বৃষ্টিগাছের রূপকথা
১।
‘বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস’।
রাস্তাঘাট এখানে দুর্গম।
তার উপর সন্ধ্যা হলেই
হিংস্র কুকুর নিয়ে লালসিং পাহাড়ায় থাকে।
এ পাহাড়ে রবাহুত তুমি
সেদিন মেলার ভিড়ে পলকে দেখেছো
তোমার বাল্যসখী, পাহাড়ের রাণী –
সুঠাম রাজার সঙ্গে তেজী ঘোরা চড়ে
মেলাটি পেরিয়ে গেলো
দুর্গগামী পথে ...
তুমি রবাহুত তাই
যেতে যেতে দেখেনি তোমাকে –
২।
মনেপড়ে বিবাহ, উৎসব –
দূরগ্রাম থেকে তুমি ফিরে এলে, আর
ঘাটে কোনো মাঝি নেই –
বরযাত্রী আনতে সবে
চলেগেছে অন্য আঘাটায় ...
কার বর, কার বিয়ে জেনে নিতে তুমি
এসে দেখলে নহবত
সখীর প্রাঙ্গনে ...
পরদিন সখীসহ বর ও যাত্রী ফিরে গেলে তুমি
সাঙ্ঘাতিক তীক্ষ্ণ এক ছুরি কিনেছিলে ...
... ছুরিতে পরেছে মর্চে বহুকাল হলো।
সখীটিরো চোখ, চুল, জিহ্বা আর নাভিটির স্বাদ
ভুলেছিলে তুমি বহুদিন।
আজ কেন গুহাগর্ভে আগুন জ্বালিয়ে
ধার করছো সেই ছুরি ফের?
মেলার পাশেই আছে অগ্নিযোনি
গণিকার তাঁবু,
তার উপর সন্ধ্যা হলেই
লালসিং সারারাত পাহারায় থাকে –
৩।
ধারালো টর্চের আলো অকস্মাৎ মুখে এসে পড়ে।
ভাবো তুমি হিংস্র কুকুরগুলি
এইবার ঝাঁপ দেবে না’কি?
ছুরিটি পেছনে করে বাম হাতে চোখ ঢাকো তুমি –
টের পাও লালসিং পায়ে পায়ে কিনারে এসেছে ...
‘ নমস্কার দাদাবাবু’ – চম্কে ওঠো তুমি –
‘রাজার হুকুম আছে আপনি এলেই
সসম্মানে তাঁর কাছে নিয়ে যেতে হবে...’
চম্কে উঠে ছুরি ফের জামায় লুকিয়ে
হতভম্ব হাঁটো তুমি
বৃষ্টিগাছে ঢাকা পথ, ঝিঁ ঝিঁ আর
শীৎকার ও জোনাকি পেরিয়ে ...
গোপন ছুরির বাঁটে হাত রেখে ভাবো
এইবার পর্দা উঠলে
কি তোমার ভূমিকাটি হবে ...
৪।
বৃষ্টিগাছে ঢাকা রাত। সামনেই রাজগৃহ, তবু
মোরাম বিছানো কোনো লাল পথ নেই,
বাগান, ফোয়ারা নেই, নারীমূর্তি নেই,
রাজদ্বারে প্রহরীরো লেশমাত্র নেই,
একবিন্দু আলো নেই মঞ্চে, আবহে –
সদর দরজার কাছে লালসিং থামে।
মোয়ালেম ডাকে তার হিংস্র কুকুরেরা।
একটি জানালা খোলে উপরে কোথাও –
লন্ঠনের আলো দেখা যায় –
‘ঠিক আছে। লাল সিং, যাও –
তোমাকে ইনাম দেবো পরের সভাতে ...’
এ’কি হচ্ছে? তুমি ভাবো
এইবার দৌড়ে পালাবে –
‘এসো, এসো –
কতোদিন ধরে
কেবল তোমারি জন্য আমরা দুজনে
পাহাড়ের এ প্রাসাদে রয়েছি...’
রাজা বলে। চিত্রার্পিত তুমি
মন্ত্রমুগ্ধের মতো পার হও
সিঁড়ি ও গালিচা ...
