প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Thursday, December 26, 2019

বিলাইতি ‘নববর্ষের’ প্রাক্‌কালে এক বাঙ্গালের বাতুলতা (১)

বিলাইতি ‘নববর্ষের’ প্রাক্‌কালে এক বাঙ্গালের বাতুলতা
=================================

“যো ডর্‌ গেয়া সমঝো মর গেয়া”
---------------------------------
 বাংলা নববর্ষ  বাঙ্গালীর যাপন থেকে বিদায় নিয়েছে বহুযুগ। এই বিদায় “সভ্যতা “ নামক জন্তুটির বপু মুহুর্মুহু চক্রবৃদ্ধি হারে বিরাট হয়ে উঠবার স্বাভাবিক নিয়মেই। শুধু বাঙ্গালী কেন আর সকল গোষ্ঠির - কন্নড়,তামিল, তেলেগু, মালয়ালম – নিজ নিজ নববর্ষও ক্রমবিলুপ্ত ওই একই কারনেই। “সভ্যতা” নামক জন্তুটির কলেবরের চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধির মাহুতটি যেহেতু বাণিজ্য, কেবলই বাণিজ্য, যে কোনো মূল্যে বাণিজ্য ফলতঃ, বকলমে, অদ্যাবধি “বণিকের মানদন্ড”ই আদতে “রাজদন্ড”। সুতরাং “কাছে দূরে গ্রামপতনের শব্দ” আর নেই। নেই কেননা গ্রামই আর নেই।  এখন মফস্বল পতনের, শহর পতনের শব্দে মেট্রো সিটি, স্মার্ট-সিটি’র বাড়বাড়ন্ত। “চাষার ছেলে কি চাষা হয়ে থাকবে না’কি” – এইমত অতি সঙ্গত প্রশ্নের উত্তর দিতে দেশগেরামের জমিজমা, ঘটিবাটি বেচে দিয়ে কাতারে কাতারে আমরা এসেছি, আসছি, আসব – মেট্রোসিটিতে, স্মার্টসিটিতে। আসব ‘ডিজিট্যাল করণিক” হতে পুঁজিপ্রভুর তোরণসম্মুখে। সুতরাং আমাদের বর্ষ শেষ, বর্ষ আরম্ভ সবই ঘটবে পুঁজিপ্রভুর বালিঘড়ির নিয়মে। আমাদের ‘চৈত্র শেষ’ কে বড়জোর ‘চৈত্র সেল্‌’ এর ছাপ্পা মেরে আরেক দফা মুনাফা তুলে নেবেন, নিচ্ছেন পুঁজি প্রভুরা। হাতেগোনা কিছু মানুষ অভ্যাসবশে, কিছু মানুষ “আমরা সংস্কৃতিবান, আমরা আমাদের সোমস্‌কৃতি আঁকড়ে আছি” জানান দিতে “শুভ নববর্ষ” হাঁকবে, লিখবে ডিজিট্যাল মাধ্যমের মোচ্ছব পৃষ্ঠায়। আমার নিজের অন্নদাতা পুঁজিপ্রভুর হয়ে “ইন্টারভিউ” নিয়ে হয় আমাকে মাঝে মাঝেই। নরম, সবুজ মুখের সদ্য ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ দেওয়া যুবকের মাতৃভূমি উড়িষ্যা দেখে কৌতুহল হল। প্রশ্ন করলাম, তবে “কর্পোরেট ডিগ্‌নিটি” বজায় রেখেই “দেশবাড়িতে কে কে আছেন? কি করেন তাঁরা?” কাচুমাচু মুখে ছেলেটি বল্লো তাঁতের কাজ তাদের পারিবারিক বৃত্তি। নিজের চোখেমুখে  প্রবল উদ্দীপনা এনে বলিঃ “বাহ্‌, তুমিও শিখেছো না’কি তাঁতের কাজ? এ’তো এক অসামান্য শিল্প হে”। আমার ছলনায় ভবি ভুল্লো। সে বল্লোঃ “হ্যাঁ, আমিইতো বাবাকে হেল্প করতাম