‘বন্ধু হে আমার রয়েছো দাঁড়ায়ে’ – আমার স্মৃতিতে সুজিৎ চৌধুরি
সপ্তর্ষি বিশ্বাস
১।
বসন্ত এসেগেছে। এসেগেছে এমন কি এই আইটি শহরেও। আর মাত্র কয়েকদিন পরেই দোল। রঙের এই উৎসবে এই আইটি শহর মেতে না উঠলেও আমার বাঙ্গালী মন মেতে ওঠে। ছুটির দুপুরে জানালা দিয়ে আকাশ দেখি। শূন্য নীল আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মনেপড়ে কয়েক বছর আগের দোলের দিন কয়েক আগের কথা...
অফিসে বসে আছি। এস্এম্এস্ আসছে। সুদীপদা’র।
‘দোলে তোদের অফিস কি ছুটি থাকছে?’
উত্তর দিচ্ছিঃ ‘হ্যাঁ’
‘তবে চলে আয় আমাদের বাসায়’
‘ আসাই যায়। তবে দোলের আগের দিন হলে বেটার হয় ...’
সেল্ ফোন কোম্পানীর টাওয়ারের হাতে বার্তাটি যথাস্থানে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে উঠে গেলাম। সেলফোন পরে রইলো টেবিলেই। রেস্টরুম্ হয়ে, স্মোকিং জোন্ হয়ে আবার ডেস্কে ফিরে দেখি আরো বেশ কিছু মেসেজ্ এসেছে। দুটি বিজ্ঞাপনের পরের মেসেজ্টাই সুদীপদার। বার্তা এইঃ ‘ফাদার এক্স্পায়ার্ড’ –
খট্কা লাগলো। কতোক্ষন ছিলামনা ডেস্কে? দশ মিনিট? বড়জোর কুড়ি – এরই মধ্যে – মনে হলো ভুল পড়ছি না’ত? যা পড়ছি তার অর্থ পারছি ত সঠিক ভাবে অনুধাবন করতে? নিজের ডেস্ক থেকে উঠে যাই সহকর্মীর ডেস্কে। তাকে ফোনটা দিয়ে বলিঃ ‘চোখে অসুবিধা হচ্ছে, দ্যাখ্তো কি লিখেছে ...’। সে পড়ে। ভ্রূ কোঁচকায়। বলেঃ লিখেছে ‘ফাদার এক্স্পায়ার্ড...’ একটু থেমে বলেঃ ‘কার? কোথায়?’ – তার প্রশ্নগুলির কি উত্তর দেবো ভাবছি, তখনি আসে আরেকটা মেসেজ। পড়ি। টাইম স্টাম্প্ দেখে বুঝতে পারি এই মেসেজটা সুদীপদা পাঠিয়েছিল ‘ফাদার এক্স্পায়ার্ড’ মেসেজের আগে কিন্তু সেল্ ফোন কোম্পানীর টাওয়ার তা পৌঁছে দিতে দেরী করেছে। ঐ মেসেজ বলছে ‘ফাদার ইস্ সিক্। ফল্ ইন্ দ্যা বাথরুম’। সামনে দাঁড়ানো হতবাক সহকর্মীকে বলি আমার লেপ্টপ্ ইত্যাদি যা কিছু টেবিলে ছড়ানো সেসবের দায়িত্ব নিতে। বাকি কথা পরে হবে। প্রায় ঘোরের মধ্যে বার হয়ে আসি অফিস থেকে। চেপে বসি অটো রিক্সায়। সিগারেট ধরাই। টেরপাই বাড়িতে খবরটা জানানো প্রয়োজন। ফোন করি। জানিয়ে দিই খবরটা। মাথা কাজ করেনা। ফোন সুইচ্ অফ করে রাখি।
অটোরিক্সা ছুটে চলেছে সুদীপদার বাসার দিকে। আশ্চর্য লাগে। যা ঘটবার ঘটেগেছে আধঘন্টারো কম সময়ে! জেঠু বলতেনঃ ‘আমার এরকমই কিছু হবে। হঠাৎই হয়ে যাবে যা হওয়ার ...’ বলতেন হাসতে হাসতেই। তাই হয়তো তেমন ভাবিনি কথাটা নিয়ে। হ্যাঁ, হার্টের অসুখ ছিল জেঠুর। বেশ কয়েকবার তার জন্য থাকতে হয়েছে হাসপাতালেও। ঠিক। কিন্তু তা বলে এতো দ্রুত? এতো কম সময়ে? ... এইতো আগের রবিবারেই সুদীপদা জেঠু আর জেঠিমনিকে নিয়ে এসেছিল আমাদের বাড়ি। বাবাও তখন অসুস্থ। বাবাকে দেখতেই আসা। বহুযুগ পরে দেখেছিলাম বাবা আর জেঠুর আড্ডা ...
