প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Wednesday, October 16, 2024

বুনো-লতা । ২।

বুনো-লতা

২।

“জগৎ পারাবারের তীরে” যারা’ই, যে কর্মেই রত, আদতে সে সকলই “খেলা”। ওই খেলার মত্ত সক্কলেই “শিশু”। – এই সহজ কথাটি কি টের পান নি রবীন্দ্রনাথ? তাহলে কেন লিখলেনঃ “ডুবারি ডুবে মুকুতা চেয়ে,/ বণিক ধায় তরণী বেয়ে, / ছেলেরা নুড়ি কুড়ায়ে পেয়ে/   সাজায় বসি ঢেলা।” – অর্থাৎ, কেন তিনি বণিক কে, বাণিজ্যকে আলাদা করে দিলেন আর সবার থেকে? শিশুর থেকে? করলেন, বা করতে বাধ্য হলেন ওই হেতুই, যে হেতু যিশুকে বলতে হয়েছিল, যে, সূঁচের ফুটো গ’লে উট যদিবা চলে যেতে পারে, ধনী কদাপি পারবেনা স্বর্গ-দোর, তা দসে যতো বিরাট-বিশালই হোক, তা দিয়ে ঢুকতে। ওই যে লোকটি বসে গলা সাধছে আর ভাবছে সংগীত গেয়ে সে অমর হয়ে থাকবে, এই যে ধেড়ে ইন্দ্রটি পদ্যের দ্বি-পদ, ত্রিপদ, চতুস্পদ লিখে লিখে, লোককে পড়িয়ে পড়িয়ে উন্মাদ হয়ে গেলো এতাবৎ তাকে রবি ঠাকুরের চেয়ে উচ্চতর আসন বাঙালী দিলোনা বলে – ইত্যাদি, এরা শিশু। শিশু হরিহর রায়, সর্বজয়া, দুর্গা, অপু, ফাদার সিয়ের্গি, প্রিন্স মিশকিন, আনা কারেনিনা, মাদাম বোভারি’রা। এরা নিজ দৈনন্দিনে এমনই নিমজ্জিত, যে, তারা ভুলে যায়, যে, তাদের এই সকল দৈনন্দিন, এই সকল অমরতা-লোভের উর্ধেঃ “ ঝঞ্ঝা ফিরে গগনতলে,/ তরণী ডুবে সুদূর জলে,/মরণ-দূত উড়িয়া চলে” – তবু খেলে চলে তারা। খেলেই চলে। – এদের সঙ্গে যদি সাম্রাজ্যবাদী লোভ, পুঁজি তান্ত্রিক পণ্যায়ণের মূল্যে মুনাফা – ইত্যাদির খেলায় যারা মত্ত, তাদেরকে মিলিয়ে ফেলি, গুলিয়ে ফেলি “শিশু” বলে, তাহলে যে মস্ত ভুলটি হবে, তারই প্রতিপক্ষে “ডুবারি ডুবে মুকুতা চেয়ে,/বণিক ধায় তরণী বেয়ে” র অন্তর্গত লোভের কথাটি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন রবিকবি।

এই মুহুর্তে আমি যে চার-পাঁচটি লেংটা শিশুর কথা বলছি তাদের আবহে পারাবার নেই। আছে একটি মড়া খাল, যার মুখ, নদীর দিকে, বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বাঁধ দিয়ে। ফলে সে আর বহতা নয়। তার সারা গা’য়ে কচুরিপানার সাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পোকামাকড়,সাপ-সাপালি। মড়া-খালের পাড়ে এক সাড় শেওড়াবৃক্ষ। কয়েকটি সুপারী গাছ। টিন-চাল, টিন-দেওয়ালের খোপ। আরেক ধারে পিচ-সড়ক। তারা লেংটা খেলে বেড়ায়, দৌড়ে বেড়ায়। কান্দে, হাসে। বড় হয়। কিন্তু বেড়ে ওঠেনা। মাঝখানে সিমেন্ট-দেওয়াল। এই পাড়ে আমাদের বা। বাসা। বাড়ি। দেওয়ালের কিনারে দাঁড়িয়ে আমি যখন ওই শিশুদের নাম, তাদের কার ক’টা দাঁত উঠলো-পড়লো – এই সকল নিয়ে তাদের সঙ্গে গল্প করছি, যখন এক্কেবারে ছোটোটি, বড়দের মতোই এই দেওয়াল-ভাঙা আসরে যোগ দিতে এসে হোঁচট খেয়েও, না কেঁদে হাসছে, তখন, বেলা এগারোটা নাগাদ, ওই মেয়েটি, ওই বুনোলতা, আবার এসেছে “ফুনে চাজ” দিতে। আগে অবশ্য আমার অনুমতি সে নিয়েছে। অনুমতি ছাড়া আমাদের মতো বিরাট ভদ্রলোকের বাড়ির গেট ওরা পার হয়না। কিন্তু ওরাও আমাদের ঠিক ততোটাই প্রতিবেশী, যতোটা, আর পাশের “কয়লাবাবু”। যিনি সবংশে বকলম, যিনি কয়লার কারবারে হাত কালো না করেই কালো টাকার পর্বত গড়েছেন। তিনি বা তাঁর গুষ্টি অবশ্য অবলীলায় ঢুকেপড়ে। হাঁকডাক দিলে আলাপ সালাপও চালায়। 

