প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Tuesday, October 29, 2013

“ডায়রী অফ্‌ এ সিনেমা গো’য়ার” থেকে ...

“ডায়রী অফ্‌ এ সিনেমা গো’য়ার” থেকে ...
সপ্তর্ষি বিশ্বাস
অন্ধকার ছবিঘরের বিস্তৃতিতে বসে ছবি দেখার বিলাসিতাটি হারালেও সিনেমা দেখি। হ্যাঁ, সবাই ঘুমালে, আলো নিবিয়ে, বসবার ঘরে, ভিসিডি-ডিভিডি চালিয়ে মাঝারি পর্দায়। দেখি। দেখতে দেখতে ভাবি। লিখেরাখি সেই ভাবনাগুলি। ভাবি কখনো বিস্তারিত প্রকাশ করব ওই ভাব। ওই ভাবনা। অনেক ক্ষেত্রে তা হয়। অনেক ক্ষেত্রে হয়ে ওঠেনা। - এখানে সেরকমই কিছু “ব্যক্তিগত নোট্‌”কে সামান্যতম সম্পাদনার পরে তুলে দিচ্ছি পাঠকসমক্ষে।
ইটালো কেল্‌ভিনোর “অটোবায়োগ্রাফি অফ্‌ এ সিনেমা গো’য়ার” আমার খুবই প্রিয় একটি গদ্য। তাই একটু দুঃসাহস করেই, ঐ নামের অনুকরনে, দিলাম এই রচনার নামটি। যদিও  “সিনেমা গো’য়ার” কথাটি আমার ক্ষেত্রে সত্য নয় কেননা আগেই বলেছি অন্ধকার ছবিঘরের বিস্তৃতিতে বসে ছবি দেখার বিলাসিতাটি হারিয়ে গেছে তথাপি ইটালো কেল্‌ভিনো’র অনুসরনের দুরাশাহেতু এই নামকরন...

জতুগৃহঃ ডিসেম্বর’ ২০১৫
...মজার কথাটা এই, যে, বহুদিন আমি জানতামই না আমার প্রিয় বাংলা সিনেমাগুলির  অনেকগুলি– ঝিন্দের বন্দী, লৌহ কপাট, গল্প হলেও সত্যি, হারমোনিয়াম – কার পরিচালিত। অবশ্যই ‘জতুগৃহ’ ছবির পরিচালকের নামও বহুদিন অজানা ছিল। - ছিল রাধা সিনেমার সামনে মান্নাদা’র ভিডিও ক্যাসেটের দোকান। ছিল হাতে কিছু পয়সা পেলেই মান্নাদার দোকান ঘেঁটে নিয়ে আসা বাংলা সিনেমার ভিডিও ক্যাসেট। ভিডিও প্লেয়ারের ভাড়া, পরের দিকে, এক রাতের জন্য পঞ্চাশ টাকা নিতো মান্নাদা। কয়েকদিন দেরী করে ফেরৎ দিলেও কিছু বলতো না। - তখনি প্রথম দেখা ঝিন্দের বন্দী, লৌহ কপাট, গল্প হলেও সত্যি, হারমোনিয়াম, শাপমোচন, হোটেল স্নো ফক্স, থানা থেকে আসছি, সপ্তপদী, এন্টনী ফিরিঙ্গী ... মূলতঃ উত্তমকুমারকে দেখা। কে পরিচালক, কি ব্যাপার সে সবই তখন অদরকারি।
তার অনেক বছর পরে হঠাৎই, একদিনে, এক মুহুর্তে জেনে গেলাম যে - ঝিন্দের বন্দী, লৌহ কপাট, গল্প হলেও সত্যি, হারমোনিয়াম -এই সবগুলো ছবির পরিচালকই তপন সিন্‌হা। -জানলাম তাঁর মৃত্যুর পরে কোনোখানে তাঁর ছবির তালিকা দেখে। ..
...
