প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Sunday, December 20, 2015

টু মিঃ টেগোর ...



টু মিঃ টেগোর ...
১।
কিভাবে সম্বোধন করবো? আপনি? তুমি? মিস্টার টেগোর? রবিবাবু? রবিদাদু? না’কি “প্রভু আমার, প্রিয় আমার, পরম ধন হে” ...
...সে যাই হোক, আপনি যখন আমার জীবনে ঢুকে পরেছিলেন তখন আমি নিতান্তই শিশু। মা শিখিয়েছিল “একদিন শিখগুরু গোবিন্দ নির্জনে...”, “অন্ধকার বনচ্ছায়ে সরস্বতী তীরে...” ... শুনেছি একটা প্রজন্ম পর্যন্ত ছন্দের সঙ্গে বাঙ্গালীর প্রথম সাক্ষাৎ ঘটতো কাশীরাম দাস কিংবা কৃত্তিবাস ওঝার কৃপায় –বৃদ্ধা ঠাকুমা দিদিমাকে দুলে দুলে পয়ারের রামায়ণ-মহাভারত পড়ে শোনানোর অনায়াসের অতলে। ঘটনাচক্রে ঠাকুমা এবং দিদিমা উভয়ের সঙ্গেই জিন্মাবধি বহুকাল আমার কোনো সংশ্রবমাত্র ছিলনা। -পিতামহীর স্থানটিতে যিনি ছিলেন –দিদিভাই-বাবার পিসী-তিনি নিজেই আমরণ ছিলেন দোর্দন্ড পাঠিকা। গল্পচ্ছলে গড়গড়িয়ে বলে যেতেন “একাকিনী শোকাকূলা অশোক কাননে...” থেকে “গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে...”... অস্ত বয়সের দিকে দৃষ্টিশক্তির ব্যাঘাত কিছুটা ঘটলেও জ্ঞান থাকা অবধি পাঠক্ষমতা ছিল চোখের। অতএব তাঁকে আমার খুব কিছু পড়ে শোনাতে হয়নি। তাই আমার ছন্দ শিক্ষার প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ, মাধ্যমিক ... সবই আপনার অক্ষরের ছায়াবীথিতে। এতাবৎ।
মা শিখিয়েছিল “একদিন শিখগুরু গোবিন্দ নির্জনে...”, “অন্ধকার বনচ্ছায়ে সরস্বতী তীরে...”... তারো আগে দিদিভাই’র কাছে শুনেছি “দেবতা মন্দির মাঝে ভক্ত প্রবীণ”, “ভূতের মতন চেহারা যেমন...” –অন্তর্গত গল্পগুলির আবডালে ছন্দ-মিলের অঙ্গুলী ঝঙ্কার তুলেছিল চৈতন্যের শিশু বীণাযন্ত্রেও।
ওই পর্বকে যদি বলি মর্মে আপনার প্রবেশ তাহলে আমার মর্ম-আসরের মধ্যমণি হয়ে বসবার পর্বটি হবে আমার সেই তেরো-চোদ্দ বছর বয়েসের দিনগুলিতে যখন সেই ফিলিপ্স রেডিওতে – যাতে বাবা এরিয়েল জোগাতো ক্রিকেট খেলার রীলে শোনবার সময়ে – দুপুর এক’টা বেজে দশ মিনিটে শিলচর রেওডিও স্টেশনের তদানীন্তন গলাদাটি জাজান দিতেনঃ “এখোন প্রোচারিতো হোচ্ছে গ্রামোফোন রেকর্ডে রোবিন্ড্র-সঙ্গীত। আজকের সিল্‌পি”... বুক ধুক্‌ধুক্‌ প্রতীক্ষায় থাকতাম। কোন্‌ নামটি এখন বলবেন গলাদা? –দেবব্রত বিশ্বাস? সাগর সেন? হেমন্ত মুখোপাধ্যায়? পঙ্কজ মল্লিক? সুচিত্রা মিত্র? সুবিনয় রায়? অরবিন্দ বিশ্বাস? ... কোন্‌ গান হবে আজ? আগে শোনা গান? না’কি নতুন গান? – কয়েক পলকের এই প্রতীক্ষার শেষে বেজে উঠতো গান আর হাতের ধাক্কা লেহে পড়ার টেবিলে ছড়িয়ে পরা কালির বোতলের কালির মতো ছড়িয়ে পরতো মর্মের আনাচে কানাচে – “জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে”, “আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে”, “এই করেছো ভালো নিঠুর হে, এমনি করেই হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো”, “যদি প্রেম দিনা প্রাণে কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে”, “আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়”... ‘গীতবিতান’ হাতে নিয়ে কেটে গেছে আমার অনেক দুপুর, অনেক রাত। অক্ষরের সূত্র ধরে শোনা না-শোনা গানের কথায়, ছন্দে তলিয়ে গিয়ে কেটেছে কৈশোর, বয়ঃসন্ধি...
