একটি সাক্ষাৎ
একটি মানুষ, তার অনেক অনেক মুখ।
প্রতিজন মানুষ, গহনে অনেক অনেক অনেক মুখ।
অথবা
বাইরে একটি মানুষ, আর তার আবডালে
অনেক অনেক লোক। প্রতিজন লোক, আড়ালে গহনে
অনেক অনেক অনেক লোক। অরণ্য।
লোকের। জনের।
সেই সকল মুখ আর মানুষের ভিড়ে একটি মুখ
দুঃখী। একজন মানুষ
দুঃখিত। দুঃখিত, বিষণ্ণ নয়। বিষাদ-মুখটি
পার হ’লে তবেই দেখা মেলে দুঃখের। ঠিক যেমন
অভিসার, আদত, সততই
ঝড়ের রাতে। দুয়ার ভেঙ্গে। দুঃখের
বর্ষায়, চক্ষের জলে। বিষাদ, সে’ও এক
বিস্তার তবু সে বোধহয় মহতী নয়
দুঃখের মতো। অশান্তির মতো। নাহলে ‘কান্না হাসির দোল দোলানো
পৌষ ফাগুনের পালা’তেও ‘অশান্তি
যে আঘাত করে’। আর ‘তাই তো বীণা বাজে’। তখনই
ঝলসে ওঠে
অভিমান?
প্রশ্ন? না’কি পৌঁছানো
এক অনুভবে, বোধে –
যা ‘স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়, ভালবাসা নয়’, যা
শুধু বলাঃ “ এই কি তোমার খুশি,
আমায় তাই পরালে মালা” ।
ওই মালাটি নিয়ে যে দুঃখী -মুখটি
বাস করে আরো হাজার-কোটি মুখের
ভিড়-বাসায়, সেই মুখটি, লুকিয়ে রাখতে গেলেও, প্রকাশিত হয়ে পড়ে
স্ব-মহিমায়, ঝড়ের রাত্রে, বিদ্দ্যুচ্চমকে।
মুহুর্তে।
মুহুর্তে।
কিন্তু সকল মুহুর্তে নয়। আরেক দুঃখীই শুধু
মর্মে জ্বালাতে পারে মুহুর্তের ঐ বিদ্যুৎ। ওই আলোতেই
সঠিক ঠিকানা দেখে নিয়ে “থামে
বন্ধুর রথ”। তখনই জাগে কান্না। জানা যায়, যে “ধন্য এ ক্রন্দন,
ধন্য রে ধন্য”।
মর্মের ঐ দুঃখীকেই ভয় দানবের।
মর্মের ঐ দুঃখীকেই ভয় পুঁজিপতির।
মর্মের ঐ দুঃখীকেই ভয় ধর্ম ব্যবসায়ীর।
তাই, তারা একত্র হয়ে নগর বানায়। গড়ে মহানগর। অশালীন ওয়াটের বাতি
জ্বেলে দেয়, অন্ধকার
ঘুচাতে নয়, মুছে দিতে নয়। ঢেকে দিতে। ঢেকে
রাখতে। দামী পর্দায়, কার্পেটে যেমন ঢেকে রাখা ভগ্ন দেওয়াল, গর্ত
হয়ে যাওয়া মেঝে। তেমনি অমানুষিক বাতি আর ঐ বাতির তলায়
পুড়তে আসা, মরতে আসা পতঙ্গের মতো লোকজনের ভিড়ে
দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম শুধু নাম-জানা
একজন ‘লোকের’। এমনই আরেক বাতি-পোড়া মহানগর থেকে
সে এসেছে এই নগরে, চিকিৎসা করাতে। সন্ততির। এটুকুই
জানি। আর জানি, সে’ও, আমার মতো, আমারই মতো,
পেটি-বুর্জোয়া। আমারই মতন বই গেলে। কাগজে কলমে কখনো
কখনো উগড়েও দেয়। অতএব তারো অনেকটাই যে আমারি মতো
বানানো, আমারই মতো
কাগজের, তাই ভয়ও ছিল সাক্ষাতে। নেহাৎই ভদ্রতার সাক্ষাতে।
ফোনে, ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছি জানিয়ে দিয়ে যে অপেক্ষা
তার মধ্যে উদ্বেগ ছিল অনেকটাই। হয়তো বেশিরভাগটাই। চেহারা-ছবির
একটা আন্দাজ ছিল। ওই আন্দাজে ভর করেই
হাত নাড়লাম একজনকে লক্ষ্য করে। সে’ও
হাত নেড়ে এগোলো। এবার সাক্ষাৎ হবে। বুক দুরদুর। কেননা
বিজ্ঞান বলে, যে, সমমেরুতে বিকর্ষন আর আমরা
এই, পেটি বুর্জোয়া, ‘লিবারেল’, নাগরিক ও ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ রা
আদতে সকলেই একই মেরু। যদি বিকর্ষন-কোয়ান্টিটি
বেড়ে যায় তাহলেই তা বিরক্তি। ভয় সেখানেই। ওই ভয় নিয়েই
দেখছি লোকটি আসছে। এগিয়ে আসছে। দশ, নয়, আট, সাত …। শূন্যে …
তখুনি শুনলাম কচি কলাপাতার মতো, পাতার বাঁশির মতন কথা, বাক্য…
“তুমি কোন কাকু? তুমিই কি সপ্তর্ষি কাকু?”