‘জতুগৃহ’কে সিনেমাভাষার বা স্ক্রিপ্টের বিচারে হয়তো ক্লাসিক বলা যাবেনা...প্রকৃত প্রস্তাবে আমার দেখা তপন সিন্‌হা’র কোনো ছবিই সেই অর্থে ক্লাসিক্‌ নয়। “সাগিনা মাহাতো” আর “ঝিন্দের বন্দী” আমার বিচারে প্রায় ক্লাসিক। কোনো বিশেষ ছবি যদিবা ক্লাসিক নয়  তথাপি তপন সিন্‌হা’র ছবির আদত চরিত্রটি ক্ল্যাসিকেল।
‘জতুগৃহ’ গল্পটি সুবোধ ঘোষের। গল্পটি আমি পড়িনি তবে মনে হয়না মূল গল্পে “আমার যে সব দিতে হবে” গানটি রয়েছে। এই গানের এই মারাত্মক ব্যবহার পরিচালকের নিজস্ব কৃতিত্ব বলেই আমার ধারণা। -যে কাহিনীর গতিপথ অপরকে কিচ্ছু না দেওয়ার শপথের মোহানার দিকে চলমান তারি আবহে এই “দেওয়া”র গান, যে দেওয়া রবি ঠাকুরের আধ্যাত্মিক দেওয়া , তাকেই যাপনের জাগতিক ‘দেওয়া-নেওয়া’র আঙ্গিনায় – মূল গানের গভীরতাকে সামান্যমাত্র ব্যাহত না করে -এই যে ব্যবহার -তাতে আমি বার বার মুগ্ধ হই।
“জতুগৃহ” ছবিতে সিনেমাভাষার সবচেয়ে কারুময় ব্যবহার মনেহয় ছবিটির শেষের দিকে – যেখানে দুই বিপরীত গন্তব্যমুখী ট্রেনের কামরায় বসা নায়ক ও নায়িকার বাক্য বিনিময়ের আবহে দেখা যাচ্ছে ওয়েটিং রুমের বেয়ারাটি টেবিল থেকে তুলে নিচ্ছে সেই পেয়ালা দুটি যা’তে এরা চা পান করেছিল অব্যবহিত পূর্বেই। গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে। দুই জনে – হয়তোবা চিরতরেই – চলে যাচ্ছে দুই পথে। বেয়ারা পায়ালা দুটি ধুয়ে নিচ্ছে। মুছছে। ট্রেন ছাড়লো। বেয়ারা একটি পেয়ালা তাকে রেখে দেখলো তার কিনারে আর জায়গা নেই। শেষ বাক্যটির বিনিময় হচ্ছে নায়ক নায়িকার। অপর পেয়ালাটিকে বেরায়া নিয়ে রাখছে অন্যত্র। অচেনা পেয়ালার পার্শ্বে। সেখানেও যে তার কিনারে কি তার ইতিহাস? যে সেই পেয়ালায় চুমুক দিয়েছিল শেষবার – সে কে? সে কোথায়? ... মনেপড়ে কুরোসাওয়া। মনেপড়ে  সা্‌ন্‌সিরো সুগাটা (Sugata Sanshiro)প্রথম পর্ব। জুজুৎসু গুরু ফিরে চলেছেন আততায়ীদের পরাজিত করে। রিক্সাওয়ালা পালিয়ে গিয়েছে আততায়ীদের ভয়ে। দূর থেকে ঐ লড়াই দেখে মুগ্ধ এক যুবক চালক হতে এসেছে রিক্সার। সামনে পড়ে আছে এক পাটি চটিজুতো। আততায়ীদের কারোর। যুবক ছুঁড়ে ফেলে দিলো সেই চটি। পরের শট্‌ সকাল। লোকজন চলেছে ঐ পথে। এক পাশে ঐ চটি। একা। পরের শটেই বিষ্টি। জুতোপাটি ভিজছে। জুতোপাটি নিয়ে খেলা করছে ছানা কুকুর। জুতোপাটি উঠে বসে আছে বেড়ার বাঁশে। জুতোপাটি জলের স্রোতে ভেসে চলেছে। কোথায় ...? ...
