প্রবেশিকা

**************************
আমি অত্র। আমি তত্র।
অন্যত্র অথবা –
আমার আরম্ভে আমি
নিশীথিনী, প্রভাতসম্ভবা।
**************************


[ পাঠক /পাঠিকার নিজস্ব বানানবিধি প্রযোজ্য ]

Wednesday, January 26, 2022

আপ্‌স্টার্ট

                                        আপ্‌স্টার্ট

                                     [ উৎসর্গঃ মা ]



প্রথম প্রকাশঃ 'সাহিত্য', হাইলাকান্দি , ২০২২

এরা কোথায় থাকে কেউ জানেনা। গীর্জাটির আশে পাশেফুটপাথে,রাস্তায় ওরা আসে। ভিড় ভাট্টা দেখলে ঢুকে যায় গীর্জার অন্দরেও। তারপর আবার কোথায় যে যায় নিশ্চিহ্ন হয়ে। রাত বিরেতে ওদেরি কি দেখাযায় ব্যস্ত হয়ে উঠতে ডাস্টবীন থেকে পাঁউরুটির টুকরো খুঁজে নিতেহয়তো এরাই। হয়তো ঠিক এরা নয়। অন্য কেউ। হয়তো। তাও যদি হয় তবে এরাও ওদেরি মতন।অথবা ওরাও এদেরি মতন – চুলযথারীতিরুক্ষলাল। উকুনে ভরা। দৃষ্টি, যথারীতি মোনালিসার চেয়েও ব্যঞ্জনাময়। এদের দেখামাত্রযথারীতিঅন্ততঃ অবিনাশের, যে এখন গীর্জাটির অপর পারে দাঁড়িয়ে ধুমপানে ব্যস্ত,সন্দেহ জাগে ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও ভূমিকা নিয়ে । সংশয় জাগে আপন অস্তিস্বের সত্যতা নিয়েও।

       এদের সব চেয়ে বড়টির বয়স হবে পনেরো। অনাহারের দৌলতে মনেহয় বারো তেরো। সবচেয়ে ছোটোটি হবে পাঁচ। দেখে মনেহয় তিন। সে ঘুরে বেড়ায় দিদিদের কোলে কোলে।তিন দিদিএক বোন।ঐ যে তারা এখন বসে আছে তিনটি প্লাস্টিকের চেয়ার দখল করেঐ গীর্জার জঠরে ।ওই যে ওদের বিস্মিত চোখ গিলে খাচ্ছে মঞ্চে চলতে থাকা নাচগানরত ছোটো ছোটো শিশুদে্র,যে শিশুরা ভিনগ্রহি।

                   গীর্জাটি পেল্লায় হলেও আকৃতি এবং প্রকৃতি নয় অভিজাত। ‘গীর্জা’ শব্দটি যে সম্ভ্রম বহন করে তা এখানে নেই। বরং একে যুদ্ধকালীন হাসপাতালই মনেহয়। খুব বেশী দিনের যে নয় এই গীর্জা তা’ও বুঝে নেওয়া যায় এক ঝলকেই। একটা বড়সড় প্রার্থনা কক্ষ –বাবাযিশুর একটি মূর্ত্তি না থাকলে যাকে ‘প্রার্থনা’ শব্দটির ধারে কাছেও কিছু ভাববার কোনো হেতু নেই । আর তার পাশে একটা ‘কমিউনিটি হল্‌’। তার আকার প্রার্থনা কক্ষ থেকে বেশ খানিকটা বড়। একফালি বাঁধানো উঠান। সামনে। ঐ কমিউনিটি হল্‌ ভাড়া দেওয়া হয় উৎসবে অনুষ্ঠানে। তা’সে কারোর বিয়েই হোক্‌ আর হোক্‌ কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । সম্ভবতঃ গীর্জার আয়ের একটা বড় অংশ আসে ঐ ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা থেকে।

গীর্জার সামনের রাস্তাটা সরু। রাস্তার ওপারে সিগারেট-কেইক-চা-বিস্কুটের একটি দোকান। দোকানের পিছনে উঁচু পাঁচিল ঢাকা মুসলমান কবরখানা। কবরখানা বলেই সেখানে কিছু গাছ সুযোগ পেয়ে গেছে বড় হওয়ার। অহেতুক ডালপালা মেলে অদ্যাবধি টিঁকে থাকবার। এমনি একটি বৃক্ষের ছায়াতে,রাস্তার ঐ পারে দাঁড়িয়ে আছে অবিনাশ। সিগারেট খাচ্ছে। রাস্তার অন্য পারেগীর্জার শরীরে রোদরোদে আসন্ন গ্রীষ্মের হলকা। বহুদিন বৃষ্টি হয়নি বলে গাছের পাতায় ধূলার আস্তরন। রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে একটি দু’টি অটো রিক্সা। কার্‌। ধোঁয়ায়ধুলায় মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে দশদিক । যেন ঐ তিনটি-চেয়ার জুড়ে বসা চারটি অজ্ঞাতকূলশীল শিশুগুলির চুলের মতোই। রাস্তাটির শেষ প্রান্তে কোথাও একটা কিছুর কারখানা রয়েছে যে কারখানার নামে এই রাস্তার নাম। সম্ভবতঃ ঐ কারখানা থেকেই উড়ে আসছে ধোঁয়া। মিশে যাচ্ছে বাতাসে। সব মিলিয়ে ‘হতশ্রী’ শব্দটি এখানে সশরীর।

   এতোক্ষন গীর্জার ভিতরে, ‘কমিউনিটি হল্‌’এ’ই ছিল অবিনাশ। সোনি-হ্যান্ডিক্যামের লেন্সে চোখ লাগিয়ে তুলে নিচ্ছিল চলচ্ছবি এই অনুষ্ঠানের। এখন খোকার হাতে ক্যামেরাটি দিয়ে চলে এসেছে বাইরে। সিগারেট খেতে। বয়স দশ পেরোয়নি খোকার। তবে খোকা হ্যান্ডিক্যাম্‌ চালাতে পারে। পারে দাবা খেলতে। ছবি আঁকতে। পারে গুগুল্‌’এ সার্চ্চ করে হোম্‌টাস্কের প্রয়োজনীয় তথ্যাদি জেনে নিতে। তা’য় আবার এ তার বোনের ইস্কুলের ‘ফাংশান’। অতএব ‘দাদাগিরি’র এমন সুযোগ সে ছাড়ে? মঞ্চে উঠে আসছে একের পরে এক দল শিশু। ব্যাক্‌গ্রাউন্ডে বাজছে নানান ভাষার গান। তামিল-তেলেগু-কন্নড়-হিন্দি-ইংগ্রেজি ঘোষক-ঘোষিকা বলে দিচ্ছেন ‘এটা পোঙ্গলের গান’, ‘এটা উগাদী’র’।  এখানে হাতে হাতে হ্যান্ডিক্যামের বদলে রয়েছে ভিডিও-রেকর্ডিং করার ক্ষমতা সম্পন্ন মোবাইল। তাতেই ধরা পরছে নিজ নিজ সন্ততির কৃতিত্ব। খোকার ইস্কুলে হলে দৃশ্যটা খুব একটা অন্য রকম হতোনা। সেখানে হাতে হাতে ভিডিও-রেকর্ডিং করার ক্ষমতা সম্পন্ন মোবাইল এর বদলে থাকতো নানা ব্র্যান্ডের হ্যান্ডিক্যাম্‌। আর হ্যাঁ, ঐ’তিনটি চেয়ার জুড়ে বসে থাকা চারটি লাল-চুল শিশু ওরা পারতোনা ঢুকতেঅবশ্যই। কেননা খোকাদের ইস্কুল ইন্টারনেশন্যাল্‌ । বিরাট তার প্রাচীর। সেই প্রাচীরের পেটের ভিতরে অডিটোরিয়াম, সুইমিং পুল।ওই প্রাচীরের ভিতরে ঢুকতেপিটিএম্‌ ছাড়া অন্য সময়ে মস্ত মস্ত এসি গাড়িওলা ‘পেরেন্ট্‌স্‌’দেরো ‘পার্‌মিশান’ নিতে হয় । খুকিকেও ওই ইস্কুলে দেওয়া হবে আরেকটু বড় হলে। এখনো ছোটো তাই কাছাকাছি এই ইস্কুলে।

