প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Sunday, February 2, 2020

‘কেমিস্ট্রি’র মিস্ট্রি এবং রানী আর আমি


কেমিস্ট্রি মিস্ট্রি এবং রানী আর আমি





ছিল এক শহর করিমগঞ্জ। 
তা’তে ছিল এক কলেজ। “করিমগঞ্জ কলেজ”। 
আর ছিল একনির্ধনদা ছিল কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরির দেখভালদার টাক মাথা বেঁটেখাটো গোলগাল পরিধান ধুতি আর হাফ শার্ট পাকা, পাকানো, মাঝারি গোঁফ হঠাৎ করে বাংলা ছবিরজহরকে মনেপড়া যাওয়া বিচিত্র নয় ছিল একনির্ধনদা ছিল কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরির দেখভালদার বারো কেলাসের ফাইন্যাল পরীক্ষার প্রেকটিক্যালে ছিল সে ম্যাজিশিয়ান মাথা পিছু দশ টাকা দড়ে লটারীতে কার কোনসল্টপরেছেএনালাইসিসেরজন্য বলে দেওয়ার বাণিজ্য তার অনেক যুগের


ছিল একনির্ধনদা আর ছিলাম এক বেচারাআমি’ – ‘কেমিস্ট্রি মিস্ট্রি অদ্যাপি যার মগজে অগম্য তবে ম্যাজিশিয়ান নির্ধনদা থাকতে পরোয়া কিসের? বুক ঠুকে, বারো কেলাসের ফাইন্যাল প্রেকটিক্যালে হাজির হয়ে দেখি বিপদ নির্ধনদাকে যতোই সাধাসাধি করি, দশের বদলে কুড়ি টাকাঅফারকরি, উঁহু, নির্ধনদা অকস্মাৎ সততার পরাকাষ্ঠা কেমিস্ট্রি মিস্ট্রি সঙ্গে এই আরেকমিস্ট্রি সমাধান সন্ধানহেতু মগজে ধোঁয়া দিয়ে কলেজের পশ্চিমে, ফিজিক্স ল্যাবের পেছনে পুকুরপাড়ে গেলাম সেখানেদেখা হয়েগেলো, অধুনা স্বর্গত, তখনকার কুখ্যাত এবং বিখ্যাত কুমারেশদা সঙ্গে ভাগাভাগি করে চারমনার টানতে টানতে কুমারেশদাকেনিদ্ধনদা পাজ্টি দিতেই কুমারেশদা উত্তর বলেদিলো সেকেন্ডেআরে, তোকে তো টাকা নিয়েসল্টের নাম বলে দেবেনা তুই তো স্যারের ছেলে জানাজানি হলে মুশকিলের ভয় হায় পিতা! সেই কলেজেরই ইংরেজির অধ্যাপক হায়! করিমগঞ্জ কলেজের ইতিহাসে তখনো আমাহেন অধ্যাপক-পুত্র ছিলনা বা অধ্যাপক-কন্যা আমদানী হয়নি যাকে নির্ধনের ভরসায় যেতে হয় পরীক্ষা দিতে অন্যান্য অধ্যাপক-পুত্রেরা, আমার সমপাঠীরাসহ, প্রত্যেকেই প্রায়অধ্যাপক একজন ইউনিভার্সিটিতে স্টান্ড করে তো আরেকজন নিয়েয়াসে গোল্ড মেডেল! আর আমি! হায়!! … অবশেষে ল্যাবের সামনে রাখাট্রেথেকে আমার রোল নাম্বার লেখা ছোট প্যাকেটটি নিয়ে ঢুকেই পড়লাম ল্যাবরেটরীতে
