Joseph K’র দিনলিপি , ২০২২
।। ১।।
বলি একদিনের কথা। বেঙ্গালোর থেকে বাড়ি গেছি। একা। হপ্তা দুয়ের ছুটিতে। ফেরার আগের দুপুরে জোনাক করিমগঞ্জ থেকে আমাকে নিয়ে এসেছে ওদের বাড়ি। পয়লাপুল। এয়ার পোর্ট তকে কাছে হয় আর তাছাড়া চা বাগান দিয়ে শর্টকাট্ ও আছে।
পরদিন সকাল। চলেছি বিমান বন্দরে। গাড়ি চালাচ্ছে জোনাক। চা বাগানের ভিতর দিয়ে। গাড়ির আওয়াজে চা বাগানের নির্জন যাচ্ছে ভেঙ্গে ভেঙ্গে। এটা গাড়ি যাওয়ার রাস্তা নয়। তবু ছোটো গাড়ি চলে যেতে পারে। যায়। এক সময় উল্টো দিক থেকে একটা গাড়ি এসে পড়লো সামনে। খুব বড় না হলেও জোনাকের গাড়ির তুলনায় বড়। পথ ছেড়ে দিতে জোনাককে, কসরত করেই, গাড়ি সড়াতে হল। স্টার্ট বন্ধ করলো। অন্য গাড়িটা যাচ্ছে, ধীরে ধীরে, কিনার দিয়ে। জানালার পাশে আমি। চারিদিকে শুধুই চা গাছের সবুজ আর শেড ট্রি। হঠাৎ মনে হলো, আহ্, এমন যদি হতো, যদি ওই অন্য গাড়িটা হতো কোনো টেরোরিস্ট বা ডাকাতের, যদি গাড়ি থেকে নেমেই ওরা গুলি করে দিতো আমাকে! আহ্, তাহলে ... তাহলে আর এয়ারপোর্ট যেতে হতোনা, সিকিউরিটি চেকিং করতে হতোনা, বোর্ডিং পাশ নিয়ে উঠ্র বসতে হতোনা বিমানে, নামতে হতোনা বেঙ্গালোর। নেমে আর বাড়ি যেতে হতোনা, অফিস না, কোনো চিন্তা, দুশ্চিন্তা না, আশা না, হতাশা না, সুখ, শোক, দুঃখ, কাম, ঘৃণা -- কিচ্ছুনা। এদের সবার হাত থেকে যেতো পালিয়ে যাওয়া। আহ্। আশ্চর্য শান্তি! ... আমাদের পার হয়ে গাড়িড়া এক মুহুর্ত থামলো। আমার মনের আশার হেউঢেউ আমাকে শিহরিত করলো পুলকে। কিন্তু ঐ দেড় সেকেন্ড। ওই গাড়ি ধরলো তার পথ। জোনাক স্টার্ট দিলো আমাদের গাড়ি। অত্যন্ত হতাশ লাগলো।
এই যে আত্মঘাতী ভাবনা এর কোনো হেতু নেই। আপাত ভাবে। হ্যাঁ, মগজের কোষে সেরেটোনিন কম হওয়ার নামই 'ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশান'। ওই হেতু এমন ভাবনা, এমন ক্লান্তি আসা সম্ভব। তবে এ নয় এক ও একমাত্র হেতু। আমরা তো কবেই পড়েছি, পড়িনি কি, বার বার, বার বারঃ
'শোনো
তবু এ মৃতের গল্প; কোনো
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখেনি কোনো খাদ,
সময়ের উদ্বর্তনে উঠে এসে বধূ
মধু— আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;
হাড়হাভাতের গ্রানি বেদনার শীতে
এ-জীবন কোনোদিন কেঁপে ওঠে নাই;
তাই'
... লক্ষ্য করো, 'তবু' নয়। 'তাই'। যেন এ'ই ভবিতব্য। এ এক গভীর অসুখ। তবে ঠিক ততোদূর হত্যাকারী অসুখও নয় যে অসুখে নিচিন্তায়, নিভাবনায় মানুষ ক্ষতি করে মানুষের, নিতান্ত রাজনৈতিক লাভের নিমিত্ত দাঙ্গা বাঁধায়, সামান্য কিছু কড়ির লোভে জাল খত দেখিয়ে উৎখাত করে মানুষকে। এই অসুখ, কাফকার 'A Country Doctor' এর সেই রাতের রোগীর ক্ষতটির মতো। গোলাপ। ক্ষত-গোলাপ। গোলাপ-ক্ষত। 'In his right side, near the hip, was an open wound as big as the palm of my hand. Rose-red, in many variations of shade, dark in the hollows, lighter at the edges, softly granulated, with irregular clots of blood, open as a surface mine to the daylight. ' ওই ক্ষত থেকেই হয়তো কাফকার মৃত্যু, হয়তো তাঁর জীবন আর জীবিত থাকাও ঋনী ওই ক্ষতের কাছে। ওই গোলাপহেন ক্ষত'র পাঁপড়ি তাঁর চেতনা। এর সৌরভ তাঁর রচনা। জীবনানন্দ যে মৃতের গল্প শোনান তারো মর্মে, নিশ্চিত, ঐ ক্ষত ছিল। কিন্তু এর সৌরভ তাকে সৃষ্টির পথে নিয়ে গিয়েও অন্তিমে, ব্যর্থই হল। পক্ষান্তরে Dostoevsky'র The Dream of a Ridiculous Man'এর সেই 'Ridiculous Man' যে বলছেঃ 'I had firmly determined to do so two months before, and poor as I was, I bought a
