প্রসঙ্গ – ‘অনীক’
মনেপড়ে রৌদ্রে রৌদ্রে জ্বলেওঠা সেই দিনগুলি। বোঝা না বোঝার কুহকের পরপারে আসলে
স্বপ্ন একটি অর্থনৈতিক শোষনহীন পৃথিবী গড়ে তোলার কাজে আপনার ভূমিকা রেখে যাওয়ার।
তখন ‘নকশাল’ শব্দে আর না আছে ঐ গ্ল্যামার না আছে ভীতি। নব্বই’এর দশক সেটা। আমরা
ডিঙ্গিয়েছি বারো কেলাস। তত্ত্ব, তথ্য থেকেও ঢের বেশী নিজ অভিজ্ঞতাবলে জেনে নিয়েছি শোষনহীন
পৃথিবী গড়ে তোলার পথে সিপিএম আর নেই। ঐ টুকু ‘বোঝা’, ‘হাজার চুরাশির মা’, ‘কালবেলা’,
নবারুনের ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’,
চারু মজুমদারের রচনাবলী, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো আর আবেগের হেউ ঢেউ আর ... আর দু’পাতা
‘অনীক’ পড়ে নিজেরাই নিজেদের ঘোষনা করে দিয়েছি ‘বিপ্লবী’ বলে, ‘নকশাল’ বলে –
তারপর? তারপর কাহিনী ফিরেছে নানা মোড়ে, বাঁকে। নিয়েছে নানান গতিপথ। ছুঁয়ে গেছে
নানা তীর। ক্রমে কিছু তত্ত্ব বুঝে, কিছু না বুঝে,খাঁটি বিপ্লবী, মেকি বিপ্লবী,
দাড়ি বিপ্লবী, কামানো বিপ্লবী, নানান পার্টির নানান লাইন, বেলাইন হয়ে এখন যেখানে
এসে দাঁড়িয়েছি সেখানেও, এতাবৎ, এই বিশ্বাসে আমি স্থির যে অর্থনৈতিক শোষনহীন পৃথিবী
গড়ে তোলার পথ মূলতঃ শ্রেণী সংগ্রামেরি পথ আর ঐ পথে সিপিএম বা তার দোসরেরা বহুদিন
হাঁটেনা। হাঁটবেওনা আর কোনোদিন। - আমার এই বোঝার বা এই অনুভবের প্রতিষ্ঠা বা
বিশ্লেষন এই লেখার প্রতিপাদ্য নয়। আবহমাত্র। প্রতিপাদ্য সেই ‘অনীক’ পত্রিকা যা
ঘিরেছিল আমাদের ঐ রৌদ্রে রৌদ্রে জ্বলেওঠা দিনগুলিকে –
ছিল ‘আবাহন’ নামের বই এর দোকান। শিলচরে। প্রেমতলায়। আজো আছে। কিন্তু সেখানে ‘অনীক’
আসেনা বহুযুগ। অথচ ঐ সময় ঐ একমাত্র দোকানেই এক সময় আসতো ‘অনীক’। লম্বা পাতায় ছাপা
রোগা পত্রিকাটির জৌলুসহীন মলাট যেন রক্তে ঝড় তুলতো। সব লেখা যে বুঝতাম বা সব লেখার
সব অংশ যে সমানভাবে বুঝতাম এরকম ভাবার কোনো হেতু নেই। যা বুঝতাম, যতোটা বুঝতাম তার
সঙ্গে যে সর্বদা একমত হতে পারতাম তেমনো নয়। তবু ‘অনীক’ ছিল এক টান – এক যোগসূত্র -সারা
দেশের প্রকৃত বামপন্থী ক্রিয়া কলাপের সঙ্গে, ভাবনার সঙ্গে। দীপংকর চক্রবর্তী, রতন
খাসনবীশ এই নামগুলি, ঐভাবেই, ক্রমে মর্মস্থ হয়ে যায়। প্রস্তুত হয়েযায় তাঁদের জন্য
শ্রদ্ধার জায়গাও। তাঁদের নাম আর ‘অনীক’এ প্রকাশিত তাঁদের লেখাগুলি ছাড়া আর যা জানতাম তা হলো কাগজটি
বহরমপুর থেকে প্রকাশিত হয়। তবু ‘অনীক’এ যেই লিখেছেন, যা’ই লিখেছেন তাঁকেই মনে
হয়েছে আপনার জন...
