প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Tuesday, April 23, 2013

‘জন্ম যদি তব বঙ্গে ...’ - মাতা বিনোদিনী দাসী’র পায়ে নিবেদিত একটি প্রচেষ্টা





‘জন্ম যদি তব বঙ্গে ...’
সপ্তর্ষি বিশ্বাস





























মাতা বিনোদিনী দাসী’র পায়ে নিবেদিত একটি প্রচেষ্টা






[ স্থানঃ রাজপথ
কালঃ মধ্যযাম
পাত্রঃ  গম্যমান একাকী পুরুষ]

নেপথ্যে। ‘দাঁড়াও পথিকবর! জন্ম যদি তব বঙ্গে
           তিষ্ঠ ক্ষনকাল’ –
পুরুষ। কে ডাকে? চাপ চাপ অন্ধকার থেকে
         কে আমাকে ডাকে?
         এ আমার ভ্রম, না’কি পাপ? প্রলয়-প্রতিভা বুঝি?
         গোপন সন্তাপ?

নেপথ্যে। কোনো পাপ
           ফেলে না’কি ছায়া
           অন্ধকারে হেঁটে যেতে
           এখন, একাকী?
           নাট্যকার, ভেবে দেখো –
           বাড়ে রাত।
           উড়ে যায় রাতজাগা পাখি ...

পুরুষ। কোন্‌ পাপে পাপী আমি?
         জানিনা। এ দাহ্য পৃথিবীতে
         জন্ম নেওয়া পাপ হয় যদি
     সে পাপের ভাগি
     আমি, তুমি, সকলেই – তবে –
     সে পাপ কেবলি আমার কেন হবে?

নেপথ্যে। জন্ম-দাগের মতো
           জন্ম-পাপ
           যাপনের সাথে মিলে মিশে
           মুছে যায়। চোরাটানে ভেসে
           সে’ও যায়
           সাগরে হারিয়ে –

পুরুষ। তাহলে কি সুরা পাপ?
        নারী পাপ? তা’ই যদি হবে
        তবে এই পাপ গুলি
        বিন্দু জলের মতো, জেনো,
        আমার জীবনবৎ পদ্মপাতা থেকে
        শেষ দৃশ্যে ক্রমে ঝরে যাবে –
        অথবা ছায়ার মতো
        আমারি সকাশে তারা
        মোহনার অভিমুখ পাবে -
     
 

নেপথ্যে। নরহত্যা পাপ তুমি
           কোনোভাবে করোনি কখনো?
           আরেকবার ভেবে দেখো,
          মশাল জ্বালিয়ে দেখো
         নিজের গহনে ...

পুরুষ। বরং যে জীবিতটিকে
         মৃত বলে ভেবে
         অন্ধকার নদী তীরে ফেলে
         সকলেই গিয়েছিল চলে
         আমি তার মুখে
         জল ঢেলে দিয়ে
         ছুটে গিয়ে পথ্য নিয়ে ফিরে এসে দেখি
         যমের দূতেরা এসে
         চুরি করে নিয়ে গেছে তাকে ...
       
        সে’ও আজ হলো কতোকাল ...
        এখন নদীর সেই ঘাট ভেঙ্গে গেছে।

নেপথ্যেভেবে দেখো, নাট্যকার, ভাবো –
           কুটিল, হিংস্র কোনো রাতের কাহিনী
           বিদ্যুৎ চমকের মতো
           কোনোভাবে মনে পড়ে নাকি ...

পুরুষ। মনেপড়ে।
         মনেপড়ে
         বহু বহু জীবিত মেয়েকে
         সারারাত্রি জিহ্বা দিটে চেটে
         ভোর হলে
         ‘অপবিত্র, বেশ্যা’ বলে
         শিষ্টজন ফেলে চলে গেলে
         তাদের গহনে আমি
         নিজহাতে জ্বেলেছি মশাল,
         শুশ্রূষায় প্রাণ পেয়ে তারা
         আলোকিত মঞ্চে এসে
         গেয়েগেছে আলোকের গান –
        স্বয়ং ঈশ্বর সেই গান শুনে, এসে        
         বলেগেছে ‘তোদের গহনে
         চৈতন্যের প্রদীপ জ্বলুক্‌ -
         সেসব গানের মর্মে
         চেতনার আলো দিতে
         সুরা ক্রমে সুধা হয়ে
         নিয়ে গেছে আমাকে ভাসিয়ে –

        এ’ই যদি ‘পাপ’ হয় তবে
        বিশ্বম্ভর হবো আমি
        পাপের মুকুটখানি নিয়ে ...


নেপথ্যে। নাট্যকার,
      আরো কোনো মুখ মনেপড়ে?