splendid revolver that very day, and loaded it. But two months had passed and it was still lying in my drawer; I was so utterly indifferent that I wanted to seize a moment when I would not be so indifferent--why, I don't know. And so for two months every night that I came home I thought I would shoot myself. I kept waiting for the right moment' আশ্চর্য এই, যে, তার সঠিক সময় কে সে আবিষ্কার করলোঃ 'As I was thinking about the gas lamps in the street I looked up at the sky. The sky was horribly dark, but one could distinctly see tattered clouds, and between them fathomless black patches. Suddenly I noticed in one of these patches a star, and began watching it intently. That was because that star had given me an idea: I decided to kill myself that night' ...
জীবন আর মৃত্যু যে কিভাবে, কখন, দিক বদলায়, হায়, প্রতিটি মানুষেরই গহনে সে নিজেও জানেনা। জীবনানন্দ, কাফকা, দস্তয়ভস্কিরা যতোনা নিজের, নিজেদের কথা বলেন, তার চেয়ে বেশী, ঐ যারা টের পায়না, তাদের মর্মগুলিকে, ঐ গোলাপের মতো ক্ষত, যা ব্লেইককেও লক্ষ্য করতে হয়েছিল, উচ্চারণ করতে হয়েছিল 'O Rose thou art sick', তাকে মেলে দেন আমাদের সামনে।
গোলাপ, সে যদি গোলাপই হয়, তাহলে তার আদতে 'sick' হওয়া ভিন্ন কোনো গতিই নেই। অতএব, অন্তমে ওই 'অসাধ', 'অসুখ' নিয়েই ফুটে উঠতে হয়, ফুটে থাকতে হয় গোলাপকে। কোনো অজ গেরামের বদ্যি টের পায় ঐ গোলাপের সৌরভ কিন্তু সে'ও নিরুপায়। ফিরে যেতে হয় Country Doctor কেও কেননা, প্রথমতঃ "the family. They knew nothing about it, and, had they known, would not have believed it. To write prescriptions is easy, but to come to an understanding with people is hard." এতদ্দিন্নঃ 'in my house the disgusting groom is raging; Rose is his victim'। অতএব গোলাপকে তার অসুস্থতার ভার বইতে হয় নিজেকেই। টের পেতে হয়ঃ
'জানি— তবু জানি
নারীর হৃদয়— প্রেম— শিশু— গৃহ– নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—
আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত— ক্লান্ত করে;
লাসকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই'
এবারের 'তাই' কিন্তু আগেরবারের 'তাই' এর বিপরীত। এখানে 'তবু' চলেনা। কিন্তু অশ্বত্থের দিকে এক গাছা দড়ি হাতে একা একা যেতে যেতে সে যদি ঘুমিয়ে পড়তো, যেমন পিস্তল হাতে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল ওই রিডিকিউলাস ম্যান তাহলে? তাহলে অন্তমে এ'ও ছিল সম্ভব, যেঃ
" It was a dream, they say, delirium, hallucination.
