দুইটি নদী, মধ্যে মফস্বল
দুইটি নদী, মধ্যে মফস্বল। একটিই পথ,
পিচের, আঁকাবাঁকা। দুই সীমানায় দুইটি ইষ্টিশান .....
বলবে, জানি, "এমন কতই আছে ..."
আমিও জানি। তবু নদীর জল
একেক ঘাটে একেক রকম বয়
এবং তাতে গল্প এসে মেশে। নিছক সত্য
সমস্তটাই নয়।
একে পাড়ায় একেক রকম রোদ।
যখনি যাও ঘুমায় চার্চরোড, জড়িয়ে গায়ে
যীশুর বাণী, কাঁথা । অনতিদূরে পুলিশ, পরিত্রাতা,
সন্ধ্যে হলেই রিক্সাওলার যম। "হেনো কোথায়, তেন কোথায়", ঘুষ
পাঁচ সিকেতেও নামতে পারে যদি
তোমার ভাগ্য এবং তাঁদের মুড
তেমন মন্দ না হয় সন্ধ্যাবেলা।
ঘুমন্ত চার্চ রোডের কিনারেই
টিলার উপর,গাছের নিচে থানা।
সরগরম বলতে স্টেশন রোড। যশোদা আর
ঘোষ ডেয়ারী ঘেঁষে মফস্বলের কো-এড কলেজ বাড়ি।
কলেজ বাড়ি দেয়ালঘেরা হলেও
উল্টোদিকেই শ্রীদুর্গা,শ্রীরাধা । 'কাকতালীয়'
ভাবতে পারো তবে নিশ্চিত নই আমি নিজের মনে।
কেননা এই দুই হলে নুন্ শোয়ে
বৃন্দাবন প্রথমবার দেখা
মফস্বলের অনেক প্রজন্মেরই। সেই ট্রডিশান
অথবা হেরিটেজ অনেক যুগ হারিয়ে গেছে, তুমি
বলবে জানি "মল্ আর পিভিআরে"।
ঠিক ধরেছো যদিও তুমি, তবে
আমার রক্তে সেই ট্রডিশান আছে।
বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল
ঝরতে ঝরতে মুছে যাওয়ার যুগ
মফস্বলে হানা দেওয়ার আগেই
খুব বেশী নয়, কয়েক বছর হবে,
মন্দ কিংবা বিপুল ভাগ্যবলে
বালক থেকে আমার কিশোর হওয়া। প্রেমপত্র
তখনও ছিল। প্রেম
নিবেদনের উথাল-পাথাল ঢেউয়ে
উঠতো দুলে তখনও পথঘাট
সরস্বতী পূজায়, সাংস্কৃতিক --
পাজামা আর পাঞ্জাবীর সাথে
পিঠ খোলা চুল। শাড়িটি লালপাড়
-- অনুষ্ঠানে, রবি জয়ন্তীতে। ভ্যালেন্টাইন দিনের
রাতডানা তখনও ছায়া ফেলেনি মফস্বলে।
বসতে পারো এখানে যদি চাও । আমার কিশোর
হওয়ার পথপাশেও পলাশ শিমুল একটি দুটি আছে।
তবুও আমার এইসব বাদ দিয়ে
পিছিয়ে যেতে দারুন ইচ্ছা করে। কারণ তাতে গল্প এসে মেশে
কাঁটাতারের নিছক সত্য বেড়া
পেরিয়ে আসি রেকর্ড প্লেয়ার যুগে।
উৎপলা সেন, নির্মলা মিশ্র কে
সঙ্গে করে জগন্ময় মিত্র, সতীনাথের
রেকর্ড খুঁজি "কৃষ্ণা মিউজিকে"।
এইচএমভি দোকান? ছিল তা'ও।
পঞ্চাশ মাইল পেরিয়ে, শিলচরে।
একেকে পাড়ায় একেকরকম রোদ।
যখনি যাও ঘুমিয়ে চার্চরোড।
তাদের বাসা তবুও চার্চরোডেই।
দুই বোন আর একজন ভাই তারা
রমা, সোমা। রতন স্কুলে পড়ে।
চার্চরোডের কাছেই ইস্কুল।
তবু রতন এসএলআর সাইকেলে
