মন’এ
রাখা
নবেন্দুকে কারোরি
নিশ্চয় মনে নেই। মনে থাকার কথাও নয়। দাঁত উঁচু, ময়লা জামাকাপড় পরা, পড়া না পারা
একটা ছেলে ক্লাস ফাইভে পড়ে, ফেল করে কোথায় চলে গিয়েছিল কেজানে। আমিও ভুলেই
গিয়েছিলাম ওকে। অন্ততঃ মনে হয়েছিল সেরকমই। কিন্তু –
নবেন্দু যে ঠিক
আমাদের “শ্রেণী”র নয় তা বুঝবার মতো জ্ঞেয়ান, যেহেতু মধ্যবিত্ত, তাই, কেলাস ফাইভেই
হয়ে গিয়েছিল আমাদের। ‘আমাদের’ বলতে আমি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্য সহপাঠীদের।
আমাদের একটা দলও ছিল। আমাদের গব্বোও ছিল – আমরা পড়াশোনায় ভালো, আমাদের মা-বাবা
শহরের লোকের কাছে পরিচিত। স্যার-ম্যাডামরা আমাদের ভালবাসেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে
পড়া বলেন। অন্য যে “খারাপ ছেলে”র দলটা – তারা কেলাসের ভেতরে ছিল আমাদের করুণার
পাত্র। তবে কেলাস শেষ হলে বা টিফিন পিরিয়ডে বা রাস্তায় বা খেলার মাঠে – হুঁ,
আমাদেরি তারা করুণা করতো।
নবেন্দু অবশ্যই ‘আমাদের’
দলে ছিলনা। সে ছিলনা “খারাপ ছেলে”র দলেও। একাই থাকতো। আর ক্লাসে মাঝে মাঝে পড়া না
পারা ছাড়া ওর উপস্থিতি কেউই কোনোদিন টের পায়নি। তবে কেলাস শেষ হলে সে মাঝে মাঝে
বেশ জোরেই শিস্ দিয়ে উঠত। সেই শিস্ দেওয়া নিয়েই ...
তখন হোষ্টেলে থাকি।
হবু ইঞ্জিনীয়ার। যদিও প্রচুর “ব্যাক্” আর “কম্পার্ট” এ ভরে উঠছে ব্যক্তিগত
শিক্ষাদীক্ষার ইতিহাস তথাপি “হবু ইঞ্জিনীয়ার” ব্যাপারটা একটা গর্ব আর ঔদ্ধত্য
জোগাচ্ছে রক্তে। সেই “হবু ইঞ্জিনীয়ার” হওয়ার দৌলতে শহরের মেয়ে মহলেও বেশ দাম পাওয়া
যায়। কাজেই শনিবার রবিবার ত বটেই, অন্য দিনও কলেজ কামাই করে ৫৬ কিলোমিটার বাসে
চেপে এসে বসে থাকি নিজের শহরে। “আরিসি’তে পড়ে” – এই শব্দবন্ধের উত্তাপ নিই আর দুটি
একটি মেয়ের সঙ্গে প্রয়াস নিই আশ্নাই গাঢ় করবার।
তেমনি এক মেয়ে সকালে পড়তে যায় কি এক
স্যারের বাড়ি। ওর সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের শ্রেষ্ঠ সময় সক্কালবেলাই কেননা ফেরার পথে
রাস্তায় লোকজন থাকে। কেউ দেখে ফেল্লে – আমার ত কদর বাড়ে – বিপদ না’কি মেয়েটির।
তখনো আমাদের মফস্বলে এসে লাগেনি স্টার টিভি’র স্মার্ট্নেস্। তখনো বছরে বেশ
কয়েকবার রবীন্দ্র-নজরুল হয়। মেয়েরা শাড়ি পরে দাঁড়ায় সামনের সাড়িতে আর বকের মতো
লম্বা গলা নিয়ে পাজামা পাঞ্জাবী পরিহিত মনোজিৎদা “লীড্” দেয় পুরুষ শিল্পীদের।
আমরাও ভিড় করে দেখি। গান শেষ করে যার যার নিজস্ব “মাল”রা স্টেজ, গ্রীনরুম ছেড়ে
বাইরে আসে। আড়ালে আসে। রমনীমোহন ইন্স্টিটিউট্ বা করিমগঞ্জ কলেজ অডিটোরিয়ামের
অন্ধকারে চলে হাতে হাত, বড়জোর গালে ঠোঁট। আবহে, মাইকে, কোলা ব্যাঙ্গের চেয়েও মোটা
গলায় “আবৃত্তি” করে রাজশেখর মিত্র মজুমদার – “পোওওওওওওওওওওওওওওরান মাঝি হাঁকো
দিয়েছে এ এ এ এ’ অথবা গলা কাঁপিয়ে পোঁসেন্জিৎদাঃ ‘ সেদিন বাতাসে ছিল তুমি জানো,
আমারি মনের প্রলাপ জড়ানো ...’
