‘হঠাৎ কখন অজানা সে’: আমার নিজস্ব সুচিত্রা মিত্র তর্পণ
সপ্তর্ষি বিশ্বাস
সৌজন্যঃ অমিতাভ দেব চৌধুরি, সাময়িক প্রসঙ্গ, শিলচর
সৌজন্যঃ অমিতাভ দেব চৌধুরি, সাময়িক প্রসঙ্গ, শিলচর
১।
এ’ও ঠিক যে এক সময় তাঁকে দিতে হয়েছে নাকচ করে...এক সময় তাঁর গায়নে আর সাড়া দেয়নি প্রাণ। তৎসঙ্গে এ’ও কি ঠিক নয় যে রবীন্দ্রনাথের অনেক অনেক গানের সঙ্গে আমার, আমাদের প্রথম পরিচয় তাঁরি কন্ঠের স্বরে,সুরে ... আর সেই পরিচয়ই কি প্রাথমিক ভাবে নির্মাণ করেনি সেই সাঁকোর ইঙ্গিত যা পার হয়ে , ক্রমে, আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে শান্তিদেবের সঙ্গে, দিনু ঠাকুর বা শৈলজারঞ্জণের সঙ্গে? মনেপড়ে সেই গানগুলি প্রথমবার শোনার অভিজ্ঞতা ... ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি...’, ‘খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে ...’ বা ‘আমার মল্লিকাবনে ...’ আসামের প্রত্যন্ত মফস্বলে, সেই ১৯৮৭-৮৮ সালে সেই শোনা অবশ্যই সুচিত্রা মিত্রের কন্ঠে...
রবীন্দ্রগান শোনা আমার আরম্ভ হয় ১৯৮৫-৮৬ সাল নাগাদ, যখন আমি ছাত্র ক্লাস সিক্স বা সেভেনের। মূলতঃ শিলচর রেডিও ষ্টেশান থেকে প্রচারিত দুপুর ১টা বেজে ১০ মিনিটে ‘গ্রামোফোন রেকর্ডে রবীন্দ্রসংগীত’ শোনানোর অনুষ্ঠান শুনে শুনেই। হেমন্ত-সাগর-চিন্ময়-সুচিত্রা-কণিকা ইত্যাদি ‘হিট্’ শিল্পীদের গানই সেখানে বাজতো বেশী। জনপ্রিয় হলেও কোনো কারনে দেবব্রত’র গান তেমনটা ঐ অনুষ্ঠানে শুনেছি বলে মনে পড়েনা। এখন মনেহয় হয়তো পর্যাপ্ত সংগ্রহ ছিলোনা তাদের। মনেপড়ে হেমন্ত’র কন্ঠে ‘আমার ব্যথা যখন আনে আমায় তোমার দ্বারে’, ‘আমার ভাঙ্গা পথের রাঙ্গা ধূলায় পরেছে কার পায়ের চিহ্ন’, সাগর সেনের ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’, ‘আমার থাকতে দে’না আপনমনে’ বা চিন্ময়ের গলায় ‘ভালবেসে সখী নিভৃত যতনে’, ‘মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে’ ইত্যাদি গানগুলি ... আমার সেই প্রথম ভালোলাগা রবীন্দ্রগান ... বোঝা না বোঝার আলো আঁধারির কোথাও বেজে যেতো গানগুলি কাঠের আলমারির উপরে রাখা ফিলিপ্স্ কোম্পানীর রেডিওতে আর একটা মোড়ার উপরে দাঁড়িয়ে সমান সমান হয়ে সেই আলমারির উচ্চতার শুনেযেতাম গানগুলি ... তাকিয়ে থাকতাম জানালা দিয়ে ... সামনের রাস্তায় ... সেইসব গ্রীষ্মের ছুটির দুপুরে ...
মা’র ছিল একটি গীতবিতান। সেই কলকাতায় থেকে এম.এ পড়ার সময় কিনেছিল মা। পেছনে লেখা মূল্য ৮.০০ টাকা মাত্র... সেই গীতবিতান খুলে খুলে খুঁজে নিতাম গানের কথাগুলি ... তবুও কি বুঝতাম কিছু? বুঝতাম না’ই বা বলি কি’করে? নাহলে ঠিক কিসের টানে সকাল থেকে অপেক্ষায় থাকতাম দুপুর ১টা বেজে ১০ মিনিটের সেই অনুষ্ঠানের? নাহলে কিসের টানে ঘন্টার পরে ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম গীতবিতানের পাতায় পাতায়?
