মাথা নত করে …
১।
আমি ঝুঁকলাম। আমি নত হলাম।
আমি নত।
কার কাছে? একটি শিশুর কাছে। তার
একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে
আমি ঝুঁকলাম শিশুটির কাছে। শিশুটির
শিশুত্বের কাছে। আমার
মাথা নত হলো। কার কাছে? কোনো
দেবতার, ঈশ্বরের কাছে? না। কারণ আমার কোনো
ঈশ্বর নেই, দেবতা নেই, ঠাকুর নেই। আমার নত হওয়া, তাই, মানুষের
অন্তর্গত মনুষ্যত্বের কাছে, মানুষের মর্মে
নিহিত মানবের কাছে। যে ‘মানব’
থাকে, ‘মানুষের মৃত্যু’ হলেও। ঈশ্বর
থাকেনা। দেবতা পথে পথে
জন্মায়, মানুষের পদাঘাতে, পদাঘাত-ধন্য
পাথর তেল-সিন্দুর মেখে। ‘দেবতার
জন্ম’। দেবতার মৃত্যুও এইভাবেই। মৃত্যু নেই
শুধু মানবের। মৃত্যু নেই মানবের গহনে
সদাজাগ্রত দুঃখীজনের, বিরহীর।
মৃত্যু নেই তার জিজীবিষার।
নত হই
সেই মানুষের কাছে, সেই মানবের কাছে, যে
ঝুঁকে পড়েছে কায়িক শ্রমে। তার
ওই ঝুঁকেপড়া, পরাজিতের
নুয়ে পড়া নয়। জাদু,বজ্জাতির মূল্যে
যুদ্ধ ঘটিয়ে এবং জিতে, তারপর, প্রজা পালনে
নিজের, নিজেদের অক্ষমতা জেনে কুত্তার পিছু নিয়ে
পলাতক ‘ধর্ম’পুত্রের,ধর্ম-বণিকের
নুয়ে পড়া নয় বানানো ‘নিয়তির’ কাছে।
২।
মনেপড়ে একটি দুপুর। পীচ-গলা রোদের দুপুর।
যদিও মফস্বল তবু আবহে
যেন তারাশংকরের কোনো গল্প-উপন্যাসের
নিদাঘ-দগ্ধ বীরভূম-মাঠ। ফুটিফাটা।
বড় রাস্তা ধরে চলেছি বাস ধরতে।
কোনো কনট্রাক্টর কোনো ভোট-লোভীর
প্রয়োজনে, এই গ্রীষ্মে ঠিকা নিয়েছে আধমরা রাস্তার গায়ে
পীচ আর নুড়ির কার্পেট
বিছিয়ে দেওয়ার। রাস্তার পাশেই করেছে
গনগনে আগুনের কুন্ড। কালো টিন-ড্রামে ফুটছে পীচ। গলন্ত পীচ
বালতি করে এনে ঢেলে দিচ্ছে
রাস্তার ফোস্কায়।
কারা?