যদিও মা-বাবা রোজই ধমক লাগান ‘ক্লাস টাস্
ছেড়ে এখানে এসে বসে আছিস্ যে বড় ... এবারেও যদি কম্পার্ট্ লাগাস্ তাহলে আর ফী
দেওয়া যাবেনা – এ কি’রে বাবা ...’ তথাপি বোবা, কালা সেজে বসে থাকি। সারাদিন আড্ডা
দিই করিমগঞ্জ কলেজে গিয়ে। সন্ধ্যায় শম্ভূসাগর পার্ক নইলে স্টেশান রোড নইলে লঙ্গাই
নদীর ধার নয়তো সরল খাঁ’র দিঘির কিনার ... রাতে বইপত্র পড়ে ঘুমাতে ঘুমাতে তিনটা।
কোনো কোনো দিন না ঘুমিয়েই ভোর পাঁচটা বাজতে সাইকেল নিয়ে হাজির হই সেই “মাল”এর
স্যারের বাড়ির রাস্তায়। “মাল”ও আসে সকাল সকাল ...
তেমনি এক সকালে “মাল”কে জানালামঃ ‘প্রিয়তমে,
যদিও আমার দুই পা সড়িতেছে না তথাপি নির্বোধ পিতামাতা চাহিতেছেন যে আর দেরী না
করিয়া আমি সত্ত্বর ফিরিয়া যাই হোস্টেলে। আমি অদ্য দ্বিপ্রহরেই বাস্কি ট্রেভেল্স্
এর ‘বিশটেকি বাস’এ চাপিয়া চলিয়া যাইতেছি। অতএব কালি প্রাতে আর হাজিরা দিতে
পারিতেছি না। প্রিয়তমে, যে কয় দিন না আসি তুমি দয়া করিয়া অপর কাহাকেও এই হাজিরা
কর্মে নিয়োগ করিয়ো না ( - শেষ বাক্যটি যে মনে মনে বলা তা আর ...)’ – “মাল”ও চক্ষু
ছলোছলো করে। সান্তনা দেয়। অতঃপর চলিয়া যায়। আমি চিত্রবানী সিনেমা হলের সামনে
দাঁড়িয়ে চারমিনার টান্তে টান্তে টের পাই এই নাটকীয় মুহুর্তে একটু চা বড় প্রয়োজন।
সকাল ছ’টা বাজে। বড়
রাস্তায় কিছু খোলেনি। কাজেই ঐ দিকে না গিয়ে যাই স্টিমার ঘাটের দিকে। ঐ দিকে একটা
দোকান সকাল সকাল খোলে। সাইকেলটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে নিজেও হাঁটতে হাঁটিতে হাজির হলাম
সেই দোকানে। অন্য দিন যে মালিক বসে আজ সে নেই। অন্য একজন। তারি মতন। তবে বয়সটা কম।
বলিঃ ‘দাদা, একটা চা’। দোকানের লোকটি চা বানায় আর আমার দিকে দেখে বার বার। আমার ভয়
হয়। আমার “মাল”এর পাড়াও কাছেই। এ ব্যাটা যদি ওর “পাড়াতুতো” ‘দাদা’ নিক্লায়,
তাহলে? ... তাহলে ... তাহলে আর কি? আমি কি কম? কম্পার্ট্ লাগ্লেও “হবু
ইঞ্জিনীয়ার” ত বটে...