পরে একটি ব্যাটারী চালিত রেডিও এলো দখলে। তখন রাতেও শোনাযেতে লাগলো গান ... অনুরোধের আসর খুঁজে খুঁজে ... রেডিও শিলিগুড়ি, রেডিও বাংলাদেশ ঢাকা ... নূতন নূতন নাম নূতন নূতন কন্ঠ ... কলিম শরাফী, সন্জীদা খাতুন, কাদেরী কিব্রিয়া ... ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’, ‘দাঁড়াও আমার আঁখির আগে’, ‘আজি বিজন ঘরে নিশীথ রাতে ...’ ... রেডিও বাংলাদেশ ঢাকা ভাবলেই মনেপড়ে ঐ গানগুলি আর ঐ শিল্পীজনেরা ... রেডিও শিলিগুড়ি তে শুনেছিলাম পংকজ মল্লিক প্রথম, সুবিনয় রায় প্রথম... সুবিনয় রায়ের কন্ঠ গেঁথে গিয়েছিল মর্মে, প্রায় প্রথমবার শুনেই... আর মূল কারন এই যে, শিবেন্দ্র চক্রবর্তী, বাবা যাঁকে ‘দাদু’ বলতো,আমরা যাঁকে ‘বাবু’ বলতাম, যিনি আমার ঠাকুর্দার সম্পর্কিত মামা ছিলেন মূলতঃ, ছিলেন আমার ঠাকুর্দারি সমবয়সী... যাঁর হাতে মানুষ হয়েছে আমার আবাল্য পিতৃহীন বাবা ... যাঁর কাছে কেটেছে আমার শৈশব সেই বাবু’ও ছিলেন সঙ্গীত শিল্পী। সঙ্গীত শিক্ষক। তবে জীবনের শেষ কয়েকটি বৎসর আর গাইতে পারেননি তিনি ... পক্ষাঘাতে হয়েগিয়েছিলেন বাক্রুদ্ধ ... বাবুর কন্ঠের সঙ্গে, গায়কীর সঙ্গে অদ্ভুত সাদৃশ্য ছিল সুবিনয় রায়ের কন্ঠের, গায়কীর ... মনেপড়ে ‘যদি এ আমার হৃদয় দুয়ার বন্ধ রহে গো প্রভু’ ... মনেপড়ে ‘লিখন তোমার ধূলায় হয়েছে ধূলি ...’
মর্মে আলাদা করে সুচিত্রাকে চিনে নেওয়ার রাতটি মনেপড়ে। চৈত্র বা বৈশাখের রাত। কাল বৈশাখীতে উল্টে গেছে ইলেকট্রিকের পোষ্ট, উপ্রে গেছে গাছপালা ... স্থানে স্থানে ... ফলতঃ বিজলী নেই শহরে। আকাশ প্রস্তুতি নিচ্ছে আরেক পশলা বর্ষণের। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করছি মা’র ডাকের ‘খেতে আয়্ ... রান্নাঘরে আয় ...’ আর ব্যাটারী চালিত রেডিওর নব্ ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে খুঁজে চলেছি রবীন্দ্রগান ... যদিও বৃষ্টি বাদ্লার রাত তবুও গরম। তাই জানালা দুটোই খোলা। সেই খোলা জানালা দিয়ে চোখ দেখছে অন্ধকার আর আঙ্গুল খুঁজে চলেছে গান রেডিওর নব্ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ... এমন সময়ই শোনাগেলো সেইগান ...ইথার তরঙ্গে ভেসেআসা ... তবে বৃষ্টিতে, মেঘে বেঁকে আসছিল সুর, দূরে সরে যাচ্ছিল সুর ... তথাপি গানের কথাগুলি আর তার আড়ালে এক আকূল কন্ঠ আমার গহনে পেতে চাইছিল কেজানে ঠিক কোন অপরূপ অবয়ব...
পরে আবিষ্কার করেছি ঐ গানের ওই রেকর্ডিং ৭০ এর দশকের অর্থাৎ যখনো সুচিত্রা গাইতেন গলাখুলে ... গাইতেন সেই মেঠো ঢঙ্গে – মেঠো ঢঙ্গ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের, দিনু ঠাকুরের, শান্তিদেবের ... তখনো সুচিত্রা অগ্রগণ্যা হয়ে পরেননি ‘ড্রইংরুম্ রবীন্দ্রসঙ্গীতের’ ...
ওই গাওয়া সেই আমলের। সেই সুচিত্রার ... সেই গান ‘ সকল জনম ভ’রে ও মোর দরদীয়া ...’