              মনে মনে রঞ্জনা মিত্রের বুদ্ধির তারিফ না করে পারেনা অবিনাশ। বেশ গুছিয়ে তুলেছে সে ব্যাপারখানা । বস্তিবাড়ির লাগোয়া গলীতে ইংরেজি ইস্কুল খুলবার দুঃসাহস সমারসেট্‌ মমের ভার্জারো দেখাতে পারতো কি’না সন্দেহ । তবে রঞ্জনা মিত্রএই মুহুর্তে দর্শকের আসনে যে বসে আছে প্রথম সাড়িতেযার পিঠ কাটা ব্লাউজের কিনারায় উঁকি দিচ্ছে ‘ভিক্টোরিয়াজ সিক্রেট্‌’যার চোখে চশমাহাতে মোবাইলপাশে চার্টার্ড একাউন্টেন্ট বর দেবর্ষি মিত্রতার দূর দৃষ্টিতে ভবিষ্যৎ যে ‘ভিশন্‌’এর মতো ধরা দিয়েছিল অনেক আগেই এ নিয়ে কারো যদি কিছুমাত্র সন্দেহ এখনো থেকে থাকে তাহলেও আগামী পাঁচ বছরে আর থাকবেনা।

     একটা সিগারেট শেষ হলে আরেকটা জ্বালিয়ে নেয় অবিনাশ। কি হবে ভিতরে গিয়েখুকি’র নাচ আপাততঃ শেষ। রঞ্জনা মিত্র বলেছে আরো দুটো নাচ আছে। আরো আধঘন্টা পরে একটা। তার আরো কিছুক্ষন পরে আরেকটা। অতএব এখানে দাঁড়িয়ে আরো একটা সিগারেট টানবার সিদ্ধান্তেই স্থির হয়ে অবিনাশ ভাবে একটু চা হলেও মন্দ হতোনা। দোকানীটিকে ‘চা’য়ে হোগা?’ বলতে বলতে তার চোখ পরে দোকানের পেছনের দিকে রাখা আয়নাতে। শস্তা আয়না। গরমে বেঁকে গিয়ে নিয়েছে অবতল আকৃতি। ফলে ছায়ার আকার হয়ে যায় বস্তুর আকারের চেয়ে ঢের বড়ো। নিজেকেমানে নিজের মুখকেএতো বড়ো করেবাস্তবে দেখেনি অবিনাশ। তাই যেন একটু চমক লাগে তার। দোকানীটি ছোটো প্লাস্টিকের গেলাসে চা দেয় কিন্তু সেদিকে মন যায়না অবিনাশের। সে যেন তন্ময় হয়ে যায় তার ঐ অবতল প্রতিবিম্বে।

      আচ্ছা মুখের বাঁদিকে এই রেখাটা গজালো কখন? না’কি ছিল আগেইগলার ভাঁজটাও যেন বেশ গভীর বলেই মনেহচ্ছে।চোখের চাউনিতেও কি যোগবিয়োগ ঘটেগেছে কিছু? নিজের দিকে তাকিয়ে একটু অস্বস্তিতেই পরেযায় অবিনাশ।  হ্যাঁচশমা আগে ছিলোনা। বছর পাঁচ হলো লেগেছে। গালেতলপেটে মাংসের মচ্ছবটাও এখানে আসার পরেই। কিন্তু ঠিক কবে থেকে সূত্রপাত হলো তারবেঙ্গালোরের পথে পথে চাকরি খুঁজে বেড়ানোর দিন গুলিতে এমন ছিলনা স্বাভাবিক কারনেই। কিন্তু বেঙ্গালোরে আসারও’ত  হয়ে গেলো প্রায় এগারো বছর। আশ্চর্য। এক বছরের খোকা পেরিয়ে গেলো দশ। যে খুকি’র নাম গন্ধও ছিলোনা কোথাও আজ সে’ই খুকি’ই যাচ্ছে ইস্কুলে । যদিও ‘প্লে স্কুল’ তবুও স্কুল’ত বটেই । খুকিকে কতো কি শিখিয়েছে এরা ।‘এ’ ফর্‌ এপ্‌ল্‌, ‘বি ফর্‌ বেট্‌’ । নেচে নেচে, চোখ মুখ ঘুড়িয়ে বলা ‘চাবি চিক্স্‌’, ‘টিংকল্‌ টিংকল্‌ ...’ চোখ বন্ধ করেহাত জোড় করে দেশবন্দনা ‘সারে যাঁহা সে আচ্ছা...’ । অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে হাত ধরে গোল হয়ে ঘরতে ঘুরতে ‘রিঙ্গা রিঙ্গা রোসেস্‌’ বলতে বলতে হঠাৎ ধপ্‌ ক’রে মাটিতে পরে যাওয়া ।আহাখোকার কম্পিউটার প্রতিভা আর খুকির এইসব দেখে তাদের আসামের দেশবাড়ি থেকে সপরিবারে বেঙ্গালোর বেড়াতে আসা সমর পাল আর তার বউ’এর তো চোখই গিয়েছিল টাটিয়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সমর বলেছিল ‘সাউথে এডুকেশনের স্টেন্ডার’ই আলাদা ...’

     চা’য়ের গ্লাস্‌ হাতে নিয়ে আরেকটা সিগারেট জ্বালায় অবিনাশ। সরে আসে ঐ অবতল আয়নার কাছ থেকে। সরে আসে তবু সরেনা ঐ ভাবনা। বেঙ্গালোরে আসার হয়ে গেলো এগারো বছর । আশ্চর্য ।এক বছরের খোকা পেরিয়ে গেলো দশ । যে খুকি’র নাম গন্ধও ছিলোনা কোথাও আজ সে’ই খুকি’ই যাচ্ছে ইস্কুলে ।

যখন এসেছিল তখনো দেশগাঁয়ে জীবিত ছিল যতো চেনা মানুষ এখন তার অর্ধেক মরে হেজে গেছে। এঁদের কয়েকজনের সঙ্গে শেষবার যে কবে দেখা হয়েছিল তা’ও আজ মনে পড়েনা । তখন যেসব ছেলেরা পার্কে জটলা করে আড্ডা দিতোহাত পাকাতো সিগারেট বা গাঁজা টানায় আজ তারা কেউ কেউ পাড়ার মাস্তানকয়েকজন মাষ্টারি পেয়েছে আশে পাশের গ্রামের ইস্কুলে আর বাদ বাকীরা আদের কিছু হয়নি তারা বলে বেড়ায় ‘কন্ট্রাকটারি করছি’ এমনি একজনসুজিত, অবিনাশের পরিচিত গিয়েছে পাগল হয়ে । কালোলম্বা মতন শঙ্করযার কোঁকড়ানো চুলের জন্য সবাই তাকে ডাকতো ‘জ্যাক্‌শন’ বলেসে ঝুলে পরেছে গলায় দড়ি দিয়ে । মা’বাবার মুখের রেখার জ্যামিতি হয়েছে জটিলতর। হাতে গোনা যে দু চারজন বন্ধু আছে তাদের সঙ্গেও কি গড়ে ওঠেনি কোনো দূরত্ব? বেঙ্গালোরে প্রথম প্রথম এসে যে সব জমি ওরা এসেও দেখেছিল সবুজ সেখানে এখন শপিং মল্‌ফ্ল্যাটবাড়িবহুতল মাল্টিনেশনেল।




                                             মনেপড়ে বেঙ্গালোরে আসার প্রথম দিনগুলিমাসগুলি। আকাশ ছোঁয়া ঐ বহুতল মাল্টিনেশনেল বাড়ি গুলির দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে মাল্যশ্রী’র চোখের কাতরতার মর্মে মিশে থাকা প্রার্থনা – চাকরীর, সুস্থিতির। স্বাভাবিক নিয়মেই মাল্যশ্রী চেয়েছিল ভাত-কাপড় আর ছাদের সুস্থিতি। তা’ই চায়নি’কি অবিনাশও, অন্ততঃ তখনযদি না চাইতো তাহলে ভিটেবাড়িঘরদোর ছেড়ে কেনই বা সে পাড়ি জমিয়েছিল এই শহরে যে শহর মূলতঃ ভূইফোঁড়যে শহরের সঙ্গে তার আত্মার কোনো পরিচয় নেইস্মৃতি নেই। তবু সে চলে এসেছিল। চলে এসেছিল এই শহরেই। নৌকা পুড়িয়ে দিয়েই এসে উঠেছিল মাল্যশ্রীর দাদা’র ফ্ল্যাটে, যে দাদা অনেক ট্রেনিং আর দুইবারের চেষ্টায় এমবিএ, যে দাদা এবং তার মাতা সদা সর্বদা জানান দিতো, নির্বাকে, যে ওরা ‘আশ্রিত’। ...