আচ্ছা, ঠিক কি বলতে চেয়েছিলেন আপনি? ঠিক কোন্‌ বস্তু,অবস্তু,প্রাণী,অপ্রাণী’কে আপনি বলেছেন ‘বন্ধু’? বার বার? নানা গানে? নানান আবহে? “জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে”, “আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার পরাণসখা বন্ধু হে আমার”, “বন্ধু রহো রহো সাথে...” - কবিতা রচনার অন্তর্গত কল্পনাআভার আঁতুড়ঘরের সন্ধানে যেতে গিয়ে জীবনানন্দ লিখেছেন “ কেউ কেউ বলেন (কবিতা রচনার অন্তর্গত কল্পনাআভা), আসে পরমেশ্বরের কাছ থেকে। সে কথা যদি স্বীকার করি তাহলে একটি সুন্দর, জটিল পাককে যেন হীরের ছুরি দিয়ে কেটে ফেললাম। ...’ –ঠিক তেমনি আপনার নানা গানের, কবিতার ঐ “বন্ধু”কে যদি ‘পরমেশ্বর’ বলে মেনে নিই তাহলেও, প্রকৃত প্রস্তাবে, ‘একটি সুন্দর, জটিল পাককে যেন হীরের ছুরি দিয়ে কেটে ফেললাম’। আবার যদি বাফ্‌-জেইঠ্যাদের গলায় গলা মিলিয়ে বলি যে ঐ “বন্ধু” – কখনো নতুন বৌঠান, কখনো ওকাম্পো, কখনো রাণু তাহলে সেই সুন্দর জটিল পাককে – এই ক্ষেত্রে হীরের নয় – জং ধরা ক্ষর দিয়ে কেটে ফেলা হয়। তাহলে? তাহলে ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছিলেন আপনি’র থেকেও গহনতর প্রশ্ন কিভাবে বুঝবো আমি? কি বুঝবো আমি? অনেক ভাবনাচিন্তার পরে মনেহয় সেই কিশোরদিনের মতোই বলি “বুঝবোনা”। গাইবো। ভাববো না। শুনবো –
      মাননীয় মিস্টার টেগোর, মৃত্যুর সঙ্গে আমার রক্তমাংসে পরিচয়টিও করিয়ে দিয়েছিলেন দিদিভাই। নয় কিংবা দশ কেলাসে পড়ি তখন। দিদিভাই মারা গেলেন। এর আগে পর্যন্ত ‘শোলোকবলা কাজলাদিদি’র মৃত্যু, অপু’র দিদি দুর্গার মৃত্যু, ফটিকের মৃত্যু, ‘ফাঁকি’ আর ‘মুক্তি’ কবিতার নায়িকাদের মৃত্যুতেই আমার মর্ম চালচিত্রে ছিল মৃত্যুর উপস্থিতি। অনুভব। দিদিভাই’র মৃত্যুই প্রথম আমাকে দেখালো ঠিক কিভাবে, কি আকস্মিকতায় একটি নরশরীর মৃতদেহ হয়ে গিয়ে কি নিদারুন অসহায়তায় নিশ্চল শুয়ে থাকে উঠানে। ছাদের, চালের অনিরাপত্তায় আর তারপরে দাউ দাউ জ্বলে ওঠে চন্ডাল আর চ্যালাকাঠের অবলীল সহযোগিতায়...
দিদিভাই’র দেহটা যতোক্ষন পুড়ে যাচ্ছিল চিতার আগুনে ততোক্ষনও কেন যেন মনে একটা ভরসা ছিল। মনে হচ্ছিল ‘আছে’। মনে হচ্ছিল ‘দিদিভাই’ এখনো আছেন। ক্রমে আর রইলোনা কিছুই। জল ঢেলে শান্ত করা হলো চিতা। অস্থিটি সংগৃহিত হলো। এইবার ঘরে ফেরার পালা।
সীমান্তের মফস্বল শহর তখন তলিয়ে গেছে মধ্যরাত্রির অতলে। যেন এইমাত্র সব কিছু মুছে ঝকঝকে অন্ধকার শেলেট। শ্মশানবন্ধুদের সামান্য পিছে পিছে হাঁটছে বাবা। বাবার কিনারে কিনারে হাঁটছি আমি। চিতায় পুড়ে গেছেন দিদিভাই তবু যেন বিশ্বাস হচ্ছেনা। মনেহচ্ছে শ্মশানে যে রয়েগেছে সে অন্য কেউ। দিদিভাই এখনো বসে আছেন কিংবা শুয়ে আছেন তাঁর কোঠায়। তাঁর বিছানায় –
বাড়িতে পা রাখা মাত্র সেই ছবিটি গেলো চুরমার হয়ে। দিদিভাই’র শূন্য কোঠার, শূন্য বিছানার খাঁখাঁকে অবলোকনমাত্র কিশোর চেতনা ফেটে পড়তে চাইলো নিরশ্রু রোদনে। একদৌড়ে এসে বসে পড়লাম সামনের বারান্দার সিঁড়ির এক প্রান্তে। দুয়েক সেকেন্ড মাথা নিচু করে থেকে তাকালাম আকাশের দিকে আর তখুনি  সমস্ত বোঝা না বোঝা’র পরপার থেকে নিজস্ব ইথার তরঙ্গে বেজে উঠলো গান, ভেসে আসলো গানঃ “জীবন মরনের সীমানা ছাড়ায়ে বন্ধু হে আমার রয়েছো দাঁড়ায়ে...” - ঠিক কোন্‌ বস্তু,অবস্তু,প্রাণী,অপ্রাণী’কে আপনি বলেছেন ‘বন্ধু’? জানিনা। সেই কিশোরকালেও। জানিনা। আজও ...