বেঙ্গালোর শহরের জ্যাম্ আর লালবাতির ফাঁক ফোঁকর দিয়ে চলেছে অটো রিক্সা। হিপ্নোটাইজ্ড্ হুয়া মানুষের মতন একের পরে এক সিগারেট উঠে আসছে আঙ্গুলে। চালান হচ্ছে ঠোঁটে। জেঠুও সিগারেট খেতেন খুব। একসময় প্রায় চেইন্ স্মোকারি ছিলেন বলতে গেলে। হার্টের ব্যাধিতে প্রথমবার আক্রান্ত হওয়ার পরেও বোধহয় চালিয়েছিলেন বেশ কিছুদিন। শেষ পর্যন্ত যখন বাধ্য হয়েছিলেন ছাড়তে তখন সিগারেট আর তাঁর সম্পর্ক নিয়ে একটা গদ্য লিখেছিলেন। প্রকাশিত হয়েছিল গৌহাটির ‘সময় প্রবাহ’ নামের বাংলা দৈনিকে। আমি সম্ভবতঃ তখন কলকাতা। আমার বন্ধু সিদ্ধার্থ পড়ে শুনিয়েছিল। টেলিফোনে।
যদিও ইতিহাসের পন্ডিত, ইতিহাস কেন্দ্রীক লেখালেখি ও গবেষণার জন্যই তাঁর মূল খ্যাতি তথাপি তিনি প্রকৃত প্রস্তাবে ছিলেন সাহিত্যেরি মানুষ। সিগারেট ও তাঁর সম্পর্ক নিয়ে লেখা গদ্যটির মতো আরো সংখ্যাতীত মুক্ত গদ্য সাক্ষ্য দেবে তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির প্রতিভার। তাছাড়াও তাঁর ইতিহাস নিয়ে লেখাগুলিতেও রয়েছে সেই প্রসাদগুন যার ছায়ার তাঁর বলবার কথাগুলি হয়ে উঠতো ঠাকুমা দিদিমার মুখে শোনা গল্পের মতো প্রাঞ্জল। তাঁর যুক্তিগুলি অবলীলায় গেঁথে যেতো মর্মে। তাঁর ‘শ্রীহট্ট কাছাড়ের ইতিহাস’ এমনি এক অনন্য রচনা যার কাছে আমি অদ্যাপি ফিরেযাই মূলতঃ সেই গল্প বলার ভঙ্গীটির টানে। জেঠুর এক অতি ঘনিষ্ঠ মানুষ, আমাদের স্যার, মনোজ চক্রবর্তীর কাছে শুনেছি এক সময় জেঠুকে চেপে ধরে দুচারটে গল্পও তাঁরা নিয়েছিলেন লিখিয়ে। আমার সৌভাগ্য, এতাবৎ, হয়নি সেই গল্প গুলি পড়ার। তবে সাহিত্য ও নানা সাহিত্যিকদের বিষয়ে তাঁর ভাবনাগুলি সংকলিত হয়েছে ‘ছিন্ন চিন্তা ভিন্ন মত’ নামের গ্রন্থে। তাঁর কথন ভঙ্গী ও চিন্তনের মৌলিকতার সাক্ষ্য ঐ সংকলনের প্রতিটি যতিতে, অক্ষরে প্রতিভাত।
শেষ পর্যন্ত তাঁকে দিয়ে তাঁর নিজের স্মৃতিকথা লিখিয়ে নিতে কিছুদূর সফল হয়েছিল অমিতাভদা। অগ্রজ কবি অমিতাভ দেব চৌধুরি। সেই স্মৃতিকথা, ‘হারানো দিন, হারানো মানুষ’, দুই খন্ডে, তাঁর নির্জলা সাহিত্য সৃষ্টির একমাত্র নিদর্শন।
যদিও জেঠুর প্রসংগ এলে তাঁর লেখা, তাঁর চিন্তা জগতের কথা আসবেই তথাপি এ’ও ঠিক যে তার সঙ্গে আমার সম্পর্কের সূত্রপাত কিন্তু ঘটেনি তাঁর লেখা কিংবা তাঁর বৌদ্ধিক জগতের কোনো কিছুর মাধ্যমেই। তাঁর সঙ্গে আমার চেনা আমার নিতান্ত শিশু বয়সের একজন প্রশ্রয়দাতা, স্নেহশীল ‘জেঠু’ হিসেবে – যিনি আমার বাবার সঙ্গে আড্ডা দিতে আমাদের বাড়ি এলেও আমার সঙ্গেও ঘন্টার পরে ঘন্টা সময় কাটিয়ে দিতেন ‘শুকতারা’, ‘সন্দেশ’, ‘আনন্দমেলা’য় প্রকাশিত গল্প নিয়ে কথাবলে।
ছয়ফুট মতো লম্বা, শ্যামবর্ণ, উন্নতনাসা, শ্মশ্রুগুম্ফমুন্ডিত, বাঁদিকে সিঁথি করে আঁচড়ানো চুল ( স্মৃতি এক আশ্চর্য দানব, এই লেখাটি পড়ে সুদীপদা জানলো যে জেঠু আসলে চুল আঁচড়াতেন ব্যাক্ব্রাশ্ করে, আমার তোলা তাঁর ফটোগুলিও জানাচ্ছে যে সুদীপদা’ই ঠিক। তবু আমার মনে চোখে কেনযে বার বার আসছে ঐ বাঁদিকে সিঁথি করা চুল ... ), চোখে কালো ফ্রেমের চশমা – জেঠু’কে দেখতাম হয় পরে আছেন পাজামা-পাঞ্জাবী নয়তো ধুতি পাঞ্জাবী । ইতিহাস পড়াতেন রবীন্দ্রসদন মহিলা কলেজে। আমাদের বাড়ি তখন আসতেন প্রায় প্রতি রবিবারেই। রবিবারে রবিবারে তখন স্টাডি সার্কল বসতো লঙ্গাইরোডে। আমাদের বাড়িতে। তখন সম্ভবতঃ পড়া হচ্ছিল ডারুইন। অরিজিন অফ্ স্পীসিস্। এতে আসতেন ফিজিক্সের নামী পন্ডিত, প্রেসিডেন্সির নামী ছাত্র, করিমগঞ্জ কলেজের অধ্যাপক অমিতাভ চৌধুরি। আসতেন ফিজিক্সের অধ্যাপক তুষার কাকু। তুষার দত্ত চৌধুরি। বায়োলজির প্রদীপবিকাশ স্যারও আসতেন। আসর বসতো বেলা এগারোটা নাগাদ। চলতো দুপুর পর্যন্ত। আমি তখন ক্লাস ফাইভ্ কিংবা সিক্সে পড়ি। যেসব দিনে জেঠু আসতেন সেই রবিবার গুলোতে আমাকে ডেকেও বাইরে খেলতে নিয়ে যেতে পারতোনা বন্ধুরা। বারান্দায় বসে অপেক্ষা করতাম ঐ ‘স্টাডি’ শেষ হওয়ার। শেষ হওয়ামাত্র হামলে পরে দখল করে নিতাম জেঠুকে। জেঠুও মনে মনে প্রস্তুত থাকতেন ঐ ‘দখল’এর ... মনেপড়ে ‘আনন্দমেলা’ শারদীয়াতে প্রকাশিত শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘আজব ঘড়ি’ উপন্যাস নিয়ে কি গুরু গম্ভীর আলোচনাই না জুড়েছি তাঁর সঙ্গে। মনেপড়ে কমিক্স্ পড়ানিয়ে তাঁর সঙ্গে কি বিতর্ক। জেঠুর মতে কমিক্সে ভাষা শেখা যায়না আর আমার যুক্তি ছবির দিকে –
বাবার বন্ধুদের মধ্যে এই জেঠু, সুজিৎ চৌধুরি আর শক্তিকাকু, শক্তিপদ ব্রহ্মচারী – প্রকৃত অর্থেই, আমরন, ছিলেন আমারো ‘বন্ধু’। বন্ধু বিয়োগের ব্যথা যেহেতু সরকারী অর্থে যারা আত্মিয় তাদের বিয়োগের ব্যথার চেয়ে ঢের বেশী নিবিড়, গভীর – তাই এতাবৎ পার হয়ে আসা সমস্ত মৃত্যুগুলির মধ্যে ঐ দুইটি মৃত্যুই আমাকে অদ্যাবধি নিঃস্ব, নিঃসঙ্গ করে... ব্যথিত করে ...
