্য করে, সেখানে মৃত্যুরও জীবন আছে, সেখানে মৃত্যু ভয়ানক নহে। কিন্তু চিহ্নের মধ্য আবদ্ধ গতিহীন মৃত্যুই প্রকৃত মৃত্যু, তাহাই ভয়ানক। এইজন্য সমাধিভূমি ভয়ের আবাসস্থল।

পৃথিবীতে যাহা আসে তাহাই যায়। এই প্রবাহেই জগতের স্বাস্থ্যরক্ষা হয়।' - রুদ্ধগৃহ, বিচিত্র প্রবন্ধ


ব্যক্তি 'আমি' রবীন্দ্রনাথের কাছে ঘুরে ঘুরে আসি, ফিরে ফিরে আসি ঐ 'মুক্তি'র ইঙ্গিতটিরই টানে। আশায়। এ মুক্তি যে ঘরে দোর দিয়ে বসা 'সন্ত'র 'মুক্তি' নয় বা 'জোতদারের গলা কাটুন' এর মুক্তি নয় তা অবশ্যই ব্যাখ্যা কিংবা উদাহরনের অপেক্ষা রাখেনা। এমনকি শ্রীরামকৃষ্ণ, যিনি 'যত মত তত পথ' হেন মুক্ত পথের পথিক রবি ঠাকুরের 'মুক্তি' সে পথে কিছুদূর গিয়েও বেঁকে যায় অন্যপথে। তাই তাঁর যে সৃষ্টি বলে জীবনদেবতার সঙ্গে বিরহ-মিলনের কথা তা'ই অবলীলায় হয়ে ওঠে রক্ত মাংসের মানব-মানবীর বিরহ-মিলন গাথাও।

এই আলোচনা যেহেতু আমার একান্তই ব্যক্তিগত রবীন্দ্র-ধারনার ভিত্তিতে তাই একে অনুসরন করতে গেলে পাঠকজনকে সতত মনে রাখতে হবে আমার এই ধারনাটিকেও।


নাটকের রবীন্দ্রনাথ


'মহারাজ, একী সাজে এলে হৃদয়পুর মাঝে/ চরনতলে কোটি শশী সূর্য মরে লাজে'

' কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না শুকনো ধূলো যত / কে জানিত আসবে তুমি গো / অনাহুতের মতো'

'আজি বিজনঘরে নিশীথরাতে আসবে যদি শূন্য হাতে / আমি তাইতে কি ভয় মানি / জানি, জানি বন্ধু জানি তোমার আছে তো হাতখানি'


এরকম আরো অনেক অনেক উদাহরন, রবীন্দ্রনাথের নানা সময়ের, নানা পর্বের গান থেকে দেওয়া যায় যেখানে গানের গহনে নাটকের উপাদান নিহিত। - 'মহারাজ, একী সাজে এলে হৃদয়পুর মাঝে/ চরনতলে কোটি শশী সূর্য মরে লাজে' - হ্যাঁ যদিও হৃদয়পুরে তথাপি এক আশ্চর্য আগমনের বার্তা। এই আগমনের ঘোষনাই নাটক। ঘোষনার ভঙ্গিই নাটক। তবে এই নাটককের নাটকীয়তার তারটি গ্রীক-শেক্ষপীরিয়-ইব্‌সেনিয় এমন কি আমাদের স্বদেশী সংস্কৃত নাটকের তারেও বাঁধা নয়।

' কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না শুকনো ধূলো যত / কে জানিত আসবে তুমি গো / অনাহুতের মতো' - জানিনা কে এসেছে। কোথায় এসেছে। জানিনা এ 'আসা' হৃদয়পুরে আসা নাকি সশরীরে আসা। শুধু জানি এই আসা, এই ভাবে  এতোই অপ্রত্যাশিত যে মনে হচ্ছে আগে জানা থাকলে চোখের জলে ভিজিয়ে রাখা যেতো আসবার এই পথটি ...

এ'কি নাটক নয়? কিংবা 'আজি বিজনঘরে নিশীথরাতে আসবে যদি শূন্য হাতে / আমি তাইতে কি ভয় মানি / জানি, জানি বন্ধু জানি তোমার আছে তো হাতখানি' - রাতের আবহে কে এসেছে? কি নিয়ে আসার কথা ছিল তার? আদৌ কি কথা ছিল আসার? কেজানে। জানিনা খালি হাতে এসেছে বলে অতিথি নিজে দুঃখিত কি'না কিন্তু এ'ই জানিযে সে শূন্য হাতে এসেছে বলে যার কাছে এসেছে সে দুঃখিত নয়। সে জানে ঐ হাতদুটিই তার যথেষ্ট সম্বল হতে পারে...