সন্ততি। ওই নাম-চেনা ভদ্রলোকের ছেলে, ছোট্ট, সে’ও আমাকে
নামে চিনেছে আর ওঠানো হাতের ইশারা দেখে, বাবা-মা’কে পেছনে রেখে
দৌড়ে চলে এসেছে কাছে। দেখলাম কচি কলাগাছের মতোই কচি মুখ। উৎসাহ
মাখা, বিস্ময়ে লেখা শৈশবের চোখ। চোখে চশমা। দাঁড়িয়েছে এসে
আমার কিনার ঘেঁষে। কোলাহল বাঁচিয়ে তাকে “হ্যাঁ
আমিই সপ্তর্ষিকাকু” কথাটি বলতে সামান্য ঝুঁকলাম।
ওই, তার দিকে ঝুঁকে পড়ার, সময়,
কতোটুকু?
এক পলক?
আধ পলক?
আধ-পলকের ভগ্নাংশ?
জানিনা।
কিন্তু ওইটুকু সময়ই যেন মহাকাল
হয়ে মুছে দিল সমস্ত দ্বিধা, সমস্ত উদ্বেগ, আমার অর্জিত পেটি-বুর্জোয়া খোলস, আমার
নাগরিক বাকল, আমার ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ …
‘ভ্যানিটি’। হ্যাঁ, ‘ভ্যানিটি’। এই শব্দটিই কেন
ব্যবহার করেছিলেন জেমস্ জয়েস তাঁর “এরাবি” গল্পের শেষে, তার
আরো একটি ইংগিতও পেলাম যেন। আমার
মর্মের দুঃখীটি
জেগে উঠলো। হায়, এই যে ঘোষিত
‘আচ্ছে দিন”, এই যে বাণিজ্য-সফল
‘সভ্যতা’, তারই কি শিকার নয় এই শিশু, যার
মন নয় আর পাঁচ জনের মনের
মতো, যে কারণে তার দরকার মনো-চিকিৎসকের সহায়তা! হায়! এই হেতুই
জীবনানন্দে ‘বাণিজ্য’ শব্দের পাশে ‘যুদ্ধ’
ফিরে এসছে। ফিরে ফিরে এসেছে। হায়, মনের কতোটুকু
জানি আমরা? কাফকা, রিলকে’র
বালক পর্বে এঁরাও কি ছিলেন না
অন্য-মনের? সার্ত্রে? আন্দ্রে জিদ?
প্রুস্ত? রোজা লুক্সেমবার্গ? আন্তোনিও
গ্রামসি? ছিলেন। এবং এ’ও ছিল সত্য, যে,
ওই অন্য-মনের হওয়ার নিমিত্তই তাদের কে ঘিরে
আশংকা, দুশ্চিন্তা — যা হয়তো অমূলক, অন্তিমে – তবু তারই
শিকার হয়েছেন তাদের পিতারা, মাতা’রা? “হ্যাঁ, আমিই
সপ্তর্ষিকাকু” কথাটি শিশুকে বলে নিয়ে সোজা হয়ে
দাঁড়াতেই মুখোমুখি হলাম শুধু নাম-জানা
একজন ‘লোকের’, তার পত্নীর। কিন্তু ওই আধ-পলকেরও ভগ্নাংশ সময়ে
যে বিপ্লব ঘটে গেছে গহনে, লক্ষ যুগের অন্ধকার গুহায়
কে যেন দিয়েছে একটি প্রদীপ, মিটমিটে, জ্বালিয়ে, আর
তাতেই সমস্ত গুহা আলোকে হয়েছে বিহ্বল্। তাই এইবার
আমার মর্মের দুঃখীটি দেখতে পেলো আরেকজন, আরো
দুইজন, দুঃখীকে। দুঃখী মানুষকে। মানবকে। অতএব
নাম-জানা একজন ‘লোক’, ‘ভদ্রলোক’ থেকে মুহুর্তে তারা মানুষ, চেনা মানুষ
হয়ে জন্ম নিলো আমার সম্মুখেই। শিশু আমার
হাত ধরলো। আমি টের পেলাম
আমার শোনিতে, শিরায়, বাজছে অশ্রু। বাজছে
মমতা। ভালবাসা। আমি তার হাত আরো জোরে চেপে
কাকে যেন বল্লামঃ “ এই কি
তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা” …