কুভেম্বুর ছায়া ।। ১।।
এইসবে কিবা আসে যায় বর্ষার? কে এখনো বেঁচে আছে, কে মরেছে, কারা মরবে, জন্মাবে কারা আর কারা জন্মাবে না – এইসবে কিবা আসে যায়? বর্ষার? সে এখানে এসেছে, এসে চার হাত-পায়ের থাবাতে আস্তানা গেড়েছে যাতে এক ঋতু থাকতে পারে সদলে, এখানে।
সে এসেছে থাকতে এখানে আকাশে মেঘের তাঁবু, মেঘের খিলান স্তম্ভে সূর্যকে যতোদূরে পারে ঠেলে দিয়ে, আপাত রাত্রির রঙে আকাশকে ঢেকে এক ঋতু বসবাস তার। তাই তার কিবা আসে যায় এই সবে – কে এখনো বেঁচে আছে, কে মরেছে, কারা মরবে, জন্মাবে কারা আর কারা জন্মাবে না …
কালপুরুষ, কাল কারো তোয়াক্কা করেনা। বয়ে যায়, উড়ে যায়, পায়ে হেঁটে পার হয়ে যায় আমূল উদাস। সহ্যাদ্রি পর্বতমালা,অরণ্য ও আরণ্যকে একই ছায়া, একই ছবি, একই উদাস। পাদদেশে যারা বাস করে, তাদের ছোট্ট সুখ, ছোট ছোট শোক দুঃখ থেকে নির্লজ্জ দৃষ্টি ফিরিয়ে তারা মগ্ন থাকে শঙ্কাকূল নিঃশব্দে অটল। তাই তার কাছে, তাই তারা সকলের, প্রত্যেকের কাছে কোনুর, হুভাল্লি কিংবা বেত্তাল্লি,সিম্বাভির মতো বসত, বসতি, তাদের সামন্ত, প্রজা, চাষীবৌ, চাষা – অবান্তর, অনর্থকই হবে, কি আছে চমকেওঠার তাতে?
বালক ধর্মুর শোক মা-বাপ দুজনকেই একত্র খুইয়ে – জোয়ান যুবক ছেলে মুকুন্দাইয়া, যার প্রেমাস্পদা আজ বৃদ্ধ সামন্তের বৌ, তার তুমুল হতাশা – পুলিশের পাতা-ফাঁদ দুঃসাহসে ছিঁড়ে পালানো তরুণ গুত্তি’র সাধ – খোয়া যাওয়া প্রেমিকার সাথে দূরের মানচিত্রে গিয়ে ফিরে ঘর বাঁধবার – নিশ্চিহ্ন হওয়ার যাতনা – পত্নী আক্কানি’র ক্রমে, অসুস্থ পতীর থেকে পয়সাওলা চিঙ্ক্রা’র দিকে স্পষ্ট ঝুঁকে যাওয়া আর সেইহেতু পিজিনার ক্রোধ ও বেদনা – দেবায়ার হাস্যকর দ্বিধা, চেষ্টা পালানোর খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের প্রতিশ্রুতি থেকে — এইসব ছোটো ছোটো কথা কিভাবে, কেন’ই নজরে পড়বে সহ্যাদ্রি পর্বতমালা, পাহাড় অরণ্য আর অতিথি বর্ষার?
পাহাড়! পাহাড়! দেখো, রোমশ দৈত্য যেন, অহং এ উদ্ধ্বত – প্রত্যহ ছিঁড়ে দিতে, ছিঁড়ে দিয়ে আকাশ, নীলিমা, মেধ – রোদ মাখে, বৃষ্টি মাখে, সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা সূচীভেদ্য রাত কুয়াশার – গায়ে মাখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এদেরকে দেখে কারো মনে আসতেই পারে বাঘের ভয়ঙ্কর কিংবা শূকরের শীতল নিষ্ঠুর! বর্ষা! বৃষ্টি! দেখো ঝমঝম, ঝুমঝুম! নির্মম হানা দিচ্ছে হাটে মাঠে দালানে কুটীরে, হানা দিচ্ছে জীবনে, যাপনে!
“ওল্ড হাউস” পরিবারে সম্প্রতি যা ঘটেছে – ঘটনা, দুর্ঘটনা কিংবা অঘটন – অদ্য সেইসকলই তল্লাটে সর্বক্ষণ চর্চার বিষয়। ডোড্ডান্না হেগডের মৃত্যু, স্বেচ্ছামৃত্যু পত্নী রাঙ্গাম্মার – এইসবই দিবারাত্রি ফিসফাসে অথবা সরবে আলোচিত হয়। কখনোবা কাঁদতে কাঁদতে, হাসতে হাসতে পরক্ষণে আলোচনা হয়। আলোচনা হয় ক্ষেতে, আলবাঁধা, নালা কাটা আর বীজ রোয়ার ফুরসতে। তাম্বাকুপাতা মুখে দিতে দিতে, মুখে দিয়ে ফিসফাস ও কলরব হয়। চচ্চা হয় সুপারি বা পান-সুপারী চিবানোর ফাঁকে। মেঘের মলাট ঢাকা ভোরে, মাঠ-কাজে যেতে যেতে, পথে এ সকল অঘটন, ঘটনা বা দুর্ঘটনা নিয়ে বার্তালাপ হয়। কাজ সেড়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরা পথেও আবার একই আলোচনা। এই আলোচনা তারা অক্ষম থামাতে যেনবা। যেনবা এসব কথা তাদের আফিং, তাদের চিরন্তন শান্তিদায়ী জল, যে জলে মিশেছে ভীতি, করুনা, মমতা, প্রেম প্রীতি। তথাপি পাহাড়ে, পথে, খাড়া-নামা খাদে জন্ম হয় নতুন ঘাসের। পোড়ামাড়ি সে’ও ঢাকা পড়ে কালের স্বহাতে রোয়া ঘাসের প্রলেপে। শ্মশান, কবর ক্রমে ভুলে যেতে আগে পূর্বতন দাহ ও গোরের ছবি। যাপনের হাতে এভাবেই ক্রমে দোদ্দান্না হেগড়ে আর রাঙ্গাম্মা হেগডতির আজীব কাহিনী স্মৃতিকথা হয়ে মিশে যায় উপকথা, রূপকথা ভিড়ে।
[ সূত্রঃ Kuvempu. Bride in the Hills, অধ্যায় ৪৫ ]
