প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Monday, January 24, 2022

যাত্রী

 যাত্রী

সপ্তর্ষি বিশ্বাস

 


শোনা গেলো, অন্ধকার ভেদ করেঃ"হেই ম্যান্‌,তুমি নিশ্চয় এয়ারপোর্টে যাচ্ছো"।

যেন দেবদূতের কন্ঠ।

প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম উপকূল। হাহা অন্ধকারে ডুবে থাকা হাইওয়ে।  রাত্রি। সামুদ্রিক ঝড়, সামান্য হলেও,ও বয়ে গিয়েছে সামান্য আগেই।

"হ্যাঁ মহাশয়। এই ভদ্রলোককে নিয়ে আমি যাচ্ছিলাম বিমান বন্দরেই। কিন্তু গাড়িটা এমন ভাবে বিগড়ে গেলো..." চালকবাবুটি অসংখ্য 'সরি'সহ বিশদ হলেন।

প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম উপকূলের এই শহরে বিমান বন্দর নেই। ঠাঁই পাওয়া যায়নি নিকটবর্তী নগরের মস্ত ব্যস্ত বিমান বন্দর থেকে উড়ান দেওয়া কোনো বিমানেও। অথচ দেশে ফেরা, এই মুহুর্তেই, চরম জরুরী। অতএব পাশ-শহরের ছোটো বিমান বন্দর থেকে উড়ান দেওয়া ভিন্ন গতি ছিলনা।

"নো প্রব্‌, ব্রো, হপ্‌ ইন্‌। ... লাগেজ?"

 হঠাৎ যাওয়া। আবার ফিরতে হবে। অতএব কাঁধব্যাগ ভিন্ন কিছু ছিলনা। উঠে পড়লাম গ্রীন্‌কার্ডধারী এশিয়ানের গাড়িতে।

-"এই রোডে এমনটা হয়, আমি আগেও দেখেছি"

-"ধন্যবাদ। অশেষ ধন্যবাদ। আমাকে প্লেনটা ধরিয়ে দিন শুধু। আপনি যা চার্জ চাইবেন ..."

-"হেই ম্যান! চার্জ আবার কি? আমি ওই শহরেই থাকি। দেখলাম আপনি অসুবিধায় ..." 

-"ধন্যবাদ। অশেষ ধন্যবাদ। কিন্তু ..."

-"নো বোদার্স ব্রো। আমি জানি গাড়ি বিগড়ানোয় আপনার অলরেডি লেট্‌ হয়েগেছে"

গাড়ির স্পীড্‌ বেড়ে গেলো। দুইপাশের ধুধু অন্ধকার মাঠ আর জলাশয় পার হয়ে যেতে যেতে  বেড়েগেলো আওয়াজ।কার্‌-স্টিরিও'র। স্বপ্নবৎ গীটার মূর্ছনার চালচিত্রে শোনাগেলো পরিচিত পংক্তিগুলিঃ 'There she stood in the doorway; I heard the mission bell, And I was thinking to myself -'This could be heaven or this could be Hell'... ধুধু অন্ধকারের মশারি ছিঁড়ে যেন উড়ান দিলো মোটরগাড়ি। গাড়ির গতি মাপক আর আমার ঘড়ির কাঁটার মধ্যে আমার দৃষ্টি পেন্ডুলাম। চালকজনের মুখ স্পীড-মিটারের আবছা দ্যুতিতে রেখায় আঁকা প্রোফাইল। সুঠাম, স্থির। যেন মহাকাল। দেখে কেমন ভরসা আসে। মনেহয় পৌঁছানো সম্ভব হবে এ যাত্রা।

#

''There she stood in the doorway ' ...

ঠিক গানটির কথার মতোই দাঁড়িয়েছিল সে। সে - একজন বিমান সেবিকা। বিমানের দরজায়।"আসুন মহাশয়। আপনার জন্যই আমরা অপেক্ষা করছিলাম। আর মিনিট দশ দেরী হলেই 'নো-শো' ঘোষনা করে বিমান উড়ান দিতো আপনাকে ছাড়াই'।

পার্বত্য চেহারার এই বিমান সেবিকাই পৌঁছে দিল সীটে। এই যাত্রার প্রতিটি ঘটনাই যেন সাপলুডো। এই সাপ। এই সিঁড়ি।গাড়ির বিগড়ে যাওয়া - সাপ। শাপ। লিফ্‌ট-দেওয়া অচেনা বন্ধু - সিঁড়ি।

সে'ই বল্লো এখন নিয়মমাফিক প্রক্রিয়ার ঢুকতে যাওয়ার অনেক ঝক্কি। প্রতি পদে দেরীর সম্ভাবনা। এই সব মফস্বলি বিমান বন্দরে সোজা রানওয়েতে ঢুকেপড়ে বিমানে উঠেপড়া যায়। বিশেষত রাত্রে। সুতরাং পাকা সড়ক ছেড়ে মাঠের অন্ধকার বেয়ে, গেরিলাহেন প্রক্রিয়ার পৌঁছে যাওয়া সঠিক বমানটির নিকটে - সে'ও এক সিঁড়ি বৈকি।

