প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Friday, April 21, 2023

"সন্ধ্যা হল গো, ও মা"

 "সন্ধ্যা হল গো, ও মা"
–--------------------------




বেজে উঠলো সেই দৈনন্দিন আকুতিঃ
"সন্ধ্যা হলো গো, ও মা সন্ধ্যা হলো, বুকে ধরো"।
বেজে উঠলো গায়কজনের সহস্র যাপন-দিনের, যাপিত-দিনের আকুতি নিয়ে। হেউঢেউ নিয়ে। শ্রবণমাত্র শিহরিত হলাম। যেন আমারো সহস্র যাপন-দিনের, যাপিত-দিনের আকুতি অনুরনিত হলো আমার শাখায়, পাতায়, শিরায়, শিকড়ে, তন্তুতে তন্তুতে।
" ফিরিয়ে নে মা, ফিরিয়ে নে গো-- সব যে কোথায় হারিয়েছে গো"...  আমার কাছ থেকে আমিটিই গিয়েছে হারিয়ে। যাচ্ছে হারিয়ে। সঙ্গী,সঙ্গিনী না'কি নিশির ডাক শুনতে পেয়ে, প্রদীপ হাতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে, প্রদীপ নিভে গেছে বাতাসেতে। তাই পলকেই "সব যে কোথায় হারিয়েছে গো"। এবারে আলোয় আর পথ যাবেনা খুঁজে পাওয়া। কারন আলোয় সব আলগা আলগা। আলাদা আলাদা। শুধু অন্ধকারেই সব এক আকার। সব একাকার। ওই অন্ধকারই এখন আমার একমাত্র আশ্রয়। আমার একমাত্র পথ, আমার কাছে ফিরবার ওই অন্ধকারের পথ ধরেই —- "ছড়ানো এই জীবন, তোমার আঁধার-মাঝে হোক-না জড়ো"....।
কে গাইছেন? পুরুষ কন্ঠ। অনেকটাই হেমন্ত ঘরানা। স্বরও হেমন্ত'র মতো। কিন্তু আর্তির এই আলোড়ন হেমন্ত'র রেকর্ডে, এই গানে, ছিল কি? না। এই যে গাওয়া তা রেকর্ডের গাওয়া হতে পারেনা। রেকর্ডের জন্য গাওয়া হতে পারেনা। ঠিক যেমন ৫০ ছোঁয়া আমি, ৪৯ ছোঁয়া আমার ভাই, আমাদের হতে পারেনা এই চেহারা যা আমাদেরই ছিল কিন্তু সে "সব যে কোথায় হারিয়েছে গো"। যেমন এই ডবল-স্পীকার পেনাসোনিক টেপরেকর্ডার আমাদের ছিলনা। অথচ এই ডবল-স্পীকার পেনাসোনিক টেপরেকর্ডারেই কি বাজছেনা গানটি? আমাদের যে ছোট টেপরেকর্ডারটি ছিল, ফিলিপ্সের, সেটিই বা কোথায়? "সব যে কোথায় হারিয়েছে গো"। কোথায় পাবো?  পাবো কি কোথাও আর? পাবো সন্ধ্যার অন্ধকারে সব এক আকার, সব একাকার হলে, সেখানেই খুঁজে পাবো আমার হারানো 'আমি' কে। আর তাহলেই ফিরে পাব সব। " টাইম রিগেইনড"। "ছড়ানো এই জীবন, তোমার আঁধার-মাঝে হোক-না জড়ো"।
দু'টি ডানা।
দুইটিই মেলে না দিলে, খুলে না দিলে জানলার মতো, না'ত ওড়া যায়, না'ত আসা যাওয়ার সাঁকো গড়া যায় ঘরের সঙ্গে বাইরের, বাইরের সঙ্গে ঘরের। এক ডানায় যে, যারা উড়তে চেষ্টা নেয়, তারা আহত। আহত পাখি। আহত মানুষ। যে দরজা রাখে ভেজিয়ে নয়তো বন্ধ করে, সে অসুস্থ। অসুস্থ দেহে না'ও হয় যদি, মন তার অসুস্থ। সুস্থ মন আর অসুস্থ শরীরের অমলের জানালা দরজা খোলার, খুলে রাখবার আকুতি আমাদের জানা। আর এ'ও জানা, যে, ব্যাধের তীর ছাড়া, শিকারীর গুলি ছাড়া ডানা কাটা যায়না পক্ষীর। তেমনি শরীরে, মনে অসুখের বীজ থাকলেও বাইরের উস্কানি ছাড়া তারা পারেনা মহামারী হ'তে।
যাপনেরো দুটি ডানা।
ঘুম আর জাগা।
জাগা আর ঘুম।
আদতে জাগরণ আর স্বপ্ন।