হ্যাঁ, এখানেই আরেকটা জিনিসও লক্ষণীয় – গানের মুহুর্তটির নির্মাণ। ঐ মুহুর্ত নির্মাণের নিরিখে বলি, যে, ঋত্বিকের “কোমল গান্ধার” এ “আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে”, “মেঘে ঢাকা তারা” র “যে রাতে মোর...”, সুবর্ণরেখার “আজি ধানের ক্ষেতে”, “যুক্তি তক্কো...”র সেই ডায়লগ্‌ “-প্রেমে পড়ে গেলাম” এর পর মুহুর্তেই শার্প কাটে “ক্ষণে ক্ষণে মনে মনে” –মুহুর্তে দর্শককে – যেন বা রানওয়ে ধরে ছুটন্ত এরোপ্লেনের হঠাৎই টেক্‌অফ্‌- নিয়ে যায় অন্য মাত্রায়।  আমার মনে হয়েছে তপন সিন্‌হা’র ছবিতেও গানের, রবীন্দ্রগানের ব্যবহার অতুলনীয় সার্থক হলেও নেই ঐ চক্রবাল থেকে মহুর্তে মহাবিশ্বে-মহাকাশে ছড়িয়ে যাওয়ার দ্যোতনা...

“গীত গাতা হুঁ মেঁ”...অক্টোবর, ২০১৩
বাংলা সিনেমার যে বস্তুটি একমাত্র দেশজ তা হলো গান।
না, হলিউডে যাদের “মিউজিক্যাল” বলা হয় তেমন ছবি ছাড়া হলিউডের ছবিতে গান থাকেনা বা থাকলেও তেমন কোনো বিশেষ ভূমিকা তা পালন করেনা। অদ্যাপি। বাংলা ছবির আঙ্গিক যেহেতু এসেছে যাত্রা আর নাটক থেকে, আর নাটকেরো একটা স্তর অবধি সেখানেও গানের ছিল বিশেষ ভূমিকা, - তাই বাংলা সিনেমায় গান ব্যাপারটা প্রথম থেকেই আসে এক বিশেষ ভূমিকা নিয়ে। হিন্দি ছবিতেও ঘটনা প্রায় একই। তাছাড়া হিন্দি ছবি যে বহুদিন অব্দি চলেছিল বাংলা ছবিকে অনুসরন করেই এ’ওত আজ তর্কাতীত সত্য।
কিন্তু একটা পর্বে এসে দেখাগেলো যে সিনেমা’কে “ইন্টেলেক্‌চুয়াল” , “অফ্‌ বীট্‌” বা ‘প্যারালাল’ বলে সংজ্ঞায়িত করতে গেলে প্রথমেই যা বাদ দিতে হবে তা হলো গান। হিন্দি-বাংলা সিনেমায় সিনেমার এই পর্বটির সূচনা মূলতঃ সেই “ইন্ডিয়ান নিউ ওয়েভ”, সেই ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে, যুগ যে যুগটি সম্বন্ধে সত্যজিৎ রায় বিস্তারিত লিখেছেন তাঁর “An Indian New Wave?”  নামক প্রবন্ধে, যা তাঁর “Our Films There Films” এর গ্রন্থের অন্তর্গত। ততো বিস্তারে না গিয়ে ঐ প্রবন্ধ থেকে কয়েকটি উদ্ধৃতিই দিচ্ছি আপাততঃ While I have seen some of the results of this new enterprise ( Indian new wave ) , I do not wish to discuss them here in any specific terms” … The first question to ask at this point would be: how does one off-beat in the context of Indian Cinema; or more specifically, of Hindi Cinema, since much of the activity seems to be centered in Bombay? ….What is this right kind off-beat? Here, I am afraid; the film makers do not help us very much. They talk