এ'ই যে নাটকীয়তা তার সূত্র নিহিত কবিতায়। যদিও এর চেয়ে অনেক বেশী নাটক, শেক্ষপীয়ারিয় অর্থে তাঁর 'গান্ধারীর আবেদন', 'কর্ণকুন্তী সংবাদ' বা 'বিদায় অভিশাপ' তথাপি 'শাপমোচন', 'চিত্রাঙ্গদা' বা 'শ্যামা'তেও রবীন্দ্রনাথের 'নাটকীয়তা' অতো প্রকট নয়। যে অন্তর্লীন নাটকীয়তায় গতিশীল রবি ঠাকুরের গান, সেই অন্তর্লীন নাটকীয়তাই রবি ঠাকুরের 'নাটক' বলে চিহ্নিত প্রতিটি রচনার প্রাণশক্তি। তাই স্তানিসলাভস্কি থেকে ব্রেখট, পিটার ব্রুক্‌বা হ্যারল্ড পিন্টো - কোনোখানেই রবীন্দ্রনাটকের সংজ্ঞা পাওয়া যায়না।

রবীন্দ্রগান যেমন বাহিরের নয়,  মর্মের গহন-কথা'ই তার উপজীব্য, রবীন্দ্রনাটকও সেইভাবেই বলে একটি মানুষের মর্মের অসংখ্য মুখের কথা, ভাবনার কথা,  আপনাকে ছাড়িয়ে গিয়ে 'বিশ্বতানের ধ্রুবপদ'টিকে স্পর্শ করবার পথে তাদের জয় পরাজয়ের কথা। যে অর্থে দস্তয়েভস্কির মিশ্‌কিন, রোগোজিন,রাস্কলনিকভদের অস্তিত্ব বাইরের থেকেও বেশী লেখকের মর্মের গহনে তেমনি রবীন্দ্র নাটকের আবহ, চরিত্র, আলাপচারিতার ভাষা ও ভঙ্গীও একান্তই রবীন্দ্রনাথের মর্মের জিনিস। কাজেই, আমার মতে, রবীন্দ্রনাটকের আত্মিয়তা মূলতঃ তাঁর গানের সঙ্গেই বেশী। ফলতঃ তাঁর নাটকের চরিত্রগুলি যতোনা চরিত্র তার চেয়ে ঢের বেশী 'আইডিয়া'। ঐ 'আইডিয়া' গুলির একের অপরের সঙ্গে ঘটে সংঘাত। প্রতিটি 'আইডিয়া'র নিজস্ব অস্তত্বের মর্মে দ্বিধার জন্ম দেয় ঐ সংঘাত। তবে না'ত ঐ সংঘাত 'ইদিপাস'এর সংঘাতের সমমর্মী, না'ত ঐ দ্বন্দ্ব 'হ্যামলেট'এর মর্মের দ্বন্দ্বের সমান্তরাল। তাই রবীন্দ্রনাটকে 'রাজা' নিজেও যোগ দেয় সেই মিছিলে যে মিছিল চলেছে তারই ধ্বজা ভেঙ্গে ফেলতে, চলেছে তারই বানানো বাঁধ ভেঙ্গে দিতে। অর্থাৎ আপনাকে ছাড়িয়ে গিয়ে 'বিশ্বতানের ধ্রুবপদ'টিকে স্পর্শ করবার পথে যারা পথিক তাদের ডাকে  সাড়া দিয়েই অবশেষে, যে আপাত 'ভিলেন'সে'ও হয়ে ওঠে 'হিরো'। শুধু অমলের পিসেমশাই বা কবিরাজের মতো হতভাগ্যেরা না'ত পারে ভিলেন হতে, না'ত হিরো। তাদের প্রতি করুণা আর  'বিশ্বতানের ধ্রুবপদ'টিকে স্পর্শ করবার পথে আমন্ত্রণ জানিয়েই মঞ্চে পর্দা নেমে আসে। রবীন্দ্রনাটক 'শেষ' হয়না। 

