প্রবেশিকা

ভিড়েই রয়েছি মিশে, নিজবেশে, তাই চিনতে পারছেনা কেউ। এ'ই স্বাভাবিক। ম্যাজিক-মাহাত্ম্য ছাড়া, ম্যাজিক-মাহাত্ম্যের মূলে অন্ধকার টুপি আর ঝোলা কোট ছাড়া, কে হে আমি? কে’বা আমি? কিভাবে ভিড়কে বলি ইন্দুরে কেটেছে টুপি, লাল-নীল রুমালের ঝাঁক উড়ে গেছে পায়রা, কাক হয়ে...

Sunday, December 14, 2025

সপ্তপদী

 সপ্তপদী

সপ্তর্ষি বিশ্বাস




একটি দিনের, একটি দিনের পেটের অন্দরে একটি রাস্তার, ঘাটের, পুকুরের, কোঠার – কোঠাটির অন্দরের আলোর, অন্ধকারের ছবি হয়না তুলিতে, হয়না কালিতে। হয়না কারণ না’ত আলো, না’ত অন্ধকার থাকে স্থির হয়ে। স্থির থাকে হয়তো আলো মাপবার যন্ত্রের, বাতাস মাপবার যন্ত্রের নিরিখে। ঠিক যেমন জ্যোতির্বিদের আকাশ। কিন্তু যে দেখে, কেবল দেখেই, তার নিরিখে? তুমি আঁকতে, তুমি লিখতে পারো একটি পলক। কিন্তু পরের পলকে এই ছবিই যে আমূল গেলো বদলে। আদতে তুমিই দিলে, তোমার দেখা দিয়েই, দিলে বদলে। ঢোকামাত্র যাকে মনে হয়েছিল নিতান্ত অন্ধকার, ঘুপচি, ধূর্ত তবু অধুনা বাতিল ফাইলপত্রের বান্ডিলে  ঠাসা একটি কোঠা, যা’তে তিনটি চারটি টেবিলে বসে থাকা মানুষগুলিও সমান ধূর্ত, সমান বাতিল – মনুষ্য সংজ্ঞার থেকে বহুযুগ, এই মনে হওয়ার আলো অন্ধকারের সঙ্গে, হাওয়া বাতাসের সঙ্গে মেলে কি, কি করে মিলবে ওই আলো অন্ধকার, যখন তুমি আবিষ্কার করলে …।

সে এক তুমুল ভয়-ভয়, ছম-ছম। ক্রমে চোখ জ্বালা। অতঃপর গড়িয়ে নামা জল। চোখ থেকে। তিন চাক্কার গাড়ি। মুর্গীখাঁচা গাড়ি। ইস্কুল ভ্যান শব্দবন্ধ ওই খাঁচা সওয়ারদের তো ছিলই না জানা, তাদের বাপ-মা’রা জানলেও, তার ব্যবহার তখনো নয় প্রসিদ্ধ। সাতটা নাকি সাড়ে সাতটায় এই মুর্গীগাড়ি হানা দিতো? ক্রিং ক্রিং বাজাতো তরজা বেড়ার উঠান-গেটের বাইরে। এই ক্রিং-ক্রিং এর আগে অব্দি এক রকম। হয়তো মনকে এক রকম বুঝিয়ে ফেলাও যেতো, যে, যাব। কি আর এমন হয়? হবে? কালও তো গেছি। এসেওছি ফিরে। এই মুর্গীখাঁচাতেই এসেছি। তাহলে? তাহলে আর কি? আজই বা …। কিন্তু যে মুহুর্তে ওই ক্রিং ক্রিং, সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত প্রতিরোধ চৌচির। তথাপি জ্বালা-চোখের অন্দরে জল বন্দি রেখে অকুতোভয় আগুয়ান হওয়া। মা কিংবা তুতুপিসী আসে। গেট অব্দি। মুর্গীগাড়ি’র পাইলট ডাইভার কাকু, বাদল, তার খোলামেলা ককপিট থেকে নেমে এসে খাঁচাদোর কিংবা খাঁচাডোর খুলে দেয়। হাতের থেকে জল বোতল আর বই বাক্স নিয়ে হেল্প দেয় আরোহনে। আরোহন অন্তে ফিরিয়ে দেয়। দেয় খাঁচাডোর বাইর থেকে ছিটকানি মেরে। খালিপায়ে হেঁটে উঠে যায় আবার ককপিটে। আবার ক্রিং ক্রিং। প্যাডেল ঘোরে। মুর্গীগাড়ি চলে। প্রথমেই মুছে যায় বাসা-গেট। এরপরে জানালা। জানালা গুলি। তখনো চোখ জ্বালা জ্বালা। এরপরে বিভুকাকুদের বাসা দেখা-সীমার বাইরে যাওয়ামাত্রই জ্বালা থেকে জল। জল ঝরে। এই জলের আবডালে ঢেকে যায় বেশ কিছু বাঁক, বেশ কিছু পাড়া, রাস্তা। আসে দাস ট্রডিং। কারখানা। এখানে এসে, ক্রমে, চোখের জল শুকায়। না শুকালেও শুকিয়ে নিতে হয়। মুছে নিতে হয়। ছড়ানো কারখানাবাড়ির ছবি, মন-চোখে, এখনো আন্দাইর আন্ধাইর, কালো কালো। প্রাসাদ তোরণহেন হলেও “দাস ট্রেডিং” খোদাই করা বিরাট গেট টি মনে পড়ায় মা’র পড়ে শোনানো ফেয়ারী টেলস্‌ বই এর এক গেটের ছবি যে গেটের অন্দরে দানবের বাস বসত। অথচ ওই হাঁ-করা রাক্ষস-মুখ থেকেই বার হয়ে আসে রোদ। কোনো কোনো বিকালে ওঠা রোদ – বাসার ওই পাড়ে যে খাল, তার ওই ধারে যে বাঁশঝাড় আর বিরাট বিরাট গাছের উঁচা উঁচা মাথাগুলি, তাদেরো উপরে, মেঘ, শাদা শাদা। তাদের গায়ে কখনো কখনো এমন রোদ সোনালী রোদ, ওঠে। ওই রোদ মাথায় নিয়ে, চুলে নিয়ে উঠে আসে “দাস ট্রেডিং এর মেয়ে”। তার নাম সোনালী। তার চুল সত্যই সোনালী। কিন্তু তাকে দাস ট্রেডিং এর মেয়ে” বলে ডাকবার রীতি করেছে অর্জুন। অর্জুন উঁচু কেলাসে। এইবার মুর্গীগাড়ি যাবে রেল গেট প্পার হয়ে। তুলবে অর্জুন আর নবলকিশোর কে। এর পরে দেবু উঠবে। এরপরে …। চোখ শুকিয়ে উঠবে আস্তে আস্তে। আরম্ভ হবে হৈ হল্লা। বাদল, পাইলট কাকু, চালাতে চালাতে ঘাড় ঘুড়িয়ে ধমক দেবে “হাল্লা না, হাল্লা না কইলাম”। তথাপি কোনো কোনো দিন হাল্লা মাত্রা ছাড়ালে “দাঁড়াও, ইসকুল অ গিয়া লই। পেন্‌জিপাল মেডামো রে নাম দিমু হক্কলের”। পেন্‌জিপাল মেডাম – কানে আসে সুভদ্র’র। কানেই আসে। এক কান দিয়ে এসে আরেক কান দিয়ে বার হয়ে যেতে যেতেও যায়না। হাল্লাগুল্লা’র ভিতরে ভিতরে শোনে “শাম্পু দিয়া চুল ফুলানি, হাতকাটা ব্লাউজ। অসইভ্যের মতো আঙ্গুল তুলে কথা বলে। আমাদের কলেজেই ত ছিল। দুই তিন বচ্ছরের মাত্র সিনিয়ার। মাইগ্য, এখন কি ফাট্‌”। তুতুপিসীর বক্তব্য। সুভদ্র’র শুনবার কথা নয় এটা। বলাও হয়েছিল আফরকে। “বুচ্ছস নি বড়দা”। বলা হয়েছিল সুভদ্র’র বাবাকে। টিফিনবাক্স না নিয়ে যাওয়া কোনো দিনে তুতু পিসী গিয়েছিল টিফিন বাক্স নিয়ে। দেখা করতে হয়েছিল পেন্‌জিপাল মেডামের সঙ্গে। তারই অভিজ্ঞতার কথা। কথাটার জামাকাপড় থেকে ‘শাম্পু’ শব্দটা, তার নিজের শাম্পু করবার অভিজ্ঞতার কাঁদাকাটার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেঁথে গেলো মনে। পেন্‌জিপাল মেডাম কে প্রথমবার দেখেই না-পসন্দ। তার সঙ্গে এই “শাম্পু” “চুল ফুলানো”। যদিও অন্য হাজার কথার মতোই পাইলট কাকু বলেছে, বলে থাকে “পেন্‌জিপাল মেডামো রে নাম দিমু হক্কলের” বাক্যটি, তথাপি ‘পেন্‌জিপাল মেডাম’ যায়না চট করে মছে, মন থেকে।