of experiment without specifying what line of experiment is to take and how far it is to go. …(1971)’ সেই “নিউ ওয়েভ”টিরই ফল হিন্দি/বাংলায় গানহীন সিনেমা নির্মাণের আঁকুপাকু। কিন্তু ভারতীয়দেরকে ‘সিনেমা’ কি তা যিনি শিখিয়েছিলেন সেই সত্যজিৎ রায় বলেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কথাঃ’ I once read a critique of a Hindi film in an American magazine which actually praised the use of songs as a sort of Brechtian alienation device, something which purposely makes the spectator aware of the artificiality of the whole thing. ‘A very interesting piece of stylization’ said the reviewer, ‘wholly in the non-realistic tradition of Indian art’. …
        I have been able to watch the development of the Hindi Film song over the years thanks to my son’s continued interest in them. I keep on being amazed at the inventiveness that is poured into them. … They first embrace all possible musical idioms – classical, folk, Negro, Greek, Punjabi, Cha-Cha, or anything you can think of from any part of the world. The latter shows a brashness and a verve in the combination of instruments – again as disparate as you can imagine – and a feeling for tonal color and contrast which call for high praise. And the main thing is that it all makes sense as music, which is more than one can say of a good deal of what is termed Modern Bengali Song. … I feel less anger than admiration for the composer who can lift the main theme of the finest movement of Mozart’s finest symphony, turn into a ‘filmi geet’ and make it sound convincing.
Satyajit Ray ' Those Songs' ,1967,  'Our Films Their Films'
             সেই “প্যারালাল”এর দল এটাও লক্ষ্য করলেন না’যে সত্যজিতের প্রথম ছবি “পথের পাঁচালী”তে সঙ্গীতময়তা ত ছিলই গানও ছিল। ইন্দির ঠাকরুণের কন্ঠের ঐ “হরি দিনত গেলো” গোটা ছবিটিকেই দিয়েছে এমন এক মাত্রা যা গান ছাড়া সম্ভব ছিলনা। যদি গানগুলি না থাকতো তাহলে ঋত্বিকের ছবিগুলিও কি অন্তিমে পেতো ঐ মাত্রা যা পেয়েছে গানের জন্য? সিনেমায় গানের প্রয়োজন প্রথমতঃ ঐ খানেই যেখানে সিনেমা তার চৌখুপী ফ্রেইমকে ভেঙ্গে হয়ে উঠতে চায় দিগন্ত বিস্তারী – যা তথাকথিত “মেইন স্ট্রিম্‌’ ছবির পরিচালকেরা টের পেয়েছিলেন।
