পদ্য-পাতায় জল
উস্তাদ বিসমিল্লা খানকে নিবেদিত একগুচ্ছ কবিতা-চেষ্টা
রচনাকালঃ নভেম্বর – ডিসেম্বর, ২০২২
অনুক্রম
১। জট
২। স্মৃতি ও মৃত্যুকে মনে রেখে
৩। চিত্রকথা
৪। পড়শী
৫। মোমের আলো
৬। কাজল
৭। স্বর্গ-নিসর্গ
৮। অতীতের রক্তপাত গুলি
৯। বসতবাড়ি
১০। শীত-দুপুর
১১। বাতাসকে বলা কথা
১২। আসছে বছর, যাচ্ছে বছর
১৩। পদ্য-পাতায় জল
১৪। উস্তাদ বিসমিল্লা খান
জট
খোলো হে, গোয়েন্দা খোলো,
সমস্ত রহস্য-জট, ষড়যন্ত্র, কুটিল
কারসাজি —- মেধার, বুদ্ধির, বিত্তের,
প্রতিভার, মুর্খামির আর সারল্যেরো।
সারল্যেরো পরতে পরতে
রহস্য-খোলস ঘিনঘিনে
গোপনে হেমন্তে,শীতে
আলগা হয়, গজায় আবার
অবলীল। বল্কল বদল করে
সাজে সং, সরল-জোকার।
গোয়েন্দা হে, 'সত্য' তুমি
কখনো জানোনি, জানবেনা।তবু চেষ্টা করো,
যদি পারো, দেখতে পলকেও,
যে তোমার 'অপরাধী',
বিষন্ন-সরল মুখ, তার।
স্মৃতি ও মৃত্যুকে মনে রেখে
" স্মৃতি আর মৃত্যুর মাঝে একটি বাঁশের সাঁকো আছে।"
" সাঁকো না সুড়ঙ্গ-পথ? একটি সূতোতে
বেঁধে রাখে স্মৃতি ও মৃত্যুকে?"
"মৃত্যু নাহলে,ভাবি, স্মৃতি নিয়ে এতো কথা,আন্দোলন,
আলোড়ন,এতো লেখালেখি
আদৌ হতো কি? খোয়া যাওয়া আংটি,নাকছাবি
অকস্মাৎ পাওয়া গেলে শতাব্দী পেরিয়ে
ফিরিয়ে দেওয়াই যেতো তাকে
নিজহাতে। অন্যথায়
বিকালের ডাকে। তোমারো হারানো খাতা, প্রিয় বই,
মলিন এলবাম, অনেক শতাব্দী পরে
নিয়ে আসতো কোনো হরকরা। নিজের ও অন্যের মুখগুলি
দেখা যেতো যখন তখন
বয়সের তাক থেকে তুলে নিয়ে
নির্ধারিত ডাকটিকিট, খাম"
" ধরো, তুমি হরকরা হয়ে
অনেক শতাব্দী দূরে
গেলে সেই নাকছাবি নিয়ে
তার অক্ষে, তার দ্রাঘিমাতে।
তোমার পাশের সিটে বসে
স্মৃতিও নামলো সেই একই ইস্টিশানে।
এবং নেমেই বল্লো
'এখানে সে নাকছাবি হারানোর দিনে
অনেক পুকুর ছিল, পুকুরের গায়ে
নুয়ে থাকা গাছ ছিল, ছিল বাঁশঝাড়
মাছরাঙা-রোদ ছিল, ধানক্ষেতে রোদে ও ছায়াতে
যারা খেলতো টুকি, লুকোচুরি
এখানে তাদের কেউ-ই থাকেনা'ত আর।
কার নাকছাবি তুমি
ফেরাতে এসেছো কার হাতে?'
তাতে কি সুনিশ্চিত প্রমাণ হবেনা
স্মৃতির চাবিটি থাকে
মৃত্যু, অ-মৃত্যু নয়
আরো কারো কড়া প্রহরাতে?"
চিত্রকথা
স্মৃতিরো বয়স আছে। বয়সেরো
গাছ-পাথর ঢেকে
স্মৃতি লেখে চিত্রকথা
শ্যাওলার সবুজ অক্ষরে।
পড়শী
আরো কতো নিকটে বা দূরে গেলে তবে
নিজেকে অন্যের মতো খানিকটা চেনা মনে হবে?
