“ পান্থজনের
সখা হে …”
সপ্তর্ষি বিশ্বাস
সে এক নক্ষত্রে ভরা মাঠ।
মাঠ ভরা নক্ষত্র।
নক্ষত্রের আড়ালে নক্ষত্র। নক্ষত্রের আবডালে গ্রহ, উপগ্রহ, উল্কা, ধূমকেতু,
বিগ্ব্যাং, ব্লেক-হোল, একবিশ্ব, মহাবিশ্ব, বহুবিশ্ব। মুহুর্মুহু তাদের জন্ম। তাদের
মৃত্যু। তাদের সকলের সঙ্গে, প্রত্যেকের সঙ্গে - পৃথিবীর প্রতিটি ধূলিকণার থেকে বহুবিশ্বের
বহু ধূলিকণার সঙ্গে এক-জীবনের যোগাযোগের আরম্ভ-মুহুর্তটি জন্ম, অবসান-মুহুর্তটি মৃত্যু।
আরম্ভ-মুহুর্তটি ভ্রূণ। অবসান-মুহুর্তটি শব। একটি ভ্রূণের মধ্যে জীবনকে সঞ্চারিত করে
যারা আমাকে এক-জীবনের জন্য বেঁধে দিল ওই নক্ষত্র-মাঠের প্রতিটি জীবিত ও মৃত নক্ষত্রপুষ্পের
সঙ্গে, নক্ষত্রধূলির সঙ্গে তারাই জনক-জননী।
জনক-জননী, তবে মাতা-পিতা কি?
এর উওর কখনো হ্যাঁ, কখনো না। কেননা এক নাড়ির বাঁধন কেটে নাড়ির যোগ
ঘটিয়ে দিলো অনেক, অনেক, অনেকের সঙ্গে। ঘটিয়ে
দিলো যোগাযোগ তবু তারপর হয়তো ভাসিয়ে দিলো ভেলায়, রেখে দিয়ে গেলো অরণ্যে - তপস্বীজনের
গতায়াতের পথিপার্শ্বে, কোনো মতিলাল পাদরীর গ্রাম্য গীর্জার বেড়ার কিনারে। যদি শিয়ালে-শকুনে
কাবার করে দিলো তো কাহিনীর সমাপ্তি এখানেই আর নতুবা যদি কোনো অধিরথ-রাধা কিংবা কোনো
মমতাময়ী ফারাও-কন্যা কোলে তুলে নিলো সেই শিশুকে তবেই, তখনই কাহিনীতে প্রবেশ ঘটলো মাতাপিতার।
মাতাপিতা তাঁরাই যাঁদের হাঁটুতে ভর দিয়ে হামাগুড়ি থেকে দাঁড়াতে শিখলো শিশু, হাঁটতে
শিখলো, বলতে শিখলো - টের পেতে শিখলো পৃথিবীর প্রতিটি ধূলিকণার থেকে বহুবিশ্বের বহু
ধূলিকণার সঙ্গে তার বাঁধনের হেউঢেউ।
তারপর একদিন
সেই মাতাপিতাকেও নিশ্চিহ্ন করে দেয় কাল। মহাকাল। 'কবরের ঘাস' কিংবা বিভূতি ভিন্ন আর
কিছুই থাকেনা। সেই যে মুহুর্ত, যখন একটি লোক পরিণত হয় মা-বাপ-হারা একজন মানুষে - তখনই
কি সে, হয়, অনাথ? সে হয় একা ? একা এক নক্ষত্রভরা মাঠের হাহা শূন্যতায়? হুহু শূন্যতায়?
না'কি সে ছিল সততই অনাথ? জন্মমাত্রই অনাথ? না'কি সে অনাথ ছিলোনা কোনো দিনই আর তাই সে
অনাথ হবেওনা কোনোদিন?