Oh! As though that meant so much! And they are so proud! A dream! What is a dream? And is not our life a dream? I will say more. Suppose that this paradise will never come to pass (that I understand), yet I shall go on preaching it. And yet how simple it is: in one day, in one hour everything could be arranged at once! The chief thing is to love others like yourself, that's the chief thing, and that's everything; nothing else is wanted--you will find out at once how to arrange it all. And yet it's an old truth which has been told and retold a billion times--but it has not formed part of our lives! The consciousness of life is higher than life, the knowledge of the laws of happiness is higher than happiness--that is what one must contend against. And I shall. If only everyone
wants it, it can be arranged at once.
And I tracked down that little girl . . . and I shall go on and on!"
এই আত্মঘাতী মুহুর্তগুলি সত্য। 'তবু শেষ সত্য নয়'। 'কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে'। কেমন সে 'তিলোত্তমা'? সে'ও ত জানেন কবিঃ
"নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয়
লিবিয়ার জঙ্গলের মতো।
তবুও জন্তুগুলো আনুপূর্ব— অতিবৈতনিক,
বস্তুত কাপড় পরে লজ্জাবশত। "
তবু কোনো শাশ্বততর না হোক অন্ধকার সত্যকে তিনি বলেন "তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়"।
মৃত্যু আমাকেও আক্রমণ করে। আদতে আক্রমণ করে ডিপ্রেশন। গোলাপের পাঁপড়িগুলি তখন ক্ষয়ে গেছে। আমি শ্লো-সুইসাইডের কথা ভাবি। আমি এমনই যুক্তিনিষ্ঠ হই তখন, যে, সরাসরি আত্মহত্যার কথা ভাবিনা। কারণ তাহলে বৌ-বাচ্চারা ইন্সিওরেন্স ক্লেইম করতে পারবেনা। আমার ছেলেমেয়ে, বিশেষ করে মেয়ে, যে এখনো ছোটোই, আমার ফাঁসি দেওয়া ঝুলন্ত দেহ তার ভিতরের কিচ্ছু একটাকে দেবে চিরতরে নষ্ট করে। শিরা কাটলে রক্তের তান্ডবের ভিস্যুয়েল। আমার মা, বৃদ্ধা, পারবেনা নিতে। কিন্তু যদি আমার ওষুধ গুলি খাওয়া বন্ধ করেদি? আমার ব্লাড প্রেসার আছে। অফিসে চাপ আছে। দু'য়ে দু'য়ে চার হতে কতক্ষণ? সুগার, কলেস্টরেল ও ওষুধ নিয়ন্ত্রিত। কিছুদিন বন্ধ রাখলে ...
রাখলাম। প্রথমবার আবিষ্কার করলো বৌ, ওষুধ কমছেনা দেখে। এবার ওষুধ হাতে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলার খেলা চল্লো কিছুদিন। এরপরে দিলাম কেনা'ই বন্ধ করে। এবারে পাড়ার দোকানী ভাবলো আমি দোকান পাল্টেছি। বৌ কি একটা কিনতে গেলে সে জানালো 'স্যর এখন কোথা থেকে ওষুধ আনেন?" ... যাইহোক, ক্রমে, ক্ষত-গোলাপের পাঁপড়ি গুলি আবার গজালো। সক্রিয় এই আত্মনাশ চিন্তা আপনি কমে এলো।
