প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Friday, January 10, 2014

আবার তোরা রেপিস্ট হ’





আবার তোরা রেপিস্ট হ’

বর্তমান লেখকের একটি কবিতা পাঠান্তে একজন পাঠক-বন্ধু লিখে জানিয়েছেনঃ ‘সরস্বতীর নাম শুনেছি ,তাঁর সাথে দেখা হয়নি আজো । তাঁর অনুচর দের উল্লম্ফন এর সাক্ষী থেকেই কেটে গেল অনেকটা সময় । তাই জানিনা দেবীর নিবাস কোথায় । তবে শুনেছি তিনি ধনি । তাই ভেবে নিতেই পারি তার একাধিক নিবাস এর সম্ভাবনার কথা , আর এ ও বুঝতে পারি যে তাঁর অন্যতম নিবাসস্থল আপনার (সপ্তর্ষি বিশ্বাস) মন-মানস । আরও আনন্দ পাই এই জেনে যে, এ কোন ভাড়াটে কুঠী নয় । ভাল থাকবেন ‘
আনন্দ পেয়েছি। অভিভূত হয়েছি। চোখে জল এসেছে। - যখনি এমন চিঠি পাই, চিরকূট পাই – আনন্দে চোখে জল আসে এই ভেবে যে অন্ততঃ একজন মানুষকে, অন্ততঃ একটি মুহুর্তের জন্যও হলেও তো ছোঁয়া গেলো। তাই বা কম কি? হয়তো আজ সে প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না রাস্তায় ভিখারিনীর বাড়িয়ে দেওয়া হাতকে, হয়তো আজ সে তার বাচ্চা ছেলেকে কাছে ডেকে নিয়ে শোনাবে গল্প, হয়তো একা বারান্দায় বসে অনেক সময় চেয়ে থাকবে দূরের একটি তারার দিকে, তার মনে পড়বে বহু আগের কোনো সন্ধ্যার স্মৃতি, হয়তো আজ সে ভুলে যাবে যাপনের কোনো একটি না পাওয়া কে, পরাজয়কে। হয়তো ...হ্যাঁ ঐ ‘হয়তো’ গুলিই আনন্দ দেয়। উদ্দীপনা দেয়। দেয় অশ্রু।
     কিন্তু পর মুহুর্তেই আসে আরেকটি ভাবনা। ভাবি অক্ষরের সেতু ভর করে কজনকে বা যায় ছুঁয়ে যাওয়া? কাদেরকে কে বা যায় ছুঁয়ে যাওয়া? – অক্ষরের সেতু দিয়ে যাদের কাছে তুমি যেতে পারো, যারা আসতে পারে তোমার কাছে – তারা ‘পাঠক’।
  কারা ‘পাঠক’? যেমন আমি একজন পাঠক। অর্থাৎ আমি পাঠ করি। অর্থাৎ আমি চোখে দেখতে পাই। যা পাঠ করি তা আমার মগজ বিশ্লেষন করতে সক্ষম। অর্থাৎ আমি মানসিক ব্যাধিগ্রস্থ নই। আমি পাঠ করি। অর্থাৎ আয়াসে কিংবা অনায়াসে আমার ভাত জুটে যায় দুবেলা এবং ভরাপেটে আমি এসব পাঠ – ইত্যাদি করে থাকি। তা থেকে আনন্দ, উদ্দীপনা পেয়ে থাকি। হ্যাঁ, তার মূল্যে আমার দ্বারা কোনো ভালো কাজ যদিবা সম্ভব নাহয় তথাপি আমি সাময়িক বিরত থাকি কোনো গর্হিত কাজ করার থেকে।
বেশীরভাগ ‘কবি’ বা ‘লেখক’ দেরো আমি একই সংজ্ঞায় দেখতে পাই। অর্থাৎ  ‘আমি কবি’ বা ‘তিনি কবি’ এই ঘোষনার মূল্যে যারা মনে করে থাকে যে  তারা সত্যিই মানবজীবনের পক্ষে অপরিহার্য কিছু একটা – আমি তাদের দলে নই। দলে নই, কেননা আমার পাঠ-বন্ধুর মন্তব্যটি পাঠান্তে আহ্লাদিত আমি যখন অফিস থেকে বাড়ি ফিরছি তখনো দেখেছি ঐ ভিখিরী বৌ’টা, সকালেরি মতন, হাত পেতে ভিক্ষা করছে। কোলে তার বাচ্চাটা খিদের চোটে চিল্লাতে চিল্লাতে এখন ঘুমে। - অর্থাৎ যে রচনাটি পাঠ করে পাঠক-বন্ধুটি এতোদূর উচ্ছসিত তার মূল্যে ঐ যে মানুষগুলো, যাদের অক্ষর তো দূরস্থান, অন্ন সংস্থান নেই ... ঐ যে সেদিন মাঠে দেখা স্নায়ু রোগাক্রান্ত বালকটি যার মগজ নিয়ন্ত্রন করতে অক্ষম নিজের হাত-পা’কে, ঐ’যে বেশ্যাটি যার পাঁচ বছরের ছেলে পরের বাড়িতে থাকে বরিশালে আর যে এখানে, বেঙ্গালোরে বেশ্যাগিরি করে দেশে টাকা পাঠায় – তাদের কি আসে যায় আমার এই লেখার প্রতিভায়? আমার ঐ লেখা পাঠান্তে পাঠকজনের আনন্দে? – শুধু আমার কেন উইলীয়াম কেরী থেকে বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, কমলকুমার হয়ে এই যে বাংলা ভাষার যাত্রা তাতেই কি আসে যায় তাদের?