ছিল একনির্ধনদা ছিলাম এক বেচারাআমি ছিলেন এক মহামহিম অধ্যাপক মনোতোষ দত্ত তিনি বই ছেপে ছিলেন হলুদ মলাটের চটি বই প্রথম দর্শনে মনে হতেই পারে বইটিজীবন যৌবন’ , ‘যৌবনের রস’, ‘কোকশাস্ত্র’ – ইত্যাদির সমগোত্রীয় অভিনিবেশ দ্বারা জানা যায় এটি কেমেস্ট্রির বই প্র্যাকটিক্যাল-হেন্ডবুক মহামহিম অধ্যাপক মনোতোষ দত্ত এই বই ছেপে ছিলেন। বেচেছিলেন কেলাসের সব্বাইকে। ল্যাবের এক কোনে দাঁড়িয়ে সেই বিশ্ব-রসায়নকোষটি খুললাম জীবনে প্রথমবার এবং স্বাভাবিকভাবেই হিব্রু কিংবা পুস্তু ভাষার সঙ্গে এই চটি’র ভাষার তফাৎ করা অসম্ভব হলো আমার। ল্যাবরেটরির জানলা দিয়ে বাইরের সুপুরীগাছেদের দিয়ে চেয়েথেকে ভাববার চেষ্টা করছি কি হতে পারে এর পরিণাম …
“কি’রে আধঘন্টাও তো হয়নি, তোর কি সল্ট এনালাইসিস্‌ শেষ হয়ে গেলো’? – পরিচিত স্বর, সস্নেহ, শুনে ফিরে তাকিয়ে দেখি রানী। রানী চৌধুরি। সহপাঠিনী হলেও রানী আমাদের গ্রাহ্যই করতোনা সমবয়সী বন্ধু হিসেবে। তার কাছে আমরা নিতান্ত নির্বোধ ছোটোভাই। আর আমি, যেহেতু ছিলাম একেবারেই লাগামছাড়া বুনো ঘোড়া ফলে আমাকে বুঝিয়েসুজিয়ে সামলে রাখাটা রানী তার দায়িত্ব বলেই ধরে নিয়েছিল। এ ছাড়াও আমার ডাকনাম আর ওর দাদা’র ডাকনাম – এক – ‘রাজা’। মঞ্চে রানীর প্রবেশ আমাকে সাহস দিলো। 
বল্লামঃ “দুর্‌ কি করব, কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা”
“কেন? বল্‌ তোর কি সল্ট পড়েছে। আমি স্যারের বই থেকে বার করে দিচ্ছি কি করতে হবে”
“আরে দুর্‌, কি সল্ট জানলে তো আর কথাই ছিলনা …”
“কেন, নির্ধনদা বলে দেয়নি”?
প্রায় সাশ্রু চোখে রানীকে জানালাম নির্ধনদা-ট্র্যাজিডি’র কথা। রানী শুনলো। শুনে দমে গেলো। গুম্‌ মেরে রইলো মিনিট পাঁচ তারপর বল্লো “ দেখি তোর সল্টটা”। দেখালাম।
“আরে এ’তো মনেহচ্ছে নুন রে। স্রেফ নুন। সোডিয়াম ক্লোরাইড। দাঁড়া মুখে দিয়েদেখি” – আমার হাত পা ঠান্ডা। যদি সোডিয়াম ক্লোরাইডের বদলে এ হয় “স্পার্কলিং সাইনাইড”… আমি রানীকে থামাতে যাওয়ার আগেই আঙ্গুল দিয়ে এক চিমটি ‘সল্ট’ জিহ্বায় দিয়ে রানী বিজয় গর্বে জানাল “যা ভেবেছিলাম। এটা সোডিয়াম ক্লোরাইড। আমারো তো এটাই পড়েছে। চলে আয় আমার ডেস্কে…”
ভাইভা’তেরানীর ডাক এলো আমার আগে। অতএব ভাইভা’তে কি কি জিজ্ঞেস্করতে পারে তা’ও পাখিপড়া করিয়ে দিলো রানী। রেজাল্ট বেরোতে দেখাগেলো কেমিস্ট্রি থিয়োরী’তে শতকরা ৩৫ না ৩৮ পেয়েছি আর প্র্যাকটিক্যাল এ, হায় নির্ধনদা, ৫০ এর মধ্যে ৪৫!!!
আগামী কাল না’কি পরশু আমার ছেলের কেমিস্ট্রি প্যাকটিক্যাল, বারো কেলাসের ফাইন্যাল। আহা, তার বারো কেলাস যেন ফিরিয়েয়ানলো আমার বারো কেলাসকে, আমাদের বারো কেলাসকে। সেই আমাদের বাররো-কেলাস বয়স, সেই আমাদের কলেজ, করিমগঞ্জ কলেজ, হায়, আছে, এখনো আছে। সেখানে আছি আমরাও। - এখানে, এই বেঙ্গালোর শহরে আছে আমার লাশ। … রানী আছে গৌহাটিতে। সে এখন জজ্‌ না’কি ম্যাজিস্ট্রেট কিছু একটা।






ঘুম ঘর