আবহ
–---------
বাদল আরেকদিনও গেল মফস্বলের প্রান্তে, সেই রুগ্ন হাসপাতালে। গেলো, কেননা সে স্থির করেছিল, যদিও তার নিজের সত্তর পেরিয়েছে আর বাল্যকালে, মেলায় হারানো দাদাটির আশি, তথাপি তাকে সে নিয়ে আসবে রুগ্ন এই হাসপাতাল থেকে তার বাসায়, যে বাসার আবহ বলতে দাগী আকাশ, রেলব্রীজ, পঞ্জরময় গাভীদের চড়ে বেড়ানো। তবু তো ভাতের হাঁড়ির নিচে আগুন জ্বলে। চাল সেদ্ধ হয়। ছড়ায় ভাতের গন্ধ, আশ্চর্য ভাতের। 'বাসা' 'বাসা' ঘ্রাণও ওঠে কখনো কখনো। তাই,সেখানেই সে আনবে দাদাকে। অতএব, বাদল আরেকদিন গেল, মফস্বলের প্রান্তে সেই রুগ্ন হাসপাতালে।
গেলো,গিয়ে দেখলো ঘুমন্ত বৃদ্ধ-ওয়ার্ডে সকলেই দুপুরের ঘুম গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে আর তার দাদার লোহার খাটে যা রয়েছে বসে , তা এক নরক-ছায়া, যার সাথে বাদলের প্রথম সাক্ষাৎ, চেনাশোনা অনেক অনেক আগে, রেলের জানলা থেকে, আকালে অথবা অকালে —- মাঠে মাঠে শুয়ে থাকা গরু মহিষের খোলা চোখ লাশের দৃষ্টিতে। বাদল দেখলো, উপবিষ্ট এই লাশ সেই পশু-লাশদের থেকে ভিন্ন কিছু নয়। বাদল দেখলো, কান্নাকাটির পরিবর্তে স্মৃতির ঝিলিমিলি।
রেল লাইনের কিনারের ধুধু মাঠ, হুহু ধুলো, ধূলোয় কয়লার ঘ্রাণ, ইঞ্জিনের বাঁশি আর মাঠে মাঠে লাশ-পশুদের চোখ, নীল, ফোলা ফোলা। কাক, শকুনের ভিড়। রাত্রে শিয়াল আসবে, নিশ্চিত, দলবল নিয়ে। তখনই বাদলের মুখোমুখি হলো সেই প্রশ্ন, যা থেকে পালানোর চেষ্টাই হয়তো যাপন।
জীবনের অর্থ কী? আছে কী কোনোও অর্থ কোনো জীবনের? বাদলের মনে পড়লো, তার বৌ, চল্লিশের কোঠা না পেরোতে হঠাৎই অজ্ঞান হয়ে গেলো। তিন দিন, তিন রাত্রি পরে জ্ঞান ফিরলে যে একটি চিৎকারের পর তার নাড়ি চিরতরে থেমে গিয়েছিল, সে এক আর্তনাদ, পাশবিক, সকল অর্থেই। ঠিক যেরকম পাশবিক তার দাদার মুখটি এখন।
[ উৎসর্গঃ কাওরু টাকামুরা, গৌতম বসু ]