প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Friday, May 20, 2011

‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব...’ - স্মরণ বাদল সরকার


‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব...’ - স্মরণ  বাদল সরকার
১।
পরিষ্কার মনে আছে মঞ্চে কি একটা গান হচ্ছিল আর অডিটোরিয়ামের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি দ্রুত টেনে শেষ করছিলাম সেদিনকার অসংখ্য নম্বর চারমিনারটা। এমন সময় শোনাগেলো শ্যামাদা’র গলা ‘ এই দ্যাখ্‌ তো বাদলদা’র কি লাগে...’ ফিরে তাকিয়ে দেখি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন বাদল সরকার ... সেই বাদল সরকার ‘পাগলা ঘোড়া’ যাঁর রচনা! যাঁর রচনা ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ ... যাঁর রচনা, বলতে গেলে, পথে পথে নাটক করে বেড়ানোর এই পাগলামিটা’ই ...
          সে হবে ১৯৯২-৯৩ সাল ... যদিও আসামের এক প্রত্যন্ত মফস্বল তথাপিও সেখানেও তখন কমতি ছিলনা আমাহেন জীন্‌স্‌, পাঞ্জাবী, হাওয়াই চপ্পল আর চারমিনার শোভিত যুবকের যারা সত্যিই ভাবতো ৭০ এর দশককে তারা ফিরিয়ে আনবেই ... আর ছিল শ্যামাদা,মন্দিরাদিহেন দাদাদিদিরা যারা নিজেদের জীবনের সর্বস্ব দিয়ে রসদ জোগাতো আমাদের ঐ স্বপ্নে ... তেমনি কিছু দাদা-দিদিদের উৎসাহে হয়েছিল এক সংস্থা, নাম ছিল ‘ঐকতান’ ... যেহেতু দাদাদিদি এবং আমরাও গোগ্রাসে গিলেছিলাম চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ইতিহাস এবং চারুবাবু ফলে ঐ সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল দ্বিমুখীঃ বাইরে থেকে এটা হলো ‘গণফ্রন্ট’ অর্থাৎ ‘কেমোফ্লেজ’ আর অন্দরে সসস্ত্র বিপ্লবের প্রস্তুতির কারখানা ...
          সেই ‘ঐকতান’এই একবার স্থির হলো ‘তৃতীয় ধারা’র নাট্যোৎসব হবে। সঙ্গে আরো কিছু অনুষ্ঠান, সেমিনার ইত্যাদি... সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হলেন বাদল সরকার! আমরা, নাটক পাগলেরা দিন গুনতে লাগলাম উৎসাহে!