         হঠাৎই তার মনে হলোঐ’যে রুক্ষ চুলের না খেতে পাওয়া শিশুগুলি ওরা কোন্‌খান্‌ থেকে এসেছে এই শহরেএই ভূইফোঁড় শহরের সঙ্গে কি তাদের সংশ্রব?

   “পাপাতাড়াতাড়ি আয়্‌।পুগির নাচ আরম্ভ হয়ে যাচ্ছে...” খোকার উত্তেজিত ডাক ভেসে আসে গীর্জার ফটকের মতো খোলা মুখটার থেকে। খুব সুন্দর হয়েছে খোকা। ঠিক যেন ছোটো বেলার অপু । সিনেমার। ডাগর চোখে অপার বিস্ময়। খুকির চোখে দুষ্টুমি। শুধুই দুষ্টুমি।

                        রাস্তা পার হয়ে এসে ছেলের কাঁধে হাত রাখে অবিনাশ। হেঁটে হেঁটে চলেযায় ‘কমিউনিটি হল্‌’ এর ভিতরে । স্টেইজে মাইক হাতে রঞ্জনা মিত্র ঘোষনা করছেন এখন হবে ‘হোলি’নাচ। বেক্‌ড্রপে ভিড় মিকিমাউস্‌সিন্‌চেন ইত্যাদি কমিক চরিত্রদের। জোরালো আলো ফেলে ভিডিও তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক ভাড়া করা ছোকরা। ঠিক খোকাদের ‘ইন্টারনেশনেল’ ইস্কুলের মতোই। ‘নারঞ্জনা মিত্র’র হবে। বেশ দ্রুত উঠে যাচ্ছে সিঁড়ি ভেঙ্গে’। তখুনি স্টেইজের এক পাশে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের মধ্যে খুকি’কে ঠিক চিনেনিয়ে খোকার হাত থেকে হেন্ডিক্যামটা নেয় অবিনাশ। খোকা মৃদু আপত্তি তুল্লেও দিয়ে দেয় ক্যামেরাটা। আই পীসে চোখ রাখে অবিনাশ। মাইকে বেজেওঠে কি একটা গান।ক্যামেরায় উঠে আসে একটি একটি করে মুখ সঙ্গে সিনেমার মতন করে যেন চোখে ভেসে ওঠে পরিচয় লিপি।

                         মনীষাঃ বাবার কাটা কাপড়ের দোকান। তবে সবচেয়ে লেটেস্ট মডেলের মোবাইল ব্যবহার করে সে। কানে লাগানো থাকে ব্লু টুথ্‌। ফাংশনে এসেছে টাই পরে।

সাসনিঃ বাবার রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা। অর্থাৎ বাড়ি ভাড়া নিতে হলে তার কাছে যাও। সে বাড়ি খুঁজে দেবে। তুমি ওকে পয়সা দেবে বাড়ি খুঁজে দেওয়ার জন্যবাড়ির মালিক দেবে ভাড়াটে খুঁজে দেওয়ার জন্য। তার গাড়ি টাড়ি সবই আছে। কিন্তু ইংরেজি বলতে পারেনা বলে অনেকেই তাকে হাতে নেয়না। এমন কি মেয়েকে কোন্‌ এক ইস্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে যাওয়ার পর তার ইংরেজির বহর দেখে মেয়ের এড্‌মিশান বাতিল হয়ে যায়।

নরহরিঃ বাবা’যে ঠিক করেন তা কারোরি জানা নেই। তিনি পটি করতে গেলেও শার্পের ল্যাপ্‌টপ্‌ সঙ্গে নিয়ে যান। বাড়িতে পার্টি হয় প্রায় রোজই। অনেক রাত পর্যন্ত। থুতনীতে ফ্রেঞ্চ্‌কাট্‌ আছে। নরহরি সমস্ত পার্টীর মধ্যভাগে দুলে দুলে শোনায়ঃ টিংকল্‌ টিংকল্‌’ ।বাবা সবাইকে বলেদেন ‘ও কানাড়া জানেইনা ।অল্‌ ডে ইংলিশ্‌’।

পুগিঃ পুগির মা রঞ্জনা মিত্র’র বান্ধবী স্থানীয়। কাছাকাছি যে বাঙ্গালী এসোসিয়েশনটি দুর্গাপুজা করে সেখানে গিয়ে পরিচয়। ‘যদিও এদের সঙ্গে আমাদের একটা স্ট্যান্ডার্ডের গ্যাপ্‌ আছেস্টীল্‌ ইউ ক্যান্‌ গীভ্‌ আ ট্রাই।আফ্‌টার্‌ অল্‌ আমি’ত আছি’ ।

মাঝখানে কি করে ঢুকে পরে ঐ চারটি মুখ? যাদের রুক্ষ লাল চুল, চোখের কোনে পিচুটি। যারা তিনজনে জড়সড় হয়ে বসে আছে দুইটি চেয়ারে? যতোই ফোকাস বদলায় অবিনাশ তবু ওই মুখগুলি – ভিতু ভিতু চোখে তাকাচ্ছে চারপাশে। সবচেয়ে ছোটোটি বসে আছে মাঝারিটির কোলে। হাতে হলুদ একটা বল। কেউ সামনে দিয়ে চলে গেলেই ভাবছে এই’না বলে ‘যাওবেড়িয়ে যাও। তোমরা এখানে কি করতে এসেছোশিক্ষা-দীক্ষার কি বোঝো তোমরাকি বোঝো নেশনেল ইন্টিগ্রাশনের ...”

নিজের অজান্তেই জুম্‌ করতে থাকে ঐ মুখগুলি, চোখগুলি।

জুম্‌ করতে করতে করতে করতে যেন ছুঁয়ে দিতে চায় তাদের অস্তিত্বকেই ।কিন্তু টেক্‌নোলজির নিয়মে তা হয়না। এক সময় আবছা হয়ে যায় মুখগুলি। পরিবর্তে ভেসে ওঠে অন্য নামঅন্য মুখঅন্য আবহঅন্য পরিচয়লিপিঃ

‘ জিউস্‌ ইন্টারনেশন্যাল স্কুল’

‘প্রতিটি বড় শহরে শাখা আছে’

‘আমাদের ইস্কুলের অমুক-তমুক এবং অমুক ঐ বৎসর আমেরিকা গিয়েছিল’

‘আমাদের তমুক ছাত্রের সঙ্গে ওবামা’র ফটো ...’

‘আমাদের প্রতিষ্ঠাতা তমুক ইন্দিরা গান্ধী’কে মালা দিচ্ছেন...’

‘এখন আমরা হাজির বাঙ্গালোরেও।তবে এক লক্ষ টাকা ডোনেশান না দিতে পারলে আর মাসে মাসে কুড়ি হাজার ফী না জোগাতে পারলে এখানে এসোনা যেন..’

‘ঐ দেখো আমাদের কৃতী ছাত্ররা।ঐ দেখো তারা নাচছে ......