বুনোলতা যখন তার “স্মাট-ফুন” চাজে লাগাচ্ছে তখন তাকে নিয়ে জেরা করছে যে, সে, আমার মা’কে দেখে রাখার, দিনরাত্রি থাকা, মাঝ বয়সী মহিলা। শিশুগুলির সঙ্গে সামান্য আড্ডা দিয়ে আমি বাইর-কোঠায় ফেরার নিমিত্ত ঘুরে দাঁড়াতেই, সেই শিশু দলের যেটি সবচে’ বড়, যার বয়স বড়জোর আট, সে ডাকলো, তার ডাকে “চুপি চুপি” মেশানো। আমিও নুয়ে কান দিলাম বাড়িয়ে। সে ফিসফিসিয়ে বল্লঃ “ক্কাকু, যে বেটি তুমরার ঘর-অ গেসে ফুন চাজ দেওয়াত, ইগু কিন্তু চুর”। হায়, চোর, হায় চুরি। হায় “না বলিয়া পরের দ্রব্য …”। বুনোলতা এই বালকের কাকি অথবা জেঠি। দুইটি ছোকরা ভাই, তাদের দুইটি বৌ – পাশাপাশি টিনিখোপে বাস করে। বালক কে নিশ্চিত তার মা’ই বলেছে, যে, বুনোলতা চোর। এবার বুনোলতাও, কালে, তার বাচ্চাকে শেখাবে, তার জা’টি, যে’ও, হয় আরো একটি বুনোলতাই, সে “চোর”। “চোর” শব্দের সংজ্ঞা এখানে, হরিহর-পত্নী সর্বজয়ার, হরিহরের দিদি, বুড়ি ইন্দির ঠাকরুন কে “চোর” বলার একই নিয়মের অধীন। অর্থাৎ দুই-পলা শর্ষের তেল, দেড়টি কাঁচা লংকা থেকে বড়জোর ইমিটেশনের শস্তা মালা’র এদিক-ওদিক। আমি বালককে বললাম, ফিস্ফিস করেই “আচ্ছা, আমি পুলিশো জানাইয়া রাখমু”। 

বাইর-কোঠায় ঢুকে আবার বসেছি লিখতে, এইবার আগমন মা’র সেই আধবুড়ি আয়া-জনের। “দাদা, আপনি বোধয় জানেন না, তাই বলছি, ওই ওকে যে বাড়ি ঢুকতে দিয়েছেন, ওর চরিত্র-স্বভাব খুব খারাপ”।

স্থির দৃষ্টিতে মহিলার দিকে তাকিয়ে বললাম “ পেটে খাওয়া না থাকলে তো স্বভাব-চরিত্র ধুয়ে বাঁচা যায়না। ওদের দেড়বেলা খাওয়া মেলেনা। তাই স্বভাব-চরিত্র বা যা খুশি’র মূল্যে ওরা খেতে পেলেই আমি খুশি। ওর স্বভাব-চরিত্র নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই”।

একটু দমে গেলেও মহিলা থাবলো না। “আরে জানইন নি, ও মুসলিমের সঙ্গে যায়” …।

আবার স্থির চোখে তাকাতে হলো। “শোনো, ও হিন্দুর সাথে গেলে যা, মুসলমানের সঙ্গে গেলেও তা’ই। হিন্দু-মুসলমানে আমার কিচ্ছু আসে যায়না। পেটের আর ক্ষুধার ও কিছু আসে যায়না”। 

