প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Friday, April 22, 2022

আহা, হাঙ্গরেরা! কেন যে মানুষ নয় তারা

আহা, হাঙ্গরেরা! কেন যে মানুষ নয় তারা

সপ্তর্ষি বিশ্বাস

 

একদা জনৈক মিস্টার কেউনের কে প্রশ্ন করে বসলো তার বাড়ির মালকিন  "মহাশয়, হাঙ্গরেরা যদি হইত মনুষ্য, তবে উহারা কি, আপনার কি ধারণা, যে,  ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলী দিগে করিত স্নেহ, প্রীতি?

কেউনে উত্তরে আরম্ভ করল বলতেঃ অবশ্য করিত। নিশ্চিত করিত। আলবাত করিত। হাঙ্গরেরা মনুষ্য হইলে, ক্ষুদ্র মাছ-মছলিদের নিমিত্ত, সমুদ্রগর্ভে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলিশান মকান দিতো নির্মাইয়া। সেই সকল মকানে নিয়মিত সাপ্লাই দিত রোটি আর কপড়ার। এমনকি স্বচ্ছ ভারতও বানাইত, গড়াইত ল্যাট্রিন। কোনো ক্ষুদ্র মাছ-মছলি'র কোনো আন্ডাবাচ্চা আহত হলে তৎক্ষণাত আসিত এম্বুলেন্স, আরম্ভ হইত চিকিচ্ছা কেননা হাঙ্গরেরা চায়না যে ক্ষুদ্র মাছ-মছলিরা হোক অকালে অক্কাপ্রাপ্ত, হোক রুগ্ন, বিষণ্ণ। তাহারা অবশ্যই সুব্যবস্থা করিত নানাবিধ জলোৎসবের যাহাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলিদের মর্মে স্ফুর্তি থাকে। তবে দুষ্টেরা এ'ও বলিত, যে, অকালে মাছেরা মরিলে হাঙ্গরেরা বড় মাছ পাইবে কোথায়? খাইবে কিভাবে? বড়মাছের টেইস্ট তো আর পোনা রুই ইয়ে নাই। দুষ্টেরা আরোও বলিত। বলিত অসুস্থ মছলি, বিষন্ন মছলি ইত্যাদি খাইতে বিস্বাদ। অতএব হাঙ্গরেরা নিজ নিজ পেটের ধান্দায় ...

"মহাশয়া, হাঙ্গরেরা মনুষ্য হইলে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলিদিগের নিমিত্ত ব্যবস্থা করিত মস্ত মস্ত মস্ত্‌ মস্ত্‌ ইশ্‌কুল বাড়ির। বিদ্যার সেই সকল আলয়ে শিখানো হইত, ক্ষুদ্র মছলিদিগের খুদে আন্ডাবাচ্চাগুলিকে, যে, কিভাবে সাঁতরানো যায় হাঙ্গরের খোলা হাঁ'এর মধ্যেও। বিদ্যার সেই সকল আলয়ে শিক্ষা দেওয়া হইত আরোও নানান বিষয়। যেমন, ভূগোল। অতঃপর এই সকল ক্ষুদ্র মাছ-মছলিরা, এলোমেলো সাঁতরাইবার কালে যদি দৃষ্টিসীমার বৃত্তে দেখিত এমন কোনো হাঙ্গর, যে নিষ্কর্মা, শুইয়া ঝিমায় অথবা নাটক-নভেল পড়ে, তখন সেই কুলাঙার হাঙ্গরটির ভৌগোলিক অবস্থান,ভূগোল এবং মানচিত্রের বলে বলীয়ান, ক্ষুদ্র মছলিরা, দিতো হাঙ্গরকূলের শিরোমণি দিগকে। তবে ক্ষুদ্র মাছ-মছলিদিগের শিক্ষায় ও শিক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্রে অবশ্যই থাকিত 'চরিত্রপাঠ', 'মরেল সাইন্স'। এই চরিত্রপাঠে ইহা বুঝাইয়া দেওয়া হইত, ধাপে ধাপে ও নানান উদাহরণ সহ, যে, এই মহার্ণবে যে সহাস্যবদনে ত্যাগ, আত্ম-প্রাণপাখিটিকেও, ত্যাগ করাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলিদের জীবনকে করে পূর্ণতামন্ডিত। ইহাও শিক্ষাদ্বারা, শিক্ষা ব্যবস্থা-দ্বারা, দেওয়া হইত স্পষ্ট করিয়া, যে, এই হাঙ্গরকূলের উপরে বিশ্বাস হারানো পাপ বিশেষতঃ হাঙ্গরকূলের চাঁই সদস্যেরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলিদিগের নিমিত্ত যে 'আচ্ছে দিন' এর কথা বলে তাহাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করাও পাপ। ক্ষুদ্র মছলিদিগের আত্মার সহিত পরমাত্মার মিলন একমাত্র তখনই সম্ভব যখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলিগন শিক্ষা করিবে আনুগত্য হাঙ্গর কূলগুরুদিগের। এতদ্‌ভিন্ন,হাঙ্গরেরা মনুষ্য হইলে,ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলিদিগের নিমিত্ত নির্মীত শিক্ষায় এবং ব্যবস্থায় ইহাও দিতো আন্ডারলাইন করিয়া, যে, ক্ষুদ্র মছলিরা যেন সমস্ত বস্তুবাদী প্রবণতা, আত্মম্ভরিতা এবং সব নষ্টের গোড়া দাড়িওলা মার্ক্স, এঙ্গেলস্‌ ও দাড়িগোঁফহীন মাও তথা ছাগলদাড়ি লেলিন ইত্যাদির প্রচার ও প্রশিক্ষণ হইতে শত ক্রোশ দূরত্ব রক্ষা করে। যদিবা কোনো ক্ষুদ্র মছলির মধ্যে এইরূপ কোনোও প্রবণতা হত দৃষ্ট তবে ওই দুষ্ট মছলিটির নামে চাঁই-হাঙ্গরদিগের নিকটে তৎক্ষণাত নালিশ জানানো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলিদিগের সামাজিক কর্তব্য।