এরাও মানুষ।
এরা মজুর।
পেটের দায়ে পোড়াচ্ছে পেট-পিঠ।
পোড়াচ্ছে চেতনা। চৈতন্য। পোড়াচ্ছে
মনুষ্যত্ব। বেঁকে যাচ্ছে ‘অর্থ নামক দালালের
আচারে। অত্যাচারে।
হ্যাঁ, অর্থ।
অর্থ এক দালাল যা মানুষের প্রয়োজন আর তার প্রয়োজনের
ন্যূনতম সামগ্রীর মধ্যেকার,
মানুষের জীবন এবং তার যাপনের সম্ভাবনা গুলির মধ্যেকার
একমাত্র প্রসিদ্ধ দালাল। … 1
এ’ই এনে এদের দাঁড় করিয়েছে রাস্তায়। আগুনে। এ’ই শিয়াল, শকুন, জোঁকেদের দিয়েছে ক্ষমতা।
কুৎসিত কে ঘোষণা করেছে সুন্দর বলে। সুন্দরকে করেছে পণ্য। কেননা
বিত্ত, বিত্তবান কুৎসিত হলেও সে কুৎসিত নয়, তার ‘অর্থ’, তার বিত্ত
তাকে দিয়েছে ক্ষমতা নিজ কদর্যতাকে বাতিল করবার, খারিজ
করবার। … 2
আর আজন্ম এই অসমান ভাগাভাগি দেখে, দেখে দেখে
আজন্ম বিত্তের দ্বারা নির্ধারিত সামাজিক ও বৌদ্ধিক অবস্থান আর তার
বিজ্ঞাপন দেখে দেখে অভ্যস্ত
চোখ আমার। আমাদের। তাই
আমাদের চোখে মির্চ-মশালা ছুঁড়ে দেয়না
এই সকল ছবি।
৩।
সে অনেক দিন আগের কথা। সে আদৌ অনেকদিন
আগের কথা কি? আমার নবযুবক
দশা চলছে তখন। আমি ওই পীচ-আগুনের ঝাপটা
বাঁচিয়ে, মাথার উপরে জ্বলতে থাকা আগুনের
ভিতর দিয়ে চলেছি হেঁটে। গা বাঁচিয়ে। ঘামে ঘামে
মুছতে বসা অস্তির, অস্তিত্বের যথাসম্ভব
নিরাপদ করে চলেছি আমি। চলতে
চলতে হয়েগেলো চোখাচোখি। একজন মানুষের সঙ্গে। কায়িক শ্রমে
নুয়ে যাওয়া একজন বৃদ্ধ মানুষের সঙ্গে। তার বয়স
তাকে স্বাভাবিক নিয়মে করেছে যতোটা বাঁকা, যতোটা কুঁজো, তা’ই
একজন মানুষের পক্ষে যথেষ্ট নতি। তার উপরে চেপেছে
যাপনের বোঝা। তার কাজ
নুড়ি বোঝাই বস্তা নিয়ে পৌঁছে দেওয়া
ওই পীচ-কাজের ক্ষেত্রে। তার চোখের থেকে একটি দৃষ্টি
এলো উড়ে, আমার দিকে। আমার দৃষ্টি
গেলো তাতে স্থবির হয়ে। স্তব্ধ হয়ে।
কি ছিল ওই দৃষ্টিতে?
থাকবার কথা ছিল রাগ। থাকবার কথা ছিল
গনগনে ক্রোধ – ওই পীচ ফুটিয়ে তোলা চুলার মতোই
ক্রোধ
থাকবার কথা ছিল ওই দৃষ্টিতে। তার
আশেপাশের প্রতিটি খেতে
পাওয়া,মানুষের জ্বালানো আগুনে ঝলসে না গিয়েও
খেতে পাওয়া প্রতিজন মানুষের প্রতি
ক্রোধ, ঘৃণা থাকবার কথা ছিল ওই দৃষ্টিতে। ওই দৃষ্টির
ছিল খুঁজে বেড়ানোর কথা – হেতু, তার এই অবস্থার,
অবস্থানের। পরিবর্তে ওই দৃষ্টি
যেন আলতো করে উড়িয়ে দিলো একটি প্রশ্ন। আমার দিকে।
আমাকে।
যেন বল্লোঃ
‘হে ছোকরা, তোমার তো যৌবন। তোমার তো
শিরায় শিরায় রয়েছে ক্ষমতা,
পকেটে, ফুসফুসে রয়েছে
বয়স। তবু, কই, তোমাকে তো পুড়তে হচ্ছেনা
প্রকৃতির আগুনের তলায় জ্বালানো
মানুষের এই অগ্নিকুন্ডে। অগ্নিকান্ডে। আচ্ছা,
তুমিই বলো তো,
আমার বয়স, আমার হাড়-পাঁজরার
কি জোর আছে, থাকবার কি কথা – এই
পাথর-বোঝা বয়ে নেওয়ার? দেখো, তবু
আমিই ওই বোঝা নিচ্ছি তুলে। পৌঁছে দিচ্ছি ওই
পীচ-কারিগরদের। কিন্তু এমনটা কি
হওয়া উচিত?