২।
আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতো রাজাদা। সে’ও আরেক গান পাগল মানুষ। আমার চেয়ে বয়সে বছর পাঁচের বড়ো।মনেআছে একদিন কোথায় যেন যাচ্ছিলাম রাজাদা’র সঙ্গে। ক্লাস নাইন টেনে পড়ি তখন। রাজাদা পড়ে ইঞ্জিনীয়ারিং। হোস্টেলে থাকে। হপ্তায় দু’ হপ্তায় আসে বাড়িতে। তেমনি এসেছে একবার।সম্ভবতঃ গ্রীষ্মকাল কেননা ঘাম হচ্ছিল খুব। চলতে চলতে হঠাৎই দাঁড়িয়ে পরলো রাজাদা।
‘গানটা শুনছিস্...’
ভরাট কন্ঠের একটা সুর ভেসে আসছিল ঠিকই। কানখাড়া করে শুনে মনেহলো রাগাশ্রয়ী বাংলা গান।
রাজাদা বল্লো ‘অখিল বন্ধু ঘোষ!’ তারপরই সটান ঢুকে পরলো যে বাড়িথেকে গানটা ভেসে আসছে বলে মনে হচ্ছিল সেই বাড়িতে।
‘কাকে চাই?’
দরজা খুলে দাঁড়ালেন এক সৌম্যকান্তি বৃদ্ধ।
‘গান শুনতে এসেছি ...’ বল্লো রাজাদা।বৃদ্ধের ঠোঁটে খেলেগেলো হালকা হাসির রেখা। বললেন ‘এসো’...
গান বাজছে হিস্ মাস্টার্স্ ভয়েসের রেকর্ড প্লেয়ারে। শ্রোতা আমরা তিনজন। বিপত্নীক বৃদ্ধ সারাদিন বাড়িতে থাকেন একা। পুত্র-পুত্রবধূ উভয়েই চাকুরে। নাতিটি যায় ইস্কুলে। গানে গানে ভেসেযায় বৃদ্ধের সারাদিন ...
সেই গান রেকর্ড করে আনলো রাজাদা। যেহেতু রেকর্ড প্লেয়ার নেই, যেহেতু বাজাতে হবে ক্যাসেট প্লেয়ারে তা’ই ক্যাসেটেই টেপ্ করাহলো গানগুলি । সেই রেকর্ডিঙ্গের যে প্রযুক্তি ও প্রয়োগ সে আরেক ব্যাখ্যান ...
সেই রাজাদা ছিল সুচিত্রা মিত্রের আরেক মুগ্ধ শ্রোতা।হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে সে মাসে অন্ততঃ একটা ক্যাসেট কিনতো।কিনতাম আমিও। তখন আমারো হাতের আওতায় এসেছে একটি ফিলিপ্স্’এর টেপ রেকর্ডার। তবে আমার সমস্যা ছিল আমাদের শহর করিমগঞ্জের তুলনায় রাজাদা’র হোস্টেলের শহর শিলচরে ক্যাসেটের দোকান ও আমদানী ঢের বেশী।ফলে রাজাদাকে চম্কে দেওয়ার মতো ক্যাসেট কেনার আমার পরিকল্পনা কদাপি হলোইনা আর কার্য্যকারী ... রাজাদা’র সংগ্রহ করা সুচিত্রা মিত্রের ক্যাসেটে শোনা গানগুলির মধ্যে মনেপড়ে ‘ক্ষত যতো ক্ষতি ততো ... মিছে হতে মিছে ... নিমেষের কুশাংকুর ...পরেরবে নীচে ...’ ... মনেপড়ে ‘পান্থ তুমি পান্থ জনের সখা হে...’, ‘আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে’ , ‘যতোখন তুমি আমায় বসিয়ে রাখো বাহির বাটে ...’
রবীন্দ্রনাথের দর্শণের গভীর, গভীরতর উন্মোচনের পথে মানস যাত্রার সেই ছিল ঊষালগ্ন। গীতবিতানের পাতায় গানগুলির প্রতিটি শব্দ, বাক্য আর সুচিত্রার কন্ঠে তাদের উচ্চারণ আমার সেদিনের বয়ঃসন্ধির ‘আমি’কে যেন দেখিয়ে দিয়েছিল এক নূতন দিগন্ত ... যে দিগন্তের দিকে আমার অন্তর্গত যাত্রা অদ্যাবধি...যেমন এই গানটিঃ
আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে
দিনের কর্ম আনিনু তোমার বিচার ঘরে
যদি পূজা করি মিছা দেবতার, শিরে ধরি যদি মিথ্যা আচার,
যদি পাপমনে করি অবিচার কাহারো পরে
আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে
লোভে যদি কারে দিয়ে থাকি দুখ ভয়ে হয়ে থাকি ধর্ম বিমুখ
পরের পীড়ায় পেয়েথাকি সুখ ক্ষণেক তরে
তুমি যে জীবন দিয়েছো আমার কলংক যদি দিয়েথাকি তায়
আপনি বিনাশ কর আপনায় মোহের ভরে
আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে।।
কোনো গভীর মেটাফিজিস্কের ইংগিত হয়তো পেয়েছিলাম মনের কোথাও তবে তারো আগে এইগান আমার কাছে প্রথম সুষ্পষ্ট করে দিয়েছিল ভালো আর মন্দের সীমারেখা ... গর্হিত কার্যের একটি পরিষ্কার তালিকা পেয়েছিলাম সেদিন ...