বাইরে নেমেছে তুমুল বৃষ্টি। গ্রাম থেকে শহরে চাকরি পেয়ে আসা যুবকের মর্মে একাকীত্বের হেউ ঢেউ। এরই মধ্যে সে শুনতে পেলো গান। আপাতঃ ভাবে যাকে মনেহয় ভীষন এন্টারটেইনিং – সেই লোকটিই গাইছে। জানালায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে। ... মনেপড়ে? মনেপড়ে “চৌরঙ্গী” ছবির “বড় একা লাগে এই আঁধারে” গানের দৃশ্য? তার সুর? তার গায়কী? – যদি ঐ দৃশ্যে ঐ গান না বেজে উঠত এভাবে তাহলে ঐ একাকীত্ব ঐ চরিত্রদুটিকে ছাপিয়ে কখনোই হয়ে উঠত না আবহমানের একাকীত্বের স্বরলিপি।
কবি, মাতাল, মারা যাচ্ছে টিবিতে। তার শেষ সময়ে তারি কথায় সুরে বাজছে গানঃ ‘মে শায়ের বদ্‌নাম, মে চলা...”, প্রেমিকা তাকে ‘অমানুষ’ ঠাউরে ত্যাগ করেছে কিন্তু সেই প্রেমিকা জানেনা সে আর মদ ছুঁয়েও দেখেনা... সেই প্রেমিকাই বাধ্য হয়ে উঠেছে তার ডিঙ্গিতে। কি করে সে টের পেলো যে তার প্রেমিকটি একটি মানুষ, অমানুষ নয়? ঐ গান ‘কি আশায় বাঁধি খেলাঘর...” ... যে লোকটিকে ঘিরে পড়শীদের জল্পনার সীমা নেই অথচ তাকে সহজ ভাবে কেউ নিতে পারেনা তার বদমেজাজী স্বভাবের জন্য তার একাকীত্বকেও আমরা টের পেয়েছিলাম ঐ গানেঃ ‘বড়ি সুনি সুনি হ্যায়- জিন্দেগী য়ে জিন্দেগী” ... নিশিপদ্মের “না না না আজ রাতে আর যাত্রা দেখতে যাবোনা” গানটি যতো সহজে উন্মোচিত করে চরিত্রটিকে তা আর কিভাবে সম্ভব আমি জানিনা। এখানে উল্লেখ করতে হয় কমলকুমার মজুমদারের “চলচ্চিত্রে গানের ব্যবহার” প্রবন্ধটিরঃ এ-দেশটার মতো এমন গানপাগলা দেশ আর কোথাও নেই। ... দুপুরে ভিক্ষে চায় যে লোক সেও খালি গলায় দরজায় দাঁড়ায় না। ভিক্ষে দিয়েও রেহাই নেই, তার গানটিও শুনতে হবে। ... তাই, আমাদের দেশের ছবিতে যে গান থাকবে এ আর এমন আশ্চর্য কি। ...গান আমরা ভালোবাসি, অক্লান্ত খাটুনির তিক্ততার ভিতরে আমরা জুড়িয়ে নিই গান গেয়ে ...। ...
ধরা যাক, একটি ছেলেও বা মেয়ে জানলায় দাঁড়িয়ে আছে। সানাই শোনা যাচ্ছে। এখানে নাটকের প্রায় অনেকখানি বলা হলো। সানাই শুনে, ছেলেটিকে বা মেয়েটিকে দেখে কেউ সহজেই ভাবতে পারেন প্রিয়জনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এখানে মন কথা চায়না, চায় গান। গান সমস্ত ব্যথাকে তুলে ধরে”  - কিন্তু অদ্যাপি বহু তথাকথিত ‘সিনেমা-শিক্ষিত’কে বলতে শুনিঃ ‘অমুক ছবিটা দারুন হয়েছে! জানেন! একটাও গান নেই!’ – অর্থাৎ গান-না-থাকা’কে সিনেমার একটি উৎকর্ষ স্তর হিসেবে অদ্যাপি ধরে রেখেছে এক শ্রেণীর বাঙ্গালী দর্শক আর সেই শ্রেণীটির হাতেই মূলতঃ, অদ্যাপি, ‘সিনে কেলাব’, ‘সিনেমা নিয়ে ইন্টু ম্যাগাজিন’ – এগুলির নেতৃত্ব!!