ঘুম, হয় সাঁকো শুধু, জাগা-কোঠা থেকে স্বপ্ন-কোঠায় যাওয়ার। ওই স্বপ্ন-কোঠাকে জেগে উঠে বাতিল করে দেওয়ার মানে জীবনের একটি ডানাকে ছেঁটে ফেলা। এ'ও অসুস্থতাই। আর সকল অসুস্থতার মতোই এরও বীজ লোভের সভ্যতার দ্বারাই বপন করা। আর এই লোভের সভ্যতাই বিকট সব বাতি,বাত্তি জ্বালিয়ে ধাঁধিয়ে দিয়েছে আমার চোখ। আমাদের চোখ। তাই আমার, তাই আমাদের "সব যে কোথায় হারিয়েছে গো"। —- এই ভাবনা বহু চর্চিত, বহুমুখী চর্চার বিষয়, অদ্যাপি। আমি গবেষক নই। আমি তাই এর বেশী বিশ্লেষণে এখানে যাব না। স্বপ্নে আমি শুনি, শুনেছি অনেক গানই। স্বপ্ন ভেঙ্গে উঠে প্রাণপন চেষ্টা নিয়েছি গানটি যতোক্ষণ সম্ভব না বাজিয়ে থাকার। কারন এতো দিনে এটুকু জেনেছি, যে, স্বপ্নে শোনা গানের আকুতি জেগে উঠে রেকর্ডে বাজিয়ে পাওয়া যায়না। বরং বেসুরেই, নিজে গুন-গুন করলে বরং অনেক গভীরে, অনেকক্ষণ ধরে ছুঁয়ে থাকা যায় স্বপ্নকে, গানকে আর নিজেকেও।
           প্রকৃত প্রস্তাবে জাগরণ আর স্বপ্নও যে নয় বিচ্ছিন্ন দুটি দ্বীপ —- আমাদের জ্ঞাতে অজ্ঞাতে চলতে থাকে পারাপার, দুই দ্বীপে। আমরা সম্ভবত কোনোটিতেই ভিড়তে পারিনা। আমাদের মন-নৌকা কখনো একটির বেশী কাছে, কখনো অন্যটির বেশী দূরে যায়। ভাসে। ভাসতেই থাকে। এই ভাবনাও নতুন কিছু নয়। বহু চর্চিত, বহুমুখী চর্চার বিষয়, অদ্যাপি।
  স্বপ্নে যে গান বাজে সেও ওই ভাসমান মন-নৌকার মতোই। তার কথা, সুর এসেছে জাগরন থেকে। আর ঘুমের সাঁকোতে তার ভিতরে ঢুকে পড়েছে জাগরনের আমি —- চ্ছিল্ল আমি, রিক্ত আমি, ত্যক্ত আমি। তাই স্বপ্নে গায়কের বকলমে যে গাইছে সে আমি। স্বপ্নের আমি। অন্ধকারের আমি। এক আকার আমি। একাকার আমি। তাই গানের কথাগুলির অক্ষর বিন্যাস রবীন্দ্রনাথের যদিবা হয়, গানটি রচিত হচ্ছে, সম্পূর্ণ নতুন করে। আমার অন্দরে। তখন "আমায় ঘিরি আমায় চুমি   কেবল তুমি, কেবল তুমি–"। আর ওই 'তুমি'র অনেকটাই আমি।
স্বপ্নে যেদিন " কা করু সজনী" শুনেছিলাম সেদিনো বড়ে গুলাম আলি সাহেব ছিলেন "বাহির" এর প্রতীক। জাগরনের ভগ্নদূত। আর " আয়ে না বালম" এর আকুলতা আমার। আমার বিরহ, আমার বিচ্ছেদ, অন্তিমে, আমার 'আমি' থেকে। তার বেদনা। তার সাথে এসে মিশেছে আমার নিশ্চেতনায় মিশে থাকা আমার মাতা-পিতার, মাতামহ-পিতামহের, বৃদ্ধ, অতি বৃদ্ধ প্রমাতামহীর প্রপিতামহীর নিজেদের হারিয়ে ফেলার যাতনা। আবহমান ভৈরবী রাগের বেদনা, আবহমান ভৈরবী রাগের বেদনা। এই আবহমান আনন্দ-বেদনা নিয়ে আমার মন নৌকা কি সম্পূর্ণ ভিড়তে পেরেছিল জাগরনে? আবার একটা অন্তত চলনসই জাগৃতি না থাকলে কিভাবে আমি অফিস সাড়লাম? মিটিং করলাম?...  
  বাস্তবে যা ঘটলো, তা এই, যে, পুনরায় অনুভব করলাম, করতে হলো, যে, প্রকৃত প্রস্তাবে জাগরণ আর স্বপ্নও যে নয় বিচ্ছিন্ন দুটি দ্বীপ —- আমাদের জ্ঞাতে অজ্ঞাতে চলতে থাকে পারাপার, দুই দ্বীপে। আমরা সম্ভবত কোনোটিতেই ভিড়তে পারিনা। আমাদের মন-নৌকা কখনো একটির বেশী কাছে, কখনো অন্যটির বেশী দূরে যায়। ভাসে। ভাসতেই থাকে। উড়তেই থাকে দু'টি ডানায়।
দুইটিই মেলে না দিলে, খুলে না দিলে জানলার মতো, না'ত ওড়া যায়, না'ত আসা যাওয়ার সাঁকো গড়া যায় ঘরের সঙ্গে বাইরের, বাইরের সঙ্গে ঘরের।
তাই, স্বপ্নের ভিতরের যাপনকে বাদ দিলে জীবনের অর্ধেকটাই পড়ে যায় বাদ।
            দিনের শেষে, সন্ধ্যায়, সব-হারানো ওই গানের মানুষটিও কি " সন্ধ্যা হল গো-- ও মা,   সন্ধ্যা হল, বুকে ধরো / অতল কালো স্নেহের মাঝে ডুবিয়ে আমায় স্নিগ্ধ করো" অথবা
"আর আমারে বাইরে তোমার কোথাও যেন না যায় দেখা / তোমার রাতে মিলাক আমার জীবনসাঁজের রশ্মিরেখা" হেন আকুতিতে, স্বপ্নেরই আশ্রয় চেয়েছেন কি?

 –--------

ঘুম ঘর