দিনলিপিঃ ২৬- অক্টোবর – ২০১৩
আসলে আর কিছু নয়, কিছুই নয় – আসলে একটা আবেশ – বুঁদ হয়ে থাকা সেই আবেশে। আপনা
আপনি ডুবে যাওয়া। কোনো চেষ্টা নয়, চোখ বন্ধ করে, ঘরে দুয়ার দিয়ে ধ্যান করা নয় তবু
আপনাকে হারিয়ে ফেলা। হয়তো ভিড়ে একটি মুখ দেখে, হয়তো এক বিকালের অনেক আলোর থেকে
একটি আলোর একটু ইশারা, হয়তো একটি কবিতার একটি পংক্তি পাঠ করে, হয়তো অনেক অনেক দিন
রাত্রি আগে শোনা একটি গানের একটি কলির সুরের মনে পড়া, হয়তো ক্যাল্কুলাসের একটি
ফর্মূলার ভিত্তিতে পদার্থবিদ্যার কোনো একটি সত্যের উন্মোচনের ইঙ্গিত – সে টুকুকেই
সম্বল করে ডুবে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া – আপনার গহনে। আর কিছু নয়। বাইরে যাপনের স্রোত
বয়ে যায় নিজের নিয়মে। সুখে, দুঃখে, আনন্দে, বেদনায়। তার আঁচ চামড়ায় লাগে বটে তবু
ফোস্কা পড়েনা। সম্মানে আহ্লাদ হয় বটে তবু সেই আহ্লাদ মুহুর্তেই ঝরে যায় পদ্ম পাতার
থেকে ঝরে যাওয়া জলের মতো। অপমানে মন বেদনার্ত হয় বটে কিন্তু সে’ও ক্ষণিকের। তারপরই
আবার সব ডুবে গিয়ে জেগে ওঠে সেই একটি মুখ দেখে, হয়তো এক বিকালের অনেক আলোর থেকে
একটি আলোর একটু ইশারা, হয়তো একটি কবিতার একটি পংক্তি পাঠ করে, হয়তো অনেক অনেক দিন
রাত্রি আগে শোনা একটি গানের একটি কলির সুরের মনে পড়া, হয়তো ক্যাল্কুলাসের একটি
ফর্মূলার ভিত্তিতে পদার্থবিদ্যার কোনো একটি সত্যের উন্মোচনের ইঙ্গিত –কোনো চেষ্টা
নয়, চোখ বন্ধ করে, ঘরে দুয়ার দিয়ে ধ্যান করা নয় তবু আপনাকে হারিয়ে ফেলা –
ওই হারানোর মন্ত্রটি নিয়ে জন্মায় সকলেই। প্রকৃত
প্রস্তাবে। কিন্তু যাপনের কোলাহলে, হাহাকারে অনেকেই হারিয়ে ফেলে তার কথা, তার সুর।
সেই হতভাগ্যদের প্রয়োজন পরে আলাদা ঠাকুরঘরের, যোগের, দোর দিয়ে ধ্যানের। নাহলে ঐ
বুঁদ হয়ে থাকার ইঙ্গিত গুলি আপনিই মনকে টেনে নেয় ধ্যানের অন্তিম স্তরে যেখানে সে
শুনতে পায় মহাসিন্ধুর ওপার থেকে ভেসে আসা সঙ্গীত। তারি মূর্চ্ছনায় কেউ লিখে, কেউ আঁকে,
কেউ গায়, কেউ পৃথিবীর সমস্ত অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে প্রাণ হারায় বোলিভিয়ার অরণ্যে,
কেউ হারিয়ে যাওয়া প্রজাতির ধানবিন্দুর সংরক্ষনের কাজে চলে যায় দূরে, গ্রামান্তরে, কারোর
মর্মে জন্ম নেয় অনু-পরমানুর জন্মকথা ( কেননা শুধু পাঠে, বিদ্যায় কেউ পারেনা প্রকৃত
অর্থে আবিষ্কারক হতেও। পাঠে, বিদ্যায় – স্কলার হওয়া যায়, সরকারী-বেসরকারী খাতে ‘বিজ্ঞানী’
তক্মা পাওয়া যায় বড়জোর)। ওই বুঁদ হয়ে থাকার মাত্রা আর গভীরতার ভিত্তিতেই স্থির হয়
কে হবেন ভীমসেন যোশি আর কে হবে কুমার শাণু, কে হবেন জীবনানন্দ আর কে হবে সুনীল, কে
হবেন এলবার্ট আইনস্টাইন আর কারা মাল্টিনেশনেলের তক্মা আঁটা সাইনটিষ্ট।
ঐ
বুঁদ হয়ে থাকাই ‘ঈশ্বর’। ‘ঈশ্বর’ আর অন্য কিছু নয়। ঐ বুঁদ হওয়ার ইঙ্গিতগুলি
মুহুর্মুহু খুঁজে পাওয়ার নামই সাধনা। ‘সাধনা’ আর অন্য কিছু নয়।