সে হবে ১৯৯২-৯৩ সাল, তখনো আমাদের ঘরে ঘরে টেলিভিশান হানা দিলেও রেডিও চালিয়ে নানান ষ্টেশান থেকে প্রচারিত নাটক শোনার লোকও ছিল কিছু ... সে ভাবেই শোনা ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ আর ‘পাগলা ঘোড়া’ ... বাদল সরকারের প্রযোজনার নকলে একদল ‘ল্যোকাল নাটুকে’ও মঞ্চস্থ করেছিলেন ‘পাগলা ঘোড়া’ আর তা ‘পাগলা  ঘোড়া’র মফস্বলি সংস্করনই হয়েছিল বটে ...
সে হবে ১৯৯২-৯৩ সাল, তখনো ইন্টারনেট নেই, নেই ‘গুগুল্‌’ তথাপি জেনেছিলাম বাদল সরকার পেশায় ছিলেন সফল আর্কিটেক্ট, জেনেছিলাম সেই রমরমে জীবিকা ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে নাটকের টানে তিনি নেমে ছিলেন রাস্তায় ...আমি ব্যক্তিগত ভাবে ঐ সব ছেড়েছুড়ে রাস্তায় নামার ব্যাপারটা তাঁর নাটকের চেয়েও আমাকে বেশী আকর্ষন করেছিল। আজো করে ...
জানতাম বাদল সরকার আমন্ত্রিত, জানতাম তিনি আসছেন তথাপি এভাবে, করিমগঞ্জ কলেজের অডিটরিয়ামের  পাশের আধো অন্ধকার বারান্দায়, রাত্রি প্রায় দশটায় তাঁর সঙ্গে হবে আমার প্রথম সাক্ষাৎ তা’কি কল্পনাও করেছিলাম কখনোও? যদিও ‘ফর্‌ নিউ ডেমোক্রেসি’ আর ‘অণীক’ পড়ে পড়ে চেষ্টা চালাচ্ছিলাম আপাদমস্তক ‘ডিক্লাসড্‌’ হওয়ার তবু কিভাবে যে তাঁকে দেখামাত্র মাথা নুয়ে গেলো, হাত চলেগেলো তাঁর পায়ের দিকে জানিনা! তিনি হাত ধরে নিবৃত্ত করলেন আমাকে। একটু সামলে নিয়ে বললাম ‘ কখন এলেন?’ বললেন ‘একটু আগে। বসে বসে অনুষ্ঠান দেখছিলাম ...আচ্ছা এখানে সিগারেট কোথায় পাই বলুন তো?’ বাদল সরকার আমাকে ‘আপনি’ বলছেন! আমার দশা মরমে মরে যাওয়ার ... বললাম ‘আমার কাছেই আছে... নিন্‌ না ...’ মেলে ধরলাম আমার চারমিনারের সম্ভার। একটা তুলে নিয়ে জ্বালিয়ে বললেন ‘ চারমিনার আপনাদের বয়সে খেয়েছি দেদার ...এখন পারিনা ... একটা দোকান খুঁজে ফিল্টার উইল্‌স্‌ পাওয়া যাবে? এখন তো অনেক রাত হয়েগেছে ...’ আমি বললাম ‘নিশ্চয় যাবে, কেন যাবেনা ... আপনি বসুন, আমি এক্ষুনি গিয়ে নিয়ে আসছি ...’ বাদল সরকার বললেন ‘ না না, আমিও আপনার সঙ্গে যাবো ... নতুন জায়গায় আমার ঘুরে বেড়াতে খুব ভালো লাগে ...’
তাঁকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে এলাম কলেজ চত্ত্বর ছেড়ে। রাস্তার ও পারেই দু দুটো সিনেমা হল্‌। শ্রীরাধা আর শ্রীদুর্গা।  শ্রীরাধা’র ভেতরে দোকান দেয় শামুদা। হিট্‌ ফিল্ম লাগলে চালায় টিকিটের ‘পাঁচ কা দশ’ ও তবে আমাদের মতো দুয়েকজন ‘প্রকৃত ডিক্লাস্‌ড্‌’ কে সে ফ্রীতে টিকিট দেয়। দেয় ধারে সিগারেট ...তখন রাত্রি ১১টা পেরিয়ে গেছে। শামুদা’র ঝাঁপ বন্ধ। তবে আমি জানি শামুদা ভেতরে আছে। আরো ঘন্টা খানেক থাকবে। শেষ করবে, একা একা, তার দুই বোতল চোলাই ...তারপর যাবে ...
শামুদা’দে ডেকে ডুকে জোগাড় হলো সিগারেট। নিজের দুই প্যাকেট উইল্‌স্‌ ফিল্টারের সঙ্গে আমাকেও উপহার দিলেন এক প্যাকেট চারমিনার। তারপর বললেনঃ ওদের কাজ কম্মো শেষ হতে এখনো বিস্তর দেরী ... একটু হেঁটে আসবেন ? ‘  
আসবোনা মানে? সঙ্গে সঙ্গে বললামঃ চলুন ...

২।

মফস্বলের সেই রাত ১১টা মনেপড়ে। মনেপড়ে তাঁর পাশে পাশে হেঁটে যাওয়া। মনেপড়ে আলোহীন মফস্বলের পাঁজর ভাঙ্গা রাস্তা। মনেপড়ে সেই উত্তেজনা, উদ্দীপনা বাদল সরকারহেন এক পার্ব্বত্য ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পাশাপাশি হেঁটে যাওয়ার ... যা মনেপড়েনা তা হলো ঠিক কি কথা, কি কি কথা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে ... যতোদূর মনেহয় তাঁর নাটকগুলি ঘিরে আমার মুগ্ধতার কথাই বলে যাচ্ছিলাম অনর্গল ... বলতে বলতে এ’ও বলেছিলাম, যে, ‘তাঁর হট্টমালার ওপারে’ কে আমার খুব দূর্ব্বল কাজ বলে মনে হয় ( আজো মনেহয় ) ... সম্ভবতঃ উত্তরে তিনি বলেছিলেন ‘ এই লেখাটারো একটা পার্পাস্‌ আছে ... সেটা ভেবে দেখবেন ...’
তারপর অনেক দিন, অনেক রাত চলে গেছে। তেমন করে না ভাবলেও ক্রমে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘হট্টমালার ওপারে’র পার্পাস্‌ আমার কাছে ষ্পষ্ট হয়েছে বহুদূর তথাপি ‘এবং ইদ্রজিৎ’, ‘বাসি খবর’, ‘যদি আরেকবার’ ,‘বাকি ইতিহাস’ বা ‘পাগলা ঘোড়া’র পাসাপাশি তাঁর ঐ রচনাটিকে স্থান দিতে পারিনি অদ্যাপি ...
এমনি এলোমেলো কথায় এক চক্কড় ঘুরে আমরা ফিরে এলাম কলেজ চত্ত্বরে। পুনরায়।