ইস্কুলে যায়। ক্লাস সেভেনে শুধুমাত্র তারই
'ব্যক্তিগত' লাল এসেলার আছে।
একটু পরেই হারান কাকা এলে
রিকশা চেপে সোমার কলেজে যাওয়া ।
জানলা দিয়ে তাকিয়ে রমা দেখে।
জানলা দিয়ে তাকিয়ে রমা দেখে
যাচ্ছে সোমা। "কো-এড আর নয়।
পড়তে হলে মেয়ে-কলেজেই যাবে"।
বাবার সঙ্গে মাকেও নিমরাজি
হতেই হয় । "এক মেয়েকে দিয়ে
শিক্ষা তোমার হয়নি কি? আর নয়।
রমা এখন ঘরেই থাকবে আর
রমার জন্য পাত্র দেখার কাজ
শুভেন্দু আর জহর দা করছেন।
ভাবছি বলব রাঘব ভট্টকেও"।
রক্তে তখন ভাসছে ইতিহাস
খুব দূরে নয়, শিলিগুড়ি ,কলকাতার
পথে। পথের পাশে জোয়ান ছেলের লাশ
কিংবা ভেসে উঠছে ডোবার জলে।
নবেন্দু স্যার পড়াতো ইতিহাস।
'পড়াতো' মানে? পড়ায় এখনো তো?
পড়ায়, তবে এখন ফাঁকে ফাঁকে
কার চোখে চোখ জিরিয়ে নিতে রাখে?
কার বা চোখে চোখ রেখে যায় বলেঃ
"ইতিহাস এর আগেও ইতিহাস
রয়েছে, আর মানুষ ইতিহাসে
ইচ্ছামতন মুখোশ বা মুখে নিয়ে
আসেনা। ওই মুখোশ কিংবা মুখ
ইতিহাসই পরিয়ে দেয় তাকে ..."
নবেন্দু স্যার মুখোশ নাকি মুখ?
রমা অনেক ভেবেছে এই নিয়ে।
ক্লাসের থেকে পুকুর দেখা যায়।
পুকুর নাকি বিরাট কালো দিঘি?
ফিজিক্স ল্যাব, ঘোড়ানিমের গাছ,
চোরকাঁটা, ঘাস, বুনো লতায় ঘেরা
এই পাড় আর আম, সুপারীর ছায়ায়
কয়েক কোঠার ছাত্র-হোস্টেল।
কোনাকুনি টানলে পরে রেখা
আর্টস বিল্ডিং। জানলা দিয়ে ডাকা
জলের সুর মনোযোগের বাধা।
এবং দ্বিধা, আজ মনে হয় ভীতি
পায়ে পায়ে জড়ায় পাকে পাকে।
কিন্তু যেদিন ওই পুকুরের ধারেই
ক্লাসের শেষে মেয়ে কমন রুমে
যাওয়ার পথে নবেন্দু স্যার নিজে
বললঃ 'রমা, দাড়াও কথা আছে ..."
ওই বিকালের পড়ন্ত রোদ্দুর
যেন দূরের রাখালবাঁশির সুর
জানলা দিয়ে তাকিয়ে ভাবে রমা,
সোমা তখন মেয়ে-কলেজে, ক্লাসে।
"এমন গল্প তো কতই পড়েছি হে
এমন ঘটনাও
বিরল নয়" "জানি হে জানি, তাও
আমিতো নিরুপায়
আমার লিখে যেতে ইচ্ছা হয় ।
এসব গল্পের
নায়ক নায়িকারা পার্শ্ব চরিত্র ও
সহজে ভিলেনেরা
এখনও হাতছানি দেয় আমায় ।
প্রেমের চিঠি লেখা লাজুক কাঁপাহাত
খাতার পাতা ছিঁড়ে
বানানো খাম ইতিতে অক্ষর
নামের জায়গাতে
যে অক্ষর শুধু নয় হে নাম।
প্রেমিক রাত্রির
দেওয়ালে লিপি লেখে
শ্রেণী ও সংগ্রামে
ভরসা তার। যেন সে মরুভূমি
এবং পকেটের
পত্রটিই শুধু মরুদ্যান।
বেলা যে পড়ে এল
জলকে চল থেকে
গলির মোড়ে বেলা
ফেরিওয়ালার ডাকে
অতঃপর বুঝি
সোজা সুপর্ণা
এবং শীতকাল
ব্যাঙের রক্তের?