-"এই নাও তোমার শরবৎ আর এই জলের বোতল"। আহ্‌, আবার সিঁড়ি। গলা সত্যই শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। আধো অন্ধকারে ঘুমন্ত সহযাত্রীদের দিকে দেখতে দেখতে এক চুমুকে শরবৎ-গেলাস আর এক ঢোঁকে জল-বোতল নিঃশেষ করতে করতেই টের পাওয়া গেলো বিমান পাখা মেলছে। টের পাওয়া গেলো ঘুম, শান্তির, বিশ্রামের নেমে আসছে।

#

আবছা সবুজ অন্ধকারে জেগে উঠে দেখাগেলো সহযাত্রীরা, পূর্ববৎ, ঘুমন্ত। উঠে জলবিয়োগ করে টের পেলাম আবার তৃষ্ণা।

কোথায় সেই বিমান সেবিকা পার্বত্য চেহারার? অথবা অন্য কোনো বিমান সেবিকা? এমন অনেক সময়ই হয়, যে, যাত্রীরা ঘুমিয়ে পড়লে বা ডাকাডাকি না করলে বিমান সেবিকারা গিয়ে আড্ডা জুড়েদেয় পাইলট-খোপের কাছে তাদের নিজস্ব খুপচিতে। সম্ভবতঃ এখনও ঘটেছে তা'ই। অতএব ধীর পায়ে হাঁটতে লাগলাম দুই সাড়  যাত্রীচেয়ারের মাঝপথ ধরে।

কেজানে বিমানে ওঠার থেকে এখন অব্দি কতোটা সময় গিয়েছে কেটে ঘুমের ভিতরে। - বুঝেনিতে গিয়ে দেখাগেলো হাতঘড়ি থেমেগেছে। হাসি পেলো। ভাবলাম এইবার কি? সাপ না সিঁড়ি?

বিমান সেবিকার খুপচি খালি।

আরেকটু সামনে উঁকি দিতে দেখলাম চালকখোপের ছোট্ট লৌহকপাট খোলা। আশ্চর্য !পাইলট-খোপের দরজা ...

তখুনি দেখাগেলো সামনের কাঁচে ভিড় করে আছে তারা আর নক্ষত্রেরা। দেখেই লোভ হলো, সেই আবাল্যের লোভ, পাইলটকোঠার ভিতর থেকে আকাশ দেখবার -

"এই যে, মহাশয়, কিছু চাই আপনার?" সেই কন্ঠ। সেই বিমান সেবিকা পার্বত্য চেহারার। পাইলটখোপে ঢোকা হলোনা।

বল্লামঃ "আমার কিছু পানীয় চাই। জল চাই ..."

এক মুহুর্ত আমার চোখে সুস্থিরে চোখ রেখে সে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতেই বল্লোঃ "না জল, না পানীয়, না খাদ্য, কিচ্ছু নেই। সব ফুরিয়ে গেছে" ।

একবার মনেহলো রসিকতা। হয়তো অন্দরে 'সাজেস্টিভ'।

আমি বল্লামঃ "তুমিতো আছো। পারবেনা আমার তৃষ্ণা মেটাতে?"

-"কে বল্লো আমি আছি? এই বিমানে শুধু তুমি আছো। তুমি। একলা তুমি। বিশ্বাস হচ্ছেনা? ওই দেখো পাইলটখোপ। কি দেখছো?"

আমি উঁকি দিতে গেলাম পাইলট-খোপে আর কে যেন আমাকে ঠেলে দিলো তার ভিতরেই।

দুটি শূন্য পাইলট-চেয়ার আর সামনের কাঁচে ভিড় করে আছে নক্ষত্রেরা।

"এসো, দেখবে এসো" - ছুঁয়ে কিংবা না ছুঁয়ে সে আমাকে নিয়ে দাঁড় করিয়ে যাত্রী কক্ষের দোরগোড়ায়।

দেখলাম, আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, সবুজ অন্ধকারে সার সার শূন্য চেয়ার। শুনলাম সমস্ত আবহ জুড়ে সেই হাহা হাসি, হো হো হাসি। সহসা স্বপ্নবৎ গীটার মূর্ছনার চালচিত্রে শোনাগেলো পরিচিত পংক্তিগুলিঃ 'There she stood in the doorway;

I heard the mission bell, And I was thinking to myself -

'This could be heaven or this could be Hell'

দেখলাম নেই বিমানসেবিকারাও। তবে ক্ষীণ, খন্ড খন্ড হাসি, হয়তোবা তাদেরই, লেগে আছে আবহে। তখনো।

তারপর?

তারপর চালকহীন, যাত্রীহীন, খাদ্য-পানীয়হীন,গন্তব্যহীন এই অন্ধকারের বিমানে আমি উড়ে চল্লাম।

উড়ে চললাম  কেজানে কোন ব্ল্যাক্‌হোল নাকি বিগ-ব্যাঙের দিকে।

 

০৩/০৯/২০২০ -- ২৪/০৪/২০২২

বেংগালোর

ঘুম ঘর