যদি পূজা করি মিছা দেবতার, শিরে ধরি যদি মিথ্যা আচার,
যদি পাপমনে করি অবিচার কাহারো পরে
লোভে যদি কারে দিয়ে থাকি দুখ ভয়ে হয়ে থাকি ধর্ম বিমুখ
পরের পীড়ায় পেয়েথাকি সুখ ক্ষণেক তরে
তুমি যে জীবন দিয়েছো আমার কলংক যদি দিয়েথাকি তায়
আপনি বিনাশ কর আপনায় মোহের ভরে
তখন বা এখনো যে উপরি উল্লিখিত গর্হিত কার্য্যগুলি থেকে সতত বিরত থাকতে পেরেছি এমন দাবী করবার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারেনা। তবে যখনি ঐ কার্য্যগুলি সংঘটিত হয়েছে আমাদ্বারা আমি মনে মনে জেনেছি আমি হেরেযাচ্ছি, আমি সড়েযাচ্ছি আমার প্রকৃত পথথেকে ... সেই প্রথম জানলাম দেবতা’ও মিছা হয় আর মিছা দেবতাকে পূজা করা অপরাধ ... জানলাম মিথ্যা আচারের কথা ... তাই শেষ পর্যন্ত কাগজে-কলমে যেমন মানতে পারলাম না তথাকথিত আধুনিকতাকে বা উত্তর-আধুনিকতাকে তেমনি চলতে পারলাম না মার্ক্সবাদী আচারের ফ্যাশনধন্য পথে... রবীন্দ্রসাহিত্যে এই কথাগুলি ঘুরেফিরে এসেছে বারবার। এসেছে নানা অনুষঙ্গে। তথাপি যেহেতু সে’ই আমার প্রথম শোনা, আমার প্রথম অনুভব তাই তার কাছে আমার যাওয়া ফিরেফিরে ...বারেবারে ... আর ঐ যাওয়ায় আশি’র দশকের শেষের সুচিত্রা বা আরো পরের সুচিত্রা না থাকলেও ঐ সুচিত্রা অবশ্যই গিয়েছেন রয়ে যাঁর কন্ঠে আমি শুনেছিলাম সেই কথাগুলি ... প্রথমবার ...
৩।
আরেকটি দিনের কথা মনেপড়ে। সে’ও সেই বয়ঃসন্ধির সময়েরি। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েগেছে। সঙ্গীসাথী যারা ছিল সবাই মিলে গিয়েছে বেড়াতে। আমার অনুমতি মেলেনি। ফলে আমি বাড়িতে। একা। যেন আমি এই শহরেই একা। রাজাদারো কিযেন পরীক্ষা সামনে। তাই বাড়িআসা হয়না তারো। আমার সঙ্গী বলতে বই আর গান। মাঝে মাঝে বেড়িয়ে যাই। সাইকেলে চেপে চক্কড় লাগিয়ে আসি শহরে। সেই চক্কড়ে একাকীত্ব বাড়ে বৈ কমেনা ...
এরিমধ্যে এসেগেলো বর্ষাকাল। তুমুল বৃষ্টিবাদল। সেদিন সকাল থেকেই মন ভালো লাগছিল না। তখন কি আর জানতাম যে ঐ অকারণ মনখারাপ বয়ঃসন্ধিরই আরেক লক্ষণ? বিভূতি রচনাবলী নিলাম। মন বসলোনা। নিলাম পরশুরাম। ভাল্লাগলোনা।আগাথা ক্রিস্টিতেও তাই ...ভাবলাম সাইকেলে চেপে একটা চক্কড় মেরেএলে ... কোনো গলীঘুঁজিতে লুকিয়ে একটা দুটো সিগারেট টেনেএলে হয়তো ঠিক হবে মন মেজাজ ... তখনি তোড়ে নামলো বৃষ্টি ...
