নববর্ষের
অভিশাপ
ইংরেজি
আরেকটি বছর ফুরিয়ে আসছে। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা। আরম্ভ আরেক ইংরেজি বছরের। আজই সকালে
ফিরে এসেছি ভংগালোর নামের শহরে। দিন পনেরো দেশ-গ্রামে কাটিয়ে। এখানে মাইক বাজছে।
অশালীন ছন্দে, বাজনায় বাজছে কি সমস্ত গান। আরেকটু পরেই শুরু হবে বাজি পোড়ানো আর
কেক্ কাটার ধুম। এই ভংগালোরে। সেই সুদূর শিলচর করিমগঞ্জেও। হায়, কতো বাংলা বছর,
ইংরেজি বছর আরম্ভ হলো, ফুরিয়ে গেলো, আরম্ভ হবে, ফুরিয়ে যাবে, তবু কি হবে ‘মানুষ’
নামক জীবেদের? হবেকি তার চেয়ে বেশী কিছু যেমন লিখেছিলেন জীবনানন্দ দাশঃ ‘তা’ই হলো
মানুষের যা হওয়ার নয় ...’
এইবার বাড়ি
গিয়ে কেবলি মনে হচ্ছিল গৌতম বসু’র এই পংক্তিগুলিঃ
বাদল ফিরে এসে, মাঠে
কেটে, নিজের মনের মতো
জলাশয় গড়লো;পঞ্জরময়
গাভী, রেলব্রিজের
পিছনে দাগী আকাশ, সবই
আছে, কিন্তু এমন ভাবে,
ভাতের হাঁড়ির নীচে আগুন
নেই, জল
নদীতে জল নেই, আগুন;
উদ্বেগ এইজন্য।
মনে হচ্ছিল
অনেক অনেক অনুষঙ্গে। প্রায় যে’ই শুনছিল আমার অভিপ্রায়, এই ভংগালোর ছেড়ে
শিলচর-করিমগঞ্জে ফিরে চলে আসার, সে’ই শোনাচ্ছিল কাহনঃ ‘আরে না না, ঐ ভুল করোনা,
একবার এই জঘন্য জায়গা ছেড়ে বড় জায়গায় চলে গেছো, এখানে আবার আসবে কেন? কি আছে
এখানে? এখানে কারেন্ট্ নেই, যানবাহনের অসুবিধা, ডাক্তার নেই, চিকিচ্ছা নেই,
লেখাপড়ার সুব্যবস্থা নেই ...’ হায়, যারা এসব বলছে যেন তারা এখানে জন্মায়নি,
লেখাপড়া শেখেনি, যেন বেড়ে ওঠেনি এখানে, যেন আমার সেই নিকটাত্মিয়টি দেখভালের অভাবে
নিজের বসতবাটি বিক্রি হয়ে যাবে জেনেও যে ‘আমেরিকান উচ্চশিক্ষা’য় মশগুল! হায়, এরা
যখন বলেঃ ‘কি আছে এখানে’? আমি বলতে চাই আছে ঐ বাড়িটি যার উঠোনে এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে
সেই ঘোড়ানিমের গাছ যার ছায়ায় আমি বেড়ে উঠেছিলাম, যার ছায়া আজো আমার অক্ষরকে দেয়
মেঘ-বৃষ্টি-রোদের আশীর্বাদ, আছে সেই মজে আসা খাল যার জলে আমার ছায়া ভেসে বেড়াচ্ছে
অদ্যাপি, হায়, তোমরা যারা আমার মতন দুর্ভাগা নও, শুধুমাত্র পেটের ধান্দায় যাদের
পালাতে হয়নি এই সব আশ্রয় ছেড়ে সেই তোমরা কিভাবে, এভাবে এমন নেমখারামের মতো
কথাবার্তা বলতে পারো? তোমাদের কথা শুনে মনেহয় এযেন তোমাদের দেশ নয় ... হায়, তোমরা
কি সেই মধু-বিধু’র গল্পটি ভুলে গেলে যেখানে একভাই মা-বাপের দেওয়া ছিটের শার্ট ফেলে
টেরিলিনের শার্টের লোভে গিয়ে হাত পেতেছিল জমিদারের দুয়ারে আর আরের ভাই ঐ ছিটের
শার্টেই পাঠ করতে সক্ষম হয়েছিল মমতার আর্দ্র অক্ষর ...
যদি তোমাদের
কথা মেনে নিয়ে স্বীকারও কর যেএখানে কারেন্ট্ নেই, যানবাহনের অসুবিধা, ডাক্তার
নেই, চিকিচ্ছা নেই, লেখাপড়ার সুব্যবস্থা নেই তাহলে এ’ও কি প্রশ্ন নয় যে কেন নেই?
নেই কেননা এখান থেকে একদল, আমার মতো, না খেতে পেয়ে পালায় ভঙ্গালোরে,
দিল্লী-কলকাতায় আর আরেকদল পালায় স্বেচ্ছায়। ‘বড়’ শহরে গিয়ে ‘বড়’ হওয়ার স্বপ্নে। আর
দুই দলই যখন এখানে আসে তখন একটিই জিনিস আসে দেখাতে তা হলো ‘দেখো, আমরা ‘বড়’ হয়েছি,
আমরা চোস্ত্ আছি ...’ ... ঐ দেখানোর জন্য মুখে কালি মেখে সং সাজতেও দ্বিধা করেনা
তারা। আর তোমরা, তাদের ঐ ভূষোকালি মাখা মুখ আর জামা কাপড় আর কেতা দেখে ভুলেযাও
তোমাদের অস্তিত্বের কেন্দ্রকে, পরিধিকে ... তোমাদের এই নেমকহারামিতেই
‘ভাতের হাঁড়ির নীচে আগুন
নেই, জল
নদীতে জল নেই, আগুন; ...’
তোমাদের অন্তর্গত
এই উঞ্ছবৃত্তিতেই ‘বাদল ফিরে এসে, মাঠে
কেটে, নিজের মনের মতো’ যতোই ‘জলাশয়’ গড়ুক তবু তাকে ঘিরে থাকে সেই উদ্বেগ! হায়,
ছোটো শহরের মানুষেরা, তোমরা শিক্ষা করো আত্মসম্মানবোধ, শিক্ষা করো হাল ফ্যাশানের
ইংরেজি ইস্কুলের নকল হাজির করার পরিবর্তে সেই মৃত্তিকাকে সম্মান জানাতে যেখানে
তোমার নাভি পোঁতা আছে, মিশে আছে তোমার বাপ-ঠাকুর্দার ছাই, কঙ্কাল, করোটি ...
নতুবা এই
মৃত্তিকারই অভিশাপে অচিরেই নিশ্চিহ্ন হয়েযাবে তুমি, তোমরা!