ঐ দেখো অর্‌বিন্দএসেছে কেরালা থেকে। তার বাবা ইলেক্‌ট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার। ওরা এখন আর কেরালা যায়না কেননা কেরালা’র যে গ্রামে ওদের বাড়ি ওখানেই কেউ ইংরেজি বলতে পারেনা। ট্রাই টু আন্ডারস্টেন্ড্‌ দ্য জেনুইন্‌ এফোর্ট্‌ হি ইজ্‌ পুটিং টু গীভ্‌ হিস্‌ চাইল্ড্‌ এ গুড্‌ এডুকেশান এন্ড্‌ এট্‌মোস্ফিয়ার।ঐ দেখো পিটার। তার বাবা একজন সফট্‌ওয়ার প্রোফেশন্যাল। ওরা কৃশ্চান। ওরা প্রতি সপ্তাহে চার্চ্চে যায়। ওদের ঠাকুমা-ঠাকুর্দ্দা থাকেন এই বেঙ্গালোরেই। একটা ওল্ড্‌ হোমে। মাসে বারো হাজার টাকা দিতে হয় ঐ হোমে। ঐ জন্য তাদের প্যানেল টিভি কেনা তিন মাস পিছিয়ে গেছে। -- আই এম্‌ শীওর ইউ কেন ভেলু দেয়ার সেক্রিফাইস্‌...এই যে ছট্‌ফটে মেয়েটি এর নাম দীপিকা। ওর মা একজন এনজিও’কর্মী। ওর মা’র সঙ্গে ওর বাবার ডিভোর্স হয়ে গেছে।ওর নতুন বাবা’কে ও বলে আংকল্‌। ইয়েস্‌দিস্‌ ইজ্‌ কল্‌ড্‌ মেনার্স্‌ ...ঐ’যে সুদীপসুডীপ চাট্টোপাড্যায়ওরা বেঙ্গলী। ওর বাবাও একজন আইটি প্রো। ওর মা খুব ভালো টেগোর-সং গাইতে পারেন। সান্‌ফ্রান্‌সিস্‌কো’তে তাঁর গান শুনেনাচ দেখে ‘অরাক্‌ল্‌’ কোম্পানীর চেয়ারম্যান খুবই প্রশংসা করেছিলেন। ওর ঠাকুর্দ্দা নেই। ঠাকুমা থাকেন কলকাতায়। একটা নামী ওল্ড হোমে। সুডীপের বাবা তাঁর প্রবল ব্যস্ততা সত্ত্বেও দু বছরে একবার যান মা’কে দেখে আসতে...মিস্টার চাট্টোপাড্যায়’ সোয়ামি অরবিন্দের একজন ফলোয়ার ।ওহ্‌হোয়াট্‌ এ কাল্‌চারেল হেরিটেইজ্‌ দে হেভ...ঐ’যে ছেলেটিওর নাম ভিনায়ক। ওর বাবা আইটি প্রো নন। কিন্তু তিনি চান ছেলে আইটি প্রো হোক্‌ তাই ছেলেকে তিনি আমাদের জিম্মায় দিয়েছেন সর্বতোমুখী তালিমের জন্য। ইয়েস্‌ দিস্‌ ইজ্‌ কল্‌ড্‌ ভিশন।ঐ যে ছেলেটিসে’ও বঙ্গ্‌। নাম অবলীল চাক্‌রাভারটি। ওর বাবার নাম আনিমেষ চাক্‌রাভারটি। উনি আইটি প্রো এন্ড্‌ এ পোয়েট এস্‌ ওয়েল্‌। ওনার ওয়াইফ্‌ মিসেস্‌ মাল্যশ্রী আমাদের স্কুলেরি একজন টীচার। বাট্‌ যেহেতু তাঁরা চাননা যে তাদের অনুপস্থিতিতে বাচ্চা ডে-কেয়ার ইত্যাদিতে থাকুক তাই মিসেস্‌ চাক্‌রাভারটি’র পেরেন্ট্‌স্‌দেরকে তাঁরা এখানে এনে রেখেছেন তাঁদের ছোটো বাচ্চাটিকে দেখে রাখবার জন্য। ইন্‌ দ্যাট্‌ ওয়ে ওঁরাও ঐ অল্ড্‌ ফেলোস্‌’দের কেয়ার নিতে পারছেন।ইজ্‌ন্‌ট্‌ ইট্‌ এ ভেরী গুড্‌ এক্সাম্‌প্‌ল্‌? ।মিস্টার চাক্‌রাভারটি ইজ্‌ ভেরী লিবারেল্‌। মা’বাবার কষ্ট হবে বলে ওদেরকে উনি আসামেই রেখেছেন। মাঝে মাঝে ওঁদের এখানে আনিয়ে তিনি ট্রিট্‌মেন্ট্‌ করিয়ে আবার ফেরৎ পাঠিয়ে দেন। তবেবাই দ্য ওয়েমিস্টার চাক্‌রাভারটি’র মাথায় একটু ছিট আছে বলেই মনেহয় আমাদের কেননা উনি বলেন যে বাচ্চাদের না’কি ভার্‌নিকুলার মিডিয়ামেই পড়াশোনা করা উচিত। আমাদের ইস্কুলের সাইকোলজিস্ট বলেছেন যে এরকম জিনিস তারাই ভেবে থাকে যারা আসলে হাম্ব্‌ল্‌ অরিজিনের। যেহেতু এরা নিজেরা ব্রেন্ডেড্‌ স্কুল-কলেজে পড়েনি তাই বাচ্চাদের ব্রেন্ডেড এডুকেশান দিতে ওদের ভেতরে একটা ইন্‌ফিরিওরিটি কম্‌প্লেক্স্‌ কাজকরে ।মে বী মিস্টার চাক্‌রাভারটি ইস্‌ আইটি প্রো বাট্‌ হি ইস্‌ ফ্রম্‌ সাম্‌ অব্‌স্‌কীওর ভিলেইজ্‌ অফ্‌ আসাম ।আচ্ছা বাদ দিন ।এই যে মেয়েটি দেখছেন ...

বেশ তো চলছিল মুখের মিছিল আর পরিচিতি পর্ব্ব। হঠাৎআবার বাদ সাধলো ঐ রুক্ষলাল চুল ওয়ালা বাচ্চাগুলি। ওদেরোতো ইন্‌ট্রোডাক্‌শান দরকার। কিন্তু কি হবে ওদের  ইন্‌ট্রোডাক্‌শানশুধু অবিনাশ নয়, সমস্যায় পরে যায় মিসেস্‌ রঞ্জনা মিত্রসেই রঞ্জনা মিত্র যে জানে ঠিক কি কি দাওয়াই দিলে বস্তির লোক ঝেঁটিয়ে আসবে তার স্কুলে কাচ্চা বাচ্চা ভর্তি করতেযে মাল্যশ্রী’কে খুকি’কে আপাততঃ তার ইস্কুলে দিয়ে দেওয়ার ফ্রেন্ড্‌লী আইডিয়াটা দিয়েছে।

‘একেতো তোমাদের বাড়ির কাছেই প্লাস্‌ আমি ত’ আছিই। এন্ড্‌ দিস্‌ ইস্‌ নাথিং বাট্‌ এক্‌লেমেটাইজ্‌ হার উইথ্‌ দ্য কন্‌সেপ্ট্‌ অফ্‌ স্কুল। কি বলো মালাএম্‌ আই রাইট্‌?” সেই রঞ্জনা মিত্র’ও পারছেনা ক্যামেরায় ভেসে ওঠা ঐ মুখ গুলিরঐ অনাদরে বেড়ে ওঠা রুক্ষ চুলগুলিরঐ অদ্ভুত চাউনি ভরা চোখ গুলির কোনো ইন্‌ট্রোডাক্‌শান দিতে। পারছেন না মিস্টার জেরী আর মিসেস্‌ জেরী যাঁদের অনবদ্য দূরদৃষ্টির ফল  জিউস্‌ ইন্টারনেশ্‌নেল । পারছেনা আইটি প্রো কাম্‌ পোয়েট অবিনাশ চক্রবর্তীও। পরিবর্তে ক্যামেরা ঘুরে যাচ্ছে অসহায় ফ্ল্যাশব্যাকে।