'মা-বাপ-মরা', অনাথ ছেলে শব্দবন্ধগুলি
আমার মর্মে সতত নিয়ে আসে 'অভাগীর স্বর্গ'র 'কাঙ্গালী'কে। 'নদীর চরে গর্ত খুঁড়িয়া
অভাগীকে শোয়ান হইল। রাখালের মা কাঙ্গালীর হাতে একটা খড়ের আটি জ্বালিয়া দিয়া তাহারই
হাত ধরিয়া মায়ের মুখে স্পর্শ করাইয়া ফেলিয়া দিল। তারপরে সকলে মিলিয়ে মাটি চাপা
দিয়া কাঙালির মায়ের শেষ চিহ্ন বিলুপ্ত করিয়া দিল। সবাই সকল কাজে ব্যস্ত—শুধু সেই পোড়া খড়ের আটি
হইতে যে স্বল্প ধূঁয়াটুকু ঘুরিয়া ঘুরিয়া আকাশে উঠিতেছিল তাহারই প্রতি পলকহীন চক্ষু
পাতিয়া কাঙালী উর্দ্ধদৃষ্টে স্তব্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল। “ - দরিদ্র, নিঃসহায় এই বালকের
অনাথত্বে পদার্পণের ছবিটুকু আমি দেখেছি আমার পিতামহতুল্য 'বাবু'র মৃত্যুর পূর্বাহ্নে
, এক সন্ধ্যায় আমার চল্লিশোত্তীর্ণ বাবার অঝোর ক্রন্দনে, দেখেছি চল্লিশের কাছাকাছি
দাঁড়ানো আমার পত্নীর পিতৃবিয়োগের কালে। মনে হয়েছে, মনে হয় , এক নক্ষত্ররচিত মাঠের মধ্যে,
পৃথিবীর প্রতিটি ধূলিকণার থেকে বহুবিশ্বের বহু ধূলিকণার মধ্যে এরা যেন এই মুহুর্তে
একা। একলার মতো একা। যেন সেই 'অভাগী'র বালক-ছেলে 'কাঙ্গালী'...
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন 'সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালবাসিলাম' । সত্য কঠিন। তবে সত্য কে কি ভালবাসা যায়? বহু মৃত্যুর রেখায় অঙ্কিত
রবীন্দ্রজীবনে 'কঠিন' 'সত্য'কে ভালবাসবার স্পর্ধা আমরা লক্ষ্য করি। ঠিক। কিন্তু নিজেদের
দিকে তাকালে দেখতে পাই যেন ঐ 'কাঙ্গালী' নামের বালককেই। তথাপি মনেপড়ে যায় সেই 'শুনঃশেপ'কে
যাকে তার মাতাপিতা বিক্রি করে দিয়েছিলো রাজপুত্র রোহনের কাছে - শতটি গোধনের বিনিময়ে
- বরুনদেবের কাছে বলী দেওয়ার নিমিত্ত। অতঃপর আরো শতটি গোধনের বিনিময়ে শুনঃশেপ'র পিতা
অজীগর্ত রাজি হল পুত্রকে যূপকাষ্ঠে বন্ধনের এবং আরো শতটি গোধনের বিনিময়ে উদ্যত হলো
বলী দিতেও। তাহলে 'শুনঃশেপ' অনাথ হলো ঠিক কোন মুহুর্তে? যখন মাতাপিতা তাকে বিক্রয় করলো
সেই মুহুর্তে নাকি যখন নিজ পিতা আরো গোধনের লোভে সম্মত হলো তাকে স্বহস্তে বলী দিতে?
না'কি সে আদপে জন্মেইছিল অনাথ হয়ে আর তার এই জন্মমাত্র অনাথত্ব প্রতীকার্থে প্রতিষ্ঠিত
হল ঋগ্বেদের এই যজ্ঞ উপাখ্যানে?
উপাখ্যানে
শুনঃশেপ'কে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করল মুনি বিশ্বামিত্র আর সঙ্গত কারনেই শুনঃশেপ
বিশ্বামিত্রকে বরণ করলো পিতৃত্বে। অর্থাৎ শুনঃশেপ'র জন্ম, প্রকৃত প্রস্তাবে, ঘটলো বিশ্বামিত্রের
দ্বারাই। - এই কাহিনীর অন্দরে যে সত্যকে আমি দেখতে পাই, তা এই, যে, বিশ্বামিত্র যেন
শুনঃশেপ'র এক নাড়ির বাঁধন কেটে তার নাড়ির যোগ ঘটিয়ে দিলো অনেক, অনেক, অনেকের সঙ্গে।
আর তা'ই যদি হয়, তাহলে, বিশ্বামিত্রের মৃত্যু'তে শুনঃশেপ 'অনাথ' হবেনা কদাপি কেননা
বিশ্বামিত্রকে মাধ্যম করে শুনঃশেপ তখন পার হয়ে গিয়েছে মানুষের নির্মীত-সম্পর্কের শৃঙ্খল।
শুনঃশেপ'র পিতা অজীগর্ত'র