২।
বাংলা-হিন্দি তথাকথিত “প্যারালাল”রা কেন বাদ দিয়েছিল গান? হ্যাঁ, পশ্চিমের অন্ধ অনুকরন তো আছেই তা ছাড়াও আছে জীবনবোধের খন্ডতা। ‘মানুষ’ এই কথাটিকে বোঝার ব্যর্থতা। সে দেখতে পায়না তার নিজের পরিবেশকে, আবহকে। নাহলে সে জানতে পারতো, কোনোরূপ ‘ইন্টেলেক্‌চুয়াল ডিস্‌কোর্স’ ছাড়াই, যে এ বাংলার জীবনের প্রতিটি উৎসব অনুষ্ঠান শুধু নয় – প্রতিটি বৃত্তি থেকে উঠে এসেছে গান। গানের নানান আঙ্গিক। মাঝির গানের সঙ্গে গরুর গাড়ি চালকের গানের উচ্চারন, কথা, আবহের বিভিন্নতায় নির্মীত হয় তার আবহ। ঐ গান সে সুখে গায়। দুঃখেও গায়। কিন্তু ‘আধুনিক’দের কর্ণে প্রবেশ করেনা ঐ গান। ‘ফিল্ম থিয়োরী’র জটাজাল তার সামনে থেকে মুছে দেয় আর সমস্ত। সে দেখতে পায় মুচীরাম গুড়েদেরি শুধু। হ্যাঁ, ঐ মুচীরাম গুড়েরা করুণা বা দয়ার পাত্র’ত বটেই কিন্তু একই সঙ্গে তাদের জীবন যে অসম্পূর্ণ একথাটা টের না পাওয়ার মূর্খামিতে ঐ “প্যারালাল”দের মূল পরিচয়।
শেক্সপীয়ার তাঁর নাটকে এনেছেন fool , বার বার। কিন্তু তারা সর্বত্র “কিং লীয়ার” এর ‘ফুল্‌’ এর মতো বিচক্ষন “ফুল্‌” নয়। কখনো তারা নেহাৎ ছ্যাবলামিও করে। করে কেননা ঐ “ছ্যাব্‌লামি” – যাকে বলে “কমিক রিলিফ” তা’ও জীবনের – আর তাই শিল্পের – এক অপরিহার্য অঙ্গ। গান, সিনেমায়, অনেক সময়ই, কমিক নয়, তবে ‘রিলিফ’এর কাজটি করে। ‘কোমল গান্ধার’ এর টান্‌ টান্‌ টেন্‌শানে যেমন, আরো অনেক কিছুর সঙ্গে, গান বারবার পালন করেছে ঐ ভূমিকাটি। “শোলে” তে “মেহ্‌বুবা মেহ্‌বুবা” যেমন।
সিনেমায় গানের কথা ভাবতে গেলেই আমার মনে আসে কমল আম্‌রোহি’র ছবিগুলির কথা। তাঁর “মুগ্‌ল্‌ এ আজম্‌” ঘরানার ছবিতে গান যে ভূমিকা পালন করে তার পাশাপাশি ‘মহল’, ‘পাকিজা’ বা ‘দায়রা’য় গান নির্মাণ করে আবহ।
৩।
বাংলা সিনেমা উচ্ছন্নে গেছে বহুযুগ। কাজেই সেই উচ্ছন্নে যাওয়া দুনিয়ায় গান সে’ও উচ্ছন্নে যাওয়া। যেমন খারাপ লিরিক, তেমনি সুর। তেমনি তার প্রয়োগ। তবে পাশাপাশি হিন্দি সিনেমায় গান ফিরে আসছে। ফিরে আসছে তার আপন ভূমিকায়। হিন্দি ছবির সুবর্ণ যুগও ছিল বহুদিন বিগত। কিন্তু নব্বই’এর দশকের শেষ থেকে ( আমার মতে ২০০২ সালে রামগোপাল ভার্মা’র ‘কোম্পানী’ সমসাময়িক হিন্দি সিনেমার চালচিত্র এনেছে পুনর্জীবন ) হিন্দি ছবির পুনর্যাত্রার আরম্ভ নতুন ঐতিহ্যের দিকে। ঐ যাত্রার ইতিহাস অন্য। তার আলোচনাও করা যাবে অন্যত্র।