কিচ্ছু আসে যায়না। কিচ্ছুনা। একবার সত্যজিৎ রায় প্রশ্ন করেছিলেন কমলকুমার মজুমদারকে, যে, ‘কমিউনিস্ট’রা যে গরীবদের “দুঃখ  দূর করতে” এতো করছে তা’কি গরীবরা জানে? কমল মজুমদার বলেছিলেন যে ব্যাঙ্গেরা কি জানে যে তাদের ল্যাটিন নাম ‘বুফোমেলানোস্টিক্‌টাস্‌’? হায়, ঐ কমলকুমার সম্বন্ধেও তাঁরি কথায় বলতে হয়, যে, ‘যাহাদের’ কে কেন্দ্র করে তাঁর ‘নিম অন্নপূর্না’ , ‘খেলার প্রতিভা’, ‘খেলার নিয়ম’, ‘তাহাদের কথা’, ‘মতিলাল পাদরী’ বা ‘পিঞ্জরে বসিয়া শুক’ লেখা – সেই ‘তাহারা’ কি উহা জানে? তাঁর ‘খারিজ’ উপন্যাসের উৎসর্গে রমাপদ চৌধুরি লিখেছেন ‘সেই পালানদের, যেদিন তারা পড়তে শিখবে’। হায়, যদি একটু বাঁকিয়ে বলি, যদি বলি, যখন ‘পালান’রা পড়তে শিখবে তখন তারা আর ‘পালান’ থাকবে না। ভদ্দরনোক হয়ে যাবে। ‘লেখক’ হয়ে যাবে। ‘পাঠক’ হয়েযাবে...
না, কমলকুমার বা রমাপদ বা আরো অনেকে, যাঁরা আমাদের চাপে পড়ে যারা মরছে তাদের কথা লিখেছেন, লিখছেন, লিখবেন ভবিষ্যতেও তাঁরা তা করছেন অসততা বশতঃ এমন ভাবার কোনো হেতু নেই। কিন্তু এই ‘লেখা’-‘পড়া’ ব্যাপারগুলোই যে তাদের জন্যে যাদের পেটে ভাত আছে, যারা অসুস্থ নয়, উন্মাদ নয়, বিকলাঙ্গ নয় – তাদের জন্য। অর্থাৎ যদিও এই ‘কাল্ট্‌’এ অনেক মানুষ তথাপিও ‘লেখা’ ‘পড়া’ একটা কাল্ট্‌ বৈ আর কিছু নয়। না, রবীন্দ্রনাথের কোনো গানই কোনো শান্তির ধারনা দিতে পারবে না বাসস্টপের ড্রেইনের কিনারে ঘুমানো সেই মেয়েটিকে যাকে ঐখানে শুয়ে ঐ ঘুমানোটুকুর মূল্যেই প্রতিরাতে মুখে নিতে হয় নানান পুলিশবাবা’র ‘পুলিশাংগ’। কোনো ধ্যান, কোনো যোগ তার ছেলেটিকে পারবেনা অপরাধী হওয়া থেকে বাঁচাতে যে প্রতি মুহুর্তে দেখতে তার মা’র দহন, তার নিজের মৃত্যু। - তাদের ঘৃনায় যতোটা পুড়ছে পুলিশবাবা, ততোটাই পুড়ছেন রবি ঠাকুর, ততোটাই শ্রীরামকৃষ্ণ, ততোটাই আমি, তুমি, প্রত্যেকে। তার ঐ অপমৃত্যুর জন্য যতোটা দায়ী পুলিশবাবা, ততোটাই রবিবাবা, বিবেকানন্দবাবা, আমিবাবা, তুমিবাবা, কবিবাবা, সাহিত্যিকবাবা, শিল্পীবাবা। কাজেই, নিজেকে কবি-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিবীদ- দার্শনিক ভাবার মূল্যে যারা নিজেদের দাবী করে, প্রকাশ্যে অথবা মৌনে, যে তারা মানবসভ্যতাকে উদ্ধার করতে এসেছে, তাদেরকে, যে ‘কবি’র ৯৯ শতাংশ রচনাই আদপেই শিল্লপোত্তীর্ণ নয় সেই ‘কবি’টির ভাষাতেই বলিঃ ‘আমার রক্ত লেখায় যেন লেখা হোক্‌ তাদের সর্বনাশ’ ... আর প্রতিদিন বাসে উঠতে আর বাস থেকে নামতে ঐ বেজন্মা ছেলেটিকে বলিঃ ‘তুই বড় হয়ে কবি হোস্‌না যেন, পাঠক হোস্‌ না যেন, তুই বড় হয়ে রেপিস্ট হ। রেপ্‌ কর্‌। যা’কে সামনে পাস্‌ তাকেই রেপ্‌ কর্‌। হোক্‌ সে পুরুষ, হোক্‌ সে মহিলা। হোক্‌ সে আমার বৌ, আমার ছেলে, আমার মেয়ে। আমরা সবাই তোকে ঠকাচ্ছি। রেপ্‌ করলেও ঠকাবো। না করলেও ঠকাবো। হ্যাঁ, আমার বৌ, ছেলে-মেয়ে’কে রেপ্‌ করলে আমি, “কবি” , অবশ্যই তোর পেছনে লেলিয়ে দেবো পুলিশের কুত্তা, তোর ফাঁসির দাবীতে সভা করব। কেননা এ আমার রক্তের দোষ। কিন্তু তাবলে আমাদেরকে রেপ্‌ করবার তোর যে টার্গেট্‌ তা থেকে তুই সড়ে যাবি কেন?
কেন?”

ঘুম ঘর