সেইসব ‘নাটকেরা’: হুমায়ুন ফরিদি স্মরণে ...
টেলিভিশন তখন অনেকের বাড়িতেই এসে গেছে। কিন্তু সমস্যা দ্রষ্টব্য নিয়ে। আসামের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে দিল্লী’র অনুষ্ঠান গুলিকে এন্টিনা বন্দী করা যেতোনা তখন। বরং যেহেতু নদী পার হলেই বাংলাদেশ তাই বাংলাদেশের জাতিয় অনুষ্ঠান গুলি ধরা দিতো সহজেই। ছবির কোয়ালিটিও ছিল ঝক্ঝকে। ফলে টেলিভিশনে একমাত্র দ্রষ্টব্য ছিল ঐ বাংলাদেশ টেলিভিশনই। প্রেসিডেন্ট এরশাদের আমল ছিল সেটা। প্রোগ্রামের ফাঁকে ফাঁকে ফাঁকে, সংবাদের সিংহভাগ সময় জুড়ে এরশাদের বাণী ও চেহারা প্রচারিত হতে বলে এ’কে বলা হতো ‘এরশাদ-দর্শন’ও ...
আমাদের পাড়ায় টেলিভিশনওয়ালা চার পাঁচটি বাড়ির মধ্যে যেগুলোতে আমাদের যাতায়াত ছিল তাদের মধ্যে ছিল মিত্রাদি’দের বাড়ি আর জ্ঞানশর্মা’জেঠুদের বাড়ি ... আমরা শুধু নয়, আরো অনেকেই গিয়ে জুটতো ঐ সব টিভি ওয়ালা বাড়িতে। এতে গর্বে গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রী’র বুক যে কিছুটা ফুলে উঠতো তা প্রায়ই বেরিয়ে পরতো তাদের কথা বার্তায় ... ‘ও আপনি অমুকের বাড়িতে যান বুঝি ... আচ্ছা ... ওদের বাড়ির পাশে’ত বাঁশ ঝাড়, সিগন্যাল আসে? ...’ বা ‘ও, ওদের বাড়ির টিভি’টা আরো কি কোম্পানীর, আমাদেরটা ত ‘পেনোরামা’ ...’ এহেন বাক্যালাপে টিভিওয়ালাদের নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতাটা’ও বোঝা যেতো স্পষ্ট ...
কিন্তু টিভিতে ঠিক কি দেখার আকর্ষনে গিয়ে হাজির হতো সবাই? আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা? কিসের টানে গিয়ে হাজির হতাম আমি? বয়ঃসন্ধির চৌকাঠে পা রাখা এক সদ্য কিশোর? হাজির হতাম কয়েকটি মুখের টানে, তাদের অভিনয়ের টানে ... হাজির হতাম সেই ভাষার টানে যে ভাষা ‘কেলু’ বা ‘কইলকাত্তাইয়া শুদ্ধ বাংলা’ নয় ... যে ভাষায় মিশে আছেন লালন, হাসন্ রাজা ... মিশে আছে আমার পিতামহ – প্রপিতামহ – মাতামহ – প্রাচীন মাতামহের স্বর, সুর ... যে ভাষায় চট্টোপাধ্যায় কে চাটুজ্জে, বন্দ্যোপাধ্যায় কে বাড়ুজ্জে বলে ছেঁটে না ফেলে বরং নরেশকে ‘নরেশ্যা’, ‘অমল’ কে ‘অমইল্যা’, ‘আব্দুল’কে ‘আব্দুইল্লা’ বলে দীর্ঘতর স্থায়িত্ব দেয় নামগুলিকে ... নামের আড়ালে থাকা মানুষ গুলিকে ... বলেনা ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কিকরে আসে যায় ...’ বলে ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কম্নে আইসে যায় ...’ ... ঐ নাটকের মানুষ গুলিও কথা বলতো ঐ ভাষায় ... শোনাতো গল্প আমাদের সেই ফেলে আসা অতীতের ... ভুলে যাওয়া মূল্যবোধের ... আমাদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া এক-অন্নবর্তী পরিবারের ... বলতো ‘আমি কানকাটা রমজান ... আমারে চিইন্যা রাখ ...’ ... বলতো ‘আপনেরা ত বট বিরিক্ষ ... তাই মনে করলাম আপনাদের ছায়ায় আইস্যা পরি ...’ ... ঐ বলার আবডালে বয়ে যতো গল্পের স্রোত ... মামা, দুলাভাই, কানকাটা রমজান, ‘তুই রাজাকার’ বলা কাকাতুয়া ... বহুব্রীহি , ঢাকায় থাকি, এই সব দিন রাত্রি, সংশপ্তক, অয়োময় – আবুল হায়াত, আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নুর ,হুমায়ুন ফরিদি, আসাদুজ্জামান নূর, বিপাশা হায়াত, সুবর্ণা মুস্তাফা ... ফলে বাংলাদেশ’কে আমার দেশ মনে হওয়ার যে বাস্তবতা, আমার মর্মে, আরো অনেক বরাক-বাসী’র মর্মে তা হঠাৎ সকালে উঠে একদিন বাঙ্গালীর ছেলের ‘চীনের চ্যায়ারম্যান্ আমাদের চ্যায়ারম্যান্’ হেঁকে ওঠার মতো ভুঁইফোঁড় কিস্যা-কাহিনী নয় ...