এ'ই। এতোটুকুই বলার কথা। আর কিছু নয়। এ’ও হয়তো ঠিক, যে জীবনানন্দ যখন অন্তিমবারের মতো হাসপাতালে, সেখানকার নার্সদের কথা তিনি বলে গেছেন ভূমেন্দ্র গুহ সহ অনেককে। এই বলা'র সত্য 'আট বছর আগের একদিন' এর সত্যের থেকে কিছু কম নয়।
২।
কবিতা রচনা বা তার প্রয়াস অথবা যে কোনো শিল্পসৃষ্টিরই প্রয়াস, অন্ততঃ আমার, মনেহয়, জীবনেরই আর সকল স্বাভাবিকতার মতোই এক স্বাভাবিকতা। অবশ্যই শিল্পসৃষ্টি দাবী করে, যাপনের অনেকানেক নিত্যকর্মের চেয়ে ঢের বেশি প্রয়াস তথাপিও, এও জীবনেরই হাত, পা, আঙ্গুল, চুল, মস্তিষ্ক যা হোক কিছু একটা। এ'কে জীবন থেকে আলগা করে নিলে আদতে যা ঘটে, তা, জীবনের অঙ্গহানি কিংবা বিকৃতি। যে বিকৃতি প্লাস্টিকের ফুল, পলিথিনের প্যাকেট। এই চরিত্রের 'কলাকৈবল্য' যুগের স্থবিরতার প্রমাণ। এর ফাঁদে ধরা দেওয়া 'নিরো রাজা'দের অপমৃত্যু। পক্ষান্তরে রবিকবি, গ্যেটে, দস্তয়ভস্কি, টলস্টয় নাহয় প্রমুখদের বাদই দিলাম, আমাদের নিকট সময়ের রামকিঙ্কর বা ঋত্বিক, জয়েস্ কিংবা সিমোনো, জীবনানন্দ কিংবা কমলকুমার, বিভূতি কিংবা অদ্বৈত মল্লবর্মন ... এঁদের জীবন থেকে এঁদের শিল্পকে অথবা শিল্পকে আলাদা করা যায় কি? ছত্তিশগড়ে শঙ্কর গুহ নিয়োগী শ্লোগান তুলেছিলেন "মার্ক্সবাদ ৮ ঘন্টা না। ২৪ ঘন্টা"। অর্থাৎ শুধু মজদুরি করবার সময়টুকু, মালিকের সংশ্রবের সময়টুকুই নয়, শুধু মজুরী বাড়ানোর দাবীই নয়, ৮ ঘন্টা কাজের পরে যে উদ্বৃত্ত সময় যা'ও আদতে অনেক লড়াই করে মজুরী সামান্য বাড়ানোর মতনই, সেই সময় টুকু, সেই সামান্য অর্থটুকুর ব্যবহারও যেন হয় মার্ক্সবাদী পথে অর্থাৎ মানবিক বিকাশে। ওই অর্থ, ওই সময়ের ব্যবহার দ্বারাই শঙ্কর নির্মাণ করেছিলেন মজুর হাসপাতাল, নাটকদল। শিল্প বা শিল্পসৃষ্টির বাসনা, কারুবাসনা, তা'ও ২৪ ঘন্টার। কেননা আমাদের বাঁচাও ২৪ ঘন্টার। ২৪ ঘন্টার এক চুল্লী। এক চুলা। যা গনগন করে না ২৪ ঘন্টাই না জ্বলে থাকলে শিল্প, যা ঐ চুলার থেকেই ছিটকে আসা স্ফুলিঙ্গ, সে'ও যাবে থেমে। তাই জীবন-চুলায় ২৪ ঘন্টা আঁচ দিয়ে যাওয়াই আদতে, আমার এতদিনের দেখায়, চিন্তায়, শিল্পেরই আঁচ দেওয়া। হ্যাঁ, এরমধ্যেও ঢুকে পড়ে এক রকমের সিনিসিজম তবু সে সিনিসিজম হয়তো ততো মারাত্মক নয় যতোটা 'মানুষ নিয়ে লিখব বলে মানুষ দেখবো'র মূর্খামিতে।