                           ক্যামেরায় ভেসে উঠ্‌ছে একটি সকাল। লাল পাড় শাদা শাড়ি পরনে এক মহিলা। একটি রিক্সায়। মহিলার কোলে একটি শিশু। কিনারে আরেকজন। রিক্সা চলেছে মফস্বলি পীচ্‌ রাস্তা ধরে। রাস্তার পাশে পাশে বয়ে চলেছে একটা নদী। নদী নয়। খাল। পরে যদিও গিয়ে মিলেছে নদীতে। এই মফস্বলের প্রান্তেই। নদীও নিশ্চয়ই কোথাও গিয়ে মিশেছে সাগরে। কিন্তু কোথায় কেজানে। রাস্তার ধারে ধারে বাড়ি। প্রায় সব বাড়ি থেকেই ভেসে আসছে পোড়োদের স্বর নয়তো হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানের রেওয়াজ। রিক্সা পার হচ্ছে মণীন্দ্র মহাজনের দোকান, জোড়া তেঁতুল গাছপার হচ্ছে রজনী শা’র বাগান।সরকারি হাসপাতাল। ইষ্টিশান রোড। যমজ বোনের মতো রাধা-দুর্গা সিনেমা হল্‌। মা’র সঙ্গে ‘সফেদ্‌ হাতী’ দেখেছে তারা এরি কোনো একটিতে। দেখেছে ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’, ‘ফটিকচাঁদ’, ‘কিং-কং’। কতোবারই গিয়েছে ভিতরে ।তবুপ্রতিবারআলো নিভে যাওয়া মাত্র কেমন ভয় ভয় করেছে। করেছে গা ছম ছম। পর্দায়ক্রমে,ভেসে উঠছে অক্ষরছবি ...

‘ অক্ষরঃ মনিমুক্তা বিদ্যামন্দির

ছবিঃ বিরাট পাঁতিল তোলা ইস্কুল বাড়ি। ইউ’র মতো আকার। শাদা দেওয়াল। ফটক থেকে বাঁধানোউঁচু পথ চলে গেছে প্রিন্সিপালের কোঠা অবধি। বারান্দা ঘিরে নীল নীল নাম না জানা ফুলের গাছ। গাছের ডাল ভাঙ্গা যায় সহজেই। ডাল ভাঙ্গলেই শাদা শাদা আঠালো রস আসে বার হয়ে। বারান্দা গুলো উঁচু হলেও মাঠটা নীচু। বৃষ্টি হলেই মাঠ জলে থৈ থৈ।পেছনে একটা পুকুর। শ্যাওলা ঢাকা ...।।

‘অক্ষর ( কোনো ছবি নেইকালো পর্দায় শাদা অক্ষরের আবহে ঘোষকের কন্ঠ ...)নিজস্ব স্কুল বাড়ি হয়নি এখনোভিকম্‌চান্দ নামক মহিলা হাই-ইস্কুলে সকাল ছ’টা থেকে দশ’টা ইস্কুল হয়আপাততঃ’

‘পালিত হয় রবীন্দ্র জয়ন্তী২৩ শে জানুয়ারীশহীদ ক্ষুদিরাম দিবসবিশ্ব বাংলা ভাষা দিবস ইত্যাদি’

‘ সব বিষয়ই পড়ানো হয় বাংলায়ইংরেজি আছে সাব্‌জেক্ট্‌ হিসেবে’

‘এই ইস্কুলটি একজন মহিলার একক প্রয়াস’

‘সবচেয়ে কম ফী’ নেওয়া হয় এই ইস্কুলে...’

‘ঐ দেখো ইস্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা।ঐ দেখো তারা নাটক করছে .।‘শারোদৎসব’ঐ দেখো তারা কবিতা বলছে ‘ব্রাহ্মণ’, ‘শেষ শিক্ষা’, ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ ।এই যে তাদের পরিচয়লিপিদেখোভেসে উঠছে পর্দ্দায়ঃ

কৃপাসিন্ধুঃ কালো। রোগা। সামনের দিকের দুটো দাঁত উঁচু। চুল কদমছাঁট। বাবার কাঠের জিনিস বানানোর দোকান। ইস্কুলের গলীর মোড়েই। ‘দিদিমণি আপনার হাতে ছেলেটাকে দিলাম ।একটু ভালো করে শিখিয়ে পড়িয়ে দিন যাতে মানুষ হয় ।আমরা’ত লেখাপড়া করতে পারিনি ।তাই যতো কষ্ট করেই হোক্‌ ছেলেটাকে পড়াবো ...’ বলে প্রধান শিক্ষিকার কাছে ছেলেকে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি ...

( কৃপাসিন্ধু আজ কোথায়কৃপাসিন্ধুরা আজ কোথায়কতোদূর লেখাপড়া হলো ওরওর বাবার দোকানটাও উঠে গেছে অনেকদিন ...)

সুজিতঃ ফর্সা। রোগা।  দুরন্ত। ইস্টিশান রোডে বাবার দোকান। প্লাস্টিকের খেলনার সুজিতের মা নেই। ইস্কুলে ওর বন্ধু বলতে বড় দিদিমণির ছেলে অনিমেষ। ওর বাবা এসে মাঝে মাঝে নালিশ দিয়ে যান বড় দিদিমণির কাছে। নালিশ দিতে দিতে কখনো নিজেই কেঁদে ফেলেন মানুষটি ।‘ ঘরে দেখবার কেউ থাকলে এমনটা হতোনা দিদিমনি ।আমার ত দিন যায় দোকান সামলাতে সামলাতেই ...’

অবিনাশঃ বাবা কলেজে পড়ান। মা’ও পড়াতেন কলেজে। তবে অন্যত্র। বিয়ের পরে চাকরি ছেড়ে চলে আসেন এখানে। ভাব ভালোবাসার বিয়ে। মার সহকর্মিনীরা মাকে বল্লো হবু বরকে দেখতে চায়। বাবাকে যেতে হলো জোড়হাট। মার সহকর্মিনীরা তখন হবু বরকে বল্লেন কি উপহার চাও বিয়েতে?’  তা বলে যাতা চাইলে চলবে না। হয় প্রেস্টীজ প্রেসার কুকার নয় বিভূতি রচনাবলী। দুটোই তখন সদ্য এসেছে আসামে ।বাবা রায় দিলো বিভূতি রচনাবলীর পক্ষেই ..অনিমেষ ইস্কুলের সব চেয়ে দুরন্ত ছেলে। অমনোযোগি। ছবি আঁকে। ইস্কুলের বিরাট পাঁচিলের ফোকর গলে ইস্কুল পালায় ...

অন্বয়ঃ অবিনাশের  ছোটো ভাই। তুলনামূলক ভাবে শান্ত। পড়ার থেকে খেলায় বেশী মন। ইনোভেটিভ্‌। ‘চিড়িয়াখানা’ শব্দ দিয়ে দিদিমনি বাক্য লিখিয়ে দিয়েছিলেন ‘চিড়িয়াখানায় পশুরা থাকে’, বাড়িতে বাবা বলেছিলেন দিদিমনি’র বাক্যের গঠনে নূতন বাক্য লিখতে। তাইহাফ্‌ ইয়ার্লি পরীক্ষার খাতায় সে লিখেছিলঃ ‘চিড়িয়াখানায় অন্বয় থাকে...’

 

শাশ্বতীঃ ‘সুবোধ’ এই শব্দটির সংজ্ঞা হয়তো এই মেয়েটিকে দেখেই লিখিত হয়েছিল। কখনো। এমনই সুবোধ এই বালিকা যে সে লক্ষী দিদিমণির’ও পছন্দের ছাত্রী। গায়ের রঙ কালো। চোখের দৃষ্টি গভীর। তার বাবা ছবি আঁকেন। ছবি বলতে ক্যালেন্ডার দেখে ভালো নকল তৈরী করতে পারেন। কাজ করেন কি একটা সরকারী অফিসে। ইস্কুলে পার হয়ে লেভেল ক্রশিং। ক্রশিঙ্গের ওপারেই শাশ্বতীদের দোতলা বাড়ি। সামনে ছোটো বাগান।

শাশ্বতী’র বাবার স্কুটার আছে।

 

সন্দীপঃ এরা জৈন। রাজস্থানের মানুষ। তবে তিন পুরুষের ব্যবসা এখানে। সন্দীপের বাবা সন্তোষ জৈন না মার্কস্‌ না বিবেকানন্দের দীক্ষিত। কিন্তু মানুষটি জানেযেব্যক্তির উন্নতি আর সমষ্টির উন্নতি পরস্পরের পরিপূরক। অতএব যে সব কাজ ভদ্রলোকের সমষ্টির উন্নতি ঘটাবে বলে মনেহয় ভদ্রলোকের তাতেই তিনি এগিয়ে যান। বড় দিদিমনি’কে ডাকেন ‘দিদি’ বলে। সন্দীপ চঞ্চল। কিন্তু মুখচোরা।

 

ভাওনাঃ সন্দীপের দিদি। রাজস্থানের মরুভূমির পান্থপাদপের সঙ্গে আসামের বিস্রস্ত নীলিমায় গড়া মুখচোখ ।পরে ইউনিভার্সিটিতে কয়েকবারই গোল্ড মেডেল পেয়েছিল ...