পুরুষ। মানি আমি শরীরের জ্বরে
      কখনোবা কারোর শরীরে
      চেয়েছি-এখনো চাই-আগুন, আশ্রয় –
      কিন্তু তা একেবারে প্রেম শূন্য,
      শিষ্টদের মর্ষকাম নয় –
      তাই জানি সে মিলন
      রিপু নয়, ব্যভিচার নয় –

নেপথ্যে। একটি রাতের পাখি
     এক ভোরে আলো দেখেছিল,
     তারপর সে আলোয় মেলে দিলে ডানা
     কেউ যদি এসে বলে
     ‘ আমার নিমিত্ত তুমি
      ফিরে সে’ই অন্ধকারে চলো’ –
      তাহলে, হে নাট্যকার, তাকে
      কি বলে ডাকবে তুমি?
      নিষাদ, চন্ডাল না’কি খুনী?
      আজ এই নদীঘাটে বসে
      আরো একটু ভেবে নিয়ে বলো –

[ অন্ধকার নেমে আসে। সব ঢেকে যায়।
অকস্মাৎ জ্বলে ওঠে ঝাড়বাতি, আলো।
সুবেশা, সুন্দরী মেয়ে খাটের কিনারে
দাঁড়িয়ে রয়েছে আর তার
পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে
এ পুরুষ। বাইরে বৃষ্টি ঝরছে।
চরাচরে রাত।]

নারী। শেষ দৃশ্যে তুমি গুরু, তুমি পিতা, তুমিই পালক –
তাই তুমি বলে দাও এখন আমাকে
এ দ্বিধার রাতে আমি কোন্‌ পথে যাবো?

পুরুষ। সকল পথই তো যায়
শেষ দৃশ্যে, মোহনার পথে –

নারী। তবু সেই স্রোতে আছে
       শ্যাওলাদাম,বালুচর, বাধা –
       মনেপড়ে সেই সব বাধা ঠেলে ঠেলে
       তুমি এলে, আমাকে বজরায় তুলে
       বজরা ভাসালে –

      মনেপড়ে অন্ধ দিন, অন্ধকার রাত ...
      ভিতর বাহির জুড়ে অন্ধকার হানা দিচ্ছে, আর
      এই মঞ্চ, একমাত্র প্রদীপ আমার
      জ্বেলে একা জেগে আছি, স্বপ্নে স্বপ্নে আমি একাকার –
      একদিন এই এক মঞ্চ ছাড়া সব কিছু ভুলে যাব
      প্রতিজ্ঞা আমার –
      ভুলে যাব জন্ম, পাপ, ভুলে যাব অন্য পুণ্য কথা ...
      তবু হিংস্র সাপ গুলি চামড়ায় লালা ছড়িয়েছে,
      স্বপ্নজলে ডুব দিয়ে ভুলেছি সে ব্যথা –
      টেনে হিঁচড়ে আপনাকে নিয়ে এসেছি আলোর দিকে,
      তোমার ছায়াতে এসে, হে পালক, পিতা,
      আশ্রয়ের ভরসা পেয়েছি –
      আজ সেই আলো ছেড়ে, আলোকের স্বরলিপি ফেলে
     ফের সে আঁধারে নেমে যাবো?

     অন্য সবে যা বলে বলুক, আমি জানি
     এই কথা তুমি বলবেনা –




পুরুষ। (স্বগতঃ) সুরা আজ সুধা হোক্‌ -
         সুধা হোক্‌ বিষের ভগিনী
         আমার উচ্চাশা হোক্‌
         আজ রাতে আমার বর্তিকা –
         পাপের নদীতে আজ জোয়ার এসেছে
         আমি তাতে ভেসে যাবো, ধুলির কনিকা –
     (নারীকে) আজ তোকে নিয়ে আমি
         যুগল গমনে যাবো
         ফের অন্ধকারে –

নারী। আমার সঙ্গে তুমি অন্ধকারে যাবে?
       পালক, বান্ধব, পিতা – সেই তুমি যদি
       আমাকে সঙ্গে নিয়ে নরকেও যাও
       তবে সে নরক হবে আমার জীবন জোড়া
       স্বর্গাদপি গরিয়সী, আলো –
       হে পিতা, আমার মর্মে সে আলোক জ্বালো –

পুরুষ। ঠিক তোকে নিয়ে আমি
         যুগল গমনে যাবো
         ফের অন্ধকারে –
         যাবো, কিন্তু ফিরে আসবো
         একা, তোকে অন্ধকারে নির্বাসন দিয়ে –

নারী। জানিনা এ শাস্তি না’কি
        শ্রেষ্ঠ পুরস্কার,
        তবু বলো নির্বাসনই কেন
        এই দৃশ্যে নিয়তি আমার?

পুরুষ। কেননা তোমাকে ছাড়া অন্য বলী
         আজ আর দেবতা নেবেনা –

নারী। কেমন দেবতা তবে তিনি?
        আজ যদি নির্বাসন, তবে
        কেন অন্ধকারে এই প্রদীপ জ্বালানো,
        দিনে দিনে ক্ষনে ক্ষনে? কেন
        হাত ধরে দেখানো ভোরের আলো?
        কুয়াশায়, নদী পরপারে?

পুরুষ। দেবতার খেলা তার সাধকের সাথেই কেবল
         তোর পাপ, তুই তাঁর নিভৃত সাধিকা –
         তাই এই পরীক্ষার দায় তোরই শুধু,
         হায় –

নারী। তুমিওত নিবিড় সাধক।
        এই দৃশ্যে তুমি কোন ভূমিকার ছায়া?