এতোদিন”। “বাহ্‌। তা এখন তুমি যে এখানে চলে এলে ...” “বাবা একজন হেল্পার রেখেছে...” “ভালো, ভালো, খুবই ভালো কথা। কিন্তু এই শিল্প তো তোমার পারিবারিক। তোমার পূর্বপুরুষদের শোণিতবাহিত হয়ে তোমার শোণিতে অবলীল। ফলতঃ তুমি যেমনটা পারবে আরেকজন, যার রক্তে নেই এই শিল্পের বীজ, সে এ কাজ করলে সে’তো শুধুই কারিগরি হবে... আর ক্রমে তোমার পারিবারিক শোণিতের থেকেও মুছে যাবে এই প্রতিভা...” বালকটি কাচুমাচু মুখে বল্লো, “তা ঠিক, কিন্তু আমি তো কম্পিউটার ইঞ্জিনীয়ার হব ভেবেছি সেই ...” – মনে এলো সমরেশ বসু’র “টানাপোড়েন”, মনে এলো উপন্যাসটির শেষ বাক্যঃ “বুনা কর। জীবন বুনা কর”। এই প্রসঙ্গটি থেকে মোড় নিলাম অন্য পথে। না, এই সদ্য যুবক, এই সব যুবকেরা নিষ্পাপ। তারা জন্মাবধি শুনে আসছে “চাষার ছেলে কি চাষা হয়েই থাকবে না’কি”? তারা দেখছে ‘ডিজিট্যাল করণিক”দের “কোঁচার পত্তন” আর ইন্টারনেটের প্রতিভায় ঢাকা পরে থাকছে অন্দরের, অন্তরের “ছুঁচোর কেত্তন”। অন্ধ্র প্রদেশ থেকে বহু বহু ছেলেমেয়ে আসছে ‘ডিজিট্যাল করণিক” হওয়ার দুর্মর স্বপ্ন নিয়ে অথচ এদের অনেকেই সম্পন্ন চাষী। হায়, কৃষিবিজ্ঞানী বা কৃষির প্রায়োগিক দিকের পঠন ও অনুশীলনের দ্বারা তারা যদি চেষ্টা নিতো ... কিন্তু কেন নেবে? কিভাবে নেবে? তারা দেখছে ‘ডিজিট্যাল করণিক”দের “কোঁচার পত্তন” আর ইন্টারনেটের প্রতিভায় ঢাকা পরে থাকছে অন্দরের, অন্তরের “ছুঁচোর কেত্তন”। সে ‘ডিজিট্যাল করণিক” হয়ে সিটি-ম্যান হওয়ার মূল্যে বাপের চাষে, তাঁতে আসছে ‘হেল্পার’ হয়তো যার পারিবারিক বৃত্তি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন, বণিকবাবা’র বানানো সভ্যতার বাড়বাড়ন্তে সে’ও হয়েছে বৃত্তিহারা, ছন্নছাড়া। ‘পাপি পেট কা সওয়াল’ এর জবাবে হয়ে গেছে তাঁতীর, চাষীর “হ্যান্ডেল” – হয়তো মাটি ছেনে মূর্তি গড়তে বসলে  এর হাতেই মৃন্ময়ী হতেন চিন্ময়ী। - কিন্তু এখন আর তা হবার নয়। এখন সকলে “কারিগর”। বাঁধা গতে গাওয়া। বাঁধা নিয়মে পথচলা। “ম্যানেজমেন্ট” – নানা ঘাটের কাদা খাবলে তুলে গিলিয়ে খাওয়ানো। মুড়িতে মুড়কিতে, গাধায়-ঘোড়ায় এমনভাবে একাকার করে ফেলা যে, ঘোড়াকে তার প্রপিতামহের প্রেত কেন, স্বয়ং প্লেটোর প্রেতও এসে আর ভরসা দিয়ে জানাতে সক্ষম হবেন না, যে, সে আদতে ঘোড়া। গাধা নয়। আর বেচারা ঘোড়ারই বা দোষ কি? কোন্‌ কালে কোন্‌ হিটলারই বা চেয়েছিল আইনস্টাইন বা কার্ল মার্ক্সহেন ইহুদী, যারা ভাবতে পারে, যারা ভাবনাকে পারে অবয়ব দিতে ...