 

হীরালালঃ হীরালাল শর্ম্মা। বাবা মারা গেছেন যখন সে একে বারেই শিশু। বাবার পেন্সনে দিন চালান মা। ফর্সা। রোগা। চঞ্চল। সুন্দর ছবি আঁকে...

( এখন কি করে হীরালালচাকরীকন্ট্রাক্‌টারিআদৌ করে কি কিছু? ...)

 

     আরো মুখআরো ছবিআরো পরিচয় লিপি ভেসে উঠবার আগেই খুকি’র দ্বিতীয় নাচও শেষ হয়ে যায় এখন মঞ্চে ডাকা হয়েছে চার জোড়া পেরেন্ট্‌স্‌’কে। সাহসী চার জোড়া পেরেন্ট্‌স্‌ উঠেও গেছেন মঞ্চে। খোকার স্বভাবতঃই ইচ্ছা ছিল তার বাবাও যাক। কিন্তু অবিনাশ ততোটা সাহস করতে পারেনি। ছেলেকে বলেছে ‘খিদে পেয়েছেকিছু খাবি?’ ‘কি খাবোকোথায়?’ ‘ঐ’যে বাইরের দোকানে...’ ‘কি পাওয়া যায় ওখানে?’ ‘চল্‌ না গিয়ে দেখি ...’।খিদে সত্যি পেয়েছিল অবিনাশের। নিশ্চয় খোকারো পেয়েছে। খুকিরো। কিন্তু খুকি এখন ইস্কুলের সম্পত্তি। অন্ততঃ আরো একটা নাচ শেষ না হওয়া পর্যন্ত।

    সামনের ছোটো রাস্তাটি পার হয় তারা। পার হতে হতে কানে আসে মাইকের দ্বারা প্রচারিত শব্দাবলীঃ এই খেলার নিয়ম হচ্ছে প্রতিজন পুরুষকে দেওয়া হবে এক একটি প্রশ্নপত্র। এতে প্রশ্ন থাকতে তাঁর স্ত্রীর ভালোলাগা মন্দলাগা বিষয়ে। মহিলাদেরো দেওয়া হবে প্রশ্নপত্র। জানতে চাওয়া হবে তাঁদের স্বামীদের ভালোলাগা মন্দলাগা বিষয়ে। এরপরে মিলিয়ে দেখা হবে ঐগুলি। আজ যে আটজন পেরেন্ট্‌স্‌ এই খেলায় জয়েন করেছেন তাঁরা হচ্ছেন ...’

খোকা বলেঃ ‘পাপাএরকম কি একটা টিভিতে কোন্‌ চ্যানেলে যেন দেখেছিলাম...”

অবিনাশ হাসে বলেঃঠিক...

   সাধারনত রাত করে ঘুমাতে যাওয়াই অভ্যাস অবিনাশের। সবাই ঘুমালে সে এসে দাঁড়ায় সামনের ব্যালকনীতে। অধুনা এগারোশো স্কোয়ার ফুটের এই ফ্ল্যাটটির মালিক সে। তার ‘বিদ্যা’র সঠিক  ‘ব্যবহারে’র মূল্যে। মনেপড়ে সর্বজয়ামনেপড়ে হরিহরমনেপড়ে অপু ।সর্বজয়া চাইত বাপের যজমানি’তেই ক্রমে থিতু হোক্‌ অপু ।কিন্তু হরিহর ।হরিহর যে কি চাইতো তা হরিহর নিজেই হয়তো জানতো না তবে এ টুকু জানতো সে ছেলেকে যজমানি ব্রাহ্মণ হতে দিতে চায়না।

           তিন তলায় এই ফ্ল্যাট্‌। সেখান থেকে দেখা যায় নিঝ্‌ঝুম রাস্তা। দেখাযায় নানান উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়ানো কুকুরেরা । ভেসে আসে তাদের কোলাহল ।দেখাযায় রাস্তার অন্য পারেসাইবার কাফে’র বারান্দায় ঘুমানোর চেষ্টা নেওয়া তিনটি মানুষ ।সম্ভবতঃ মা-বাবা আর ছেলে। গত তিন চার মাস ধরে এ’ই তাদের রাতের আস্তানা ।দিনের বেলা পুরুষ দুইজন থাকেনা ।মহিলাটি ভিক্ষা করে কেভি সান্দ্রা বাস স্টেন্ডের সামনে ।রাতের দিকে ফিরে আসে পুরুষ দুইজন ।এখন এরা ঘুমে নয়। একজন বসে আছে। বোঝাযায়। আরেকজন মাটিতে আধশোয়া হয়ে কিছু বলছে ।ওদেরকে দেখতে দেখতে সিগারেট জ্বালায় অনিমেষ।ভাবে হয়তো এ’ই তার নিয়তি ।এখানেএই ব্যালকনীতে এইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আকাশ পাতাল কথা ভাবা আর সকাল হতেই সমস্ত ভাবনাকে জলাঞ্জলী দিয়ে অফিসের পথে ছুট লাগানো ।এর থেকে কারোরি মুক্তি নেই ।সবই যেন পূর্ব নির্ধারিত ।যদিও সোডিয়াম আলোতে আকাশের অবয়ব ধর্ষিত তথাপি একটি দু’টি তারা এখনো দেখা যায় ।দূরেকেন্টন্‌মেন্ট্‌ স্টেশন থেকে ভেসে আসে রেল গাড়ির চলে যাওয়ার শব্দ ।অবিনাশের মনেপড়ে অনেক কাল আগে পড়া একটি কবিতার কিছু পংক্তিঃ Surely, if the stars are lit

There is somebody who longs for them,

Somebody who wants them to shine a bit । অবিনাশের মনে হয় কে’সে যার চাওয়ার মূল্যে এই তারাগুলি জ্বলমানসে’কি অবিনাশ চক্রবর্তী না’কি ফুটপাথের ঐ রাতজাগা মানুষগুলি

   এদিক ওদিক দেখে নিয়ে আস্তে হলেও দৌড়ও দেয় খোকা। পার হয়ে যায় রাস্তা। এবার গীর্জার গেইটের দিকে তাকিয়ে অবিনাশ বুঝতে পারে খোকা’র আচমকা দৌড়ের হেতুটি। কল্লোল ডাকছে তাকে। কল্লোল রঞ্জনা মিত্র’র ছেলে। খোকার চেয়ে বছর দুই’এর বড় হলেও খোকার সঙ্গে খুব ভাব। কল্লোল পড়ে সিক্সে। কোন্‌ আরেক ইন্টারনেশনেলে। আচ্ছাএই কল্লোল কি পড়েছে তার মা’র ইস্কুলে কোনো দিনইরঞ্জনা মিত্র’র মেয়েটি ঠিক খুকিরি বয়সী। সে আপাততঃ রঞ্জনা মিত্র’র ইস্কুলেরি ছাত্রী। তবে সামনের বছর থেকে তার জন্যও নির্ধারিত হয়ে গেছে একটি ইন্টারনেশনেল। ‘ মালাইউ কুড্‌ টেক্‌ ইয়োর ডিসিশান ফ্রম নেক্সট্‌ ইয়ার এবাউট পুগি ।আসলে কি জানো মা’র ইস্কুলে হ’লে বাচ্চারা স্কুলটাকে ঠিক স্কুলের মতো নেয়না ।দ্যাট্‌স্‌ হোয়াই আমি ঋতা’কে অন্য স্কুলে দিয়ে দিচ্ছি ...’ ঋতা’র জন্মদিনের পার্টি হচ্ছিল রঞ্জনা মিত্র’র বাড়িতে। সেখানেই প্রসঙ্গটা তুলেছিল রঞ্জনা মিত্র। ইতিমধ্যে দুই পেগ্‌ মতো হুইস্কী চালান হয়ে গিয়েছে অবিনাশের পেটে। ঐ হালকা নেশার ঘোরেও রঞ্জনা মিত্র’কে তারিফ করেছে সে। করতে বাধ্য হয়েছে। উফ্‌ কি সাট্‌লিটি। এ একদিন চ্যালেঞ্জ করবেই জিউস্‌ হেন আরো বহু ইন্টারনেশনেল্‌’কে ...