সেই বয়সে কতোটা আর মনে নিতে পারতাম সেই সব নাটকের অন্তর্গত ইঙ্গিত গুলি? জানিনা। তবে কাহিনীর গহনের ভালো মন্দের মোটা বিভেদ রেখাটাকে ছুঁতে পারতাম অবশ্যই। সেই টানেই গিয়ে হাজির হতাম ‘টিভি ওয়ালা’দের বাড়িতে ... তারপর এলো ‘দিল্লী’ তার প্রচার যন্ত্র নিয়ে। এন্টিনা ঘুরিয়েও আর পাওয়া গেলোনা ‘সেইসব দিন রাত্রি...’ ... ‘নাটক’এর স্থান দখল করে নিলো সিরিয়াল ... মেগা সিরিয়্যাল ... ক্রমে ... প্রভূত বিত্তশালী পরিবারের আবহে কাহিনীকার আর পরিচালকের স্ব-কপোল-কল্পিত সমস্যাই যে গুলির উপজীব্য ... হ্যাঁ যদিও হিন্দি ভাষায় তথাপি ‘মালগুড়ি ডেইস্’হেন কিছু সিরিয়াল’ও দেখিয়েছিল দিল্লী ... ঠিক ... কিন্তু ঐ’যে, আমি বাঙ্গালী, আমি বাংলাদেশী, ‘আমি বাংলায় গানগাই ...আমি বাংলার গান গাই...’ তাই ভাষার টান না থাকায় বাংলাদেশ টেলিভিশানের সিগন্যাল আসা বন্ধ হয়ে যাওয়াটা আমার এক অতি নিবিড়, ব্যক্তিগত বিয়োগ ... পরে আবার বাংলা চ্যানেল বলে এক রকমের চ্যানেল যখন মাথা চাড়া দিলো, তখন অবস্থা আরো সঙ্গিন! ‘বহুব্রীহি’ বা ‘সংসপ্তক’এর কাছে ঐ সব ‘কইলকাত্তাইয়া’ সিরিয়েলের কাহিনী যেমন ‘জাস্ট অখাদ্য’ তেমনি অখাদ্য অভিনয় ... তেমনি অসৎ তাদের প্রযোজনা ... যেখানেই পূর্ব বঙ্গীয় চরিত্র, সেখানেই এক আজগুবি ভাষা’র আমদানী যে ভাষা পূর্ব বঙ্গে কোনোদিন ছিলোনা, থাকবেও না ... যে ভাষা ‘কফি হাইস্ ইন্টেলেক্চুয়াল’দের সুরাপানের মৌতাতে নির্মীত ... ঐভাবে এরা অবমাননা করলো শুধু পূর্ব বাংলার বা তার ভাষার নয়, অবমাননা করলো সমগ্র বাংলা ভাষা-পৃথিবীর ...
কথাগুলি মনে আসে, মনেপড়ে ছবিগুলি, দৃশ্যগুলি, কানে বাজে উচ্চারণগুলি, প্রতি নিয়ত ... কিছু কিছু প্রকৃত ভাষা প্রেমিক ঐ নাটকগুলিকে যত্নে উঠিয়ে রেখেছেন ইন্টারনেটে, ইউ-টিউবে ... তা’ই মাঝে মাঝে দেখি, একা একা বসে, রাত্রি জেগে ... ভাবি সেই শৈশবের কথা, অতীতের কথা ... ভাবতে ভাবতে আবারো টেরপাই বাংলাদেশ’কে আমার দেশ মনে হওয়ার যে বাস্তবতা, আমার মর্মে, আরো অনেক বরাক-বাসী’র মর্মে তা হঠাৎ সকালে উঠে একদিন বাঙ্গালীর ছেলের ‘চীনের চ্যায়ারম্যান্ আমাদের চ্যায়ারম্যান্’ হেঁকে ওঠার মতো ভুঁইফোঁড় কিস্যা-কাহিনী নয় ... সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মলইবাজার এই নামগুলি ছাড়া, ভূগোলগুলি ছাড়া যেমন আরম্ভই হয়না আমার, আমার মতো অনেকের শিকড় সন্ধান তেমনি বহুব্রীহি , ঢাকায় থাকি, এই সব দিন রাত্রি, সংশপ্তক, অয়োময় – আবুল হায়াত, আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নুর ,হুমায়ুন ফরিদি, আসাদুজ্জামান নূর, বিপাশা হায়াত, সুবর্ণা মুস্তাফা – এই নামগুলি, মুখগুলি ছাড়া পূর্ণ হইনা আমি, আমার শৈশব, আমার বর্তমান, আমি, আমার কবিতা ...
... হায় ... সেই সংসপ্তকের সেই হুমায়ুন ফরিদি আজ নেই ! নেই সেই ‘কানকাটা রমজান’ ... হায় আমার শৈশবের দিকে ফিরে যাওয়ার পথের আরেকটি সাঁকো আজ ভেঙ্গে গেলো ...
১৪/০২/২০১২