হে রবি ঠাকুর, আমি কোনো ঋষিপুত্র ছিলাম না, ছিলাম না কোনো ঋষির আশ্রমে অধ্যয়নরত ‘অন্ধকার বনচ্ছায়ে সরস্বতী তীরে’। না’ত ছিলাম কোনো ‘ফাদার’এর নভিস। কোনো মাদ্রাসার ছাত্রটি। এমনকি আপনার জীবদ্দশার যে শান্তিনিকেতন তাহেন কোনো আধ্যাত্মিক-শিক্ষা-দীক্ষা-আবহ আমার ছিলোনা। তথাপি কি অনায়াসে, অবলীলায় সেই রাত্রে আমি নির্ভর করলাম আপনার গানে। গানের কথার, সুরের আধ্যাত্মিকতায়। আজো টেরপাই সেই রাত্রিটির শান্তিছায়া। -অনেক পরে টের পেয়েছি যে ধর্ম আর আধ্যাত্মিকতা অনেক অনেক অনেক আলোকবর্ষ দূরের দুই বাসিন্দা। টের পায়েছি সেই রাত্রে, সেই গানে আপনি আমার মর্মে যার অঙ্কুর রোপন করেছিলেন তা’ই আধ্যাত্মিকতা। প্রকৃত, প্রাকৃত আধ্যাত্মিকতা।
জীবনের কেন্দ্রে স্থাপন করতে চাই ঐ আধ্যাত্মিকতাকে। যাপনপ্রবাহের ঘটনাবলীর প্রতি নিজ প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই ঐ আধ্যাত্মিকতার নিরিখে। সমস্ত কিছুর পরে পেতে চাই সেই বিরাটের স্পর্শ যাই ইঙ্গিত আপনি দেখিয়েছিলেন সেই রাত্রে। - কিন্তু ব্যর্থ হই। ব্যর্থ হই জীবনে-যাপনে ঐ বিরাটের ইঙ্গিতকে অনুধাবনে। বরং ‘একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে’ – তাদেরি মতন ফুঁসে উঠি। পুড়ে যাই। ভস্ম হয়ে যাই...
তথাপি নিশ্চিহ্ন যে হইনা একেবারে, হইনি একেবারে তার হেতু হঠাৎই এক সময়-নিজেরো অজান্তে – আপনার মর্ম ইথারে ভেসে আসে গান। গান গুলি। উঠে আসে ‘গীতবিতান’। আমার মায়ের ছাত্রী জীবনে কেনা। পাতা হলুদ হয়ে যাওয়া। কৃষ্ণা স্টোর্স থেকে কিনে আনা ‘জয় মাতাদী’ সিরিজের ক্যাসেট বেজেওঠে -একবার ‘এরিয়ার’ পেয়ে বাবার কিনে আনা ফিলিপ্স টেপ্‌রেকর্ডারে – দেবব্রত বিশ্বাসের কন্ঠ – ‘হে পূর্ণ তব চরণের কাছে যাহা কিছু সব আছে আছে আছে” গেয়ে ওঠেন সুবিনয় রায়ঃ ‘অমল কমল সহজে জলের কোলে আনন্দে রহে ফুটিয়া / ছোটে না কভু আলয় কোথায় বলে/ধূলায় ধূলায় লুটিয়া...” শোনাযায় সাগর সেনের গলাঃ ‘যদি ঝড়ের মেঘের মতো আমি ধাই চঞ্চল অন্তর / তবে দয়া করো হে, দয়া করো হে, দয়া করো হে ঈশ্বর” ...।
হে রবি বাবু, রবি ঠাকুর, মিস্টার টেগোর, হে রবীন্দ্রনাথ – ভরসা চাই –শুধু এই ভরসাটুকু চাই – বাইবেলের ঐ ‘জব্‌’টির মতো –শয়তান কিংবা ঈশ্বর কিংবা সহোদর মানুষের দ্বারা সব হারালেও, পঙ্গু হলেও যেন ঐ ‘জব্‌’টির খেঁকিয়ে না উঠি – অকারণ অভিশাপে দগ্ধ না করি পারিপার্শ্বকে। যেন তখনো নিজস্ব বেতারকেন্দ্র থেকে নিজস্ব ইথারে ভেসে আসে গান, ভেসে আসে সুরঃ ‘যা পেয়েছি প্রথম দিনে সেই যেন পাই শেষে / দুহাত দিয়ে বিশ্বেরে ছুঁই শিশুর মত হেসে...”


ঘুম ঘর