দুই ভাইকে পাঠানো হয়েছিল ‘প্রান্তিক’ নামের এক কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ।কেননা ঐ স্কুলে বাবার কলেজের অধ্যাপক মাণিক বাবু’র ছেলেরাম যায় যায় হোমরা চোমরা বিনয় বাবুর দুই ছেলে ।অতএব আমাদেরো নিয়তি যে হবে ঐ স্কুল তাতে আর বিচিত্র কি?  ইস্কুলের রিক্সা ভ্যানে করে যেতাম। প্রায়ই সেই যাওয়া হতো কাঁদতে কাঁদতে। ফিরতামও ঐ রিক্সা ভ্যানে। আমাদের পাড়ার আর কোনো বাচ্চা ঐ ইস্কুলে যেতোনা। ফলে অনেকটা পথ একা একা আসতে হতো ভ্যানে। ঐ একা আসার প্রতিটি মুহুর্ত্ত ছিল ভয়ের। যদি ড্রাইভার কাকু আজ বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার বদলে নিয়ে চলে যায় অন্য কোথাও ।যদি বিক্রি করে দেয় ।অবশেষে পাড়ার মোড়ের মশ্‌জিদ আর তার লাগোয়া কবরখানাটা দেখা মাত্র বুকে বয়ে যেতো এক আনন্দের শিহরণ! আহ্‌! বাড়ি আর দূরে নয় ।আহ্‌! ‘হোম্‌ সুইট্‌ হোম্‌’ ...

     প্রতি সন্ধ্যায় ইস্কুলের খাতা গুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে দেখতো মা। কি’যে দেখতো স্বাভাবিক ভাবেই বুঝতাম না তখন। তবে মাঝে মাঝে ডাক পরতো আমারো ...

‘লিট্‌ল্‌’ বানান এ ক’টা ‘টি’?’

‘দু’টো’

‘খাতায় তাহলে তিনটে লিখেছো কেন?’

কিংবা ‘নাইনের সঙ্গে সেভেন প্লাস্‌ করলে কতো হয়?’ ।আঙ্গুলে গুনে টুনেঅবশেষে বলি ‘সিক্সটিন্‌’ ।‘ কিন্তু খাতায় ত লিখেছ ফিফ্‌টিন্‌ ।এই ম্যাথ্‌ গুলো রাফ্‌ খাতায় আবার করো বসে বসে ’ ।রাগ হতো। ভাবতাম ‘মিস্‌’ দেখে ‘কারেক্ট্‌’ দিয়ে দিয়েছে ।তা আবার দেখা কেনঅনিচ্ছা নিয়ে খুলে বসতাম বই খাতা ...

     একদিন রীতিমতো ভীত হয়ে গেলাম মা যখন বল্লো ‘ কাল ইংলিশ্‌ আর ম্যাথ্‌ খাতা স্কুলে নিয়ে যেতে হবেনা ...’ ‘আরে মিস্‌ বক্‌বে যে ...’ ‘ আমি দুটো নতুন খাতা এনেছি তোমার জন্যপুরোনো গুলো আমার কাছে থাক্‌...’ নতুন খাতা পাওয়ার আহ্লাদে মা কেন রেখেদিলো পুরোনো খাতাগুলো এই প্রশ্ন চাপা পরেগেলো ...

     ইস্কুলের সামনের দিকটা গোল মতন। গেট্‌ খুলে ঢুকেই দুটো বড় বড় গাছ । এতে যে ফুল ফোটে তা দিয়ে লাটিম বানায় বাচ্চারা। আমাদের ক্লাস বসে এক তলায়। ইস্কুলের ফটক দিয়ে কেউ ঢুকলে দেখা যায়না তবে বারান্দায় উঠে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কোঠার দিকে গেলে দেখাযায়। হঠাৎ দেখি মা! বারান্দা পার হয়ে চলেছে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কোঠার দিকে! এক দৌড়ে ক্লাসঘর ছেড়ে সোজা মার কাছে। পেছনে পেছনে ‘মিস্‌’। মা বল্লো ‘আজ আর ভ্যানে যেতে হবে নাআমি বসে সঙ্গে করে নিয়ে যাবো ।এখন ক্লাশে যাও ।আমি প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করে আসি ...’ অগত্যা ফিরতে হলো ক্লাশ ঘরে। কিন্তু মন পড়ে রইলো কখন মা’র কথা শেষ হবে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সঙ্গে আর কখন মা’র সঙ্গে রিক্সায় চাপবো ...

  একটু পরেই ক্লাশের দরজায় দেখা গেলো মেট্রন মাসীকে। এ’ও শুভলক্ষন। মা’বাবা এসে বাচ্চাকে নিতে চাইলে ক্লাশ ঘরে এসে সে খবর জানিয়ে যাওয়ার কাজ মেট্রন মাসীর। নিশ্চয় মা ডাকছে !! হায়কিন্তু মেট্রন মাসী এসে বল্লো প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম ডাকছেন ক্লাসের ‘মিস্‌’ কে। মিসের ভ্রূ তখন কুঁচকে ছিল কি’না মনে নেই তবে মিনিট দশেক পরে যখন ফিরে এসেছিলেন তখনকার তাঁর জ্বলন্ত দৃষ্টিবিশেষতঃ আমার দিকেআমার চোখে ভাসে এখনো ...’অবিনাশ ইয়োর্‌ মম্‌ ইজ কলিং ইউ ...’ বই খাতা বাক্সে ভরে এক দৌড়ে চলে এলাম মা’র কাছে। রিক্সা দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক গল্প হলো ।মা’কে প্রশ্ন করলাম ‘আজ ইস্কুলে এলে কেন?’ মা বল্লো ‘এইতোতোকে নিয়ে যেতে ...’

     পরদিন থেকে ক্লাশে মিসের ব্যবহারে দেখা গেলো বিশেষ পরিবর্তন। আগে যে সমস্ত অপরাধে ক্ষমা পেয়েছি অনায়াসেযে সব অপরাধের জন্য জয়ন্তনবল কশোর সিংমনোজসোনালী কেউ’ই পায়না শাস্তিসে সবের জন্যও শাস্তি জুটতে লাগলো আমার। তা’য় বাড়ি যাওয়ার আগেপ্রতিদিনসমস্ত খাতা প্রিন্সিপাল মিস্‌’কে দেখিয়ে যাওয়ার নিয়ম হলো আমার জন্য ...

 হ্যাঁসেই আরম্ভসে’ই মা’র মাথায় ঢুকলো একটা ইস্কুল করার চিন্তা যেখানে এভাবে তিনটে ‘টি’র ‘লিটিল্‌’ বানানে ‘কারেক্ট্‌’ দেওয়া হবেনাযেখানে প্রতিমাসে বেতন বাড়বে নাযেখানে বাংলা ভাষায় পড়ানো হবে বাচ্চা দেরকে ...

    তখনি প্রথম দেখি অরুনিমা মাসী আর ঝর্ণা মাসীকে। আমাদের বাড়িতে।  এঁদেরকে নিয়ে বেড়িয়ে যেতো মা। কখনো ফিরতে ফিরতে হয়ে যেতো সন্ধ্যা। কোনো কোনোদিন বাবাকে দেখেছি রাগে ফেটে পরতে। কোনো কোনোদিন মা উত্তর করেনি। কোনো কোনো দিন করেছে। বহুদিন ঘটনা গড়িয়েছে কেঁদে কেটে না খেয়েই মা’র ঘুমিয়ে পরা অবধি। আমরা দুই ভাই বাবার তত্ত্বাবধানে ভয়ে ভয়ে খেয়ে দেয়ে উঠে পরেছি বিছানায় ।কোনো কোনো মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখেছি আবার কি সব কথা বার্তা চলছে মা আর বাবায় ।কথা বার্তার মাঝখান থেকে ‘ইস্কুল’ শব্দটি ছিট্‌কে লেগেছে কানে ...