ছিল তিনটি পুত্র। শুনঃশেপ মধ্যম। জ্যেষ্ঠজন পিতার প্রিয় তাই তাকে বিক্রি করতে দিলোনা
পিতা। কনিষ্ঠটি মাতার প্রিয়। অতএব মধ্যম শুনঃশেপকেই বিক্রি হয়েযেতে হলো। এই 'বিক্রি'
কে, এক অর্থে, 'সংসার' নামক প্রক্রিয়ার সাবেক ছকের থেকে বার হয়ে পড়া বলে ভেবে নিলে
কি খুব ভুল হবে? যদি বলি - এইভাবে, এই সাবেক সংসার প্রক্রিয়ার থেকে ছিটকে গিয়েছিল বলেই
শুনঃশেপ'র নাড়ির যোগ ঘটে গিয়েছিল নক্ষত্র-রচিত
সেই মাঠের সঙ্গে যেখানে নক্ষত্রের আড়ালে নক্ষত্র। নক্ষত্রের আবডালে গ্রহ, উপগ্রহ, উল্কা,
ধূমকেতু, বিগ্ব্যাং, ব্লেক-হোল, একবিশ্ব, মহাবিশ্ব, বহুবিশ্ব … তাহলে কি বেদ-বিদগ্ধ'র
দল আমাকে ভষ্মীভূত করে দেবেন কোপানলে? - জানিনা। জানলাম যা, তা এই, যে, আদতে আমরা প্রত্যেকেই
'শুনঃশেপ' তথাপি 'কঠিনেরে ভালবাসিলাম' এ উত্তীর্ণ হতে পারিনি বলে, পারিনা বলে আমরা
'অভাগীর ছেলে' সেই 'কাঙ্গালী' হয়েই রয়েযাই। - এই 'রয়ে যাওয়া' কি নয় আদতে এক রকমের পরাজয়ও?
পরাজয় এই মহাবিশ্বের কাছে, তার অব্যক্ত মহানিয়মের কাছে? ফিরে যাই ঋগ্বেদস্থ ঐতরেয়
ব্রাহ্মণের রোহিত-শুনঃশেপ কাহিনীতেই।
পিতা তাকে বরুনদেবের
কাছে বলীদানে শর্তবদ্ধ – এই সংবাদ পাওয়ামাত্র রাজপুত্র রোহিত গেলো অরণ্যে পালিয়ে। পালাতে
পালাতে পালাতে পালাতে … যেন গোদারের 'ব্রেথলেস্' এর সেই প্রোটাগোনিস্ট … এক সময় অন্তর্গত
শ্রান্তিতে থেমে গেলো সে। তখনই সে পিতার অসুস্থতার সংবাদটিও পেলো। সুতরাং সে স্থির
করলো ঘরেই ফিরেযাবে। আমাদের অভিজ্ঞতা-ব্যবহৃত চিন্তা-নিয়মে রোহিতের এই সিদ্ধান্তকে
সঠিক মনে হতেই পারে। কিন্তু তক্ষুনি তাকে ছদ্মবেশী ইন্দ্র এসে জানালো যে “চরৈবেতি”।
জানালো, যে, একমাত্র পরিভ্রমণকারীর কাছেই মহাবিশ্ব প্রকাশ করে আপনাকে - সহায়'এ, সম্পদে।
পক্ষান্তরে বীরজন বলো, মেধাবীজন বলো, গুনীজন বলো - আলস্যে আপনাকে আটকে রাখলে ক্রমে
পরিণত হয় নির্জীবে। অতএব “হে রোহিত, চরৈবেতি'।
নানা শ্রান্তায় শ্রীরস্তি ইতি রোহিত শুশ্রুম।
পাপো নৃষদবরো জন ইন্দ্র ইচ্চরতঃ সখা চরৈবেতি চরৈবেতি।।
আরো কিছুকাল ঘুরে বেড়ালো রোহিত। আবারো সে
শ্রান্ত বোধ করলো স্বাভাবিক নিয়মেই। বাঁক ঘুরে সে আবার নিতে চাইলো ঘরের পথ। এবারেও
সেই ব্রাহ্মণ, ছদ্মবেশী ইন্দ্র, এসে দাঁড়ালো পথিপার্শ্বে। আবারো বল্লোঃ 'চরৈবেতি'।
বল্লোঃ একমাত্র ভ্রাম্যমানেরই কোনো পাপ হয়না, সে অশুচি হয়না। তার সমস্ত শ্রান্তি ধুয়ে নেয় পথ।
আমার গহনে বেজেওঠেঃ পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে, পথে চলাই সেই তো
তোমায় পাওয়া। যাত্রাপথের আনন্দগান যে গাহে তারি কণ্ঠে তোমারি গান গাওয়া।
পুষ্পিণ্যৌ
চরতে জঙ্ঘে ভুষ্ণুরাত্মা ফলগ্রহিঃ ।
শেরেহস্য
সর্বে পাপ্মানঃ শ্রমেণ প্রপথে ততশ্চরৈবেতি চরৈবেতি।।
তারপর আরো তিনবার, রোহিতের গৃহাভিমুখ-যাত্রা'র পক্ষান্তরে আমরা শুনি
সেই একই উপদেশঃ 'ভ্রমো! ভ্রমণ কর! চরৈবেতি'
আস্তে
ভগ আসীনস্যোর্ধবস্তিষ্ঠতি তিষ্ঠতঃ।
শেতে
নিপদ্য মানস্য চরাতি চরতো ভগশ্চরৈবেতি, চরৈবেতি।।
… হে রোহিত যাওয়াহীন যে মানুষ
তার জন্য সমস্ত কালই কলিকাল...