২।
অটোরিক্সা এসে থেমেছে সুদীপদার বাড়ির সামনে। ‘বাড়ি’ মানে ফ্ল্যাট্বাড়ি। সুদীপদা পেশায় সাংবাদিক। জেঠুর ছেলে। আমার সঙ্গে বয়সের ফারাক বছর দশেক। তাছাড়া তার বারো কেলাস পাশ হওয়ার পরেই সে করিমগঞ্জ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ফলে আগে তাকে দেখিনি। প্রথম সাক্ষাৎ এই বেঙ্গালোর শহরেই। জেঠু বেঙ্গালোর এলে জেঠুর সঙ্গে দেখা করতে সুদীপদার বাড়ি গিয়ে।
জেঠু-জেঠিমনি পাকাপাকি চলে এসেছেন সুদীপদার কাছে। এরমধ্যে জেঠিমনিও অসুস্থ হয়েছেন। চলাফেরার ক্ষমতা কমে গেছে অনেকদূর। নইলে, সেই কলেজ-ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের বাউন্ডুলে দিনগুলিতে যখন ঘন্টার পরে ঘন্টা কাটিয়েছি জেঠুর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে তখন জেঠিমনির হাতের এটাসেটা আসতো প্রতি আধঘন্টায় ...
সুদীপদার সঙ্গে আগে কখনো দেখা শোনা না হলেও জেঠু মারফৎ সুদীপদার অনেক খবরই আমি পেতাম। জানতাম তার বই কেনার আর পড়ার বাতিকের কথা। সুদীপদাও জেঠু মারফৎ আমাকেও জানতো অনেকটাই। তাই সুদীপদার সঙ্গে আলাপ পর্ব থেকে পরিচয় পর্বে যেতে সময় লাগলোনা খুব। সুদীপদার ছেলে ‘সানি’র সঙ্গে আমার ছেলের ‘অর্ক’ সমবয়সী। তাদের বন্ধুত্বও ঘটে গেলো অবলীলায়। জেঠিমনি বল্লেনঃ ‘নেও, বন্ধুত্বের তিন জেনারেশন পূর্ণ হইল...’ ...ভাবি নগর যতো নাগর হয়ে উঠছে ততোই কি আমরা হারিয়ে ফেলছি না এই ‘বন্ধুত্ব’ গুলি? এই আত্মা’র আত্মিয়তাগুলি? এই বানিয়ে তোলা ‘কাকু’, ‘জেঠু’, ‘মাসী’র জায়গায় ‘আঙ্কল্’, ‘আন্টি’ র শূন্যতা কে ভরে নিয়ে আমরা কোথায় চলেছি? ... মনেহয়, মনেপড়ে ... যেন এইতো সেদিন – মনেপড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি করিমগঞ্জ মিশন রোডের অন্ধকারে ঘাপটি মেরে। রাত দশটা পেরিয়ে গেছে। শীতের রাত। মফস্বল শহর ঘুমিয়ে পরেছে ন’টা বাজতেই। রাস্তার কিনারের চল্লিশ পাওয়ারের বাল্বগুলি ঘিরে জমেছে কুয়াশা। শিবুদার সাইকেল আর সাইকেল রিক্সা রিপেয়ারিং এর দোকানও বন্ধ। দাঁড়িয়ে আছি ঐ বন্ধ দোকানের বারান্দায়। অপেক্ষা জেঠু কখন বেরোবেন আড্ডা সেড়ে। মোড় পেরিয়েই ‘মহানায়ক’ পত্রিকার অফিস। ওখানে বসতো আড্ডা শহরের ‘বড়’দের। বলাহতো ‘রাষ্ট্রসংঘ’।আড্ডা সেড়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতেন জেঠু। ঐ সময়টা আমি তাঁর সংগ নিতাম। তখন ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ি। থাকি শিলচরে। হোস্টেলে। কিন্তু মন টেঁকেনা। এক রাতের জন্য এসে বাবার বকা ঝকা, মার অনুনয় সমস্ত এড়িয়ে মাসের মধ্যে দশ দিন কাটাই বাড়িতেই। জেঠু তখনো রিটায়ার করেননি। ফলে দিনে তাঁকে পাওয়া যায়না প্রায়। ছুটির দিনে গেলেও একা পাওয়া মুশকিল। কেউ না কেউ থাকেই তাঁর কাছে। ফলে রাতের ঐ নিঝ্ঝুম সময়টুকুর অধিকার করিমগঞ্জে থাকলে আমি ছাড়িনা কিছুতে।
‘রাষ্ট্রসংঘের’ আড্ডা ভাঙ্গে। দেখাযায় কেউ স্কুটারে চাপছেন। কেউ সাইকেলে। কেউ আবার রিক্সা পাওয়া যায় কি’না দেখতে হাঁটছেন বাজারমুখো। এদের সবাইকে পেছনে রেখে পাজামা-পাঞ্জাবী আর গায়ে শাল জড়ানো একজন লম্বা মানুষ, মুখে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে আসেন মিশন রোডের মোড়ের দিকে। আমি জানি ঐ মানুষ জেঠু। ঐ জ্বলন্ত সিগারেট চারমিনার। আমি আমার সদ্য জ্বালানো চারমিনারটা পায়ে পিষে নিভিয়ে দিয়ে এগিয়ে যাই তাঁর দিকে।
‘জেঠু’ –
তিনি জানেন আমি থাকবো। বলেনঃ ‘ও, তুই আস্স – চল্’
শুরু হয় পথচলা। কথায় কথায় ...
কথা। কতো কথা ... কতো ভাবনা। হায়, যদি লিখে রাখতাম ... আজ ভাবি ... শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশংকর, বিভূতিভূষণ থেকে ফ্রেজারের ‘গোল্ডেন বাউ’। মানবেন্দ্র নাথ রায় থেকে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। শিবনাথ শাস্ত্রি’র শিশুদের জন্য রচনা থেকে প্রেমেন মিত্তির, লীলা মজুমদার হয়ে সত্যজিৎ রায়... ‘বোমার ভয়ে বার্মা ত্যাগ’হেন না শোনা নাম, নাজানা কাহিনী ... বাংলা শিশুসাহিত্য এই মানুষটির মতো এতো নিবিড় করে পড়েছেন এমন কাউকে আমি এতাবৎ জানিনা। - ঐ কথা বল্লেই জেঠু বলতেন তাঁর ‘টোকোদা’র কথা। অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যে যিনি মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নামে পরিচিত। তাঁরা ছোটোবেলায় ছিলেন করিমগঞ্জেই। সেই ‘টোকোদা’র বইএর সংগ্রহের কথা বলতেন জেঠু। বলতে বলতে ঢুকে পড়তো নানা বই, নানা লেখক বিষয়ে তাঁর মৌলিক ভাবনা। কথা। কতো কথা ... কতো ভাবনা। হায়, যদি লিখে রাখতাম ... আজ ভাবি ...