"হাঙ্গরেরা যদি মনুষ্য হয়, তবে, গো মহাশয়া, তাহারাও নিশ্চিত পরস্পরের বাধাইত যুদ্ধ। যুদ্ধের হেতুও, গো মহাশয়া, হইত এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলি, ইহাদের অধিকার এবং সেই সকল যুদ্ধে সৈনিক হইত এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলিরাই। হাঙ্গরেরা ঘোষণা করিত, যে, যদিও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলিরা জাতে নির্বাক তথাপি প্রতিপক্ষ হাঙ্গর দ্বারা অধিকৃত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলিরা নির্বাকের যে ভাষায় বাক্য বিনিময় করে, তাহা, হয়, অতি দুর্বোধ্য অতএব ওই ভিন্ন নীরবের ভাষা বলা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলিদিগে নিধন করাই শ্রেয়। বলিত "হে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলিরা, তোমরা যে'ই সমরে প্রতিপক্ষের দুইটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলি বধ করিবে তাহাকেই দেওয়া হইবে উপাধি, দেওয়া হইবে জলঘাসের মেডেল। তোমরাই হইবে অপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আম মাছ-মছলির আদর্শ। নায়ক'।'

'গো মালকিন মহাশয়া, যদি মনুষ্য হইত হাঙ্গরেরা, তবে অবশ্য তাহাদেরো থাকিত নিজস্ব শিল্প,শিল্পী,শিল্পতত্ত্ব,শিল্পমান ও তাহা জরীপের মাপকাঠি। সেই শিল্পতত্ত্বমতে হাঙ্গরের দন্তপাটির শোভা হইত চিত্রিত, ক্যানভাসে, মুরালে, কাগজে,কালিতে, তুলিতে। অঙ্কন গুলি যাতার্থ্য প্রমাণ করিত হাঙ্গরের দন্তশোভা ও তদন্তে হাঙ্গরের মস্ত ও প্রমোদ উদ্যানহেন পেটের। সিনেমা হল নির্মাইয়া, ট্যাক্সোহীন উদারতায় দেখানো হইত সেইসকল চলচ্চিত্রগুলি যেগুলিতে হাঙ্গরের দশনশোভায় আকৃষ্ট মহান একটি ক্ষুদ্র মছলি সাহসী সন্তরনে গিয়া প্রবেশ করিতেছে ওই হাঁ-মুখে। আহা! ওই দৃশ্যের আবহে বাজিত বেহালা, ফাটিয়া পড়িত অর্কেষ্ট্রা, সেতার, জলতরঙ্গ আর সেই দেশভকত ক্ষুদ্র মছলি স্বপ্নালু, সুবৃহৎ আদর্শ বহিয়া ক্রমে হান্দিয়া যাইত ওই হাঁ-মুখে। প্রেক্ষাগৃহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলিদিগের ল্যাজ-তালিতে হইত মুখর। হাঙ্গরাস্কার দেওয়া হইত ওই চলচ্চিত্রকে।

'তদুপরি থাকিত, অবশ্য, ধর্ম, মহাশয়া, হাঙ্গরেরা মানুষ হইয়া গেলে। ধর্ম ইহা দিত সাফ্‌ জানাইয়া, যে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলির জীবাত্মা একমাত্র হাঙ্গর-পেটস্থ হইলেই সক্ষম পরমাত্মার সহিত মিলনে।

'আর ইহাও নিশ্চয় হইত, মহাশয়া, হাঙ্গরেরা মানুষ হইলে, ঠিক মানুষেরই মতন, তাহারাও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলিদিগে ভুলাইয়া ছাড়িত, যে, আদতে সকল মাছই মাছ। এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে প্রতিজন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলির অধিকারই, হয়, সমান। হাঙ্গরেরা কিছু কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলি বাছিয়া ইহাদিগে দিত বড় বড় পদ,পদবী। অপর কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলিকে ছাপ মারিয়া দেওয়া হইত এসসি, এসটি, ছোটোজাত। আরো কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলি শূদ্র। চাঁড়াল। পাঁচের বাদ। পক্ষান্তরে হাঙ্গরেরা কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলিকে আরোও ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্রতর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলিকে গিলিয়া খাইবার অধিকার অবশ্যই দিতো। ইহাতে, ওই পদ ও পদবীপ্রাপ্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলিরা অপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলিদের শাসনে, ছলে, কৌশলে, রাখিত বুঝাইয়া, বশ করিয়া। লইত শিক্ষক, অধ্যাপক, আধিকারিক, প্রযুক্তিবীদ ইত্যাদি পদ ও পদবী। দুষ্টলোকে বলে, ইহাতে, হাঙ্গরদিগের সুবিধা হইত সুনিদ্রার।

"মহাশয়া, মোদ্দা কথা হয় এই, যে, হাঙ্গরেরা মনুষ্য হইলে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ-মছলিদিগের নিমিত্ত, সাগরে, মহাসাগরে প্রথমবার তাহারা করিত সংস্কৃতির পত্তন।

আহা, মহাশয়া অন্তিমে বলিতে বাধ্য হই, যে আহা, হাঙ্গরেরা! কেন যে মানুষ নয় তারা! “

 

 

[ Bertold Brecht এর If Sharks were Men গল্পিকার ছায়ায় ]

 

 

  

ঘুম ঘর