এবারে দেখা যায় সিনেমা হল। ‘চিত্রবানী’। এবার আবার পলকের বুক কাঁপা। ‘চিত্রবানী’ মানেই ইস্কুল। প্রায় মুখামুখি। “প্রান্তিক কিন্ডারগার্টেন স্কুল”। শহরের একমাত্র “ইংলিশ মিডিয়াম”। যারা কমিটিতে, বোর্ডে – সবাই, সব্বাই হাই এডুকেটেট। মাণিক সাহা বলেছে। বাবাকে। বাজারে একদিন। তার ছেলেও যায়। ওই ইস্কুলেই যাওয়াতে হবে সুভদ্রকে। ‘কমিটি’ শব্দটি কোনো ছবি আনেনি। কিন্তু ‘বোর্ড’ শব্দ এনেছে। “বোর্ডে” সবাই, সব্বাই হাই এডুকেটেট। – কিন্তু …। নাহ, বোর্ডে সবচে’ বেশী সময় যাকে দেখে সুভদ্র, তাকে তো “হাইলি এডুকেটেট” হেন কোন অজানা জন্তুর মতো মনে হয়না। তাহলে? “হাইলি এডুকেটেট” কথাটার মানে জিজ্ঞাসা করে নিতে হবে। প্রায়ই ভাবে। বাবাকে? নাহহ। এতে কেমন যেন বিপদসম্ভাবনা টের পায় সুভদ্র। এর চে মা কিংবা তুতুপিসী সেফ। কিন্তু সমস্যা হলো যখন জিজ্ঞেস করবার কথা মনে আসে তখন না’ত মা, না তুতুপিসী – আছে আশেপাশে। আর যখন তারা আশেপাশে, তখন আরো হাজারো বাজে কথার তলায় এই জরুরী কথাটাই যায় চাপা পড়ে। অতএব একদিন, যাকে দেখে মোটেই “টাইগার”, “লায়ন” বা ““হাইলি এডুকেটেট” এর মতো হিংস্র কিছু মনে হয় না, অথচ, যে থাকে বেশীরভাগ সময়েই, বোর্ডে, তাকেই জিগিয়ে ফেল্লো কথাটা সুভদ্র।

মিঠুমিস হাসলেন। “তোদের ভুলবো কি’রে? কতো আর বড় হয়েছিস? দাড়ি গোঁফ ও তো গজায় নি ভালো করে। ইঞ্জিনীয়ারিং কোন ইয়ার?” উঠলেন চেয়ার ছেড়ে। ওঠা? নাকি উত্থান? কেরোসিন কাঠের চেয়ার-হাতলে ভর করে, পায়ের পাতায় বিকল করে মাধ্যাকর্ষন উঠে এলো নাভি। শাড়ি’র গিঁট নাভির খানিক তলায়। সেই প্রান্তিক কিন্ডারগার্টেন দিনের মতোই। প্রান্তিক কিন্ডারগার্টেন  আর সেই দিনটি – অন্তত দেড় দশকের দূরত্ব। তবে কি সেই প্রান্তিক কিন্ডারগার্টেন দিন থেকেউ উঠে আসছেন মিঠু মিস? তাই এই ওঠা, এক উত্থান? বসে পড়ে সুভদ্র। মেঝেতে বসে পড়ে। আর বসেই আশ্চর্য হয়ে দেখে নাভিটি। নাভিটি এগিয়ে এসেছে। আসছে। থেমে গিয়েছে তার সামনে। “That gently, o'er a perfumed sea, The weary, way-worn wanderer bore,  To his own native shore.” – কি ওই নাভি? কোনটি? perfumed sea? না’কি সুভদ্র’র own native shore? ওই নাভিতে, নাভির অতলে, নাভির থেকে সামান্য নিচে – অরণ্য? ঝোপঝাড় নাকি সে’ও এক ঘাসহীন, ঝোপঝাড় ছাড়া বেলাভূমি? Shore? এর থেকে আরেকটু নিচে নামলেই … “ঠিক আছে। অনেক পড়া হয়েছে। এখন খেলা হবে। গান খেলা। খেলা গান”। গোল আকারের দোতলা দালানটির নাম “রমণীমোহন ইন্সটিটিউট” ।  নিচু দেওয়ালে ঘেরা চত্ত্বরে, গেটের এক ধারে দুটি গাছ। কি যেন ফুল ফোটে। ফুলের মোটা, পিচ্ছিল পাঁপড়ি। ডগা লাল। গাঢ়। গোড়ার দিকে ক্রমে গোলাপী। একটি ফুটো। তার অন্দরে …। তার অন্দরেই সমবে কাচ্চাবাদের মূল মস্তির জিনিসটি। ফুলের বোঁটা। শুকিয়ে গেলে ঠিক লাটিমের মতো। একটা দেশলাই কাঁঠি গুঁজে দেওয়া শুধু। তবে সুভদ্র’র কপাল মন্দ। বোঁটা কুড়ালেও তার ভাগ্যে এখন, কখনো জোটেনি তেমন বোঁটা যা টেক্কা দিতে পারে রেল গেইটের দীপংকর লালা কিংবা নবলকিশোরের লাট্টুগুলিকে।  “দেখি, গিভ মি। আমাকে দে” বললেন মিঠু মিস। কাঁধের ঝোলা ব্যাগ দিলো সুভদ্র। দিলো? নাকি আপনি আশ্চর্য চলে গেলো ঝোলাটি? “দেখি, গিভ মি” – নুয়ে, লাটিম নিলেন মিঠু মিস। কানে আগুন লাগলো কি? কানে হাত দিলো সুভদ্র। কানে যা স্পর্শ করলো তা’কি? মিঠুমিসের …। চোখ বন্ধ করে সুভদ্র। কিন্তু কেন? চোখে তো কিছু …। মা নাকি তুতুপিসী বলেছিল? কেন বলেছিল? মনে নেই। বলাটিও মনে ছিলনা। কিন্তু উড়ে এলো। তখন। ওই মুহুর্তে। “মেয়েদের বুকের দিকে দেখতে নেই, হাত দিতে নেই…”। “সি, তোমার লাটিমও ঘুরছে … লাটিমকে ইংলিশে …”। লাটিম, ওই একবারই,প্রান্তিক কিন্ডারগার্টেন দিনে, ঘুরেছিল সুভদ্র’র। নবল-দীপঙ্করের মতোই বন্‌ বন্‌ ঘুরেছিল। লাটিম হাতে বোকা বোকা, একা একা, দুঃখ দুঃখ তার দাঁড়িয়ে থাকা তবে দেখেছিলেন মিঠু মিস? নিশ্চয় দেখেছিলেন। নিশ্চয় মায়া হয়েছিল। তুতুপিসীকে কথাটা বলেছিল। “হ্যাঁ, মিঠু, মিঠু তো আমাদের সঙ্গেই পড়তো। ওর বোধয় ফিলসফি ছিল। আরেকদিন গেলে দেখা করবো”। – মিঠুমিস্‌ও, পরে একদিন, বলেছিল “তোমার পিসী সীমা, তাইনা? বলো আমার কথা”। এখনও লাটিম ঘুরছে। ঘুরছে নাভিতে। কামাল হাসান আর রতি। ক্লাস সেভেনে, ইস্কুল পালিয়ে। এক দু’জে কে লিয়ে। লাটিম ঘুরছে। নাভি হচ্ছে শিহরিত। নাভির সামান্য নিচে যে গিঁট তা নড়ছে। যাচ্ছে আলগা হয়ে। “চল, এখন তো তোরা এডাল্টই, চা খেয়ে আসি”। উঠে দাঁড়িয়েছেন মিঠুমিস। রোগা না হলেও পাতলা, হাল্কা-পলকা, অনেকটা লম্বা, আর গায়ের রঙ – মেঘলা দিনে, ময়নাপাড়ার মাঠে যেতে যেতে গিয়েছে থমকে, আর “Thy hyacinth hair” … ইংরেজি পংক্তিগুলিই কেন যে মনে আসছে অনর্গল। তাহলে কি “বনলতা সেন” কবিতাটি ভুলে গেলো, ভুলেগেছে সুভদ্র? হাল্কা বেগুনীতে কেয়া-হেন ফুল আঁকা শাড়ি। কালো ব্লাউজ। কালো বলেই ভিতরের ব্রেসিয়ার যে শাদা তা …। 