আমার নিজের কথা বলি। আমার ছেলের যখন বয়স ২-৩ এক গ্রীষ্ম দুপুরে, সম্ভবতঃ গরমেই, কয়েক সেকেন্ড তার সংজ্ঞা, হয়তো, ছিলনা। ছিলাম শিলচরে। ডাক্তারেরা বল্লো কি একটা পরীক্ষা গৌহাটিতে নিয়ে করিয়ে আসতে। ভয় তো ছিলই মনে। গেলাম গৌহাটি। পরীক্ষাটি এরকম, যে, ও ঘুমাবে আর মাথায় কিসব বসিয়ে ওরা কিসব গ্রাফ দেখবে। প্রক্রিয়াটি আরম্ভ হল। ছেলে বৌ'এর কোলে ঘুমাচ্ছে। আমি আর সিদ্ধার্থ দাঁড়িয়ে আছি। যন্ত্র তার কাজ করছে। ... কি করছে যন্ত্র? মনেহলো যন্ত্র আমার ছেলের চেতনার গ্রাফ আঁকছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে এলো 'স্ট্রিম অফ কন্শাসনেস'। মনেহলো পন্ডিতেরা জয়েসের 'ইউলিসিস' কে আর ভার্জিনিয়া উলফের রচনাকে একত্রে বলে থাকেন,'স্ট্রিম অফ কন্শাসনেস' কিন্তু, অনেকবার একটু একটু করে, 'ইউলিসিস' যা পড়েছি, যেটুকু টের পেয়েছি, তাতে উল্ফ্ ( ইনিও আমার প্রিয় ) আর জয়েসের কোনো সম্বন্ধ পাইনি। দ্বিতীয় কথা মনের গতি, নিজের মনেরো, কি সত্যই ঐ ভাবে যায় ধরাছোঁয়া? যদি আমি স্থির করি যে, আগামী ৩ ঘন্টা আমাই মার মনের উপর নজর রাখব, নোট করবো কোন কোন জিনিস তার মোড় কোন কোন দিকে ঘুড়িয়ে দিচ্ছে, তখুনি কি আমি ভুলটা করছিনা? আর অন্যের মন, এমন কি আমারই সৃষ্ট চরিত্রের মনে আমি যে চিন্তা প্রবাহকে যার ভিত্তিতে যে দিকে ঘোরাচ্ছি, তা'তো ভুল হতে বাধ্য। একমাত্র, এমন অনেক সময় হয়, যে, এক সময় স্রেফ অনর্থক কোনো একটা দিনের কথা, কিছু সময়ের কথা মনে আসে আর তখন ভেবে তাজ্জব হতে হয়, যে, ইশ, কত কত বিপরীত ভাবনাই না ভেবেছি। ... এই কথাগুলি নিমিত্ত মাত্র। আমি বলতে চাইছি, যে, আমার মনে পুত্রের জন্য দুশ্চিন্তা, তখন আর্থিক দুশ্চিন্তাও ছিল অনেকটা, তার ঘুমন্ত মাথায় বসানো ইলেকট্রোড... এ সমস্ত সত্ত্বেও আমি মুহুর্তে যেন গায়েব হয়ে গিয়েছিলাম ঐ চিকিৎসা কোঠা থেকে। সম্বিৎ ফিরলে নিজেকে পাষন্ড মনে হলো। কথাটা সম্ভবতঃ বলেওছিলাম, সেদিনই বা তখুনি সিদ্ধার্থকে। এখনো আমার, নিজেকে সিনিক্যালই মনে হয়, ওই ঘটনাটা ভাবলে। শিল্পী স্বার্থপর। সে সব্বার সব কিছুকে নিঙড়ে নিয়ে চায় তার রচনার শিরায় প্রকৃত শোনিত বওয়াতে। জগদীশ গুপ্ত পথে যেতে যেতে, বস্তি অঞ্চলে ঝগড়া শুনলে ওইখানেই দাঁড়িয়ে যেতেন। শুনতেন ঝগড়া। রচনার রসদ। কিন্তু তাঁকে পারভার্ট বলতে পারিনা কেননা তিনি ওদের সাজ নিয়ে 'ওদের কথা' শোনাননি বা ৭ দিনের পিকনিকে সাঁওতাল পরগণা গিয়ে মাতলামির মূল্যে আপনাকে 'মাটির মানুষ' বলে দাবীপত্র ছাপাননি।
নিজের ব্যাপারে বলতে গেলে বলতে হয়, যে, লেখা নিয়ে আমি কনশাস্ আগেও ছিলাম না, এখনো নই। হ্যাঁ, না লিখলে, বাস্তবিকই শারিরীক অসুবিধা হয়। তাই লিখি। আর লিখে ফেললে একটা চেষ্টা থাকে তার দেহ থেকে শ্রমের দাগ গুলি যতোটা সম্ভব মুছে দেওয়ার। বরং লেখা আর পড়া আমার কাছে, আমার নিজের কাছ থেকে পালিয়ে থাকার একটা মস্ত উপায়। অবলম্বন। লেখায়, পড়ায় দেখি নিজের মুখই। আনন্দিত, দুঃখিত, আর্ত, কামার্ত, সফল, ব্যর্থ -- সব মুখই। কিন্তু সেটা আয়নার মতো নয়। তাই একটা দূরত্ব থেকেই যায় আর ওই দূরত্বটুকুই আমার প্রয়োজন। নাহলেই নিজের যাপনের [ যার অনেকটাই আমার,তোমার,তার, তাদের কারোর উপরেই নির্ভর করেনা ] রক্তাক্ত পর্বগুলি, সেগুলিতে আমার ও অন্যের ভূমিকা ইত্যাদির পর্যালোচনা চলে আসে।