এখনো তো দূরত্ব রেখেই চলি, তবু
কখনো নিজেকে ঢেকে ফেলি —- দূরে গিয়ে
নিজের ছায়াতে। কখনো নিজেই নাড়িভুড়ি
হয়ে যাই নিজের নিকটে যেতে যেতে।
কয়েকবার আয়না ভেঙ্গে ঢুকে যেতে গিয়ে
হয়েছি রক্তাক্ত তবু নতুন আয়না কিনে নিয়ে
পুনরায় বসেছি জাঁকিয়ে। অথচ কি সহজে অন্যকে
খানিকটা চিনি বলে, দেখো, দরজা বন্ধ থাকলে
ফিরে আসি, বড়জোর দুটি টোকা দিয়ে।
তাহলে চিনবো বলে ভাঙ্গতে চাওয়া কেন যে নিজেকে?
সুতরাং স্থির করতে হবে কতোটা নিকটে কিংবা
দূরে গেলে তবে, নিজেকে অন্যের মতো খানিকটা চেনা মনে হবে।
মোমের আলো
মোমের শিখায় লেখা রাত
করি পাঠ নিওন-বাতিতে।
যতি চিহ্ন বেয়ে ওঠে চাঁদ —-
ডাক দেয় চাঁদের ওপিঠে।
#
সব মোম গলে যাবে জ্বলে?
মাটির তেলের দীপ জ্বেলে
জানি কারা আজো কথা বলে।
চলে যাব ঠিকানাটি পেলে…
#
আমার নিয়ন-ছ্যাঁকা রাত
ততোদিন পুড়ুক একাই।
মোম কি মাটির বাতি নিয়ে
যতোদিন না আসে প্রভাত।
কাজল
মধ্যরাতের ঝমঝম রেলগাড়ী
ঘুম ঘুম নদী পার হয়ে গেলে ভাবি
কারা যায় ওই কামরা গুলিতে, কেন
তারাও দিয়েছে অচেনা গ্রহতে পাড়ি?
#
অচেনা গ্রহের হর্ম্যেও পথে পথে
তাদের স্বপ্ন ঘুম-ডানা মেলে ওড়ে।
তাদের গাড়িটি যতো যায় দূরে চলে
আমার ততোই আরো গাঢ় ভয় করে।
#
তবু আমি জানি সব গাড়িতেই থাকে
একজন, যার বিরাটপর্ব শেষ।
তাই চোখে নেই ঘুম, স্বপ্নের লেশ।
সে চলেছে তার পোঁতা নাড়িটির ডাকে।
#
তারই পথে আমি ঝমঝম রেলগাড়ী।
"অপু নয়, তবে কাজল ফিরেছে বাড়ি"।
স্বর্গ-নিসর্গ
নিসর্গকে
ভালবাসি। তাই
স্বর্গকে
ঘৃণা
করতে
দ্বিধা বোধ করিনি কখনো।
স্বর্গে
বেড়াতে গেলে
ঘুরে এসে
দেবতা-দেবতা গন্ধ
ধুয়ে নিই
কালি আর তুলি নিয়ে
কাগজে
নিসর্গ-ছবি এঁকে।
স্বর্গে নয়
আমি বাস করি
আমারই রেখায় লেখা
নিসর্গ-নরকে।
—-------------------
অতীতের রক্তপাত গুলি
অতীতের রক্তপাত গুলি
ভবিষ্যতে ছোটো নদি, ছোটো ছোটো
খাল। ছোটো, তবে খরস্রোতা। খরস্রোতা,
তথাপি গভীর। পারাপার
অসম্ভব
ভেলা বা সাঁকোতে। অতীত আর বর্তমান,
সর্বস্ব-সম্পদ হেন, হাতের মুঠোতে নিয়ে
ঝাঁপ দেবো, ভাবি।
#
যদি পার হতে পারি,
কোথায় ভাসবে লাশ? অতীতে না
অক্ষান্তরে, অন্য অতীতে?
বসতবাড়ি
আলো আমার ভাল্লাগেনা । অন্ধকারই বসতবাড়ি –
আলোর যারা আহ্লাদী, হায় তারা সবাই করুক আড়ি।
আমার লগ্ন কৃষ্ণপক্ষ অমাবস্যা, রাত নিশুতি ।
যক্ষরা সব সখা আমার, বান্ধবী হয় সব প্রেতিনী।
স্বর্গে আমার শরীর ব্যথা, আলোয় আমার যক্ষা-কাশি –
নরক আমার ঠিক-ঠিকানা। অন্ধকারের রূপ-তরাসই
আমার চোখে, ফুসফুসে আর ত্বকের নিচে, শিরায় শিরায়।
আলোয় যাদের ভরসা তারা পুড়ছে কূপীর নগ্ন শিখায়।
#
চাঁদ উঠেছে ? ফুল ফুটেছে ?
জ্যোৎস্না আমার কে ?