একটি দিনের, একটি দিনের পেটের অন্দরে একটি রাস্তার, ঘাটের, পুকুরের, কোঠার – কোঠাটির অন্দরের আলোর, অন্ধকারের ছবি হয়না তুলিতে, হয়না কালিতে। হয়না কারণ না’ত আলো, না’ত অন্ধকার থাকে স্থির হয়ে। স্থির থাকে হয়তো আলো মাপবার যন্ত্রের, বাতাস মাপবার যন্ত্রের নিরিখে। ঠিক যেমন জ্যোতির্বিদের আকাশ। কিন্তু যে দেখে, কেবল দেখেই, তার নিরিখে? তুমি আঁকতে, তুমি লিখতে পারো একটি পলক। কিন্তু পরের পলকে এই ছবিই যে আমূল গেলো বদলে। আদতে তুমিই দিলে, তোমার দেখা দিয়েই, দিলে বদলে। নাহলে অনেকগুলি দিনের মধ্যে অনেক রোদের, অনেক বৃষ্টির, মেঘের, কুয়াশার সকাল, দিন, থাকলেও কেন সব দিনগুলিই সুভদ্রর মনে হয় মেঘলা নাহলে সদ্য বৃষ্টি হয়ে যাওয়া রঙ্গে আঁকা? আরম্ভ ক্লাসে মিঠুমিস। পরেও। মাঝখানে কোন এক ক্লাসে ভয়। “শাম্পু”, “ফুলানি চুল”, “হাতকাটা ব্লাউজ”। পেন্‌জিপাল মেডাম। ইনি নিশ্চিত “হাইলি এডুকেটেট”। কিন্তু “বোর্ড” এ তো যান না ইনি মিঠুমিসের মতো। বোর্ডে দান না। মজার মজার ছবিও আঁকেন না। তবে ইনি, হয়তো “হাইলি এডুকেটেট” কিন্তু “বোর্ড” নয়। এঁর আসার সঙ্গে সঙ্গে যে শ্যাম্পুর ঘ্রাণ, ঝাঁঝের মতো নাকে লাগতো সুভদ্র’র তা কি সত্য? সম্ভাবনা কম কারণ সুভদ্র’র নাক চিনতো তার মাথায় মা, বাবা কিংবা তুতুপিসী যে শাম্পু দিয়ে দিতো স্নান করিয়ে তারই ঝাঁঝ। তখন যুবতী পেন্‌জিপাল মেডামের শ্যাম্পু অবশ্যই তা ছিলনা। তথাপি পেন্‌জিপাল মেডাম ক্লাসঘরে ঢোকামাত্র যে শাম্পু-ঝাঁঝ টের পাওয়া যেতো, তা মিথ্যা নয়। তা মিথ্যা হলে, মিঠুমিসের চুলের ঘ্রাণ কিভাবে, এই মুহুর্তে, ফিরিয়ে আনছে ওই লাটিম-ধরা ফুলের গন্ধ? পেন্‌জিপাল মেডামের ক্লাসে সময় থেমে থাকে। এই ক্লাস আবার হয় দোতলায়। গোল আকারের দোতলা দালানটির নাম “রমণীমোহন ইন্সটিটিউট”। আদতে একটি প্রেক্ষাগৃহ। তারই নানান কোঠা, গ্রীনরুন, লাইটিং রুম, ব্যালকনি – ইত্যাদি ব্যবহার করে বসে ইস্কুল। তা’ও বসে। যদি না বসতো? যদি এই শহরে থাকতোই না ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, তাহলে? তাহলে মাণিক সাহা বলেছে, বদলী নিয়ে নিতো। তার বাবা নিতো কি? মনেহয় না। দিদিভাই বলে “ত’র বাবা গুয়াড়-গোবিন্দ”। সেক্ষেত্রে সুভদ্র’র জানাই হতো না “ইংলিশ মিডিয়াম” ইস্কুল। চেনাই হতোনা মিঠুকে। মিঠুমিস কে …। পেন্‌জিপাল মেডামের ক্লাস বসতো দোতলায়। দোতলার জানলা দিয়ে দেখা যায় গাছের মাথা। দেখা যায় ‘চিত্রবানী’ সিনেমাত ছাত। ছাতে কাক বসলো উড়ে এসে। আরেক কাক ছাত থেকে লাটুম্ফুলের গাছে। উঁচু ডালে। “ডার্টি হ্যান্ডরাইটিং। সোবড্র, ইউ আর ফ্রম এ প্রবেসার ফেমিলি”। উফ্‌। বেতের বদলে পেন্সিল। লক্ষ্য আঙ্গুলের গোঁড়া, গাঁট। “গেট আউট অফ দ্য ক্লাস”। এটা মন্দ লাগেনা সুভদ্র’র। “গেট আউট” হলে ক্লাসের কিনারের চিলিতে বারান্দায়। আর বারান্দার রেলিং ডিঙ্গাতে পারলেই থাক থাক সিঁড়ি উঠে গেছে “রমণীমোহন ইন্সটিটিউট” এর ছাতে …। পেছনের দিক থেকে কি করে যেন ছাতে ওঠে নবলকিশোর, দীপংকর লালা। ওদের সঙ্গে ওঠে মিষ্টিদি। শানুদাসের মেয়ে মিষ্টিদি। শানুদাসও ছিল প্রান্তিক কিণ্ডারগার্টেনের পক্ষে। কি কারনে একবার বাড়ি এসেছিল শানুদাস। “ইউ টুক রাইট ডিসিসান। প্রান্তিক ইজ্‌ দ্য স্কুল। অল এডুকেটেট। হাই-লি”। নবলকিশোর, দীপংকর লালা’দের সঙ্গে ছাতে উঠবার পরে একদিন শানুদাস এসেছিল ইস্কুলে। এসেছিল আরো কয়েকজন মোটাগাঁট্টা লোক। দেবু বলেছিল “বোর্ড মেম্বার্স”, ওর মা চেনে এদের। পরে একদিন জানান দিলো শানুদাস আর বোর্ড মেম্বাররা এসেছিল নবলকিশোর আর দীপংকর লালা’র বাবাকে ‘থ্রেট’ করতে। সোনালীকে বলেছিল দেবু “চল একদিন তোকে ছাতে নিয়ে যাব”। সেই ছাতে, সুভদ্র উঠে গেলো অবলীলায়। পানিসমেন্ট পেয়ে, বারান্দা থেকে বেয়ে বেয়ে। 