পুরুষ। এই দৃশ্যে কাপালিক আমি।
         তুই বুঝি কপালকুন্ডলা –
         আমাকে ধাক্কা দিয়ে জলস্রোতে ভাসিয়ে না দিলে
         এই খড়্গে প্রাণ যাবে তোর ...
         
         হা জীবন, হায় মহা মায়া –

নারী।  তাহলে নিয়তির সাথে তুমিও রয়েছো?
         তাহলে তুমিও চাও এই পরিণতি?
         ফের সেই বেশ্যাবৃত্তি? দেহ বিক্রি?
         গণিকা, রক্ষিতা?
         নিয়তির মুখে আমি তুড়ি মেরে চলে যেতে পারি,
         রক্ত মাংসের হে পালক, তোমাকে পারিনা –

পুরুষ। আমি নিজে চাইনা কিছুই।
         আমি চাই শুধু সেই রঙ্গমঞ্চ হোক্‌,
         যা আসলে আমাদের সাধনা-মন্দির –
         যেখানে প্রত্যেক রাত্রে অভিনয় শেষে
         নিজ নিজ সাধ্যমত অমৃত আর বিষটুকু নিয়ে
         দর্শকেরা ফিরে গেলে গৃহে কিংবা গণিকা আলয়ে
         দেবীর দুয়ারে বসে আঁধারে নীরবে
         তুই আর আমি কাঁদবো আমরন, চুপে –

নারী। বিনিময়ে আরো এক সাপের ছোঁবলে
        আমার শরীর, শিরা দগ্ধ হয়ে যাবে –

পুরুষ। ঠিক। তবু
        বিনিময়ে বাংলা তার একমাত্র রঙ্গমঞ্চ পাবে –

নারী। শেষ দৃশ্যে তুমি গুরু,
       তুমি পিতা, তুমিই পালক –
       ফলতঃ চালকও  তুমি, মনেপড়ে সেই যে বালক
       অঙ্গুলী চ্ছিন্ন করে গুরুপদে দিয়েছিল, তাকে –
       এসো, তবে হাত ধরে এখনি আমাকে
       নিয়ে চলো বলী দিতে, বধ্যভূমে, সেই অন্ধকারে –
       জ্বলুক প্রদীপ তবে
       চিতা হয়ে, এখানে, এ পারে –

[ পুনরায় আলো নিভে যায়।
  আলো জ্বল্‌লে দেখা যায়
  স্থান সেই রাজপথকালঃ মধ্যযাম
পাত্র সেই   গম্যমান একাকী পুরুষ]


পুরুষ। এ নর হত্যার স্মৃতি ভুলবো কিকরে?
         তাই আসি, প্রতিরাত্রে পোড়া সেই রঙ্গমহল ছেড়ে
         নিজের নিকটে আসি নিকষ আঁধারে।
         সুধা নয়, সুরা দিয়ে জ্বালাই নিজেকে –
         নিজেই চন্ডাল হই, নিজে শব, নিজের হাতেই
         মুখাগ্নি সম্পন্ন করি নিজের চিতাতে।


        ওহে, তুমি কোথা গেলে? যে আমাকে ডেকে
        এখানে বসালে এনে এই মধ্যযামে?
        কে হে তুমি? নও তো সে সাজানো বিবেক
        রঙ্‌ মেখে ঢঙ্‌ করে আসর মাতিয়ে
        ঢেকে রাখো পাপ গুলি আলখাল্লা দিয়ে?
        কে হে তুমি? অন্ধকারে কোথায় পালালে?

       বোঝা গেছে, বোঝা গেছে কেউ নেই,
       বোঝা গেছে কোনোদিনই কেউই ছিলোনা –
       আমারি সমীপে আমি গুপ্ত এই হত্যা কাহিনী
       ঢেকেছি সুরায় তাই সুরা আজ সুধা থেকে
       নীল বর্ণ বিষ হয়ে গেছে –
      সেই বিষ পানে আমি পূর্বাপর অপারগ বলে
      বিশ্বম্ভর নই আর। আমি শুধু খবর কাগজে
      রাষ্ট্র হওয়া ‘নট’ এক। বাংলার সাজানো ‘গ্যারিক’ –
      আমার পাপের মূল্যে সে’ই অন্তরালে
      দেবতার নদীপথে প্রকৃত নাবিক।

 

  আছো কি কোথাও কেউ, যে আবার এসে
  জাদুমন্ত্রে এ সুরাকে সুধা করে দেবে?
  ‘জন্ম যদি তব বঙ্গে তিষ্ঠ ক্ষনকাল’
  শোনো এ হত্যার পাপ এতাবৎ আমি
  কিভাবে বহন করছি গহনে, নীরবে ...।।

১০/০৪/২০১৩-২৩/৪/২০২৩
বেঙ্গালোর































[ কৃতজ্ঞতাঃ কবি সর্বজয়া, কবি কৌশিক বাজারী]

ঘুম ঘর