দুপুরের দিক। বৃষ্টি ধরেছে ঠিক। তবে থামেনি। এদিকে চলেগেছে কারেন্ট। নাহলে টেপ রেকর্ডারটা চালিয়ে গান শোনাযেতো আর নাহলে টিভিটা খুলে অন্ততঃ দেখাযেতো কি চলছে ... অগত্যা সেই প্রায় ভুলেযাওয়া ব্যাটারী চালিত রেডিওর শরণ নিতে হলো ... সেটাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বসলাম আমাদের বসবার ঘরে। সারাবাড়িতে ঐ কোঠাটিতেই শুধু দুটো কাঁচের জানালা আছে ... বাকী সমস্ত কোঠার জানালা দরজা বন্ধ। বৃষ্টির ছাঁট ঢোকে ...
বাইরের কোঠার কাঁচের জানালার পর্দা সড়িয়ে গিয়ে বসলাম একটা চেয়ারে। বাইরে তখনো বৃষ্টি। জানালার কাছে ছোটো ছোটো ফুলগাছের বৃষ্টিভেজা মাথা ... আকাশে মেঘ ... ব্যাটারী চালিত সেই রেডিওর নব ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে খুঁজছি যদি পাওয়া যায় শোনার মতন কিছু ... এই ষ্টেশনে যদি চলছে অতি খেজুড়ে আধুনিক গান তো অন্যটাতে কোন অচেনা ভাষায় খবর ...ভাবছি এটাও বন্ধকরে এবার গিয়ে শুয়েই পরবো ... ঠিক তখন ... হ্যাঁ ঠিক তখনি শুনলাম ... কোন ষ্টেশন বোঝাগেলোনা তবে শুনলাম ... আসরের শেষ শিল্পী সুচিত্রা মিত্র ... অনুরোধ আপনাদের আজিমগঞ্জ থেকে শেফালী, গীতালি ... ইত্যাদি ইত্যাদি ... টেপ রেকর্ডার আসার পরথেকে রেডিওর সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় ছিলোনা বললেই চলে তাই ঠিক ধরতে পারলাম না কোন ষ্টেশন ... আর তখনি বেজে উঠলো গানটি ... পরে ঐ গান শুনেছি বহুবার দেবব্রত বিশ্বাসের কন্ঠে ... ভালোও লেগেছে খুব ... তথাপি ঐ দিনের ঐ শোনাটি আমার চির কৃতজ্ঞ হয়েআছে সুচিত্রা মিত্র’র কাছেই ...
যেন আমার সেই বাদলা দিনের মনখারাপই সুরের অবয়ব পেলো তাঁর সেদিনের সেই কন্ঠে, সেই গানেঃ
‘এই শ্রাবণ-বেলা বাদলঝরা যূথীবনের গন্ধে ভরা ...’
একটু দ্রুতলয়ে দেবব্রত গেয়েছেন গানটা। সুচিত্রা গেয়েছেন অতি ধীরলয়ে ... হায় সেদিন আমার মন ঐ গানের ঐ ধীর লয়টিতেই পেয়েছিল আশ্রয়, পেয়েগেলো আশ্রয় ... অন্তরায় এসে সুচিত্রা গাইলেনঃ
‘হঠাৎ কখন অজানা সে আসবে আমার দ্বারের পাশে
বাদল সাঁঝের আঁধার মাঝে গান গাবে প্রাণ পাগল করা
এই শ্রাবণ-বেলা বাদলঝরা যূথীবনের গন্ধে ভরা ...’
গান থামলো। শেষহলো অনুরোধের আসর। কোন ষ্টেশন জানার ইচ্ছা হলোনা। বন্ধ করেদিলাম রেডিও কারন তখন আমার মনেপ্রাণে বেজেউঠেছে সেই অন্তহীন প্রতীক্ষা যার শেষে ‘হঠাৎ কখন অজানা সে আসবে আমার দ্বারের পাশে ... বাদল সাঁঝের আঁধার মাঝে গান গাবে প্রাণ পাগল করা ...’
তারপর জীবনে এসেছে গেছে আরো আরো বর্ষার দিন, বর্ষার রাত ... শুনেছি রবীন্দ্রনাথের আরো আরো বর্ষার গান ... শুনেছি অনেকের কন্ঠে ... শুনেছি সুচিত্রার কন্ঠেও তথাপি ঐ একটি বর্ষার দুপুর, তার আনন্দ ও বিষাদ ঘিরে আজো বেজে চলেছেন সুচিত্রা মিত্র। সুচিত্রা মিত্র’ই শুধু ...
০৯/০১/২০১১
বেঙ্গালোর