মধ্যে কিছু নেই?
কিছুই থাকবে না?
পায়রা এক ঝাঁক
রোদ, উজ্জ্বল?
তাদের ওড়া আর
রকমসকম দেখে
হাসেনি ভোর-আকাশ?
নামেনি ঢল?
লিখেনি চিঠি কেউ
থানা গারদ থেকে
মা'কে ও ছোড়দিকে?
বর্ষা রাত
নামেনি গান হয়ে
অবিশ্রাম?
বেলা যে পড়ে এল
জলকে চল থেকে
এই যে পিভিআর
এই যে মল্
কি করে গজালো, হে,
কিকরে ধর্ষিতা
সহজপাঠ, নদী,
মফস্বল?
যদিও একদিন
শ্মশান হবে সব,
কবরে ঢেকে দেবে
নতুন ঘাস।
তবুও লিখে রাখো
এসব ছবিগুলি
স্মৃতি ও সত্যের
সারাৎসার।
জানোনা তুমি কবে
কার যে কেন হবে
এসব লিপিপাঠে
কি দরকার।
কখনো মাঝ রাতে নেমেছো নাকি পথে
পাওনি শুনতে কি রেকর্ড গান
ঝরা পাতা ঝড়কে ডাকে
অথবা পাষাণে লিখোনা নাম?
এখনো ঝড় এলে বাতাসে ঝরাপাতা
ছদ্মবেশী চিঠি। চিঠির খাম
কখনো আর কেউ
বানাবে খাতা ছিঁড়ে? পত্রে প্রেম নেই
কেবল স্মাইলি, জটিল সঙ্কেত
ও পিভিআর।
সকল দেওয়ালের দখল নিয়ে গেছে
বিজ্ঞাপন সেল্, জাঙ্গিয়ার।
লিখে রাখো
রোদে লাল হেমন্তের দিন
বিগত শরৎ অগোচর প্রতিবেশে
একটি নিমেষ দাঁড়ালো পুকুরধারে।
"যেওনা, দাড়াও, কথা আছে" এই ডাকে
থামলো কালে চিরচঞ্চল গতি।
তখনই বাতাসে রেডিয়োর গান ভাসে
'কথা রাখো। শ্যাম, পথ ছাড়ো"।
"সত্যিই বেজেছিল নাকি", তুমি বলবেই, জানি।
আমিও "বলব নিছক সত্য নিয়ে
ব্যাপার করিনা আমি।
কল্পনা হয় সত্যের রাজধানী"।
সোমার রিক্সা দৃষ্টির সীমা পার হয়ে যায়, তবু
রমা জানালায় একলা দাঁড়ায় যতক্ষণ না মা,
মঞ্জু মাসীমা, মিঠু এসে ডাকে তাকে
ভুলিয়ে রাখতে কাজে কাজে পাকঘরে।
আর ক'টা মাস। তারপরই ঠিক শকুন্তলার মতো ...