জেঠুর সঙ্গে সাহিত্য নিয়েই আমার কথা হতো বেশী আর সাহিত্য নিয়ে কথা উঠলেই যাঁদের প্রসঙ্গে সব চেয়ে বেশী কথা বলতেন জেঠু তাঁরা হচ্ছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আর আগাথা ক্রিস্টি।
বিভূতিভূষণকে নিয়ে বাংলা ভাষায় এতাবৎ লিখিত সমস্ত প্রবন্ধের শ্রেষ্ঠ কয়েকটি অবশ্যই জেঠুর লেখা। ‘ছিন্ন চিন্তা ভিন্ন মত’ সংগ্রহে রয়েছে ঐ লেখাগুলি। এর মধ্যে একটি পাঠ করেছিলেন সাহিত্য একাডেমীর দ্বারা আমন্ত্রিত হয়ে একবার। পরে, বাবার কাছে জেনেছি ঐ সময়ে সাহিত্য একাডেমীর চেয়ারম্যান নির্মল ভট্টাচার্য ঐ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে ফোনে শক্তিকাকু’কে বলেছিলেন ‘ আন্ডাউটেড্লী দ্য বেস্ট’। বিভূতিভূষণ নিয়ে আরেকটি প্রবন্ধ সম্ভবতঃ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল সুকুমার বাগচি সম্পাদিত গৌহাটির বাংলা দৈনিক ‘সময় প্রবাহ’তে। শরদিন্দুর ভাষা আর আগাথা ক্রিস্টির চরিত্রায়ন নিয়ে কতোযে মৌলিক বিশ্লেষন দিয়েছেন জেঠু ...
বলতেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অন্তর্দৃষ্টির কথা। বলতেন মধ্যবিত্ত সংসার জীবনের ভালোমন্দের কথা – ভালোর দিকে যাওয়ার সহজ পথনির্দেশ এমন ভাবে আর কোথাও নেই। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘যাওপাখি’ ছিল জেঠুর মতে সংসার জীবনের বাইবেল। “স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্ক থেকে সন্তানের প্রতি পিতার আবার মাতাপিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য – এই স-ম-স্ত জিনিসগুলি শীর্ষেন্দুর ঐ লেখা থেকে শেখার। আমি’ত সুদীপ-চৈতী দুজনকেই ঐ বই কিনে দিয়ে সব সময় পড়তে বলেছি ...’ আমার বিয়ের পরে নতুন বৌ নিয়ে তাঁর বাড়ি প্রথমবার গেলে প্রথমেই বলেছিলেন জেঠু ‘ওকে ‘যাওপাখি’ পড়িয়েছিস্ তো?’ – শীর্ষেন্দু’কে নিয়ে কিছু যদি লিখতেন জেঠু বিভূতিভূষণকে নিয়ে তাঁর লেখাগুলির মতোই সে’ও অবশ্যই হতো ‘ আন্ডাউটেড্লী দ্য বেস্ট’।
... হাঁটতে হাঁটতে পার হচ্ছি বনমালী রোডে যাওয়ার বাঁশের সাঁকো, পার হচ্ছি রেশনের দোকানের মুখোমুখি বাঁশঝাড়, কুয়াশায় গাঢ় হচ্ছে, ক্রমে। পার হচ্ছি থানার টিলার নীচের যমজ বট। তারপর বাঁদিকে পর পর দুটো গলী। মধ্যে পুকুর। দ্বিতীয় গলীটি গিয়ে মিলেছে নটী খালের সমান্তরাল লঙ্গাইরোড গামী রাস্তায়। ঐ গলীরি প্রান্তে ‘দুলাল কুঠি’। জেঠুদের তখনের বাসা। তরজার বেড়াঢাকা। বাঁশের গেট। ঐ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আরো কিছুক্ষন গল্প গাছা। তারপরে জেঠু ঢুকে পরেন গেট খুলে। আমি সিগারেট ধরাই। হাঁটি। পথের কিনারে কিনারে ‘Quiet Flows The Don’ ‘ধীরে বহে নটীখাল’ ...
৩।
জেঠুকে নতুন বৌ দেখাতে যাওয়ার সন্ধ্যাটি মনেপড়ে। সম্ভাব্য বৌ খবর জেঠুকে জানিয়েছিলাম সর্বাগ্রে। কিন্তু বিয়ের সময় ঘটলো এক মজার ঘটনা। আমার আর সুদীপদা’র বিয়ে হয়েছিলো একই দিনে। ফলে বিয়েতে আসতে পারেননি জেঠু।
এক সন্ধ্যাবেলা নতুন বৌ নিয়ে হানা দিলাম জেঠুর বাড়ি। জেঠু তখন রিটায়ার করে ফেলেছেন। ‘দুলাল কুঠি’ ছেড়ে বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন আমাদের গলীর মোড়েই ওয়াচালি স্যারের গলীতে। আমার বৌ ‘জেঠ’' ও তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক বিষয়ে অবহিত। তাই উৎসাহ আছে তাঁকে দেখবার। আবার এর আগে এতটা অসমবয়সী বন্ধুত্ব দেখেনি বলে একটু নার্ভাসও বটে।
সেদিন অনেক কথা বলেছিলেন জেঠু। সবচেয়ে বেশী মনেপড়ে, যেন আজো কানে বাজে এই কথাগুলিঃ ‘শোন্, আমাদের এই যে সমাজ তাতে পুরুষকেই সব সংসারে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ভালো হোক্, মন্দ হোক্ - এটাই আমাদের সমাজের অকথিত নিয়ম। কাজেই তোর সংসারেও তুই, যেহেতু পুরুষ, তাই এমনিতেই প্রধান। কাজেই ঐ প্রাধান্যকে প্রতিষ্ঠা বা পরীক্ষা করার জন্য এমন কিছুই করিস্ না যাতে এই মেয়েটি ও তার মা-বাবা-পরিজন দুঃখ পায়। আঘাত পায়...’ ... আমার জীবনে তাঁর বলা আরো অনেক কথার মতন এই কথাটিও রাখতে পারিনি। তবে যখনি স্ত্রীকে বা তার মা-বাবা-পরিজন’কে দুঃখ দিয়েছি তখনি মনে এসেছে জেঠুর কথাগুলি। কখনো স্বপ্নে বেজেছে ভর্ৎসনার মতো ... মনে হয়েছে এই মানুষটি আমাকে যতোটুকু চিনেছিলেন আমার জন্মদাতা মাতাপিতাও আমাকে অদ্যাপি ততোটুকু চেনেন কি? ...