এই যখন চালচিত্র, তখন ১লা বৈশাখের ভূমিকা চৈত্রসেল্‌ এর “কনটেক্সট্‌” ভিন্ন আর কি’ই বা হতে পারে? কেনই বা হতে যাবে? এর চে’ ‘গ্লোবাল নিউ ইয়ার’, ১লা জানুয়ারী, ‘প্রভু’ দের সঙ্গে গলা মিলিয়ে “হ্যাপ্পী ন্যু ইয়ার, হিপ্‌ হিপ্‌ হুর্‌রে”ই কি নয় সহজ এবং অবলীল? ১৯৬০ এর দিকে অলোকরঞ্জন লিখেছিলেনঃ
মা জননী বসে আছেন, চোখের সামনে খালি
শহরে কাজ নিতে পালায় বলাই, বনমালী।
লিখেছিলেনঃ
বলাই বনমালী সুবল শ্রীদাম সুদাম শেষে
রমেন নরেশ পরেশ হল শহর ভালবেসে।
(এক জানালা রাত্রি আমার, যৌবন বাউল)
আজ ২০১৯ এর শেষে’র বাস্তব এই, যে, রমেন নরেশ পরেশ – সক্কলে হয়ে গেছে – ভিকি,ভিশাল,ফ্যাগি, জিম, দিব্‌ইয়া, এন্সি, ন্যান্সী ...। সুতরাং ১লা বৈশাখের ভূমিকা চৈত্রসেল্‌ এর “কনটেক্সট্‌” ভিন্ন আর কি’ই বা হতে পারে? কেনই বা হতে যাবে? এর চে’ ‘গ্লোবাল নিউ ইয়ার’, ১লা জানুয়ারী, ‘প্রভু’ দের সঙ্গে গলা মিলিয়ে “হ্যাপ্পী ন্যু ইয়ার, হিপ্‌ হিপ্‌ হুর্‌রে”ই , হয়, সহজ এবং অবলীল। ... অথচ এই কি হওয়ার কথা ছিল? বাঙ্গালীর? কোনো জাতির? কোনো মানুষের? মর্মে বেজে ওঠেন জীবনানন্দ দাশ “মানুষের তা’ই হল, যা হবার নয়’। হলো, কেননা ‘বণিকের মানদন্ড’ই এই সভ্যতাজন্তুর মাহুত, রাজদন্ড তারই হাতে আর তার একটিই প্রয়োজন, সে প্রয়োজন লাভ, সে প্রয়োজন মুনাফা। এদিকে আবার লাভ-মুনাফা আর ‘পাওয়ার’ একে অপরের পরিপূরক। সুতরাং রাজনৈতিক ‘পাওয়ার’এর প্রয়োগে যদি কিছু মানুষের, থুড়ি, “রিসোর্সের” দেশ-কাল মুছে দেওয়া যায় তাহলে সেই সকল “রিসোর্স”ই হবে “ফ্রী”। মহান আমেরিকায় লেটিন আমেরিকানরা যে রকম। একটি উদাহরণ - নীলছবির বাজারে একজন আমেরিকান মহিলার দামে ৩ জন ল্যাটিন আমেরিকান মেয়ে’কে দিয়ে যায় শুট্‌ করানো কেননা তাদের পাসপোর্ট নেই, কেননা তাদের দেশে তাদের বেঁচেথাকা তো দূরস্থান, সঙ্গতি নেই টিঁকে থাকারও। কেন নেই? হে মহান আমেরিকা? উত্তর মেলেনা। এইবার দরকার এমনই আরো ফ্রি-রিসোর্স। সুতরাং দেশে দেশে জাল ফ্যালো। দ্যাখো, কোন ফোঁকড়টি দিয়ে যায় ঢুকেপড়া। এন-আর-সি? সি-এ-বি? – ‘জয় রামজী কী’। ‘মন্দির বোহি বানায়েঙ্গে’। কি আসে যায় দেশী, বিদেশী নববর্ষে? কি আসে যায় আগামী কালের ভাবনায়? “আজ তো আমি হিন্দু, মরুক শালা মুসলমানের বাচ্চারা” – কিন্তু এই যে ‘বণিকের মানদন্ড’, যে এই সভ্যতাজন্তুর মাহুত তার খিদে কি মিটবে একটি দেশ, একটি রাজ্যের ‘ফ্রী রিসোর্স’ এ? সে ইহুদীদের ‘ফ্রী রিসোর্স’ করেছে একদিন, পরদিন ল্যাটিন আমেরিকা, আজ সে বলছে ‘মুসলমান’ – এরপরে যে সে এসে বলবেনা যাদের জন্ম কোনো বিশেষ ক্ষণ’এ নয়, ‘অস্‌পিসাস’ গ্রহ-নক্ষত্রের যোগে নয়, তারা সক্কলেই ‘ফ্রী রিসোর্স’, তারা সরকারী সাহায্য পাবেনা, সরকারি চাকরি পাবেন, পাবেনা রেশন কার্ড, গ্রীন কার্ড, ব্লু কার্ড ... তখন? তখন যদিবা তুমি বলোও, যে, “সরকার, ম্যায় নে আপ্‌ কা নমক খায়া”, তাহলেও গহ্বর ‘ভাই’ বলবেন “ আব্‌ গোলি খা”। অতঃপর আচমকা গুলিতে তিনটি খুলি উড়িয়ে অন্যদের স্তব্ধ করে দিয়ে গর্জে উঠবেন গহ্বর ভাইঃ “মন্দির এহি বানায়েঙ্গে!! যো ডর্‌ গেয়া সমঝো মর গেয়া”। প্রেক্ষাগৃহ ফেটে পড়বে হাততালিতে, তখনো, নিশ্চিত।

ঘুম ঘর