বৃষ্টি হয়ে গেছে সামান্য আগেই। ভেজা ছাত। সোজা তাকালে দেখা যায় নদী। কুশিয়ারা। কুশিয়ারা ন্দীর পাড়ে অন্য দেশ। আরেক দেশ। বাংলাদেশ। সেখানে নাকি আছে সিলেট। আছে? নাকি ছিল? ঠিক করতে পারেনা সুভদ্র। সে থাকুক আর না’ই থাকুক এখন, কখনো ছিল, না হলে তার বাবার জন্ম কি করে হবে সিলেটে? তাদের নাকি বাড়িও ছিল সিলেটে। ইচ্ছা হয়, হঠাৎই, সিলেটে চলে যেতে। সিলেটে নিশ্চয় সকাল সকাল মুর্গীগাড়ি আসেনা ক্রিং ক্রিং ঘন্টি বাজিয়ে। সিলেটে নিশ্চয় …। কিন্তু সিলেটে কি মিঠু মিস …। পরের ক্লাস গিয়েছে আরম্ভ হয়ে। ক্লাস থেকে বার হয়ে যাওয়ার সময় পেন্‌জিপাল মেডাম লক্ষই করেনি সুভদ্র’র গর হাজিরা। লক্ষ্য করলো মিঠু মিস। আন্দাজও করে নিলো কি ঘটেছে, কি ঘটতে পারে। সিলেটের কথা ভাবায় মশগুল সুভদ্র’র কানে এলো কিচিরমিচির। পাখির না। মানুষের। “মিস, আমি যাই”, “না মিস আমি” – চিলতে বারান্দায় মিঠুমিসকে ঘিরে দেবু,টুলু,সোনালী,রাজু। সক্কলেই যেতে চায় সুভদ্রকে ছাত থেকে ক্লাসে ফিরাতে। “সুভদ্র …”। 

“আমাদের অফিসে ক্যান্টিন একটা আছে ঠিকই। কিন্তু চা খুব বাজে।”

অন্ধকার ঘুপচি কোঠা থেকে বার হয়ে তারা আলোয় এলো। সুভদ্র আর মিঠুমিস।

চারদিকে বাজার। সেটেলমেন্ট বাজার। সেটেলমেন্ট রোড গজিয়েছে এই বাজার আর জমিজমার হিসাবনিকাশ অফিস, “সেটেলমেন্ট অফিস” কে ঘিরে। এই তল্লাট এই আট আনা কিংবা পাঁচ সিকা মফস্বলেরও শহরতলী। রাস্তার এক দিক উঁচু। সরল খাঁ টিলা উঠে গিয়েছে কিছুদূর গিয়ে। আরেকধার নিচু। জল জমে, জল ওঠে প্রত্যেক বর্ষায়। বাজার দুদিকেই ছড়ানো। ঢালু দিকে সেটেলমেট অসিফের মূল বাড়ি। বর্ধিত অংশ, আমিনালির পুরনো ডেরা ভাড়া নিয়ে। মিঠুমিস বসে ওই হালে বর্ধিত টুকরোতেই।

“না রে, এটা পার্মানেন্ট জব নয়”। 

মুখামুখি বসতে বসতে এ’ও লক্ষ্য করে, যে, “নায়ক” সিনেমার শর্মিলা ঠাকুরের মতো, মিঠু মিসও কলম গুঁজে রাখে ব্রাউজে। এই কলম ছুঁইয়ে থাকে মিঠুমিসের …।

“এখানে আমি আসি। এখানে চা’ও ভালো। মানুষটাও …”।

“আমরাও আসি মিস। এই দোকানে আমাদের আড্ডা বসে। জানো মিস, এই যে রশীদ, ওর বাবা আসেন সন্ধ্যাবেলা …”।

“ঘন, পাকা চুল, খাড়া নাক – বয়স্ক ভদ্রলোক?”

“হ্যাঁ। উনি দারুন সব গল্প বলেন। আজব সন অভিজ্ঞতা তাঁর”।

চাকরির, পার্মানেন্ট-টেম্পোরারির, ইঞ্জিনীয়ারিং এর ইয়ার-সেমেস্টারের থেকে বার হ’তে চেয়ে …। বার হ’তে চায় সুভদ্র একা’ই নাকি মিঠুমিস’ও? কথাটা বলে ফেলেছে কথার নিয়মে হয়তো। 

চা দিতে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে রশীদের ভাই রোনক। “আরে, ভদ্র দেখি। তুমি মেডাম রে কেমনে…”।

“আমি তান স্টুডেন্ট …”।

“দুর, কিসের কি। সেই কোন নার্সারীতে না ওয়ানে”। – মিঠু। মিঠুমিস।

“না, তে’ও। টিচার হইলে ত টিচারউ। আমরা তান কাসে পড়িসি না। কিন্তু মেডাম যে টিচার টের পাই”। – রোনক।

“আমি তোর লেখা পড়েছি। তখন ভেবেওছি, এটা কি আমাদের সুভদ্র …? সুন্দর লিখিস তুই”।

"Que sera, sera” – সিঙ এভরিবডি সিং।Que sera, sera মানে  Whatever will be, will be মানে যা হবার হবে, দেখা যাবে। Que sera, sera, The future's not ours to see… কাল যা হবার হবে, সেসব নিয়ে বোকা রা ভাবুক – সিঙ, এভ্‌রিবডি সিঙ্গ”। সুভদ্র’র ছাতে উঠে যাওয়া আর নামিয়ে আনার ঘটনায় নিশ্চয় নিজেও বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল মিঠুমিস। যখন ডেকেছিল “সুভদ্র” – ওই ডাকে একটা উৎকণ্ঠা ছিল। ছিল গলা, জিহ্বা শুকিয়ে যাওয়া। হয়তো ওই উৎকণ্ঠা থেকে নিজেকে বার করে আনতেই গান। গানের আয়োজন। আগে “উই শ্যাল ওভার কাম” হয়েছে কয়েকদিন। কিন্তু এই গান সেদিনই প্রথম। 

“সীমা কেমন আছে, সীমা? তোর পিসী । আমার ক্লাস-মেট ছিল…”।

“তুতুপিসী নাগাল্যান্ডে থাকে। ওর মেয়ে এখন পড়ে নার্সারী ক্লাসে। বাপ্‌রে কি কথা বলে …”।