রাজা আরো দৈনন্দিন নানাকথা বলে –
তুমি মাথা নাড়ো আর
গোপন ছুরির বাঁটে হাত রেখে ভাবো
এইবার পর্দা উঠলে
কি’যে ঠিক তোমার ভূমিকা –
৫।
তেতলায় শয্যাকক্ষ। দেওয়ালে মশাল।
শয্যাতে যে নারীটি নগ্ন শুয়ে সে’ই
তোমার বাল্যের সখী –
যার বাম স্তনে তোমারি দাঁতের চিহ্ন
আঁকা আছে আর
যোনিরোম অদ্যাবধি গভীর, পিঙ্গল –
তোমার বুকের লোম কবে এতো শাদা হয়ে গেছে? –
দেওয়ালে হাড়ের নক্সা। কাঁচের দেরাজে
শুধু গ্রন্থ, প্রিয় গ্রন্থ, তোমার নিজেরো –
দেখে তুমি স্থানু ফের। মনেপড়ে ‘ডিভাইন কমেডি’
শেষ না করেই তুমি
ভিন্গ্রামে চলে গিয়েছিলে ...
পয়সা ছিলোনা বলে ‘ডেকামেরন’ কিনতে পারোনি ...
এসব ভাবনার ঘোরে ডুবে যেতে যেতে
গোপন ছুরিটি তুমি আস্তে নামিয়ে রাখো
হাড়ের টেবিলে ...
তখনি ঘাড়ের কাছে স্পষ্ট হয় চিতার নিঃশ্বাস –
৬।
বাল্যসখী টেনে নেয় তোমাকে দুহাতে।
তোমার স্তম্ভিত মুখ নাভিহ্রদে চেপেধরে বলেঃ
‘বৃষ্টি থেমেছে বাইরে। আমি বৃষ্টিগাছ।
এবারে ঝরবো আমি স্বর্গ মর্ত্য পাতাল ভিজিয়ে ...’
ধীরে ধীরে জিভে জাগে কবেকার আমলকির স্বাদ –
গ্রামের দুপুর জাগে, ঘুঘু ডাকে, ঝিঁঝিপোকা, আর
পুড়ে যেতে যেতে তুমি ভিজে গিয়ে বলোঃ
‘রানী, তবু মুক্তামালা নেই?
হীরার অঙ্গুরী নেই?
হাড়ের নূপুর?’
‘কবরে রেখেছি সব।
বলিনিকি ‘মমি’ হতে
খুব সাধ- সেদিনো – তোমাকে?’
নগ্ন তোমারো ছায়া কেঁপেযায় হাড়ের আয়মায়,
এতোযে পুরুষ আজো রয়ে গেছো তুমি
নিজেই চম্কে ওঠো অকস্মাৎ এই সত্য আবিষ্কার করে ...
দশটি আঙ্গুলে সেই প্রজ্জ্বলিত বাতিদান ছুঁয়ে
বাল্যসখী হাসে, বলেঃ
‘ যদিও হয়েছো বড়ো, দুঃসাহসী এবং বিশালও
তবু আমি ঠিক টের পাই
ভেতরে তো সেরকমই, বোকাসোকা, ন্যালাখ্যাপা আছো –
আমার এ গোপন ঝর্ণায় হাত রেখে বলো
এ পাহাড় ছেড়ে আর যাবেনা কখনো’ –
রাজা বলেঃ ‘বইগুলি এবং প্রাসাদ –
লাল সিং, রানী ও কুকুর
আজ থেকে সকলি তোমার’ –
রাজার নগ্নতা দেখে লজ্জা পাও, চোখ ঢাকো তুমি –
তখনি সে বাতিস্তম্ভ তীক্ষ্ণ এক ছুরির আঘাতে
মেঝেতে ছিট্কে পরে। রক্ত, হাহাকার
তোমার সংজ্ঞা কেড়ে হাসে হো হো করে –
গ্রন্থগুলি চোখ বুজে ভীতি আর
ব্যথার বিকারে ...
৭।
সেই থেকে এ প্রাসাদে,
বৃষ্টিগাছে ভরা এই মেঘের পাহাড়ে
রানীমা’র প্রিয় খোজা তুমি।
ছুরিহাতে সর্বক্ষন রাণীমাকে ঘিরে
তুমি থাকো। তোমার সামনেই
রাজারানী মেতেওঠে নগ্নহয়ে
তুমুল শীৎকারে –
তারপর ক্লান্ত রাজা রানীর উরুতে
মুখটি ডুবিয়ে দিয়ে
ঘুমে মড়ে গেলে
পাহারায় বসে তুমি একা একা ভাবো
বহুআগে এই ছুরি তুমি
কোনোদিন কেন কিনেছিলে ...