সেই মনে হওয়ার অতলে ‘পার্টি লাইন’, ‘তত্ত্ব’,
‘জ্ঞান’, ‘তথ্য’ থেকেও যে বোধ মূলতঃ কাজ করতো তা হলো এই, যে, যাঁরা এইরকম একটি
কাগজ বছরের পর বছর ধরে প্রকাশ করে যেতে পারেন তাঁরা নিশ্চয়ি আমাদের দেখা মেকি
বিপ্লবী, দাড়ি বিপ্লবী, কামানো বিপ্লবী-দাদাদের মতন শখের বিপ্লবী নন। অতএব এই কাগজ
নিশ্চয়ই দাঁড়িয়ে তাঁদের সততার ভিত্তিতে, কোনো না কোনো রকম ত্যাগের ভিত্তিতে ...
পরে, ক্রমে, কিছু কিছু জানতে পারি ঐ
মানুষদের কয়েকজনের বিষয়ে – জানতে পারি অর্থনৈতিক শোষনহীন পৃথিবী গড়ে তোলার
স্বপ্নের মূল্যে অনেকেই কারাবরণ করেছেন। কংগ্রেস সিপিএম দুই সরকারের হাতেই
নানাভাবে হয়েছেন নিপীড়িত ও নির্য্যাতিত –
আমি মফস্বলের এক ভদ্রলোককে জানি যিনি, এই নব্বই বছর
বয়সেও এমনি একটি অতি বাম পত্রিকা বেচেই একটি বিশেষ নকশাল দলের অদ্যাপি হোল্টাইমার।
আচ্ছা, কি হবে যদি হয়ইবা ঐ পার্টি লাইন ভুল তাহলেও? শ্রেণী সংগ্রামের মূল তত্ত্বও
যদি হয় অনর্থক তাহলেও ঐ মানুষটি প্রণম্য থেকে যাবেন তাঁর নিষ্ঠায়, সততায় – ঠিক যেমন
‘ঈশ্বর’ বলে কিছু নেই প্রকাশ্যে প্রামাণিত হলেও শ্রীরামকৃষ্ণের ‘কথা’ গুলি থেকে
যাবে অমৃতই। ঠিক একইভাবে ‘অনীক’এর কুশীলবদের এই নিষ্ঠা, শ্রম, তিতিক্ষা ছাড়িয়ে যায় তাঁদের বিশ্বাসের মূল তত্ত্বকথার
ভিতকেও...
তারপরে যখন কলকাতা চলে এলাম চাকরীর সন্ধানে তখনো সংগ্রহ করে আনতাম ‘অনীক’। তখন
যে তেমন খুঁটিয়ে আর পড়তাম তা নয়। তখন ‘অনীক’ দেখে, ‘অনীক’ ছুঁয়ে যেন ভরসা পেতাম,
যেন জানান দিতাম নিজেকেই, যে, এখনো, এ দেশেও কিছু মানুষ আছে যারা স্বপ্ন দেখতে
সক্ষম ...ক্রমে কলকাতা ছেড়ে দক্ষিণে এলাম... ‘অনীক’ও ক্রমে হারিয়ে গেলো জীবন থেকে
...
অনেক অনেকদিন পরে অগ্রজ সুশান্ত কর ইন্টারনেটে জানালো যে সেই ‘অনীক’এর প্রাণপুরুষ,
সেই দীপংকর চক্রবর্তী আর নেই! জানালো ইন্টারনেটে ‘অনীক’ এর উপস্থিতির কথা। - আবার
খুলে বসলাম ‘অনীক’। এবার কাগজে ছাপা ‘অনীক’ নয়। ইন্টারনেটে, পিডিএফ ফাইলে অনীক। পড়ছি
কম্পিউটার খুলে বসে। পড়ছি সেই প্রবাদপ্রতিম দীপংকর চক্রবর্তীকে নিয়ে আরেক প্রবাদপ্রতিম রতন খাসনবীশের স্মৃতিকথা। পড়ছি আর
বিদ্ধ হচ্ছে এক আত্মিয় বিয়োগের যাতনাতেই যেন ... আর মনে পড়ছে বোঝা না বোঝায় মেশা
সেই রৌদ্রে রৌদ্রে জ্বলেওঠা দিনগুলি।
[ দীপংকর চক্রবর্তীর মৃত্যু সংবাদ ও অনীক’এর দীপংকর চক্রবর্তী স্মরণ সংখায় রতন
খাসনবীশের স্মৃতিচারন পাঠের পর ...]