সুতরাং 'রক্তকরবী' নাটকের আবহে শম্ভু মিত্র যখন আমদানী করে বসেন কয়লা খনির 'টিপিক্যাল' বাস্তবতা - বিশেষতঃ ধ্বনির প্রয়োগে তখন 'রক্তকরবী'র অন্তর্গত বিস্তারটিকেই মরে যেতে হয়। কেননা কয়লা খনির 'টিপিক্যাল' বাস্তবতা যাকে প্রথমেই টুঁটি টিপে মারে তা হলো রবীন্দ্রনাটকের সঙ্গে রবীন্দ্রগানের আত্মিয়তাকে। এবং অন্তিমে তা চলেযায় রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব শিল্প ধারনার একেবারে বিপরীতে কেননা রবীন্দ্রনাথের শিল্প ধারনার মূল ধারনাটি এক কথায়ঃ 'সাহিত্যে আমরা জগতের সত্য চাই, কিন্তু জগতের ভার চাহি না'। (রাজসিংহ, আধুনিক সাহিত্য) আর শম্ভু মিত্র বা তৎসমরা কারবার করেন ঐ 'ভার'টুকুকে নিয়েই।


রবীন্দ্রনাথের "মুক্তধারা"

১।

আবার ফিরে যাই সেই প্রাক্‌কথনে। 

আবার বলি, আমার অনুভবে যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমস্ত সৃষ্টির ধ্রুবপদ মাত্র দু'টি পংক্তিঃ

"যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি বিশ্বতানে

মিলাব তাই জীবন গানে..."

বিশ্বতানের যে ধ্রুবপদটিকে  রবি ঠাকুর তাঁর জীবনে, সাহিত্যে মেলাতে চেয়েছেন সে এক অন্তহীন মুক্তির ইঙ্গিত। 'আকাশ ভরা সূর্য তারা, বিশ্ব ভরা প্রাণের' সঙ্গে আপনার প্রাণটিকে মিলিয়ে দেওয়ার সাধনার আনন্দ, বেদনা, হাহাকার। তাঁর দেবতা তাই জীবনদেবতা যাঁকে বাঁধা যায়না কোনো বিশেষ পূজাবিধির, মন্ত্রের, ধর্মের আঙ্গিকে। বাঁধা যায়না কেননা বিশ্ব নিয়মে কোথাও কোনো বাঁধা নেই, বাধা নেই। তাই অন্তরের গতি যেখানেই রুদ্ধ সেখানেই তাঁর আপত্তি। আর অন্তরের গতি রুদ্ধ হলে সমাজ-সভ্যতার গতিও বাধ্য রুদ্ধ হতে।অতএব সেই রুদ্ধদ্বারটি খুলে দেওয়ার কাহিনীই মূলতঃ রবীন্দ্র নাটকের অন্তর্বস্তু।

'বাল্মিকী প্রতিভা' আর 'বিসর্জন' এর কাহিনীও তাই তথাপি ঐ দুইটি নাটকে প্লটের যে ভূমিকা তা পরবর্তী রবীন্দ্রনাটকে ক্ষীয়মান। ক্রমে তাঁর 'আইডিয়া' গুলিই 'প্লট'এর স্থান নিয়ে সক্ষম হয়ে উঠেছে অদ্ভুত সাবলীলতায়। সফলতায়। 'ফাল্গুনী' তে প্লট থেকে রবীন্দ্রনাটক একেবারে মুক্ত। 

কিন্তু প্লটহীনতার দিকে রবীন্দ্রনাটকের এই যাত্রা, আমার ধারনা, মূলতঃ 'কন্টেন্ট্‌' এর দাবীতেই কেননা রবীন্দ্রনাটক মূলতঃ, তাঁর গানের মতোই, সতত বলেগেছে অন্তরের বদ্ধতা আর মুক্তির দ্বন্দ্বের কথা। 

রবীন্দ্রনাথের নাটকে যে "রাজা" সে কেবল বিত্তের রাজা নয়, সামন্তবাদের "রাজা" নয়। সে এক প্রবল শক্তির প্রতিমা ( প্রতীক নয় কদাপি) যার মর্মে আছে আপনার ও অপরের মুক্তির সংবাদ কিন্তু যে সংবাদটি তার চোখে পড়েনা বলেই সে বন্দী থাকে আপন বলের কাছে। 'রাজা' নাটকের 'রাজা'ও তা'ই। 'রক্তকরবী'র 'রাজা'ও তা'ই।'ডাকঘর' এর 'রাজা' এই রাজাদেরো রাজা। তিনি মুক্তির দূত।