আপাততঃ উল্লেখ করছি সমসাময়িক কিছু সফল ছবিতে প্রয়োগ করা কিছু গানের কথা।  প্রথমেই মনে পড়ছে বিশাল ভরদ্বাজের “ওম্‌কারা”। ঐ ছবিটি যাঁরা মন দিয়ে দেখেছেন দেখেছেন আর যাঁরা শেক্সপীয়ারের “অথেলো” নাটকের চরিত্রগুলির আবহটিও টের পান তাঁরাই কেবল  প্রকৃত ভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন ঐ ছবিতে “বিড়ি জ্বালাইলে” গানের অনিবার্যতা। মূল ওথেলো’তেও বেশ কিছু গান রয়েছে আর সেই বিখ্যাত “Willow Song”  সহ অন্যান্য সব গানেরো বিষয়, ঘুরে ফিরে প্রেম ও কামের কাছে মানুষের অন্তর্গত অসিহায়তার কথা। ওই “বিড়ি জ্বালাইলে”ও গহনে বলে একই কথা – বলে শীতের রাতে নিজের উনানে আগুন না থাকলে পড়শীর ‘চুলা’ থেকে ‘বিড়ি’ জ্বালিয়ে নাও... ঐ “বিড়ি” আর “পড়শী” – ‘ওথেলো’-‘ওম্‌কারা’ দুইটির ঘটনা-কেন্দ্র’র দিকে নির্দেশ করে প্রচ্ছন্ন ভাবে, নানান মাত্রায়।
দরকার ও লোভ দুই’ই আছে শেক্সপীয়ারের ‘ক্যাসিনো’ চরিত্র আর বিশাল ভরদ্বাজের ‘কেশব’ চরিত্র দুটিকে নিয়ে আলোচনার। কিন্তু এইখানে তা প্রসঙ্গান্তর বলে আপাততঃ এড়িয়ে চলে যাচ্ছি রামগোপাল ভার্মার “কোম্পানী” ছবিতে। “খাল্লাস্‌”। আপাতঃ ভাবে একটি “আইটেম সং”। প্রকৃত প্রস্তাবে ঐ একটি গানের পরিসরে ছবির দ্বিতীয়ভাগের, অর্থাৎ বিস্তার পর্বের, সমস্ত মুখ্য চরিত্রদের ‘চরিত্র’ ঐ গানের আবহেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। মনেপড়ছে “ডেভ্‌ ডি’ ছবির “ইমোশোনেল অত্যাচার” গানের কথাও। আর “গেংস্‌ ওফ ওয়াসিপুর” ছবিতে গানের প্রয়োগের অনিবার্যতা ও সাফল্য নিয়ে কথা বলতে গেলে আরেকটি আলাদা প্রবন্ধ লিখতে হয়।  ইদানীংকার হিন্দি ছবির গানের witticism নিয়ে কথা বলার ইচ্ছা রইলো।
এসবের পাশে বাংলা ছবিতে যাকে ‘গান’ বলে চালানো হয় তা যেন আরশোলাকে পাখি বলে চালানোর চেষ্টা। ওরা ‘গান’কে আমদানী করে । নাচ গান দেখানোর জন্য বানানো ‘সিকোয়েন্স’এর বোকামি যায় ধরা পড়ে। এই সময়ের বাংলা ছবিতে গানের দুটি ধারা। এক, ‘তোমার জন্য জান হাজির” টাইপের সিকোয়েন্স ও লিরিক আর তার পাশাপাশি শ্রীজাত’হেন কিছু ‘কবি’র অন্তঃসারশূন্য “নাগরিক”-“জীবনমুখী” ঘ্যান্‌ঘ্যানানি। আরেকটা ধারাও আছে তা হলো যা’কে তাকে দিয়ে যেভাবে ইচ্ছা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ানো।
অন্তিমে ফিরে যেতে হয় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানেই। না, গান থাকলে ছবি ‘নন্‌ ইন্টেলেক্‌চ্যুয়াল’ হয়ে যায় না আর গান থাকলেই যে তা এক্কেবারে ক্লাসিক্‌ - তা’ও নয়। ছবিতে গানের ব্যাপারে সত্যজিতের সেই কথাগুলিই বোধহয় অন্তিমঃ ‘Personally I would not mind the songs if they did not go against the grain of a film. And from an aesthetic point of view, too, there would be nothing to object to them if they did not.Satyajit Ray ' Those Songs' ,1967,  'Our Films Their Films'



ঘুম ঘর