আবহ একটা ঘটনা। অনেকদূর নিয়ন্ত্রক ও বটে। যেমন মাণিক বন্দ্যোপাধায়ের 'হলুদ পোড়া'। গল্পের শেষে অসংখ্য সিদ্ধান্তে আসা যায়। প্রতিবার পাঠেই। একটি সিদ্ধান্ত, অবশ্যই, এই, যে, যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক ধীরেন পাগলই হয়ে গেলো। কিন্তু কেন? একটা ব্যাখ্যা হতে পারে সে'ই শুভ্রার খুনী। আরেকটা এই, যে, ধীরেন ভিন্ন গ্রামের এবং গ্রামান্তরেরো, এমন কি তার নিজ সন্ততিরা অব্দি 'শুভ্রা'র ভূতে এবং 'ভূতের কথায়' আস্থা রাখছিল। কোথাও মানসিক আশ্রয় পাচ্ছিল না ধীরেন। পক্ষান্তরে মাণিকেরই 'হারানের নাত জামাই'এ, নিতান্ত স্বার্থপর, ভিতু, কুচুটে জগমোহন, যে আসলেই হারানের নাত জামাই, সে অন্তিমে, হয়ে ওঠে সাহসী। স্থির করে বিদ্রোহী ভুবনকে সে বাঁচাবে। দাঁড়াবে আড়াল করে। কেন? কেননা তার পারিপার্শ্বিক তাকে জোগায় হিম্মৎ। কিন্তু সময়ের যে বাঁকে আমরা দাঁড়িয়ে সেখানে জগমোহনের ভুবন হয়ে ওঠার থেকে ধীরেনের পাগল হয়ে যাওয়ার আবহই বহুল। এই কথাটিই কি জীবনানন্দ বলেননা এখানেঃ
"আমার এ-জীবনের ভোরবেলা থেকে—-
সে-সব ভূখণ্ড ছিল চিরদিন কণ্ঠস্থ আমার ;
একদিন অবশেষে টের পাওয়া গেল
আমাদের দু-জনার মতো দাড়াবাব
তিল ধারণের স্থান তাহাদের বুকে
আমাদের পরিচিত পৃথিবীতে নেই । "
নেই। ঠিকই কি নেই? ছিলনা? থাকবেনা? যদি 'নেই', যদি 'না থাকবে' তাহলে এই পংক্তিগুলিই রচিত হল কিভাবে? হলো, এইভাবেঃ
"ফিরে এসে বাংলার পথে দাঁডাতেই
দেখা গেল পথ আছে,—ভোরবেলা ছডায়ে রয়েছে,--
দক্ষিণ, পশ্চিম, পূর্ব, উত্তরের দিক
একটি কৃষাণ এসে বার-বার আমাকে চেনায় ;
আমার হৃদয় তবু অস্বাভাবিক "।
কি কি ঘটলো এখানে? চৌখুপী কোঠা ছেড়ে, বাসা ছেড়ে, পথে দাঁড়াতেই দেখা গেলো... দেখা গেলো 'রূপসী বাংলা'। দেখা গেলো আমার দিক নির্ণয়ে ভুল ছিল। তা'ই শুধরে দিল। কে? কিষাণ। প্রকৃত প্রাকৃতজন। যে '(অ)মানুষ নিকটে গেলে উড়ে যায়'। তার কাছে -- তার দৈনন্দিন আনন্দের, বেদনার, শোকের, উদ্যমের এবং নিরাশারো কাছেও -- পথ আছে। দিক গুলি ঠিক ঠাক আছে। তথাপি "আমার হৃদয় তবু অস্বাভাবিক"। এ সমস্যা 'আমার'। একান্তই আমার। এই হতাশা, এই আত্মনাশ-ইচ্ছা, সবই আমার। আমার কথা শুনবার মানুষ নেই। কার আছে? কোথায় আছে মানুষ? কিন্তু গাছ তো আছে। গাছের কাছেও তো বলা যায় কথা। কান পাতলে গাছের কথাও শোনা যায়। যদি বলি তেমনই কিছু ইঙ্গিত রেখেছেন, বোদ্লেয়ার, এখানেঃ
The pillars of Nature’s temple are alive
and sometimes yield perplexing messages;
forests of symbols between us and the shrine
remark our passage with accustomed eyes.