'মুক্তধারা'র 'রাজা'র সঙ্গে 'রক্তকরবী'র রাজার সাদৃশ্য প্রবল। দুই 'রাজা'ই আপাতভাবে বন্দীত্বের, যন্ত্রের, শক্তির পূজারী কিন্তু অন্তরের কোথাও উভয়েই জানে এই বানানো বন্দীত্বের অসারতার কথা। টের পায় নিজ অক্ষমতাকে। তা'ই তাদের মর্মের কোথাও রঞ্জনের প্রতি, বিশু পাগলের প্রতি, যুবরাজের প্রতি, ধনঞ্জয় বৈরাগীর প্রতি এক ধরনের ভীতি মিশ্রিত শ্রদ্ধা যা থেকেই অবশেষে একজন একজন যায় আপনারি বাহিরের বলের ধ্বজাটি অন্তরের বল দিয়ে ভেঙ্গে ফেলতে, আরেকজন মর্মে আনন্দিত হয় আপনার পরাজয়ে।

'মুক্তধারা'য় এই বার্তাটি প্রথম টের পাওয়া যায় এই কথোপকথনেঃ

দূত। যুবরাজ বলছেন কীর্তি গড়ে তোলবার গৌরব তো লাভ হয়েছেই, এখন কীর্তি নিজে ভাঙবার যে আরো বড়ো গৌরব তাই লাভ করো। 

বিভূতি। কীর্তি যখন গড়া শেষ হয় নি তখন সে আমার ছিল; এখন সে উত্তরকূটের সকলের। ভাঙবার অধিকার আর আমার নেই। 

দূত। যুবরাজ বলছেন ভাঙবার অধিকার তিনিই গ্রহণ করবেন। 

বিভূতি। স্বয়ং উত্তরকূটের যুবরাজ এমন কথা বলেন? তিনি কি আমাদেরই নন? তিনি কি শিবতরাইয়ের? 

দূত। তিনি বলেন— উত্তরকূটে কেবল যন্ত্রের রাজত্ব নয়, সেখানে দেবতাও আছেন, এই কথা প্রমাণ করা চাই। 


যে দেবতার কথা এখানে বলছে দূত,আসলে যা যুবরাজেরি কথা,সেই দেবতাও প্রতিমা ঐ বিশ্বতানের ধ্রুবপদটির। 'মুক্তধারা'র অন্তিমে সেই বার্তাটিই অবয়ব নেয় এইভাবেঃ

সঞ্জয়। যুবরাজ মুক্তধারার বাঁধ ভেঙেছেন।

রণজিৎ। বুঝেছি, সেই মুক্তিতে তিনি মুক্তি পেয়েছেন। 


অর্থাৎ বিশ্বতানের ছন্দনিয়মে যা গতিশীল তাকে বদ্ধ করার চেষ্টাতেই অসুন্দরের,বিষের সৃস্টি। তাই এই নাটকের সারকথাটি,রবীন্দ্রভাবনারো সারকথাটি উচ্চারিত হয় এইভাবেঃ 

অভিজিৎ। যা-কিছু আমার জীবনকে মধুময় করেছে সে সমস্তকেই আজ আমি নমস্কার করি।

আর আমার মনে আসতে থাকে 'যা পেয়েছি প্রথম দিনে সেই যেন পাই শেষে,দু হাত দিয়ে বিশ্বেরে ছুঁই শিশুর মতো হেসে/যাবার বেলা সহজেরে /যাই যেন মোর প্রণাম সেরে/             সকল পন্থা যেথায় মেলে সেথা দাঁড়াই এসে...'

মনেপড়ে 'কি পাইনি তার হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি ...' ... মনেপড়ে 'এ দ্যুলোক মধুময়/ মধুময় পৃথিবীর ধূলি ...'