করিমগঞ্জ- শিলচর শহরে একটা সময় এমনই হয়েছিল যে আমার বিষয়ে কিছু নালিশ থাকলে শহরের লোকে আমার বাবাকে না জানিয়ে সে নালিশ জানাতো জেঠুর কাছে। আমার হয়ে অন্যলোকের কাছে সাফাই গাওয়া, এমনকি এক সময় আমার জন্মদাতা পিতার কাছেও – করেছেন জেঠু। করেছেন শক্তিকাকু। আবডালে আমাকে শাসনও করেছেন দুইজনই। তবে শাসন করতে গিয়ে বা উপদেশ দিতে গিয়ে তাঁরা কখনোই যাননি আমার ‘স্বভাব’ এর বিপরীতে। ফলে তাঁদের শাসন কিছুটা হলেও মেনে চলার চেষ্টা করেছি। আজো করি।
নেশাভাঙ্ করা শিখেছিলাম এগারো কেলাশ থেকে। ক্রমে জড়িয়ে
পরেছিলাম একটি মেয়ের সঙ্গেও। সেই বয়সের নিয়মেই সেই জড়িয়েপরার জাল ছিঁড়েও গিয়েছিল
অচিরে। তখন ঐ ঘটনার দোহাই দিয়ে নেশা ভাঙ্গের মাত্রা বাড়িয়ে আমার দিনগুলি তখন বেশ
দেবদাস। ছোটো
শহর। জেঠুর কানেও উঠেছে সব কিছুই। নেশা করলে জেঠুকে এড়িয়েই থাকতাম সাধারনতঃ। একদিন
আর পারলাম না। বেসামাল না হলেও খানিকটা নেশাগ্রস্থ অবস্থাতেই তাঁকে পাকরালাম
সন্ধ্যাবেলা। বাড়ি থেকে বার হয়ে তখন তাঁর রাস্ট্র সংঘে যাওয়ার সময়। কি বুঝলেন জানিনা।
রাস্ট্র সঙ্ঘে না গিয়ে আমাকে নিয়ে গিয়ে বসলেন ‘ভারতী প্রেস”এ। কথায় কথায় এক
সময় সব বলেই ফেল্লাম তাঁকে। শুনলেন। ব্যথিত হলেন। বল্লেন “এই সমস্ত এই বয়সে ঘটে।
বেশী কিছু বলছিনা, শুধু
বলছি আমরাও এই বয়সটা পার হয়ে তবেই না বুড়ো হয়েছি। ... কি আর বলি তোকে? তবে তোর যদি
মনেহয় আমার মতো বুরো মানুষের সঙ্গ ( আদপে তখন ততো কিছু বুড়ো নন জেঠু, সেটা ১৯৯০-৯১
সাল) যদি তোকে ঐ সমস্ত নেশা ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে আমার কাছে যখন
ইচ্ছা চলে আসিস্ । আমি সব কাজ বাদ দিয়ে তোকে সঙ্গ দেবো ...’ ... হায়, ঐ কথাগুলি, ওই স্বর যেন
আজো শুনতে পাই! শুনতে পাই আর জানতে পারি আর কেউ আমাকে কোনোদিন এভাবে বলবেনা...
প্রশ্রয় দেবেনা ... মনে আসে Old man and the sea …
এর কিছুকাল পরেই বোধহয় জেঠু সিমলা গেলেন সম্ভবতঃ সেন্টার অফ্ এড্ভান্স্ড্
স্টাডিসে কিছু একটা করতে। তখন নিয়মিত চিঠি বিনিময় হতো আমাদের। আমি, যথারীতি, লম্বা লম্বা
চিঠি পাঠাতাম খামে পরে। জেঠু উওত্তর দিতেন পোস্টকার্ডে। কিন্তু ঐ পোস্ট কার্ডের ঐ
ছোট্ট দেড়পাতায় আমার সমস্ত প্রশ্নের, কৌতুহলের জবাব থাকতো। ঐ চিঠিগুলি, হায়, ... ‘হায়রে হৃদয়, তোমার সঞ্চয় –
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয় ...’ ... ঐ চিঠিগুলিতে থাকতো তাঁর
সিমলা জীবনের, যাপনের
কথাও। একটা চিঠিতে লিখেছিলেন। সিমলার ঐ স্টাডি সেন্টারের লোকজন প্রসঙ্গেঃ ‘এখানের
মানুষজনেদের বেশীর ভাগেরি বিদ্যার থেকে বুদ্ধির দৌড়’ই বেশী...’
আমার জীবনে ফ্রেজার, নীহার রঞ্জন রায়, মানবেন্দ্র নাথ রায় থেকে আন্তোনিও গ্রামসী’ – এঁদের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঐ জেঠুর মাধ্যমেই। তাঁর নিজের সংগ্রহের বই পুঁথি ত দিতেনই পড়তে, রবীন্দ্রসদন কলেজের লাইব্রেরী থেকেও জোগান দিতেন বইএর। পরে অবশ্য এ’ও বলেছিলেনঃ ‘ জানা আর বোঝার জন্য, মানে curiosity মেটাতে ত ঢের পড়লি। এবার আস্তে আস্তে শুধু ভালোলাগার পড়ার দিকে যা...’ এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে জেঠুর বলা একটি anecdote … নীরদ সি চৌধুরির তখন প্রবল দৈন্য দশা চলছে। তথাপি নীরদ সি প্রায়ই কিনে আনেন পাশ্চাত্য সঙ্গীতের দামী দামী রেকর্ড। একদিন নীরদ সি’র স্ত্রী নীরদ সি’কে বল্লেন ‘আমাদের তো রেকর্ড প্লেয়ারই নেই, তবু তুমি এতো এতো রেকর্ড কেন কিনে আনছো?’ উত্তরে নীরদ সি বল্লেন যে টাকা হলে যে কোনো সময়ই রেকর্ড প্লেয়ার কিনে নেওয়া যায়। কিন্তু ঐ রেকর্ডগুলো ত তখন আর না’ও পাওয়া যেতে পারে। তাই কিনে রাখা ...
জেঠুর মতে এই সময়ের বেশীরভাব বিজ্ঞাপিত বিদ্বানদের ব্যাপারটা এই, যে, তারা রেকর্ড কিনে রেখেছে ঠিকই। কিন্তু প্লেয়ারটা আর তাদের কেনা হয়নি। তাই তাদের পাঠ বেজে ওঠেনি তাদের মর্মে। তাই বিদ্যার থেকে বুদ্ধির দৌড়েই এরা পারদর্শী ...