মহিলা এবার ক্ষান্ত হলো তবে বল্লো “ওই দাদা ঘরে থাকলে এরা আসবার সাহস পায় না”।

অর্থাৎ, আমার ছোটোভাই, যে এই মুহুর্তে, মাদ্রাজে অবস্থান করছে, থাকবে কয়েকদিন সপরিবারে, সে। অর্থাৎ রূপক থাকলে এরা এতোটা সাহস পেতোনা। কিজানি। হয়তো আমিও যদি এখানেই থাকতাম, হয়তো আমাকেও ওরা ভয় পেতো। হয়তো আমার মধ্যেও ওই ভয় দেখানো ভদ্রলোকি ডালপালা মেলতো। এবং মেলাটাই স্বাভাবিক যদিনা আমরা সক্রিয় ভাবে ওই ভদ্রলোকি’র বিষ-চারাটিকে মুড়িয়ে না ফেলি, প্রতি মুহুর্তে। কিজানি। হয়তো ডাবলিনে বাস করলে জয়েস না লিখতেন ডাবলিনার্স, না ইউলিসিস। গতকাল সকালেই, লঙ্গাই বাজার গিয়ে মা’র জন্য মাছ কিনেছিলাম। হেঁটেই গেছি। ফেরাও যেতো হেঁটেই। তা’ও ফাঁকা অটোরিক্সা দেখে, উঠে পড়লাম। বসলাম অটোচালকের কিনার-সিটে। বসতে না বসতেই  অটো চালক গল্প আরম্ভ করে দিল। বল্লো, চৈত্র থেকে আশ্বিন গেলো মেঘে আর জলে। এখন কয়দিন রউদের মুখ না দেখলে সব যাবে। জানালো এই চৈত্র থেকে আশ্বিনের মেঘের নিমিত্ত 

কি কি রকমের ধান ভাল হবে, কিকি রকমের ধান হবেনা বা পরিমাণে কম হবে। সব জানালো। হায়, আমি, একদা এই শহরে জন্মে, বড় হয়ে, পরে সিলিকন-সিটি’র বাসিন্দা, আমি, “ চৈত্র”, “আশ্বিন”, “মেঘ”, “পানি”  শব্দগুলিতে  আকুল হলাম। কিন্তু  ধানের নাম ১টাও বুঝতেই পারিনি। পারিনি, যারা এই শহরে বাস করে, তারাও কি পারে? পারতো? – না। ধান, চালের সঙ্গে আমাদের বিচ্ছেদ বহু আগেই পূর্ণ হয়েছে। “অন্ধ বিক্রেতার থেকে ধূপ কেনার সুযোগ নষ্ট হয়েছে”। 

               দিনে রান্না করতে যিনি আসেন দীপালীদি, তাকে মাছ ইত্যাদি দিয়ে বাইর-উঠানে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানলাম। এরপরে ভিতরমুখো হ’তেই দেখি দীপালিদি আমার মা’র সঙ্গে কি এক শলাপরামর্শে নিমগ্ন। কান পাতলে বোঝা গেলো, মাছ ঠিক যতো টুকরো মা খাবে, ঠিক ততো টুকরোই সে রাঁধবে নাহলে। “বুঝরা অইত …”। বুঝলাম। – বুঝলাম মাছ-টুকরো বেঁচে গেলে তা পেটে যাবে মা’র এই আয়া-জনের এবং তা দীপালিদির ইচ্ছা নয়। বুঝলাম এবং আবার এসে দাঁড়াতে হলো শূন্যে। একদিকে “আদর্শ হিন্দু হোটেল”, অন্যদিকে “হুনান রিপোর্ট”। 