লোকটি চা নিয়ে আসে।
টেবিলে রাখে। তারপর বলেঃ ‘তুমি গম্মেন্ট্ ইস্কুলো ফড়তায় না? তুমার নাম ... তুমার
নাম ... বিশ্বাস...’ আমি চম্কে উঠি। ভালো করে তাকাই লোকটির মুখের দিকে। হ্যাঁ,
তখনি টের পাই নবেন্দু’কে আমি ভুলিনি। জীবনের প্রহসনে তাকে এমনি দেখ্লে ‘লোক’ই
বলতে হয়। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গোঁফের রেখা ছিল সেই ফাইভের সময়েই। এখন তা
রীতিমতো চুরি যাওয়ার মতো গোঁফে পরিনত। তবু ভালোকরে তাকিয়ে দেখলে ঠিক টের পাওয়া যায়
সে’ও একটি “ছেলে”ই।
আমি বলিঃ তুই
নবেন্দু –
সে হাসে। “অয়, মনো
আসেনি আমারে...”
আমি কিছু বলিনা।
বলতে পারিনা আসলে। সে বলেঃ ‘কিতা করস্ অখন? পড়া শেষ নি?’
‘না’
‘কিতা পড়স্?”
টের পাই তার সামনে
আমার “হবু ইঞ্জিনীয়ার” স্টেটাস্টা বলতে পারছিনা কিছুতেই। আমার গলা, টের পাই,
জড়িয়ে আসছে। বলিঃ ‘ঐ কিতা কিতি পড়ি – চাকরি বাকরি পাওয়ার ধান্দায়...’
নবেন্দু কি বোঝে
কেজানে। হাসে। বলে “অয় পাট্নার, একটা ভালা চাক্রি ল, তে আমরাও কইতাম পারমু...’
শিস্ দেওয়ার একটা বদ্অদ্যাস ছিল নবেন্দুর।
একদিন কার ক্লাসেও শিস্ দিয়ে ফেলেছিল। সম্ভবতঃ অপর্ণা ম্যাডামের ক্লাসে।
ম্যাডামের কানে যেতেই গর্জে উঠলেনঃ ‘ কে? কে শিস্ দেয়? অসভ্য ছেলে!’ ম্যাডামের
কাছে ‘সভ্য’ সাজার তাগিদে আমি দেখিয়ে দিয়েছিলাম নবেন্দুকে।
‘ওউ মাইয়া অটা কে
তর্ গার্লফ্রেন্ড্ নি?
শিস দেওয়ার অপরাধে নবেন্দুকে
ক্লাসের বাইরে নিল্ডাউন করিয়ে রেখেছিলেন অপর্ণা ম্যাডাম। ছুটির সময় নবেন্দু
শাসিয়েছিলঃ ‘দেখি লাইমু রে বাইচ্চা ফুয়া, চিত্রবানী রোওডও আর আইতায় না’... ভারি ত
চিত্রবানী রোড, কে যাবে ঐ দিকে? যাহ্ -
‘মানে, অয়, না , মানে ...’