কলিঃ
শয়ানো ভবতি সংজিহানস্তু দ্বাপরঃ ।
উত্তিষ্ঠংস্ত্রেতা
ভবতি কৃতং সংপদ্যতে চরংশ্চরৈবেতি চরৈবেতি।
চরন্
বৈ মধু বিন্দতে চরন্ স্বাদুমুদুম্বরম্ ।
সূর্য্যস্ব
পশ্য শ্রেমাণং যো ন চন্রয়তে চরংশ্চরৈবেতি চরৈবেতি।।
যে সতত ভ্রাম্যমান সে'ই শুধু লাভ করতে সক্ষম হয় মধু। অতএব …
এই ভ্রমণ আদতে এক প্রতীক। এই ভ্রমণ মনোজ ভ্রমণ।
এই ভ্রমণ মর্মের অন্তর্গত দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াটিকে সতত সজাগ, সবাক রাখবার মনোগত-গৃহযুদ্ধ।
এই ভ্রমণের তলে তলেই একজন 'কাঙ্গালী' হয়ে ওঠে, উঠতে পারে 'শুনঃশেপ'। এই ভ্রমণের আবডালে
আপনিই ক্ষয় হতে থাকে সমস্ত বন্ধন – যা বাহিরের, যা নির্মীত, যা বেনিয়ম, যা বিশ্বনিয়মের
বিপরীত … যেন শুনতে পাইঃ বিপদ বাধা কিছুই ডরে না সে, রয় না পড়ে কোনো লাভের আশে, যাবার লাগি মন তারি উদাসে--যাওয়া
সে যে তোমার পানে যাওয়া …' মনেহয় যেন এই ভাবেই,
দ্বিধায়, দ্বন্দ্বে, বিস্ময়ে এগিয়ে যেতে যেতেই আমাদের সমস্ত বাধাবিঘ্নগুলি ক্ষয়ে যাবে,
আমরা উত্তীর্ণ হব মানবতার সেই স্তরে যেখানে “বন্ধন ছাড়া হারাবার আর থাকেনা কিছুই
...” …
এই হয়তোবা সত্য। হয়তো
আমরা জন্মমাত্র অনাথ। আমরা জন্মমাত্রই শরিক নক্ষত্র-রচিত সেই মাঠের সঙ্গে যেখানে নক্ষত্রের
আড়ালে নক্ষত্র। নক্ষত্রের আবডালে গ্রহ, উপগ্রহ, উল্কা, ধূমকেতু, বিগ্ব্যাং, ব্লেক-হোল,
একবিশ্ব, মহাবিশ্ব, বহুবিশ্ব … সুতরাং কোনো মৃত্যুতেই, কারোর মৃত্যুতেই কেউ হয়না অনাথ...
তবু এই কঠিনকে ভালবাসতে পারিনা, পারিনি এখনো, এখনো 'পোড়া খড়ের আটি হইতে যে স্বল্প
ধূঁয়াটুকু ঘুরিয়া ঘুরিয়া আকাশে উঠিতেছিল তাহারই প্রতি পলকহীন চক্ষু পাতিয়া ...উর্দ্ধদৃষ্টে
স্তব্ধ হইয়া চাহিয়া' থাকি আমরা …
শৃংখলকে দেখতে পাইনা, টের
পাইনা শৃঙ্খল বলে। তাই এ'ও টের পাইনা যে প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের শৃঙ্খল ছাড়া আর কিছুই
নেই হারাবার...
১৮ জুন ২০২০, বেঙ্গালোর