এই আয়া-জনকে দেখেছি, দুপুরের পরে দুপুর একটি পুরনো শাড়ি, যা কখনো “দামী” ছিল, তার আঁচল কিংবা পাড় – সেলাই করছে। তার নিজের অন্নবস্ত্রের সংস্থান অপরের ঘরকাজ করে। ওই বুনোলতা’র মতো তার নিজের মেয়ে বা বোন রয়েছে নিশ্চয়। তথাপি, যেহেতু সে “ব্রাহ্মণ” এবং যেহেতু সে “অনেক আগের থেকেই ভদ্রলোক”, ফলে, সে নিজেকে, নিজ মনেই, বুনোলতা’র চেয়ে উপরে একটি অবস্থান দিয়ে ফেলেছে। বামনি বলে সে “উচ্চ” দীপালিদইর চেয়েও। এবং দীপালিদি, আমার ভাই’র বিয়ের পরপর, আমার ভাতৃবধূকে বলেছিল “এরা বুধয় ভালা বাবন না”। একে ঝুমা তখন নতুন বৌ, তা’য় শ্বশুরবাড়ির “ব্রাহ্মনত্ব” নিয়ে প্রশ্ন। অতএব, ঝুমা দীপালিদিকে প্রশ্ন করল, কেন এমন মনেহয় তার, প্রকৃত প্রস্তাবে, তার শ্বশুরবাড়ি মস্ত বড় ব্রাহ্মণ। দীপালিদির উত্তর “তারা আমার হাতের রান্না খান, তাই বললাম”। – অর্থাৎ বঞ্চিত হ’তে হ’তে, হ’তে হ’তে এরা নিজেদেরকে নিজেরাই পারছেনা আর সম্মান করতে। মূল্য দিতে। শুধু বুনোলতা নয়, দীপালিদি বা ওই আয়া-জন এরা প্রত্যেকেই সেই কুন্তা। এরা পরস্পরকে ঘিরে দাঁড়ালেই দানা বাঁধবে, বাঁধতে পারে, আদত প্রতিরোধ। আদত মহিষাসুর সেটি টের পেয়েই, বহু আগেই এনে দিয়েছিল জাতপাত। উপনিবেশ-ওয়ালারা একে করেছিল অস্ত্র। অতঃপর সরাসরি উপনিবেশ থেকে যখন দেশগুলি “স্বাধীনতা”র পাজামা-পাঞ্জাবী-পতাকা’তে হলো পরোক্ষ উপনিবেশ, তখন, এই জাতপাতকেই ব্যবকার করলো “স্বদেশ” এর “স্বাধীন” নেতা ও তাদের দলগুলি।

এক টুকরো মাছের লোভ, ওই আয়া-জনের, আমার মর্মে এনেদেয় ইন্দির ঠাকরুনের নোনা ফলের লোভের বৃত্তান্ত, তার নাজেহাল হওয়া ভ্রাতৃবধূ সর্বজয়ার কাছে। আবার পরবর্তীতে এই সর্বজয়াকেই দেখি, বড়লোক বাড়িতে কাজ কত্রবার আমলে, ক্ষণে ক্ষণে লোভী হ’তে, নিজের জন্য নাহোক, অপুর জন্য। বুনোলতা’র এই মোবাইল-লোভ, চার্জ-দেওয়া লোভ, এ কি নয়, দুর্গার পুঁতিমালা লোভ? ফোনে কে তাকে দেবে কোন মহার্ঘ্য সম্বাদ? বাস্তবে মোবাইলটি ঘেঁটে, গান, রিল্‌ চালিয়ে, সে নিজেকে ভেবে নেবে “সুখী” বলে, তার আশেপাশের ভদ্রলোক মেয়ে-বৌ’দের মতো বলে। এর মূল্যে সে ভুলে থাকবে তার সমূহ না পাওয়া। এতাবৎ। তার সমূহ না পাওয়া – আমরণ।


 – এই সকল “লোভ” আদতে লোভ নয়। এই সকলই প্রকাশ, জিজীবিষার। অথবা এরাই জিজীবিষা। এটি শনাক্ত করতে না পারলে, অন্তিমে, সব প্রতিরোধ, সব আন্দোলনই ভেঙ্গে যাবে। “আমার মাথা নত করে দাও” – কার কাছে? ঈশ্বর? অনন্ত? শালা, কে ঈশ্বর আর কি অনন্ত? মাথা নত করে দাও ওই সকল জিজীবিষার কাছে। জীবনের কাছে। যাপনের অন্তর্গত দুঃখের কাছে। অন্যথায়, হায়, ফিরে যেতে হয় সেই রবিকবির কাছেইঃ

“যখন তোমায় প্রণাম করি আমি,    প্রণাম আমার কোন্‌খানে যায় থামি,

      তোমার চরণ যেথায় নামে অপমানের তলে

          সেথায় আমার প্রণাম নামে না যে

      সবার পিছে, সবার নীচে, সব-হারাদের মাঝে॥”












ঘুম ঘর