যারা এই 'মধুময় ধূলি'কে পারেনা অন্তরে তুলে নিতে তারাই বাঁধ দিতে আসে, আসে পৃথিবীর বুকের থেকে মরা ধন তুলে নিয়ে কারবার করতে, শিশুকে অসুখের অছিলায় দূর করে রাখতে আলো বাতাসের স্পর্শ থেকে। তারাই বর্ণাশ্রমের নিগড় তুলে 'অন্ত্যজ' সংজ্ঞা দিয়ে মানুষকে বঞ্চিত করে রাখে তাদের সহজাত অধিকার থেকে। তারাই অতি উৎপাদনের পসরা বিকাতে দখল করে দেশ। বাধায় যুদ্ধ। - তাদেরকে হটিয়ে দিয়ে নয়, তাদের মর্মে বিশ্বতানের ছন্দটি জাগিয়ে তুলতেই আসে নন্দিনী, বিশু পাগল, রঞ্জন, যুবরাজ, ধনঞ্জয়, ঠাকুর্দা'রা ...। এখানে class struggle এর নিয়ম অচল। কেননা class ও নিয়ম। আর ঐ নিয়মে করা Struggle ও নিয়ম। বানানো নিয়ম। তাই  'বিশ্বতান' এর 'ধ্রবপদ'টি, মার্কস্‌, লেনিন, মাও বা গুয়েভারা'র মতো মহাপ্রাণেরাও কানে শুনলেও মর্মে নিতে পারেননা। ফলতঃ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আর রবীন্দ্রনাথ নানা স্থানে বহুদূর সন্নিকটবর্তী হয়ে পরলেও, 'রাশিয়ার চিঠি' লিখেও , দুটি পথ ভিন্ন। সুতরাং রবীন্দ্রনাথকে তাঁর অন্তিম মুহুর্তে স্বাভাবিক ভাবেই বলতে হয়ঃ

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি

বিচিত্র ছলনাজালে ,

হে ছলনাময়ী ।

মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে

সরল জীবনে ।

এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত ;

তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি ।

তোমার জ্যোতিষ্ক তারে

যে-পথ দেখায়

সে যে তার অন্তরের পথ ,

সে যে চিরস্বচ্ছ ,

সহজ বিশ্বাসে সে যে

করে তারে চিরসমুজ্জল ।

বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু ,

এই নিয়ে তাহার গৌরব ।

লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত ।

সত্যেরে সে পায়

আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে ।

কিছুতে পারে না তা ' রে প্রবঞ্চিতে ,

শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে

আপন ভান্ডারে ।

অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে

সে পায় তোমার হাতে

শান্তির অক্ষয় অধিকার ।


২।

ফিরে আসি 'মুক্তধারা' প্রসঙ্গে।

অন্তিম বিচারে 'মুক্তধারা' ততটা সবল নয় যতোটা 'ডাকঘর', 'রক্তকরবী' আর 'রাজা'। সবল নয় কেননা 'মুক্তধারা'য় তাঁর 'আইডিয়া' গুলির ব্যক্তিকরনকে সহজেই যায় শনাক্ত করা, চিহ্নিত করা যায় তাঁর উদ্দেশ্যকে। 'মুক্তধারা' কে একটি পূর্ণাংগ রচনা না ভেবে এটিকে 'রক্তকরবী'র দিকে তাঁর যাত্রা পথের একটি মেইল ফলক বলেই ভাবতে সুবিধা হয় আমার।

রবীন্দ্রনাটকের মঞ্চায়নের ব্যাপারে যখনি ভাবি তখনি মনে আসে রবীন্দ্রনাথের শিল্প ধারনার মূল ধারনাটি এক কথায়ঃ 'সাহিত্যে আমরা জগতের সত্য চাই, কিন্তু জগতের ভার চাহি না'। (রাজসিংহ, আধুনিক সাহিত্য)- মনেহয় রবীন্দ্রনাটকের মঞ্চও হবে ভারহীন। চরিত্রদের পোশাক পরিচ্ছদও তাই। কেননা এখানে 'রাজা'  মানে রাজা ইদিপাস্‌ নন, এখানে 'পাগল' মানে 'সাইকিক্‌' নয়। এখানে সবই একটাই মানুষের গহনের নানান ভাবনার স্রোত। মনেহয় রবীন্দ্রনাটক মঞ্চস্থ করতে গেলে পরিচালককে মূলতঃ চালিত হতে হবে নাটকটির গান গুলির দ্বারা। মঞ্চ, আলো, আবহ, চরিত্র, অভিনয় যদি সক্ষম হয় দর্শকের মর্মে নাটকের গান গুলে বাজিয়ে তুলতে তবেই সে সার্থক। নতুবা সে শম্ভু মিত্রের 'রক্তকরবী'র মতো আদত 'রক্তকরবী'র 'গ্রোটেস্ক'মাত্র।

২রা জুন ২০১৪

বেঙ্গালোর




ঘুম ঘর