চাঁদের হাটে জলের দড়ে
বিকিয়ে গিয়েছে।
শীত-দুপুর
শীত-দুপুর।
কুয়াশা ভোর।
কাপড় শুকায়
শীত-দুপুরে,
ছাতে।
রাতে
ওম্ কি উত্তাপে
এরাই ভেজে। তাই
সারা দুপুর ধরে
খাবলে জমায় বুকে
গড়ানো রোদ, তাপ।
পাপ?
শিউরে ওঠে ঘাস
যখন মেলা ছাতে
গোলাপী পেন্টিকে
আদর করে রোদ।
লাল ব্রেসিয়ার কাঁপে
ঈর্ষা না আহ্লাদে?
সে যার দুধে থাকে
তারও কি আঁচ লাগে?
এদিক ওদিক দেখে
কম্বলে গা ঢেকে
ডাকে সে রাত্রিকে?
শীতের দুপুর বেলা
আগুন নিয়ে খেলা।
বাতাসে শীৎকার?
মেলা কাপড় যার …
মেলা কাপড় কার?
বাতাসকে বলা কথা
“ যেন বিস্মিত হতে পারি । যেন
অভিজ্ঞতা
বিস্ময়ের কাছে
পরাজিত হতে পারে । যেন
প্রশ্নবাণ এভাবেই বিদ্ধ করে
উত্তরের নগ্ন বুক । আবার আবার
প্রশ্ন-শরে যেন কেঁপে ওঠে
অস্তিত্ব আমূল। বিস্ময়ের
উৎসে যেন থাকে
ছায়াপথ,ধূলিকণা থেকে
ঘাসপাতা,
ছড়ানো তন্ডুল”।
আসছে বছর, যাচ্ছে বছর
যাচ্ছে বছর।
আসছে বছর।
আসবে বছর । আসবে না যারা
বেঁধে ছিল ঘর কুড়িয়ে, জুটিয়ে
কুটো আর খড়
গাছে, ডালে ডালে । আপন না পর তারা হে আমার,
জানিনা জানিনা । জানতে চাইনি, জানতে
চাই না । তবু তারাইতো
গেছে উড়ে উড়ে
পান্তা আনতে, নুন ফুরালেও
দূরে দূরে দূরে ।
অনেকে ফেরেনি । শিকারী-গুলিতে
ঝরে গেছে তারা – পালক ছড়িয়ে
এবং রক্ত
ঘাসে, মাঠে মাঠে। শিকারী-গুলিও
বর্শা এড়িয়ে, ষড়যন্ত্র ও ফাঁদটি পেরিয়ে
পেরেছি ফিরতে। পেরেছে ফিরতে
যারা সন্ধ্যায়
তারা গাছতলে জুটেছে সকলে
ভাগ করে নিতে
পান্তা কি নুন? নুন কি পান্তা?
জ্বলেছে উনুন? থেমেছে কান্না ?
চাঁদ এসে গেছে । চাঁদ
হেসে গেছে
ছড়িয়ে তারা ও মুক্তা পান্না।
তবুও ফেরেনি
অনেকে । কখনো
ফিরবেনা আর।
তারা কই সব? আসছে বছরে
উড়ে যেতে যেতে
পুড়ে যেতে যেতে
তাদের কথাই শুধু মনে পড়ে।
শুধু মনে পড়ে …
পদ্য-পাতায় জল
পদ্ম-পাতা। জলে
পদ্মের পাতা। পদ্য-পাতা
শব্দের শব,
শব্দের চুপ, কথা।
পদ্মপাতায় বিন্দু শিশির, জল –
অনিশ্চয়ের
অতল অস্থিরতা।
পদ্য-পাতায় জল রেখে যায়
যাদের যায়নি লেখা
সেই সবগুলি শব্দের
পথরেখা।
পদ্ম-পাতায় শব্দ-শিশির
রোজ মোছে সব লেখা।
উস্তাদ বিসমিল্লা খান
মাত্র তো সাতটিই সুর !
সেগুলি দিয়েই আঁকো ভোর,
মধ্যযাম,বিকাল,গোধূলি –
একে একে আঁকো তারাগুলি!
#
জৌনপুরী পথ ধরে হেঁটে
মধ্যরাতে মালকোষে আসি।
দেখি, তুমি একলা বাদক —
হাতে শুধু একটিই বাঁশি!
#
একটিই বাঁশি! সাত সুর!!
এই মাত্র তোমার সম্বল?
জাদু জানো? নাহলে কি করে
মিলাও হে, নিকট আর দূর?
#
‘বাঁশি নেহি। সাহ্নাই নাম”।
হোক্ যা’ই – সেলাম, প্রণাম,
আর এই শব্দ-কুরুবক
তোমাকে, হে একলা বাদক।।