৩।
অনুষ্ঠানের শেষ দিন তাঁকে বলা হল বক্তব্য রাখতে। বাদল সরকার বললেনঃ বক্তব্য আর কি রাখবো, বরং আমার নাটুকে জীবনের কিছু কিছু অভিজ্ঞতার কথা আপনাদের বলি আর আপনারাও বলুন আপনাদের অভিজ্ঞতার কথা...’
অভিজ্ঞতার সেই সমস্ত কথাগুলি কে যেন ধরে রেখেছিলেন টেপ্‌ রেকর্ডারে, পরে সম্ভবতঃ কোথাও ছাপাও হয়েছিল এগুলি। এতো বছরের দূরত্বে সে সব আর মনে পড়েনা আজ ... মনেপড়ে শুধু একটি ঘটনার কথাই ... সে টা বোধহয় পুরুলিয়ার দিকে কোথাও ঘটেছিল ... দল নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে নাটক করে বেড়াচ্ছেন বাদল সরকার তখন। এভাবে দুটো গ্রাম পারিয়ে আসার পর তাঁরা লক্ষ্য করলেন এক বুড়ি, প্রায় ভিখারী শ্রেণীর, তাঁদের দলের পিছু পিছু যায় আর দর্শকের আসনে বসে দেখে নাটকগুলি ... একই নাটক হয়তো তবু দেখে আর সে দেখার মূল্যে সে পায়ে হেঁটে চলেযায় তাঁদের পিছু পিছু ...
বাদল সরকার ডেকে আনলেন সেই বুড়িকে। দলের সঙ্গে বসিয়ে খাওয়ালেন... সে’ও হয়ে উঠলো, অন্ততঃ সেই সফরে তাঁদের দলেরি একজন ... পরে একদিন তাকে না’কি প্রশ্ন করেছিলেন বাদল সরকারঃ ‘আপনি এতো পরিশ্রম করে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুড়ে বেড়ান কেন ...’ বুড়ি না’কি বলেছিল ‘ ভালো লাগে ...’
   ঐ গল্পে এসে আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম সেদিনো, আজো যাই কেননা আমার মনেপড়েযায় আরেক নাটক পাগলকে যার নাম ভৃগু, যে ঋত্বিকের ‘কোমল গান্ধার’ ছবির নায়ক ... যার অভিনয়ে অভিভূত হয়ে জমির লড়াইএ সব হারানো বৃদ্ধা ভৃগুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন জমির লড়াইএ নিহত তাঁর একমাত্র ছেলের শেষ স্মৃতি চিহ্ন ...
    ভাবি বাদল সরকার আর তাঁর ঐ পথে চলা নাটক কোন স্মৃতি, কোন মায়া, কোন আশা, কোন হাহাকারকে প্রাঞ্জল করেছিল সেই বুড়ি ভিখারিনীর মনে ... ভাবি নাটক তো লিখেন, করেন, লিখবেন, করবেন আরো অনেকেই ... কিন্তু আবার কবে কার নাটকে সেই বুড়ি ভিখারিনীর  আপনাকে খুঁজে পাবে প্রকৃতই ... পাবে কী কোনোদিন?  নাটক তো লিখেন, করেন, লিখবেন, করবেন আরো অনেকেই ... কিন্তু আবার কবে বাদল সরকারহেন আরেক পর্ব্বতপ্রমাণ ব্যক্তিত্ব এসে দেখিয়ে দিয়ে যাবেন, যে, শুধু নাটককে ভালোবেসে কি করে পথে নামাযায় জীবিকার, যাপনের সমূহ প্রলোভন কে অস্বীকার করে ...
১৩ মে ২০১১ দিনে বাদল সরকার এর মৃত্যু হলো ... ভাবি, মৃত্যু হলো কি? আমাদের এই ‘যমেও নেয়না’ জীবনের বহিরাকাশে তিনি কি থেকে গেলেননা আমরন পথিকত্বের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে? ...
২০/৫/২০১১

ঘুম ঘর