আমার বয়সে? আমার শরীরে? বলো,
হে ছোকরা, তুমিই বলো …’
৪।
আমি সেই প্রজন্মের, সেই পরিবেশের
অন্তিমদের একজন যাদের ফুসফুসে,
রক্ত কণিকাতে রবীন্দ্রগান মিশে যেতে পেরেছিল
হাওয়া বাতাসের মতো, শ্বেত আর লোহিত
কণাদের মতো। ওই গানগুলি’র কথা, সুর
ঠিক কি বার্তা দিতো আমাকে? আমার তেরো চৌদ্দ
থেকে পনেরো ষোলো
পর্যন্ত বয়সে? স্পষ্ট বলা অসম্ভব। কিন্তু কিছু একটা
ঘটে যেতো, নিশ্চিত,
প্রতিটি গানের সঙ্গে মনের। নতুবা আজ অবধি কেন
মন ফিরে যায় প্রতিটি গান প্রথমবার শোনার
দিকে? জীবনের সেই কুয়াশা-সকাল থেকেই
শুনি, শুনেছি ‘আমার মাথা নত করে
দাও হে তোমার চরণধূলার তলে’। কিন্তু
ঠাকুর-কোঠার সামনে মাথা নোয়ানো, মা-ঠাকুমার, রাস্তার চলতে চলতে মাথা নোয়ানো,
রাস্তার লোকের — মন্দিরে,মশজিদে,গীর্জায়, এই সকলের সঙ্গে ওই
‘মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলার তলে’কে মেলাতে পারিনি
আবাল্য। সন্ধান করে গেছি, যাচ্ছি, অদ্যাপি, মেলানোর
মতো কিছু একটার কিংবা অনেক কিছুর। অন্ততঃ
ইঙ্গিতের। তবে প্রথম সন্ধান… সন্ধান না হোক, তার একটি ইঙ্গিত
পেয়েছিলাম সেই দিন, সেই গনগনে দুপুর-রাস্তায়, জ্বলন্ত চুলার তাপের
ঝাপটায়, খুনি-নিদাঘের আবর্তে। আমি, আমার অস্তির,
অস্তিত্বের সমস্ত নিয়ে, লুটিয়ে পড়েছিলাম
ওই গতর-খাটা বৃদ্ধের পায়ে। টের পেয়েছিলাম মাথা
নত হয়, হ’তে পারে মানুষর ওই অন্তর্গত মানবের কাছেই। ক্রমে
মানবের অন্তর্গত দুঃখকে, অশান্তিকে যতো টের পেয়েছি, গভীরে, আপনারো গভীরে
নত হয়েছে মাথা ওই দুঃখের কাছে।
শিশুটি আজ আবার নত করলো আমাকে
মানবের, মানবাত্মার সেই দুঃখের কাছে যা’র একটি মূল হেতু
নিহিত ‘অর্থ’ নামক দালালের লীলায়।
অর্থের দ্বারা শ্রেণী বিভক্ত এই সময়, এই সমাজে প্রতিটি নবজাত
অসুস্থ, জন্মমাত্র। ওই অসুস্থতা টের পাওয়ার মতন
শারীরিক, মানসিক সুস্থতাও বিলোপ এই অর্থ আর অনর্থক উৎপাদন আর বিষম অসম
বন্টনের খাতে। এই পেটি-বুর্জোয়া ঘরের শিশুটি থেকে
ওই মজুর বৃদ্ধ প্রত্যেকেরই
একই আততায়ী। সে ‘অর্থ’।
‘অর্থ’ দালাল। ‘অর্থ’ দেবতা।
বিত্ত’ই পরম । হায়, বিত্ত’ই মঙ্গল, তাই বিত্তবান সতত উত্তম। বিত্ত
আর অর্থই শঠতা সত্ত্বেও কিনে দেয়, দিতে পারে
সৎ-মুখোশ। তাই বিত্ত’ই পরম । হায়, বিত্ত’ই
মঙ্গল। তাই
বিত্ত’ই মর্ম, মন
স-ব। তাই বিত্তবান
কিভাবে নিরেট হতে পারে? অথবা
অসৎ? দরকারে
বিত্ত তাকে কিনে দেয়, দেবে
সহস্র সৎ-সত্তা, শত শত
সত্যার্থী সমাজ, শুভ
কাজ। কিনে দেবে
ঘিলু ও মগজ। ‘মেধা’ ছাপ মেরে
তারা তাকে
‘মেধাবী’ তকমা দিলে
বিত্তবান ভগবান
হবে। হয়। হয়ে গেছে
অনেক অনেক কাল
আগে। অনেক অনেক কাল
