“রংগ-শংকরা”
মানুষটি হানা দেয়। কোনোদিন টের পাই
ঠিক যাওয়ার পরেই। কখনো কয়েকদিন, সপ্তাহ, মাস
কেটে যায় টের পে’তে পে’তে। যে রকম টের পেলাম
আজ, ঘুম ভাঙ্গারও অনেক, অনেকক্ষণ পরে –
মানুষটি গতকালও হানা দিয়েছিল। হানা দিয়ে দিয়েছিল
“রংগ-শংকরা হল্” সংলগ্ন বই-দোকানটিতে। নাটক দেখতে গিয়ে
যে দোকানে আমাদের ঢোকা। তখন
পাইনি টের। তখন পাইনি টের, শীতের সন্ধ্যা তবু
আমাকে কেন্দ্র করে পরিধির মতো নেমে এসেছিল
অনেক দূরের দু’টি দুপুর ও বিকাল। লোকটি দোহারা,
লম্বা। জালিম হিন্দির সঙ্গে রেপিডেক্স-ইংলিশ-স্পিকিং মিশিয়ে
যা সে বলছিল তা আদতে “চিচিং ফাঁক” আর
প্রত্যেকবার “চিচিং ফাঁক” বলামাত্রই খুলে যাচ্ছিল দরজা
একেক কোঠার। যেন বা আরব রাত্রি, যেন বিশ হাজার লিগ
জল-অতল থেকে মফস্বলি, ছাপোষা ভিটাতে
প্রবাল দেওয়াল উঠে গেলো আর হারুন অল রশিদ, খলিফা,
ছদ্মবেশে নিজে ঘোড়সওয়ার – সাবালক যুগ আর
কৈশোর-দুর্যোগের ঠিক চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা
দুই জোড়া চোখে। ছবিসহ বিশ্বকোষ, বিদেশী ফেয়ারি-কথা,
সিন্ধু,মায়া সভ্যতা হয়ে হিমালয়, কিলিমাঞ্জেরো পার হয়ে
অকস্মাৎ অন্ধকার। ব্ল্যাক-হোল। পরের পলকে অবিশ্বাস্য
আলো, রং, আলো – চোখ ঝলসে যাওয়ার জোগাড়। – আধ শতক আগে
তিন হাজার। সরকারি সামান্য গ্রান্টে কোনোমতে চলে যাওয়া
কলেজে মাস্টার। কোপারেটিভ-লোন, পত্নীর গয়না বন্ধক, আরো কিছু
ধারকর্জ ব’লে উদ্বাস্তু বিশেষণ মুছে যেনতেন ভিটা, সদ্য উঠেছে। তবু
“জালিম হিন্দি’র সঙ্গে রেপিডেক্স-ইংলিশ-স্পিকিং” এর হাতে
অগ্রিম দেওয়া হলো। দুপুরেই। কেন ? কারণ ওই দুই জোড়া চোখ
“জালিম হিন্দি’র সঙ্গে রেপিডেক্স-ইংলিশ-স্পিকিং” এর নিয়ে আসা
আলিবাবা-গুহার অন্দরে ঢুকে তখন আর বেরোবার
রাস্তা পাচ্ছেনা। হয়তো থেকে যেতো গুহা-অন্দরেই, ‘বই আসবে’
ভরসা না পেলে। অপেক্ষার মাস তিন ইস্কুল পালানো সহ
ইস্কুল হাজিরা জনিত নিত্য বৃত্তান্ত, শুধু
চালচিত্রে আশ্বাস, উৎকন্ঠা ও উত্তেজনা ছিল। এলো
বইগুলি, তিনমাস-শেষে এলো ছোটো কাঠ-বাক্সে হ’য়ে, এলো
যে বিকালবেলা, রিক্সা চেপে, সে দুপুরে
এক পশলা বৃষ্টি হয়ে নতুন গেঞ্জি গায়ে রোদ উঠেছিল। নিত্যদিনই
সাইকেলে, তবু, সেদিন ফেরার পথে মানুষটির
রিক্সা নিতে হলো বিশ হাজার লিগ জলের অতল থেকে
উঠে আসা রত্নপেটিকাটি হেতু। কলেজেই নাকি চেনা
কারোর বাড়িতে সে বিকালে মানুষটি তার সাইকেল
রেখে এসেছিল? – জানা হয়নি। আর জানা কখনো
যাবেনা। যেমন জানিনি কাল, সন্ধ্যাবেলা, মানুষটির আসা। “বাবা,
ওই দ্যাখ, ইরফান হাবিবের ‘পিপ্ল্স্ হিস্ট্রি সিরিজ’”। এক সেকেন্ড
থেমে “ পুরো সেট”। যৌবনের চৌকাঠে খাড়া, জন্মসূত্রে
নাগরিক, তবু দুই চোখে ছিল কি সে একই ঝলসে যাওয়া
মফস্বলে? আধ শতক আগে? উচ্চ মধ্যবিত্ত মানে
যদিও এখনো দিন কেটে যাচ্ছে নাগরিক ইস্কেলে, তবু, সত্য এইঃ
চাকরি নেই চার মাস হলো। সত্য এইঃ এ বাজারে
আধ শতক পেরোনো বয়সে, চাকরির নয়া সম্ভাবনা –
শতকরা পঞ্চাশ-পঞ্চাশ। গ্রেচুইটি, পিএফ ইত্যাদি
ভেঙ্গে ভেঙ্গে দিন উচ্চ মধ্যবিত্ত মানে যাচ্ছে
এতাবৎ, নাগরিক স্কেলে। “পুরো সেট টা আছে? আচ্ছা।
পুরো সেট কতো দাম হবে?” বলি। বলা’র আড়ালে স্পষ্ট
দেখতে পাই – সংশয়, দ্বিধা ও হিসাব, দেখতে পাই
পায়ে পায়ে আসছে এগিয়ে “রংগ-শংকরা হল্”
সংলগ্ন বই-দোকানটিতে।
বুঝিনি তখন, তবে আদতে তখনই ওই মানুষটি এসে
কিনারে দাঁড়িয়েছিল। কাঁধে আলতো হাত রেখে
আদতে তখন ওই মানুষটিই নিশ্চিত আমাকে বলেছিলঃ
“যা হবার হবে। দেখা যাবে। এখন এই বইগুলি
কিনে ফ্যাল্। নাহলে এ সদ্য যুবক আর ওই তার সহোদরা চশমা-কিশোরী
– ফিরে আসতে পারবেনা এই আলিবাবা বই-গুহা থেকে। তখন
কি হবে? কিনে ফ্যাল্। পরে কিছু, ঠিক, হয়ে যাবে”।
#
মানুষটি হানা দিয়েছিল। নিশ্চিত কাল, সন্ধ্যাবেলা,
“রংগ-শংকরা হল্” সংলগ্ন বই-দোকানটিতে। অন্যথায়
সব কিছু অন্য কিছু হতো। তখন পাইনি টের। পেতে পেতে
বারো ঘন্টা, চৌদ্দ ঘন্টা দেরী হয়ে গেলো। তাকে বলিঃ
“ হোক দেরী। তবু টের পেতে যে দিয়েছো সে’ই “সাত
বলদের দুধ”। এরকমই এসো, আর, এসেছিলে, দেরীতে
হলেও, এভাবে জানিয়ো”।
১২.১১। ২০২৫
বেঙ্গালোর