“ওহ, বর নাগাল্যান্ডে বুঝি…”।

“হ্যাঁ”। মাথা নাড়ে সুভদ্র। টের পায় প্রথম শীতের দুপুর-দুপুর রোদ ঢোকা সত্ত্বেও এই চা-কোঠাটি নাকি এই দুটি নিচু বেঞ্চি আর তাদের মাঝখানের নিচু ডেস্কে ঝাঁপ দিলো এক টুকরো অন্ধকার? অন্ধকার নাকি এক টুকরা মরিন? ‘বর’ শব্দটি কি নিয়ে এলো ওই মলিন? “অতি বড় ঘরনী না পায় ঘর আর অতি বড় সুন্দরী না পায় বর” চিবিয়ে চিবিয়ে বল্লো কাকা। কাকা মানে বাবার সৎভাই। যে অর্থে তুতুপিসীও বাবার সৎবোন। সৎ-অসতের মানে তখন যতোটা স্পষ্ট তাতে এই কাকা বা তুতুপিসী কে ‘সৎ’ বলে ভাবতে অসুবিধা ছিলনা। কিন্তু বাবার একই মা’র পেটের যে ‘জেঠু’ – জেঠু কি ‘অসৎ’ তবে? অসৎ-ভাই? অসৎ দাদা বাবার? অথচ কেটু’কে তো অসৎ বলে মনেই হয়না কখনো। যখনই আসে জেঠু, সুভদ্র আর ছোটোভাই সোম কে ছবি এঁকে দেয়। শেখায় আঁকা। বেড়াতে নিয়ে যায় লঙ্গাই ব্রীজে। গান করে। বাঁশি বাজায় রাত্রিবেলা বারন্দায় বসে। তাহলে? সৎ-অসৎ ভাইবোনের, কাকা-জ্যাঠা-পিসী-মাসীর এই প্রশ্নের উত্তরও নিশ্চয় আছে মিঠুমিসের কাছে। কিন্তু জিগিয়ে নেওয়ার সাহস …। “এটা তোর বন্ধু মিঠু না?” সৎকাকা বল্লো। সৎকাকা মস্ত মানুষ। বিরাট বড়লোক। বোম্বাই থাকে। সেখান থেকে এরোপ্লেনে চেপে আসে শিলচর। শিলচর থেকে শেয়ার ট্যাক্সিতে – নিজেই বলেছে “না, বাস ট্রেনে আসার ঝক্কি পোষায় না” – আসে করিমগঞ্জ। আনে এরোপ্লেনের টিকিট। এরোপ্লেনে দেওয়া চকলেট। “বুঝলায় ত, বাপ ঠাকুর্দার আশির্বাদ থাকলে, কেউ আটকাইত পারেনা। আর আমি ত … ইয়ে আমরা ত মহাপুরুষের বংশধর”। জেঠু, অসৎ-জেঠু একবার ইংরেজিতে … হ্যাঁ … সেই ইংরেজি কথাটাও – বাস্টা … বাস্টার … অর্থ নিশ্চয় জানে মিঠু মিস। কি তুমুল ঝামেলা হয়েছিল সেদিন বাড়িতে। “না, আর আসবোনা কক্ষনো আসবোনা। কাঁড়ি কাঁড়ি, হাজার হাজার টাকা খরচ করে, সেই কোন বোম্বে থেকে, ছুটি বাঁচিয়ে, সব্বার জন্য কিছু-মিছু কিনে নিয়ে আমি আসি। কেন আসি? এসব শুনতে? বাস্টার? আমি বাস্টার? … এই লল্লাম। একবস্ত্রে চললাম। এই বাড়ির জলও আর দেবোনা মুখে…”। ভীত সুভদ্র আর সোম দেখেছিল তুতুপিসী আর মা কাঁদছে। “চল সীমা, চল, তুই আমার সঙ্গে চল। বোম্বাই থাকবি। তোর বৌদি তো রোজ বলে…”। এবার চোখে জল এসে পড়ে সুভদ্র আর সোমেরও। তুতুপিসী চলে যাবে? তাহলে …। অন্তিমে তুতুপিসী যায়নি। সৎকাকা গিয়েছিল তবে দিনটা কোথাও কাটিয়ে রাত্রে আবার এসেছিল ঘুরে। সৎকাকার আসাটাও সুভদ্র’র কাম্য কেননা সৎকাকা এলে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যায় তুতুপিসীকে। লগ-ধরে চলে যায় সুভদ্রও। সেদিনও ম্যাটিনী সিনেমা, শ্রীদুর্গা হল্‌ এ, দেখে বাইরে এসেছে তারা। তখনই সৎকাকা বল্লো তুতুপিসীকেঃ  “এটা তোর বন্ধু মিঠু না?” ‘মিঠু’ শব্দ সুভদ্রকে চাবুক মেরে ফিরিয়ে আনে ‘ঘোষ ডেয়ারী” দেওয়ালে আটকানো সিনেমা পোস্টার থেকে। 

স্নধ্যা নেমেছে মফস্বলে। শীত-শীত সন্ধ্যা। এই রোড, ‘সন্তরবাজার রোড” মফস্বলের হৃৎপিন্ড বললে হৃৎপিন্ড, জান্‌ বললে জান্‌। এখানেই আছে দুই-দুইটি সিনেমা হল্‌। শ্রীরাধা-শ্রীদুর্গা – মুখামুখি। এই মুখামুখির উল্টোদিকেই কলেজ। কাছাকাছি দুটি বই-দোকান – ‘দি স্টুন্ডেন্টস্‌ লাইব্রেরী”, “বীনা লাইব্রেরী”। ওই দোকানগুলির তাকে আছে “গোরস্থানে সাবধান”, “কালনাগিনী বনাম দস্যু মোহন”, “আঙ্কল টম্‌স্‌ কেবিন হ্যারিয়েট বিচার স্টোই” …। সামান্য এগিয়ে, সন্তরবাজারের কাছে এলে আছে “সংবাদ বিচিত্রা” – সেখানে আছে, সেখানে আসে নতুন নতুন অরণ্যদেব, ম্যানড্রেক, শুকতারা, খেলার আসর। আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিষ্টান্ন ভান্ডার, আছে সব পাওয়া যায় – বক্সী’র দোকান। আছে শ্রীরামকৃষ্ণ বস্ত্রালয়, তাতে আছে ব্যাগী শার্ট। আর্‌, নবলকিশোর-দীপংকর লালা একদিন এসেছিল ব্যাগী শার্ট পড়ে ইস্কুলে। কিন্তু সেই পেন্‌জিপাল মেডাম – “শাম্পু দিয়া চুল ফুলানি, হাতকাটা ব্লাউজ। অসইভ্যের মতো আঙ্গুল তুলে কথা বলে” পেন্‌জিপাল মেডাম ওদের ডেকে কিছু বলেছিল। পানিশমেন্ট দিয়েছিল কি? – এরপরে ওরাও আর পড়ে আসেনি ব্যাগী শার্ট। আর ব্যাগীশার্টের কথা বাবার কাছে তোলা …। নাহ্‌। 

সন্ধ্যা নামতেই সারা শহর উঠে আসে, আসতে চায় এই সন্তরবাজার রোডে। বাবা বলে “আড্ডা দিতে আসে। আড্ডা দিতে দিতেই সব শেষ করে দিলো এরা”। আড্ডা দিতে আসে, সিনেমা দেখতে আসে, বেড়াতে আসে, দোকানে খেতে আসে, জামাকাপড় কিনতে আসে। আসে। সবাই আসে, আসতে চায়, সন্ধ্যা হ’তেই এই সন্তরবাজার রোডে। সৎকাকার কথা থেকে ‘মিঠু’ শব্দটিকে লাইফ নিয়ে সুভদ্র দেখলো মিঠুমিস। ওইপাড়ের ফুটপাথে মিঠু মিস্‌। সঙ্গে…। আরে বাহ্‌। সঙ্গে আশুকাকু। আশুকাকু। মাইকে ‘রিলে করে’ – ইংলিশে। একেবারে রেডিওতে চালানো রিলে’র মতো – বাবা যা শুনতে এরিয়েল টাঙ্গায়, ঐ রিলে’র মতোই রিলে করে আশুকাকু। “ইন দিস ম্যাট্‌চ ইন্ডিয়া ক্লাব, গ্রেট ইন্ডিয়া ক্লাব অব দ্য গ্রেট শিলচার সিটি ইস গোয়িং টু ফেস্‌ দ্য মোস্ট এন্সিয়েন্ট ক্লাব অফ আওয়ার গুড ওল্ড কারিমগাঞ্জ – দ্য ব্লাড মাউথ”। রিলে ছড়িয়ে যায় মাইকে মাইকে। ফেরাপথে, মুর্গীগাড়ির অন্দরেও ঢুকেপড়ে আশুকাকু। ঢুকেপড়ে রিলে। দীপংকর লালা বুঝিয়ে দেয় “ক্লাব লিগ চলছে। এখন আশু আংকল খুব বিজি থাকে।” – সেই আশু আংকল, সেই আশুকাকু যে মিঠুমিসের বন্ধু হবে, মিঠুমিসেরই বন্ধু হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। এই প্রথম মিঠুমিস কে দেখা সুভদ্র’র শাড়িছাড়া। অন্য পোষাকে। সালোয়ার কামিজে মিঠুমিস্‌কে …।