তখন কথাটা যতোনা বুঝেছিলাম, আজ নানা ঘোষিত ‘বিদ্বজ্জন’দের বেশ কাছ থেকে দেখে জেঠুর ঐ কথাটির সত্যতা টের পাই হাড়ে হাড়ে।
৪।
লেখালেখি করতাম ছোটোবেলা থেকেই। ক্রমে হয়ে উঠলাম ‘কবি যশোপ্রার্থী’। কবিতা লিখছি। বন্ধুদের পড়াচ্ছি। তারা খুব পিঠ চাপড়ানি দিচ্ছে। ফুলে ফেঁপে আরো লিখছি। ছাপাও হচ্ছে কিছু কিছু কবিতা এখানে ওখানে। জেঠুও পড়ছেন। উৎসাহ দিচ্ছেন। কিন্তু সাহস পাচ্ছিনা। নিজের লেখার সঙ্গে নিজে যখনি একা হচ্ছি মনে হচ্ছে লেখাগুলো কি কবিতা হচ্ছে ঠিক? – জেঠুর প্রসংশাতেও ঠিক নির্ভর করতে পারছিনা কেননা ততোদিনে জেঠু যে আমাকে ঠিক কি রকম স্নেহ করেন তা টের পেতে শিখে মনেহচ্ছে তাঁর প্রসংশার মর্মেও হয়তো আছে ওই স্নেহ –
কথাটা একদিন খোলাখোলি বল্লাম জেঠুকে। বল্লামঃ ‘আমার মনেহয় তুমি আমাকে ভালোবাসো বলেই বলো আমি ভালো লিখি’ –
জেঠু হাসলেন। বল্লেনঃ ‘কথাটা একেবারে মিথ্যেও নয় আবার পুরো সত্যিও নয়। তবে পরীক্ষা করতে চাইলে একটা কাজ কর – ‘সাহিত্য’ পত্রিকাতে তোর লেখা পাঠিয়ে দে’ –
‘সাহিত্য’ পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন বিজিৎ ভট্টাচার্য। অনেক দিনের পত্রিকা। তখনকার দিনে যাদেরকে আমার ‘বড় কবি’ মনেহতো এমন অনেকেরি লেখা ছাপা হয় সেখানে। ঐ পত্রিকাতে জেঠু নিজেও লেখেন। সেটা ১৯৯১ সাল। জেঠুর ‘শ্রীহট্ট কাছাড়ের ইতিহাস’ তখনই বোধহয় ‘সাহিত্য’তে ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে। জেঠু আরো বল্লেনঃ ‘বিজিৎ নিজে লেখে তাছাড়া এতো বছর ধরে নানা জনের অনেক ভালো কবিতা প্রকাশ করেছে। ও নির্বাচন করলে একটা মানে নিশ্চয়ই থাকবে। আর তাছাড়া’ হেসে বল্লেন জেঠুঃ ‘ওর সঙ্গে তোরতো পরচয় ও নেই যে আমার মতো সন্দেহ করবি তার নির্বাচনে ...’
‘কিন্তু যদি না ছাপে?’
‘ছাপবে’ একটু থেমে, প্রত্যয়ের সঙ্গে বল্লেন জেঠুঃ ‘আমি জানি, তোর লেখা ছাপবে’।
আমার নিজের লেখার উপর নিজের ভরসা থেকেও জেঠুর ঐ প্রত্যয়ভরা ‘আমি জানি, তোর লেখা ছাপবে’র উপর ভর করে দিলাম একটা লেখা পাঠিয়ে। আজো মনে আছে ঐ লেখাটি। পয়ারে। ‘প্রতিশ্রুতির পাথর গুলো’ ... দীপাবলীর পরে বাড়ি থেকে হোস্টেলে যেতে, বাসে লেখা ...
পরের সংখ্যা ‘সাহিত্য’ এলো বাড়িতে। চুপি চুপি খুলে দেখি অন্য অনেক কবিতার সঙ্গে ছাপা হয়েছে আমার নাম। আমার কবিতা ‘প্রতিশ্রুতির পাথর গুলো’। পিওন এসে কাগজ দিয়ে গেছে দুপুরে। জেঠু তখন নির্ঘাৎ কলেজে। তাই বিকাল অব্দি কোনোমতে কাটিয়ে, পত্রিকার সংখ্যাটা হাতে নিয়ে ছুটলাম জেঠুর বাড়ির দিকে। জেঠুকে পেয়ে গেলাম পথেই। বাড়ি ঢুকছেন তখন। আমাকে দেখেই বল্লেনঃ ‘দেখলি ত, তোর লেখা ছাপা হলো... বলিনি?’
সেই থেকে ‘সাহিত্য’তে নিয়মিত লিখেছি দীর্ঘদিন। ‘সাহিত্য’তেই আমার লেখা পড়ে আমাকে অনেকে চিনেছে প্রথম। জেনেছে প্রথম। ঐ পত্রিকাতেই আমার লেখা পড়ে দেবাশিস তরফদার চিঠি লিখে কবিতা চাইলেন তাঁদের ‘অনুবর্তন’ পত্রিকার জন্য। ‘অনুবর্তন’ এ লেখার সূত্রে, ক্রমে, আমার পরিচয় হলো বৃহত্তর পাঠক সমাজের সঙ্গে – এই সময়ের অনেক প্রধান কবি, লেখকের সঙ্গে... কিছু কিছু পাঠকের মর্মে প্রতিষ্ঠাও পেলো আমার কবিতা ... আজ ভাবি জেঠু যদি ঐ দিন ঐ উৎসাহটুকু না দিতেন, না জ্ঞাপন করতেন তাঁর প্রত্যয়, আমার লেখার উপরে তাহলে আমার জীবনের ইতিহাস নিশ্চিত হতো অন্য রকম কেননা যদিও আমি লিখে খাইনা তথাপি আমি আসলে লিখে বাঁচি, ঐ লেখার, লিখতে পারার মূল্যে আমি সক্ষম হই যাপনের বহু কুশাংকুরকে পায়ে পিষে যেতে ... আর কোথাও প্রকাশ না হলে, পাঠকের মুখ না দেখলে, অন্যের কথা জানিনা, আমার পক্ষে অন্ততঃ অদ্যাবধি এই চর্চা চালিয়ে যাওয়া হয়তো সম্ভব হতোনা।
বাংলা কবিতার পৃথিবীতে আমার শিকড় গাঁথা ও সেই শিকড়ের বিস্তারের অনেকটাই দেখে গেছেন জেঠু কিন্তু যা দেখে যেতে পারেননি তা আমার মুদ্রিত প্রথম বইটি। আমার প্রথম বই ‘পাপের তটিনী ধরে’ আমার হাতে আসে জেঠুর মৃত্যুর হপ্তা খানেক আগে। ভেবেছিলাম দোলের সময় তাঁকে দেবো তাঁর কপি। কিন্তু নিয়তির মনে ছিল অন্য অভিপ্রায়। তাই পরের সপ্তাহে যখন দেখলাম জঠুকে তখন তাঁর মরদেহ মেঝেতে শায়িত ...