Like long-held echoes, blending somewhere else
into one deep and shadowy unison
as limitless as darkness and as day,
the sounds, the scents, the colors correspond.
... খুব ভুল হয়তো হবেনা। শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর একটি পংক্তি মনেপড়ে প্রায়ইঃ
'মানুষের কাছে একটি আরেকটি প্রকৃতির কাছে / সিঁদুর মাখানো দুটি মুদ্রা বাঁধা আছে' [ স্মৃতি থেকে লিখছি]।
৩। বিষয় 'ম্যাজিশিয়ান', কারিগর অভিজিৎ সেনগুপ্ত
তাঁর পত্রটি মনে এনে দিলো দেবাশিসদার ১টি পংক্তিঃ "অশ্রুর কত যে উৎস " ...
তিনি এবং তাঁর লেখা বিষয়ে আমি অবগত বহুদিন এবং মুগ্ধ পাঠকও। রেখায়, রঙেও যে তিনি তেমনই মাটির দেবতা তা'ও জানলাম, দেখলাম এবং অভিভূত হলাম। সঙ্গে বিষণ্ণও। বিষণ্ণ, কেননা এই যোগাযোগটা ঘটলো জীবনের অনেকটা পথ পার হয়ে আসার পর। জানিনা কোনোদিন সাক্ষাৎ হবেকিনা --- আমার এই বেঙালোর যাপন থেকে বার হয়ে এসে ... যাইহোক, তাঁর পত্রটি আমার উপার্জন।
আসলে হালের 'আনন্দমেলা' গল্পটি ছাপেনি জেনে আশ্বস্ত হলাম । হ্যাঁ, কখনো নীরেন চক্রবর্তীর পরেও কিছুকাল, যারা সম্পাদক ছিল, তাদের বোধ কিছুটা হলেও ছিল। অতঃপর পৌলমী নামের মহিলার হাতে আসার পর থেকে ...
'ম্যাজিশিয়ান' গল্পটিতে অনেকগুলি মেটামরফোসিস আছে তবে ওই গুলি, কাফকার প্রতি সমস্ত শ্রদ্ধা সত্ত্বেও, বলতে বাধ্য, যে সূক্ষতর।
প্রথমেই নীরস অঙ্ক ক্লাশের মেটামরফোসিস যাদুর আসরে। যেন হাহা, ফসলহীন মাঠ, হয়ে গেলো এক নদী, কিংবা মৃত্যুর দেশে যেতে যেতে বাসন্তী দেখলো, একটি শিশুর ছুটে যাওয়ার আবহে মাঠ ভর্তি ধানের মাথাতোলা। ঋজু'র বকলমে, আমাদের সকলেরই, নীরস যাপনে এলো জীবনের, প্রাণের সবুজ।
২য় মেটামরফোসিসের ইঙ্গিত ইন্দ্রকুমারের পোশাকের খুঁত ঋজুর চোখে ধরা পড়ে গিয়ে 'ইন্দ্রকুমার' যাদুকর ম্যানড্রেকের থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে এলো রক্তমাংসের দিকে। ঋজুও এক ধাপ এগিয়ে গেলো, যেন ইন্দ্রজালের ইন্দ্রকুমারের আবডালের দিকে।