    কোনো কোনো দিন আমাদের রেখে যাওয়া যেতোনা। বায়না করতাম। তাই আমাদেরো সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়ে যেতো মা। এরকমই একদিন গিয়েছিলাম সন্তোষ জৈন’দের বাড়িতে। মনে আছে ‘দিদি’ ‘দিদি’ বলে মা’র সঙ্গে কথা বলছিলেন ভদ্রলোক। আমাদেরকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলতে ।একদিন গিয়েছিলাম মিলনশসী নামের এক রাগী বৃদ্ধার বাড়িতে। ইনি আমাদের এখানের একটি নামী মেয়ে ইস্কুলের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন ।মা’কে প্রশ্ন করেছিলাম ‘আমরা এদের বাড়িতে যাই কেন?’ মা বলেছিল ‘তোমাদের জন্য একটা নতুন ইস্কুলনতুন রকমের ইস্কুল হচ্ছে ।তা’ই ...’ কথাটা ভালো করে না বুঝলেও ঐ ভ্যানে চড়ে ঐ ইস্কুলটিতে আর যেতে হবেনা এমন একটা সম্ভাবনায় আমি আর ভাই দুজনেই আনন্দিত হয়েছিলাম যার পরনাই ।জল্পনা কল্পনাও চলেছিল অনেক ...

          একদিন মা বল্লো ‘কাল থেকে আর ইস্কুলে যেতে হবেনা’ ।আহাএমন আনন্দ সংবাদ!! শুনে যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। মা বল্লো ‘দু সপ্তাহ বাড়িতেই পড়াশোনা করবে তারপর যাবে নতুন ইস্কুলে ...’ ।নতুন ইস্কুলতার মানে সেই স্কুল টি হয়েগেছে যার জন্য মা এতো দৌড়া দৌড়ি করতো? ...সে কোথায়কি তার নামমা বল্লো ‘নতুন ইস্কুলের নাম মণিমুক্তা বিদ্যামন্দিরঐ ইস্কুলে তোমাদের ক্লাসে পড়াবেন অরুনিমা মাসী ...আমিও থাকবো ’ সে যে ঠিক কি রকমের উত্তেজনাকি আনন্দ ।বাড়িতে আসতে লাগলো বড় বড় রঙ্গীন কাপড়তাতে নানা রঙ্গে লিখা ‘মণি মুক্তা বিদ্যামন্দির’ ।আসতে লাগলো প্লাস্টিকের বলব্যাট্‌ ।বাবা-মা’র রাগারাগিও যেন কমে গেলো অনেক দূর ।এবারে আরম্ভ হলো রিহার্সেলমা বল্লো ‘উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নাটক হবে ।শেষশিক্ষাতুমি হবে গুরু গোবিন্দ সিংহ...’

    আমাদের বাড়ির কাছেই বিপিনচন্দ্র পাল হাই স্কুল। বিকাল চারটার পরে সেখানে গিয়ে হাজির হতাম মা’র সঙ্গে। আসতো অরিনিমা মাসী, ঝর্ণা মাসীলক্ষী দিদিমনি ।আসতো সন্দীপভাওনাশাশ্বতীকৃপাসিন্ধু ।শিবা দিদি গান গাইতো ...কে কে যেন নাচতো ‘আমায় ক্ষম্‌ হে ক্ষম্‌ নমো হে নমো ...’ ।আবার সকাল হতে অরুনিমা মাসী না হলে ঝর্ণা মাসীর সঙ্গে বেড়িয়ে পরতো মা ...’

             রাস্তার অন্য পার থেকে ভেসে আসে খোকার উত্তেজিত স্বরঃ ‘পাপাআয়এবার পুগিদের ক্লাসের প্রাইজ্‌ ডিস্ট্রিবিউশান ...’ সিগারেট ফেলে দিয়েফেলে দেওয়া সিগারেটটাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে রাস্তা পার হয় অবিনাশ। খোকা ক্যামেরাটা এগিয়ে দেয় তার দিকে। ভয় পায় অবিনাশ।আবার যদি ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রাখা মাত্র ক্যামেরা চলেচায় ঐ রুক্ষ-লালচুল বালিকা ও শিশুগুলির দিকে ...ভীত অবিনাশ মৃদু হাসেখোকার মাথায় হাত দিয়ে বলেঃ ‘তুই তোল্‌তো দেখি এটা। দেখবো কেমন হয় ...’ খোকা মহোৎসাহে ভিডিও ক্যামেরা ঝুলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায় যাতে ভালো করে তার ক্যামেরায় ধরা পরে সব। অবিনাশের মনেপড়ে ‘কাছে দূরে কেবলি গ্রাম পতনের শব্দ হয়’...মনেপড়ে যায়  একটু আগে মনে না পড়া কবিতাটির পরের পংক্তি গুলিঃ

বলাই বনমালী সুবল শ্রীদাম সুদাম শেষে

রমেন নরেন পরেশ হল শহর ভালবেসে।

মধ্যমগ্রাম হালিশহর রামপ্রসাদী সোনা

চুরির ভয়ে আব্‌জে নিল চব্বিশ পরগণা ।

               মঞ্চে এখন জোর হাততালি। একটি বাচ্চাকে প্রশ্ন করা হয়েছে ‘হোয়াট্‌ ইজ্‌ ইয়োর নেম্‌?’ সদ্য বাজারে আসা একটি হিন্দি ছবির নায়কের কায়দায় সে বলেছে ‘খান্‌ মাই নেম্‌ ইজ্‌ খান্‌’। ঐ হাততালির ভেতর দিয়ে অবিনাশের কাছে এসে স্থির হয় একটি মীমাংসা। নিয়তি’র মীমাংসা।বহুদিনেরবহুরাতের একটি প্রশ্নের উত্তর আজ সরল অবয়বে চলে আসে তার ধরা ছোঁয়ার ভিতরে।

মা যদি ইস্কুলটা তখন বেচে দিতো  ঐ আগরওয়াল’কে তাহলে না তাকেনা মাল্যশ্রী’কে ভিটে বাড়ি ছেড়ে আসতে হতো এখানে। পরিবর্তে ঐ মফস্বলের মিস্টার এন্ড্‌ মিসেস্‌ জেরী হয়ে যেতে পারতো তারা অথবা মিস্টার এন্ড মিসেস্‌ মিত্র আর তার পরিবর্তে ...

       হ্যাঁএই মীমাংসায় এসে পৌঁছানোর জন্যও সে কৃতজ্ঞ ঐ রঞ্জনা মিত্র’র কাছেই। রঙ্গীন পেন্সিলে পাঠ্য বইএর ইম্পর্টেন্ট লাইনগুলো দাগিয়ে দেওয়ার মতোই রঞ্জনা মিত্র দাগিয়ে দিয়েছে তার চেতনাকে ।একটু আগেই দোকানের অবতল আয়নায় দেখা তার নিজের মুখটি আবার মনে আসে তার ।আর সেই সঙ্গেই একটা প্রবল পরিচিত ইংরেজি শব্দও উঠে আসে তার ঠোঁটে ।সে বিড় বিড় করে বলে ।কাকে বলেরঞ্জনা মিত্র’কেমিসেস্‌ জেরী’কেএই ফাংশনের দর্শককূলকে না’কি নিজেকে? না’কি সকলকেই? কেজানে।তবু বলেবিড় বিড় করে নিজের মনেই বলে ‘আপ্‌স্টার্ট,আপ্‌স্টার্ট’ ...।

নিজের কানে এই শব্দই যেন প্রতিধ্বনিত হয় ‘বাস্টার্ডবাস্টার্ড’।

 

১৭/০২/২০১২ – ২৬/০১/২০২২

 

 

ঘুম ঘর