আগে বিত্তই ছিন্ন করেছে
যোগাযোগ
‘আমি’ ও ‘আমার’। ‘তুমি’ ও
‘তোমার’। তোমার ও
আমার। … 3
আমরা তাই ছিন্নতার নিষিদ্ধ সন্তান।
সে’ই ঢেকে রাখে, ঢেকে রাখছে মানবের
অস্তিত্বের আ-কেন্দ্র পরিধি। সকল অস্তি থেকে
অস্তিত্বকে বিচ্ছিন্ন করেছে সে। এই ‘খন্ড অস্তি’ গুলিরই
একাংশ অস্থিচর্মসার, ‘ইতিহাসের
ছেঁড়াপাতার মতো’, অনাহারে, অর্ধাহারে
মুহুর্মুহু লোপাট হচ্ছে বিত্তের বুনিন করা
পর্দার মোহিনী আড়ালে। তবুও সম্পূর্ণ লোপাট হচ্ছেনা, হবেনা, কেননা
বিত্ত দেবতার দরকার আছে ওদেরকে নিয়ে। দরকার তাদের খাটিয়ে
মারবার। ওই সব মৃত্যুই ফুলে ফেঁপে
প্রোফিট, মুনাফা। এই ‘খন্ড অস্তি’ গুলিরই
আরেকাংশ আমরা। এই শিশু। এই আমি। এই তার
মাতাপিতা। ওই আমার
কন্যা-পুত্র। আমার মধ্যবিত্ত মাথা
নত হয়, হতে চায় যে বিরাট
মানবের যে বিরাট দুঃখদের কাছে
তা’ও সে পারে কি? “যখন তোমায়
প্রণাম করি আমি, প্রণাম আমার
কোন্খানে যায় থামি”...
৫।
কোন্খানে যায় থামি?
থেমে যায় অস্তি আর অস্তিত্বের
মাঝখানে। থেমে যায় দুর্গ-দেওয়ালে
যে দেওয়াল ‘বিত্ত’,’অর্থ’। যে দেওয়ালের
স্থপতি, পাথর-ইঁট —- ‘মুদ্রা’,‘অর্থ’,
’বিত্ত’। সুতরাং হে মানব, মানুষের অন্তর্গত
হে মানব,মৃত্যুহীন, “তোমার চরণ
যেথায় নামে অপমানের তলে, সেথায়
আমার
প্রণাম নামে না যে”। ঐখানেই আমারো বিচ্ছেদ
ঘটে যায় আমার ‘আমি’র সঙ্গে। তোমার
‘তুমি’র সঙ্গে। আমাদের
প্রণামের ভিতরেও
ঢুকে পড়ে ‘মুদ্রা’,‘অর্থ’,’বিত্ত’ । তাই
আমাদের নিমিত্তই গীত “অন্ধজনে
দেহো আলো”। আমাদের খন্ড সত্তার, খন্ড
আত্মার গীতি “মৃত জনে
দেহো প্রাণ”।
********************
“Money is the pimp between man’s need and the object, between his life and his means of life.”
“I am not ugly, for the effect of ugliness—its deterrent power—is nullified by money.”
“ Money is the supreme good, therefore its possessor is good. Money, besides, saves me the trouble of being dishonest: I am therefore presumed honest. I am stupid, but money is the real mind of all things and how then should its possessor be stupid? Besides, he can buy talented people for himself, and is he who has power over the talented not more talented than the talented? Do not I, who thanks to money am capable of all that the human heart longs for, possess all human capacities? Does not my money therefore transform all my incapacities into their contrary?” Karl Marx, Economic and Philosophic Manuscripts of 1844