৫।
জেঠু যখন পাকাপাকি চলে এলেন সুদীপদার কাছে, ব্যাঙ্গালোরে, তখন ভেবেছিলাম তাঁকে ঘিরে আরম্ভ হলো আমারও জীবনের আরেক অধ্যায়। আমাদের বাড়ির আর সুদীপদার বাড়ির দূরত্ব আর অফিস-যাপন, আইটি যাপনের কারনে খুব ঘন ঘন তাঁর কাছে যাওয়া যে হতো তেমন নয়। তবু মনের কোনোখানে এই বোধটুকু থাকতো যে জেঠু খুব দূরে নয়। ইচ্ছে করলেই গিয়ে হাজির হওয়া যায় তাঁর কাছে। কথা বলা যায়। কথা শোনা যায় ...
আমি তখন হাসপাতালে, সাইনাসের অপারেশান হয়েছে আমার, জেঠুকে ফোন করেছিলাম। জেঠু দেশ’ পত্রিকা থেকে একটা কবিতা পড়ে শুনিয়েছিলেন। ‘মাঝে মাঝে হঠাৎ এরকম কিছু ভালো কবিতা এখনো ছাপা হয়েযায় এই কাগজে’। বলেছিলেন জেঠু। যেহেতু জেঠু ছিলেন গোয়েন্দা কাহিনীরো নিবিড় পাঠক তাই প্রথম যখন জর্জ সিমোনো’র ম্যাগ্রে কাহিনীগুলি পড়ি তখন থেকেই ইচ্ছে ছিল জেঠুকে ম্যাগ্রে পড়ানোর। জেঠু পড়লে আনন্দ পাবেন আর এ ছারাও লোভ ছিল এই আন্কোরা নতুন ধরনের কাহিনীগুলি নিয়ে জেঠুর ভাবনা শোনার। একদিন এক খন্ড ম্যাগ্রে অমনিবাস নিয়ে হাজির হয়েছিলাম। দিয়েছিলাম পড়তে তাঁকে। হায়, তখন কে জানতো এ’ই হবে তাঁকে আমার শেষ বই পড়তে দেওয়া?
জেঠু বেঙ্গালোরে আছেন। ইচ্ছে করলেই গিয়ে হাজির হওয়া যায় তাঁর কাছে। কথা বলা যায়। কথা শোনা যায় ... এই বোধটুকুতে ভর করে উঠতে না উঠতেই এলো ঐ এস্এম্এস্ - অটোরিক্সা আমাকে এনে দাঁড় করালো তাঁর মুখোমুখি। জেঠুর দেহ মেঝেতে শোয়ানো। কিনারে জেঠিমনি বার বার ভেঙ্গে পরছেন কান্নায়। দরজায় উপচানো ভিড় কিন্তু বিভুঁই’এর এই ভিড়ে আছে কি সেই মুখগুলি যেগুলি তাঁর মৃত্যুতে সত্যিই মলিন? ঐ’তো শায়িত জেঠুর দেহ কিন্তু ওই দেহ আর উঠে দাঁড়াবেনা কোনোদিন, বলবেনা কোনোদিন ‘কি আর বলি তোকে? তবে তোর যদি মনেহয় আমার মতো বুরো মানুষের সঙ্গ যদি তোকে ঐ সমস্ত নেশা ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে আমার কাছে যখন ইচ্ছা চলে আসিস্ । আমি সব কাজ বাদ দিয়ে তোকে সঙ্গ দেবো ...’ ... এইতো আবার ফোন করা হলো এম্বুলেন্সের চালককেঃ ‘কিধার হো আভি?’
‘আ রহা স্যার। পাঁঞ্চ মিনিট ...’
এই শহরের নাম বেঙ্গালোর। এখানে উঠতে আইটি বসতে আইটি। এখানে যারা থাকে তাদের মা বাপ থাকেনা। থাকলেও থাকে ‘দেশ’এ। সেখানে একাঘরে মড়ে যায় তারা। আর নাহলে এখানে যদি থাকেই তো থাকে ছেলে আর বৌ’এর যুগ্ম উপার্জনে সাহায্য করার জন্য বাচ্চা দেখার আয়া হয়ে। এখানে মরদেহ বাহিত হয়না বাঁশের ‘খাট’এ। এখানে ‘কাঁধ’ দেওয়ার রীতি উঠেগেছে বহুযুগ। এখানে মরদেহ যায় এম্বুলেন্সে করে। এখানে রাত্রি আটটার পরে শ্মশান খোলা রাখাতে গেলে শ্মশানওয়ালাকে ঘুষ দিতে হয় তিন হাজার টাকা। এখানে সুজিৎ চৌধুরি নামটি কারোর মর্মে তোলেনা, তুলবেনা কোনো আলোড়ন! আমি সুদীপদার বাড়ির পেছনের ব্যালকনীতে দাঁড়িয়ে টেনে যাচ্ছি একের পরে এক সিগারেট। কোনো স্মৃতি, কোনো অনুভুতি টের পাচ্ছিনা। ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসা গুঞ্জন, কান্নার ধ্বনি সমস্ত মিলে মিশে কিযেন বলতে চাইছে কিন্তু আমার অনুভুতির টাওয়ার ব্যর্থ হচ্ছে তার অনুধাবনে। সময় বয়ে যাচ্ছে তার অমোঘতায়। আসছে এম্বুলেন্স। তোলা হচ্ছে জেঠুকে। কারো একটা গাড়িতে বসে আমিও চলেছি শ্মশানের দিকে ...
শ্মশানের কিনারেই রেল লাইন। একটা রেলগাড়ি ছুটে গেলো হুইসেল বাজিয়ে। ঐ’ত চিতায় পুড়ে যাচ্ছেন জেঠু। মুখাগ্নি করছে সুদীপদা। মনেপড়ছে কোথাও নাগাজাতি ও নাগাল্যান্ড বিষয়ে ইংরেজিতে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন জেঠু। শিলচরের “খ” পত্রিকার গৌতমদা ঐ প্রবন্ধটি কাউকে দিয়ে বাংলা করিয়ে প্রকাশ করতে চেয়েছিল “খ”তে। কিন্তু ঐ বাংলা অনুবাদ পছন্দ হলোনা জেঠুর। বল্লেন নিজেই অনুবাদ করে দেবেন। কিন্তু শরীর তখন অসুস্থ থাকায় টানা লিখতে পারছেন না জেঠু। তাই ঠিক হলো জেঠু মুখে মুখে বানলা করে বলে যাবেন আর আমি টুকে নেবো। পরে জেঠু পুরোটা এডিট্ করে দেবেন। তখন জেঠু থাকেন ওয়াচালি স্যারের গলীর বাড়িতে। রোজ সকাল বিকাল যাই নোট নিতে। মধ্যে মধ্যে উঠে গিয়ে চারমিনার কিনেও আনতে হয় জেঠুর জন্য। ঐ সুযোগে আমিও ফুঁকে নিই সিগারেট। ফাঁকে ফাঁকে চা আসে। আসে জেঠিমনির হাতের নানান সুখাদ্য। ‘বাপী’ এসে দিয়ে যায়। - ‘বাপী’ বলে দরিদ্র পরিবারের মেয়েটিকে জেঠু নিজের কাছে রেখেছিলেন নিজের মেয়ের মতো করেই। ইস্কুল কলেজ পড়িয়ে সুপাত্র ন্যস্ত করা অবধি দায়িত্ব নিয়েছিলেন তার। ভাবি, এর চেয়ে ঢের অল্প কিছু অন্যের জন্যে করেই লোকে বাজারে নিজের ঢোল পিটিয়ে বেড়ায় আর জেঠু কি অবলীলায়, নিঃশব্দে করে গিয়েছিলেন কাজটি ...