‘সিন্ডারেলা’ কথাটির সেদিন মনে আসবার রহস্য নিয়ে ভেবেছে সুভদ্র। পরে। পরে, যখন ফ্রয়েড,ইয়ুং, পাভলভ শিখেছে, পড়েছে। জেনেছে সাব্‌, আন্‌ – দুই কনশাস। কেন ওই শিশুমনে এসছিল ‘সিন্ডারেলা’ কথাটাই? এর কারণ কি তখন মন আর কোনো বিদেশী নায়িকা-নাম জানতোনা? হ’তে পারে। কিন্তু তাহলেও স্নোহোয়াইট মনে আসতে পারতো, মনে আসতে পারতো ‘কুঁচবরণ কইন্যা তার মেঘবরণ কেশ’...। শিশু অবচেতন ঠিক টের পেয়েছিল মিঠুমিসের আবহে এমন একটা কিছু রয়েছে যা নিত্যদিনের নয়, চেনা নয়। চেনা নয় রোজকার কথার মতো, ভাষার মতো। তাই মন যায়নি বাংলা ভাষার দিকে। উড়ে গেছে বিদেশী ভাষার, তার অন্দরের অচেনার দিকে। তাই রূপকথার বললে এসেছে ফেয়ারী টেল। আর ফেয়ারী টেল থেকে … কেন? সিন্ডারেলাই কেন? নয়ই কেন সিন্ডারেলা? যদিও বোঝা যাচ্ছে মিঠু এখনো অনুঢ়া …। ‘অনুঢ়া’ ? ভাবার ভিতরে আরো একটি ভাবনা জাগে। ‘বিয়া হয়নি’, ‘আইবুড়ি’ – কেন নয়? কেন ‘অনুঢ়া’? কেননা এখনো মিঠুমিস নিত্যদিনের ব্যবহার্যের বাইরে। অন্তত সুভদ্র’র। যারা তাকে ব্যবহার করেছে – কখনো ‘তন্তুশ্রী’র মেসবাড়িতে, ‘অন্নপূর্ণা হুটেল কম রেস্টুরেন্ট’ এর ভিতর কোঠায় – তাদের কথা আলাদা। কিন্তু সুভদ্র’র কাছে, এখনো, মিঠুমিস, নিত্য ব্যবহারের  ‘বিয়া হয়নি’, ‘আইবুড়ি’ – ইত্যাদি শব্দবন্ধ নয়। ‘অনুঢ়া’ শব্দের অপরিচয় তার প্রমাণ। … ‘সিন্ডারেলা’ নয়ই কেন? হতেই পারে মিঠুমিস এখনো ‘অনুঢ়া’, ‘সেটেলমেন্ট অফিস’ এ ক্যাজুয়েল করণিক তথাপি কেজানে, এই সময়ের তার ফেলে আসা, হারিয়ে আসা একপাটি জুতো নিয়ে ঘরে ঘরে, বাজারে বাজারে, মেহফিলে মেহফিলে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেনা কোনো রাজকুমার? “অতি বড় ঘরনী না পায় ঘর আর অতি বড় সুন্দরী না পায় বর” চিবিয়ে চিবিয়ে বল্লো সৎকাকা। “এখন বুঝি আশুকে পাকড়েছে? আগের বার তো এসে শুনলাম লটঘট চলছে রতন উকিলের সঙ্গে”...। সামান্য থেমে “এর আগে তো আমাদের স্বপনের সঙ্গে”...।

     প্রায় সন্ধ্যায় ইস্কুলের খাতাগুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতো মা। মাঝে মাঝে ডাক পরতো সুভদ্ররও।

‘নাইনের সঙ্গে সেভেন প্লাস্‌ করলে কতো হয়?’ 

আঙ্গুলে গুনেটুনে, অবশেষে ‘সিক্সটিন্‌’ ।

‘ কিন্তু খাতায় ত লিখেছ ফিফ্‌টিন্‌ । এই ম্যাথ্‌ গুলো রাফ্‌ খাতায় আবার করো বসে বসে ’ ।

     একদিন মা যখন বল্লো ‘ কাল ম্যাথ্‌ খাতা স্কুলে নিয়ে যেতে হবেনা ...’।

 ‘আরে পেনজিবাল মিস্‌ বক্‌বে যে ...’।

 ‘ আমি দুটো নতুন খাতা এনেছি তোমার জন্য, পুরোনো গুলো আমার কাছে থাক্‌...’ ।

নতুন খাতা পাওয়ার আহ্লাদে মশগুল সুভদ্র আর কিছু ভাবলোনা। ভাববার হেতুও ছিলনা। ছিলনা বয়সও।

     ইস্কুলের সামনের দিকটা গোল মতন। গেট্‌ খুলে ঢুকেই দুটো বড় বড় গাছ । এতে যে ফুল ফোটে তা দিয়ে লাটিম বানায় বাচ্চারা। 

পরের দিন, ক্লাস বসেছে দোতলায়। পেনজিবাল ম্যাডামের ক্লাস।

হঠাৎই মা। সুভদ্র’র ক্লাসকোঠার দরজায়। মা, কিন্তু কেমন যেন অচেনা মা। 

পেনজিবাল ম্যাডামের চোখ পড়লো। কপালে ভাঁজ পড়লো। “ইয়েস”।

“আই হ্যাভ কাম টু মিট ইউ। আই উইল ওয়েট ফর ইয়োর ক্লাস …”।

মা পারে! আশ্চর্য! মা’ও পারে! মিঠুমিসের মতন না হলেও মা’ও পারে ইংরেজি বলতে! 

কেমন ঝিম ঝিম করে ওঠে মাথা, সুভদ্র’র।

কিন্তু মা কেন এসেছে ইস্কুলে?

পেনজিবাল ম্যাডামের চোখ পলকে সুভদ্রকে ছুঁয়ে আবার মা’তে।

“থ্যাংকু”।

 এই ক্লাস ফুরালে টিফিন। কিন্তু সেদিন তেমন হাল্লাগুল্লার দিকে যেত্যে পারলো না সুভদ্র। দেখলো পেনজিবাল ম্যাডামের কোঠায় মা। মা’র হাতে সুভদ্র’র ম্যাথ খাতা। দেখলো ওই কোঠায় আছেন মিঠুমিস ও।

ঘন্টি বাজলো। জানা গেলো টিফিন আওয়ার শেষ। অগত্যা ফিরতে হলো ক্লাশ ঘরে। কিন্তু মন পড়ে রইলো কখন মা’র কথা শেষ হবে পেনজিবাল ম্যাডামের সঙ্গে ।  একটু পরেই ক্লাশের দরজায় দেখা গেলো মেট্রন মাসীকে। এ তো শুভলক্ষন। মা’বাবা এসে বাচ্চাকে নিতে চাইলে ক্লাশ ঘরে এসে সে খবর জানিয়ে যাওয়ার কাজ মেট্রন মাসীর। মেট্রন মাসী এসে কিছু বল্লো মিসকে। অপর্ণা মিস।  অপর্ণামিস বল্লো “ইয়োর্‌ মম্‌ ইজ কলিং ইউ ।”  বই খাতা বাক্সে ভরে এক দৌড়ে সুভদ্র চলে এলো। মা বল্লো “চলো, আজ ছুটি করিয়ে নিলাম। বাড়ি যাই”। রিক্সা দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক গল্প হলো । মা’কে প্রশ্ন করলো সুভদ্র  ‘আজ ইস্কুলে এলে কেন?’ মা বল্লো ‘এইতো, তোকে নিয়ে যেতে ...’