‘বুচ্ছি । লইজ্জা
পাইরে। আরে পাট্নার মাল ইগু ভালা, চালাইয়া যা। আমরার ত আর ইতা অইবার না’
‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ এসেছে চিত্রবানী সিনেমা হলে।
মা’র সঙ্গে এসেছি দেখতে। পাঁচটার শো। আমি আর ছোটোভাই। লাইন দিয়ে ভিতরে ঢুকছি – হায়
– এমনি সময় সেখানে নবেন্দুর উদয়। ‘কিতারে, কইস্লাম নি, চিত্রবানী রোওড আইলে
দেখিলাইমু – যা সিনিমা দেখিলা, আমি ইনো দাড়াইমু’ – মা’কে বলবো কি? না। তাহলে? কি
করবে নবেন্দু? ফেলুদা গোয়েন্দাগিরি করে মগন্লাল’কে পাক্ড়াচ্ছে আর আমার মাথায়
ঘুরছে নবেন্দু আর তার ডায়লগ্ - ‘কিতারে, কইস্লাম নি, চিত্রবানী রোওড আইলে
দেখিলাইমু – যা সিনিমা দেখিলা, আমি ইনো দাড়াইমু’ – সত্যিই দাঁড়িয়ে থাকবে না’কি
নবেন্দু? দাঁড়িয়ে কি করবে? পার্টি নিয়ে হামলা করবে? ...
‘কেউ কুনো জাবড়া
করলে কইস্, ইনো আমার পুরা হোল্ড্’
সিনেমা শেষ। মগনলাল
কুপোকাত্ ফেলুদা’র মগজাস্ত্রে। আমরা বার হয়ে আসছি। ব্যালকনী থেকে নামার সিঁড়ি
হলের বাইরের দিকে। মা পেছনে। আমরা দুইভাই আগে আগে। তখনি দেখলাম নবেন্দু! ঠিক
দাঁড়িয়ে আছে। চেয়ে আছে ঐ সিঁড়ির দিকেই! মুহুর্তে আমার সব রক্ত মুখে। এখন কি করবে
নবেন্দু? মা’কে বলব কি ‘মা, জানো একতা বাজে ছেলে...’
‘আম্রার আর কিতা
রে, তরার ভালা অইলে সবোরে কইমু, ঐ বিশ্বাস আর আমি একলগে ফড়তাম...’
নবেন্দু দেখেছে
আমাদের। ঠিক। আমরা নামছি। ভিড় কমে যাচ্ছে। এবার কি নবেন্দু আসবে তার দলবল নিয়ে?
‘তখন পাট্নার খালি
ভুলি যাইয় না, দেখলে চিনিও...’
নবেন্দু চলে
যাচ্ছে!! চলে যাচ্ছে না’কি আরো পার্টি আনতে যাচ্ছে? আবারো কানে বাজে ‘কিতারে, কইস্লাম নি,
চিত্রবানী রোওড আইলে দেখিলাইমু – যা সিনিমা দেখিলা, আমি ইনো দাড়াইমু’ – মা রিক্সা
ডাকে। আমরা চাপি রিক্সায়। রিক্সা চলতে আরম্ভ করে। নবেন্দু আসেনা পার্টি নিয়ে...
‘তুই যে আমারে
দেখিয়া চিন্ছস্ অটাউ আমার বড় ভালা লাগ্সে’
পরদিন ইস্কুলে
এসেছে নবেন্দু। বুঝতে পারছিনা গতকালের না নেওয়া প্রতিশোধ কি সে ইস্কুলেই নেবে? যদি
তা’ই হয় তবে কি করা উচিত? ... ‘শুন্, কালকে তোরে ফিট্সিনা কেনে জানস্ নি? লগে
তোর মা আস্লা। আমার মা নাই। অতার লেগিয়া ...’
চা’এর পয়সা নেয়না
নবেন্দু। আমি উঠে আসি। সাইকেলে চাপি। বাড়ি যাইনা। অনেকক্ষন চুপচাপ বসে থাকি শম্ভূ
সাগর পার্কের বেঞ্চিতে। চারমিনার টানি। বুঝতে চেষ্টা করি নবেন্দুকে সত্যিই কি মনে
রেখেছিলাম আমি? রেখেছি আমি?