অতঃপর ঘটলো এক বিপরীত মেটামরফোসিস। আসল আর নকলের। নকল টাকা ঝলসে উঠলো আসলের মতনই। এখানে এসেই ঋজুর বা আমাদের লোভী মুখটাও উঠলো ঝলসে। ১০০ টাকাকে ২০০ করার ফন্দি এলো ঋজুর মাথায়। যেন 'সারপ্লাস' তোয়ের করার আবডালে এডাম স্মিথের 'ভগবানের হাত'। কঠিনতম পরীক্ষার দিকে, সমগ্র মানবজাতির হয়ে, যেন তারকোভস্কির 'সেক্রিফাইস'এর আলেকজেন্ডার, নিজের অজান্তেই হাঁটা দিল ঋজু।
এবারে গল্পের শেষ 'মেটামরফোসিস'টির দিকে যাওয়া, যে মেটামরফোসিস, আগের ছোটো ছোটো মেটামরফোসিসকে নিয়ে হয়ে উঠবে এক বিরাটের অংশ। চেক লুঙ্গি আর কড়করে রুটি চিবোনো 'ইন্দ্রকুমার'কে দেখামাত্র ঋজুর কি কি হতে পারতো? প্রথমত মোহভঙ্গ এবং তজ্জনিত কারণে ঘৃণা, বিরক্তি এবং প্রত্যাখ্যান। দ্বিতীয়তও মোহভঙ্গ তবে ঘৃণা, বিরক্তি বা প্রত্যাখ্যান নয়। সহমর্মীতা। এই ম্যাজিশিয়ান অন্যের শ্রমের দ্বারা উপার্জিত অর্থকে ভোজবাজিতে নিজের করে নিয়ে 'বড়লোক' হয়না, বলেনা 'আমার এই বড়লোক হওয়ার গভীরে আদতে আছে ঈশ্বরের হাত'। এখানেই এই সময়ের পরম মন্ত্র 'লোভ'কে পার হয়ে যায় ঋজু। পরিবর্তে অজান্তেই করুনায় আর্দ্র হয় সে। যে লোভী ছেলেটি বার হয়ে এসেছিল ১০০ টাকাকে দ্বিগুন করিয়ে নেবে বলে, সে'ই, আরেক ম্যাজিশিয়ানের ম্যাজিকবলে, হয়ে ওঠে, না, 'দাতা' নয়, দান-ধ্যানের মূল্যে সে ইহ এবং পর দুইলোকের কাছেই কিচ্ছু চায়না। ম্যাজিক দেখানোর নিমিত্ত রাখা নকল টাকার ভিড়ে তার আসল ১০০ টাকাটি রেখে সে আসলে পার হয়ে আসে নিজেকে, তার নিজের শ্রেণীকে, মানুষের লোভকে। সে'ও হয়েওঠে ওই দরিদ্র, ভেলকি দেখিয়ে ফেরা মানুষটির সমযাত্রী।
এই যে 'ম্যাজিক' আর এই যে 'ম্যাজিশিয়ান' তাদের কাহন বলা যায়না হালের চমক সর্বস্ব ফিকিরে। এ হচ্ছে সেই 'কিচ্ছা' যা অধুনা অবলুপ্ত ঠাকুমা-দিদিমারা শোনাতেন একদা। এ হচ্ছে টলস্টয়ের 'ইভান দ্য ফুল্' এর কাহন যা বলে যেতে হয় এভাবেই, যাকে বয়ে যেতে হয় এভাবেই, নদীর মতন অবলীল।
আর এই 'কিচ্ছা'কে মর্মে ধারন করতে পারাও এ যুগের যুগন্ধরদের ক্ষমতা বহির্ভূত তাই অভিজিৎ সেনগুপ্ত, 'যিনি মাটির তেলে'র বাতি জ্বেলে বসে শুনিয়েছিলেন আরেক 'আরণ্যক', কেবল তাঁর কাছেই এসে ধরা দেয় এই কাহন।
দেবাশিসদার সংযোজনঃ 'আর অন্তিম মেটামরফসিস: জাদুকর আর জাদু মুগ্ধের রোল রিভার্সাল।'