     পরদিন থেকে ক্লাশে মিসের, মিসদের ব্যবহারে দেখা গেলো বিশেষ পরিবর্তন। আগে যে সমস্ত অপরাধে ক্ষমা পাওয়া গেছে, এমন কি পেনজিবাল ম্যাডামের কাছেও, সে সবের জন্যও শাস্তি জুটতে লাগলো  অন্য মিস দের হাতেও। সুভদ্রর। শুধু সুভদ্ররই।  বাড়ি যাওয়ার আগে, প্রতিদিন, সমস্ত খাতা মিঠুমিস কে দেখিয়ে যাওয়ার নিয়ম হলো সুভদ্র’র জন্য। এই নিয়মটি হওয়ানোর জন্য মা’কে নাকি পেনজিবাল ম্যাডাম কে থ্যাংক্স দেবে – স্থির করতে পারলোনা সুভদ্র।

কয়েকদিন, কয়েকদিন নাকি কয়েকমাস? হয়তো বচ্ছর খানিক হবে। হিসাব করে বার করে নেওয়াই যায়, যায় মা’কে জিগিয়ে নেওয়া। তবে ইচ্ছা হয়না হিসাবনিকাশে যেতে। এক হিসাব থেকে উঠে আসে, উঠে আসবে অন্য হিসাব। হিসাবের খাতায় আসবে কেন মিঠু’র ‘রখনো বিয়া হইলো না’, আসবে “অতি বড় ঘরনী না পায় ঘর আর অতি বড় সুন্দরী না পায় বর”, আসবে ‘ক্যাজুয়েল’ আর ‘পার্মানেণ্ট’। আসবে না কি পেরোনো তিন সেমেস্টারে, তার নিজের, সুভদ্র’র রেখে আসা দুটি করে – তিন দু’য়ে ছয়টি – ব্যাক পাওয়া পেপার? – আসবে। আসতেই পারে। অতএব সেদিকে যায়না সুভদ্র। একদিন মা বল্লো ‘কাল থেকে আর ইস্কুলে যেতে হবেনা’ । আহা, এমন আনন্দ সংবাদ!! শুনে যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না। মা বল্লো ‘দু সপ্তাহ বাড়িতেই পড়াশোনা করবে তারপর যাবে নতুন ইস্কুলে ...’ । নতুন ইস্কুল? তার মানে সেই স্কুল টি হয়েগেছে যার জন্য মা এতো দৌড়া দৌড়ি করতো? ...সে কোথায়? কি তার নাম? মা বল্লো ‘নতুন ইস্কুলের নাম মণিমুক্তা বিদ্যামন্দির, ঐ ইস্কুলে তোমাদের ক্লাসে পড়াবেন অরুনিমা মাসী ..., আমিও থাকবো ’ সে যে ঠিক কি রকমের উত্তেজনা, কি আনন্দ । আনন্দ … ঠিকই। তবে …। তবে নতুন ইস্কুল মানে …। নতুন ইস্কুল মানে তো সেখানে থাকবেনা মিঠুমিস। তাহলে? … পরে, টের পেয়েছে মা’র ইস্কুলে মা’কে বললে ‘চাকরী’ হতেও পারে মিঠুমিসেরও। কিন্তু কথাটি মা’কে বলা…। নাহ, আর হয়নি বলা কখনো। কখনোই। – ইস্কুল রইলো। মিঠুমিস রইলোনা। এক সময় মিঠুমিসও রইলো না। অন্তত দৈনন্দিনে। কিন্তু মিঠুমিস যে ছিল, তা কখনোসখনো টের পেলেও, আজ এই শীত-শীত রোদে, ঠান্ডা ঠান্ডা ছায়ায় গভীরভাবে জানলো সুভদ্র।

পক পক, পকাত পকাত।

আওয়াজ ওঠে। টিপ দেওয়া ডটপেন, ব্লাউজের ভাঁজ থেকে চলে এসেছে আঙ্গুলে। বাঁ হাতের মুঠোয়। মিঠুমিসের। বুড়ো আঙ্গুলের চাপে উঠছে নামছে কলমের মাথা। কলমের নিব বার হচ্ছে। ঢুকে যাচ্ছে। ঢুকে যাচ্ছে। বার হচ্ছে। থেকে গিয়েছে আর সব আওয়াজ। শুধু পক পক। শুধু পকাত পকাত। সুভদ্র’র বুড়ো আঙ্গুল, পায়ের, ভিজে যাচ্ছে। নিশ্চয় ভিজে যাচ্ছে সায়া। অন্দরে। পক পক, পকাত পকাত। গ’লে যাচ্ছে ডান পায়েরব বুড়ো আঙ্গুল। পুড়ে যাচ্ছে। গলে যাচ্ছে সব। সবকিছু। খাঁখাঁ রমণীমোহন ইন্সটিটিউট গলছে। গলছে ফটকের সিমেন্ট থাম। গলছে যমজ গাছ – লাটিম ফুলের। মেঘ গ’লে যাচ্ছে। ঝরে যাচ্ছে। বৃষ্টি হয়ে নয়। মোমের ফোঁটার মতন। টপ্‌ টপ্‌ করে। খাঁখাঁ রমণীমোহন ইন্সটিটিউটের প্রেক্ষাকোঠায় কারা? নবলকিশোর? দীপঙ্কর লালা? দেবু? মিষ্টি? দাস ট্রেডিং এর মেয়ে? কোথায় প্রেক্ষা-কোঠা? এ তো ছাত। অল্প আগেই বৃষ্টি হয়ে যাওয়া ছাত। রমণীমোহন ইন্সটিটিউটের। রাত্রি। আকাশে তারা। উঠে বসছে মিঠুমিস। উত্থান। উঠে, এগিয়ে আসছে নাভি। আঙ্গুল আর যথেষ্ট নয় তবে? মিঠুমিসের আঙ্গুল আওয়াজ তুলছে। কটকট কটকট। টিপ দেওয়া ডটপেন, ব্লাউজের ভাঁজ থেকে চলে এসেছে আঙ্গুলে। বাঁ হাতের মুঠোয়। মিঠুমিসের। বুড়ো আঙ্গুলের চাপে উঠছে নামছে কলমের মাথা। কলমের নিব বার হচ্ছে। ঢুকে যাচ্ছে। ঢুকে যাচ্ছে। বার হচ্ছে। আওয়াজ তুলছে। কটকট কটকট।

“তোর যে ছোটভাই, ও কি করে?”