'শকুন্তলা কি? শকুন্তলার মনে মনে অন্ততঃ
আশ্বাস ছিল, মিথ্যা হলেও
প্রেমের ভরসা ছিল। তার যাওয়া শুধু টান ছিঁড়ে ফেঁড়ে
অপ্রেম, অমরণ। যদি যেতে হয় নিজেকেও ছিঁড়ে
ফেলে রেখে চলেযাবে
দুইটি নদীর বেড়াবাঁধা
মফস্বলের পথেঘাটে।
দীপ্তি, টেলিগ্রাফ-তার। ডাক বিভাগ
সোমা। দীপ্তির চিরকুট বলেঃ নবেন্দুর চাকরি হয়তো
থাকবে না আর বেশি দিন। তার নামে পুলিশ কেস
আছে। রমার জানাই ছিল। কলেজের কর্তৃপক্ষ
এখন জেনেছে। জানাজানি ঘিরে এই
কানামাছি খেলাটিতে তার
বাবার কতটা হাত? ভাবতে চায় না রমা।
পুলিশ কেস আছে, রমা জানে, জানে
নবেন্দুর দাদা, তার পঙ্গু জ্যাঠার ছেলে,
মা হারানো, সুকুমার, কয়েক বছর আগে
লাশ হয়ে গেছে। রাত্রিবেলা। গান্ধীনগরে।
কলোনীর সুভদ্রার শোকে শরীক হয়েছে রমা।
যদিও সে রাষ্ট্র,রাষ্ট্রযন্ত্র,শ্রেণী
এখনো বোঝেনা ভালো করে।
নবেন্দু কোথায় যাবে? এখনো তো
রাত্রি নামে, শোনা যায়, গান্ধীনগরে।
প্লেয়ারে রেকর্ড রমা কেন যে চাপায়
হয়তো ফ্রয়েড নইলে কার্ল ইয়ুং জানে।
গান বাজে। গান ঝরে। বাতাসে ছড়ায় গান। তনু
চার্চরোড ঘুমিয়েই থাকে।
ইস্কুল কি এক কারণে তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেলে
একা একা চার্চ রোড ধরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে তুমি
শুনেছিলে "শাওন রাতের গান" জগন্ময়ের কন্ঠে,
চিনেছিলে বিষাদের স্বর। ধূসরতা। মনে আছে?
যদি ওই গান এই কাহিনীর রমা
বাজিয়েই থাকে ... অথবা বাজায় নি যে
কে বলতে পারে? একই গান এক একটি মোড়ে
প্রতিবারই ভিন্ন কোনো গল্প নিয়ে আসে।
উত্তরাধিকারের সূত্রে মধ্যবিত্ত রক্ত ছাড়া
কিছু বই আর ছেঁড়াখোঁড়া দিনলিপি, ঠাকুরদার নিরুদ্দিষ্ট ভ্রাতার,
পাওয়া গেছে। জ্যাঠতুতো দাদা কে দেখেছে সম্ভাবনা নিয়ে
বড় হতে হতে প্রথমে ফেরার হলো। এক-অন্নবর্তী সংসারে
পুলিশী তোলপাড়। কয়েক বছর পরে
বাবা গিয়ে শনাক্ত করেছে লাশ। জ্যাঠা পক্ষাঘাতে
পঙ্গু। তারও আগে প্রতিবেশী কাকা ও কাকিমা, অবশ্যই শুভ অনুধ্যায়ী,
চুপিচুপি বলে গেছেঃ "ওই সব বইপুঁথি,বৌদি,পুড়িয়ে ফেলো"।
মা লুকিয়ে পুড়তে দিয়েছে। জ্যাঠিমা থাকলে কি
সত্যই সব বই, সব নোটবুক
এভাবে পোড়াতে পারতো? সবার আড়ালে
আধপোরা কটি বই বাঁচিয়েছে হাত দিয়ে ফারেনহাইট
ফোর ফিফ্টি ওয়ান উত্তাপে। প্লাস্টিকে জড়িয়ে বইগুলি ছোট্ট বাগানে
পিস্তলের মতন মাটি খুঁড়ে পুঁতে রাখা দিয়ে
পা রেখেছে সেই রাস্তা ধরে যে রাস্তায় ইতিহাস মানে শ্রেণীগত সংঘর্ষে এবং
হেঁটে ও দৌড়ে যেতে যেতে অবশেষে একদিন দাদা সুকুমার
তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে। হাত রেখে কাঁধে
বলেছে নির্ভর আর স্নেহ মায়া নিয়েঃ
খতম, শুধুই খতমে কিছুই হবে না, ভাই, খতমের ফাঁদে
আমরাই খতম হয়েছি। তোরা অন্য পথ ধরে হেঁটে দেখ
শ্রেণীর সংঘর্ষের দিকে যাওয়া যায় কিনা..."
তক্ষুনি ঝোপের আড়ালে নড়েওঠা ছায়া
জানিয়েছে স্পাই, রাষ্ট্রীয় ডালকুত্তা
পিছনে লেগেছে।