বেদব্যাসের ভূমিকায় জেঠু আর গণেশের ভূমিকায় আমি - আমাদের এই নোট-পর্ব চলেছিল হপ্তা খানেক। ঐ নোটের ফাঁকে ফাঁকে জেঠুর কাছে শুনছিলাম নাগাল্যান্ডের ইতিহাস। ইতিহাস থেকে চলে আসছিল সাহিত্য। যথারীতি। ইঞ্জিনীয়ারিং পরার দ্বিতীয় বছরে ঠিক করেছিলাম ইঞ্জিনীয়ারিং ছেড়ে দেবো। তখন বাবা বলছিল ইংরেজি অনার্স নিয়ে পড়ে নিতে। জেঠু বলছিলেন ইতিহাস। - সেই প্রসংগও উঠেছিল কথা প্রসঙ্গে। জেঠু তখনো বলছিলেনঃ ‘তুই ইতিহাস নিয়ে পড়লে ভালোই হতো ...’ ... যেদিন ঐ নোট নেওয়া পর্ব শেষ হয়ে গেলো সেদিন বিকালেই চলে গিয়েছিলাম শিলচর। এক অদ্ভুত শূন্যতার বোধ ঘিরেছিল আমাকে –
ঐ রকমেরি এক শূন্যতা বোধ নিয়ে দেখছি চিতায় পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন জেঠু। আস্তে আস্তে ফিরে আসছে বোধ। টের পাচ্ছি আর কেউ তাঁকে কোনোদিন দেখবেনা সিগারেট মুখে নিয়ে বার হয়ে আসতে ‘রাস্ট্র সঙ্ঘের’ আড্ডা সেড়ে। রাত্রির পথে। করিমগঞ্জে। আর কোনোদিন জেঠু কথা বলবেন না বিভূতিভূষণ নিয়ে ...শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ভূতের গল্প নিয়ে কথা বলতে বলতে চলে যাবেন না মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গে ... আর কোনোদিন তাঁর কলম লিখবে না কোনো অক্ষর ...উগ্র অসমীয়া জাতিয়তাবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবেন না আর ... জেঠু আস্তে আস্তে হারিয়ে যাবেন সকলের স্মৃতি থেকেও ...
৬।
সুজিৎ চৌধুরী। ডঃ সুজিৎ চৌধুরী। তবু জীবনে “ডঃ” লিখেননি নামের আগে কোনোদিন। জীবনে দেখিনি আত্মপ্রচার বা আত্মগৌরবে লীপ্ত হতে বা সেরকম কোনো সুযোগের সদ্বব্যবহার করতে। অসমীয়া সাহিত্য থেকে বাংলা অনুবাদের জন্য পেয়েছিলেন একাডেমী পুরস্কার। পেয়েছিলেন নরসিংহ দাস পুরস্কার। আরো অনেক কিছুই পেয়েছিলেন – আমার হয়তো জানা নেই। কিন্তু এই পুরস্কার গুলি, এই লেখালেখি গুলিই কি তাঁর আসল ও শেষ পরিচয়? কারো কারো কাছে হয়তো তা’ই। কিন্তু আমার কাছে ঐ সমস্ত ছাড়িয়ে জেঠু এক বিরাট মাপের ছায়াদায়ী বৃক্ষ – আজ যাঁর চিতার সামনে দাঁড়িয়ে আমি টের পাচ্ছি আমার নিঃস্বতা ...
#
জেঠুকে চিতায় ভাসিয়ে দিয়ে, ফিরে এসে সেই রাত্রে লিখেছিলামঃ
প্রায় অবিশ্বাস্য অথচ এক অন্তিম সম্ভাবনারি সাংকেতিক নাম মৃত্যু। রাত্রির নিশুতি আকাশকে ছুঁয়ে থাকা বৃদ্ধ,অতিবৃদ্ধ ঝুড়িনামা বৃক্ষরাজির ছায়াতে, বিশীর্ণ চন্দ্রালোকে অথবা নাক্ষত্রিক অলীকতার স্পর্শাতীত আড়ালে আবডালে অপরের রুক্ষহাতে বিরচিত শরশয্যায় অনিচ্ছার এই যে শয়ন – যার একধারে মুখাগ্নি অথবা কফিন – অন্যধারে রাত্রির চষাক্ষেতে দিগন্ত-বিস্তারী কুয়াশার শ্রান্ত ইষ্টিশান,শ্লথগামী রেলগাড়ি,কুয়োতলা,সাঁকো ও পুকুর এবং তোমার সব বই-পুঁথি,চিঠিপত্র,দোয়াত ও লেখনী – ইজিচেয়ার,পাশবালিশ,ছোট্ট টেবিলটিতে ঢেকেরাখা এক গেলাস জল – - এ সকলি অতিশয় নিগূঢ়ার্থ জ্ঞাপনে সক্ষম...অথচ যে নিগূঢ়ার্থ নিয়ে সকলেই আজীবন অতিশয় উদাসীন থেকে,বহু বহু দাহকার্য্য শেষকরে এসে,স্নান সেড়ে,হাতে ছুঁয়ে সামান্য আগুন ভাতখেয়ে নিদ্রা যায় মাদুর বিছিয়ে...তারাতো জানেনা কবে এবং কিভাবে মৃত্যু এসে টুকেনিচ্ছে ক্রমে –মাদুর,পাটী ও গ্রন্থ, প্রিয় পাখা, দোয়াত আর ধুতি ও চাদর ...
ফলতঃ অন্তিম দৃশ্যে এতোবেশী অবিশ্বাস্য সম্ভাবনা হয়ে মৃত্যু এসে হানাদেয় আর
রাতের রেলগাড়ি যায় শ্লথপায়ে আকাশে হারিয়ে ...
[ প্রথম প্রকাশঃ দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ, শিলচর ]