“ম্যাথস্‌ অনার্স নিয়ে পড়ে। কলকাতা”।

“বাহ্‌। বৌদির স্কুল তো এখন খুব নাম করেছে। ইশ, কি যে ছিলি, মনে আছে, দাস ট্রেডিং এর মেয়ে, কি নাম … সোনালী? না রূপালী? ওকে ভ্যানে রেখে ভ্যান ঠেলে ফেলে দিচ্ছিলি …”।

মনে ছিলনা। তবে মনের কোথাও ছিল। নাহলে বলামাত্র কি করে ফিরে আসবে ওই দুপুর? ওই মোড়, বিপিনপাল রোডের? মুর্গীগাড়ি রেখে পাইলট কাকু গেছে কাকে যেন বাড়ি দিয়ে আসতে। ভ্যানগাড়ির জালের ভিতর দিয়ে আঙ্গুল ভরে দিয়ে ভ্যান-দরজা খুলে ফেলা। সঙ্গে কে, কে কে নেমেছিল? দেবু নেমেছিল। নবলকিশোর নেমেছিল নাকি দীপঙ্কর লালা? দাস টেডিং এর মেয়ে নামেনি। সুভদ্রর ইচ্ছা ছিলো কক্‌পিটে বসে গাড়ি চালিয়ে দেওয়া। কিন্তু কে যেন ঠেলতে লেগে গেলো মুর্গীগাড়ি…। … কটকট কটকট আওয়াজ চলে। তবে ফ্রকোয়েন্সি, পিচ্‌ দুই-ই কমেছে। মিঠুমিস কি পেন্টি পরেছে? শাড়ির, শায়ার তলায়? এখন? তখনো পড়তো কি পেন্টি শাড়ির,সায়ার অন্দরে? 

“তোর সঙ্গে যেন আর কারা ছিল ক্লাসে… দেবু, জুবিন, সুনন্দ …”।

স্বপন ভট্‌, রতন উকিল, আশু ইংলিশম্যান…। তারপরে? তারপরে এক দুইবার – করিমগঞ্জ কলেজের অডিটোরিয়ামে বা রমণীমোহন ইন্সটিটিউটে – কোনো নাটক কিংবা গানের অনুষ্ঠানে দেখেছে মিঠুমিসকে। দেখেছে। দেখামাত্র শিউরে উঠলেও, গিয়ে কথা বলবার, কাছ থেকে দেখবার ইচ্ছা হলেও তা হয়নি, হয়নি যে কেন তা’ই কেজানে। আর আজও যে দেখা হয়েগেলো, তারও কোনো প্রস্তুতি ছিলনা। খোলামঞ্চে নাটকের অনুষ্ঠান করা হবে। আয়োজন করছে ‘একতারা’। বাইরে এরা নাটক করে, গানবাজনা করে। অন্দরে রাজনীতি। রাজনীতির টানেই এদের সঙ্গে ক্রমে ভিড়ে গেলো সুভদ্র। পাশের শহর শিলচরে তার হোস্টেল যাপন। ক্লাস। বাদ দিয়ে চলে আসে প্রায় হপ্তায় হপ্তায়। মা-বাবা’র দুশ্চিন্তা – তার প্রতি সেমেস্টারে জমিয়ে তোলা ব্যাক নিয়ে, ভবিষ্যৎ নিয়ে – এড়িয়ে যায়। সকাল দশটায় পা রাখতে না রাখতেই বার হয়ে পড়ে। তুতুপিসী বলতো “টোটোকোম্পানী, আর ছন্দার কথা বলিস না। ও তো টোটো কোম্পানীর ম্যানেজার”। এবার টোটো কোম্পানীর সঙ্গে আসন্ন নাটক উৎসবের চাঁদা তোলার কাজও নিলো সুভদ্র। পকেটে রিসিদ বই নিয়ে টোটো কোম্পানী। যেখানে ইচ্ছা ঢুকেপড়া। চাঁদা চাওয়া। বলা “এটা আমার, আমাদের বাবার বিয়ে নয়। এটা আমাদের,আপনাদের সবার দায়। দায়িত্ব”। সম্ভব হলে তর্ক খুঁচিয়ে দেওয়া। সেভাবেই টোটো করতে করতে ঢুকেপড়া গিয়েছিল এই অফিসবাড়িতে। বাইরে থেকে, এই শীত-শীত রোদে এই পুরনো, বাইর-থামে ঘাস গজানো বাড়িটিকে দেখে মনেই হয়নি তার পেটে এতো, এতোটা অন্ধকার। এতো ধূর্ত, মৃত ফাইল। শৃগাল। তাই পড়েছিল ঢুকে। তারপরে? তারপরে I met a lady in the meads, Full beautiful—a faery’s child, Her hair was long, her foot was light, And her eyes …” …।

“ম্যাডাম, আমাদের সময়ে কে ছিলেন হেড মিস্ট্রে … স্যরি প্রিন্সিপ্যাল, প্রান্তিকের, মনে আছে?”

“কেন মনে থাকবে না। অন্নপূর্ণা দি ছিল। সব মিলিয়ে বছর দশ ছিল অন্নপূর্ণাদি …”।

“অন্নপূর্ণাদি”, অন্নপূর্ণা! আশ্চর্য! আশ্চর্য তথাপি বাস্তব। পেন্‌জিপাল মেডাম – “শাম্পু দিয়া চুল ফুলানি, হাতকাটা ব্লাউজ। অসইভ্যের মতো আঙ্গুল তুলে কথা বলে। … কি ফাট্‌”। নাম অন্নপূর্ণা! নাম নয় গ্রেটা গার্বো কিংবা Blanche DuBois, অন্তত ইভা ব্রাউন!  আশ্চর্যের তবু না হওয়াই স্বাভাবিক যেমন স্বাভাবিক অন্নপূর্ণা হওয়াই। বাসবে, আরো নিবিড় বাস্তবে এদের সব্বার নামই কি নয় নীতা? এরা নয় বাস্তবের “মেঘে ঢাকা তারা”? আশ্চর্য  “অতি বড় ঘরনী না পায় ঘর আর অতি বড় সুন্দরী না পায় বর”  এই কথাটিই নীতার মা’ও বলেনি নীতাকে? এই যে অন্নপূর্ণা পেনজিবাল সে’ও কি কারো মনে, কারো কারো শিশুমনে আনেনি প্রথম লিবিডো-লিপি বয়ে? হয়নি কারোর হেলে, কারো বনলতা সেন? আচ্ছা, এই মিঠুমিসের নাম যদি হতো অন্নপূর্ণা কিংবা লক্ষী কিংবা পারুল, তাহলে? তাহলে ওই খোলা চোল, ওই মেধাবিনী চোখ, সংকেত, ওই নাভি, ওই ডটপেনে দাগানো স্তনের উচ্ছাস, ওই ‘Que sera, sera , Whatever will be, will be’ সত্ত্বেও …। কিজানি। “মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যালের মুখ;উড়ুক উড়ুক তা’রা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়ুক”। “হীরের প্রদীপ জ্বেলে শেফালিকা বোস যেন হাসে, হিজল ডালের পিছে অগণন বনের আকাশে”। অরুণিমা সান্যাল, বনলতা সেন, শেফালিকা ঘোষ – ‘নাম,শুধু নাম’ …। নামের আবডালে …।

“ওই ম্যাডাম এখন …”

“অন্নপূর্নাদি? ওর বাবা তো ছিলেন বরফকলের ম্যানেজার। বরফকল উঠে গেলো…। ওরাও চলে গেলো…”।

কোথায়? কেজানে। মফস্বলের এসকল অরুণিমা সান্যাল, বনলতা সেন, শেফালিকা ঘোষ রা কোথায় যায়, কেউ জানে কি? প্রয়াস নেয় কি জানবার? মফস্বলের আশু ইংলিশম্যান, প্রেমিক স্বপন ভট, চালবাজ রতন উকিলদের দেখা যায়। প্রায়শ দেখা যায়। যেমন মিঠু’র স্বপন ভট কে নিত্য পাওয়া যায় পলান ঘোষের চোলাই দোকানে। বেশী রাতে। আরো বোতল লাগে তার। পকেট রেস্তহীন। খিটিমিটি বেঁধে যায় রোজই। ঐ স্বপনের কোথাও নেই প্রেমিক স্বপন আর। আশু ইংলিশম্যান খাঁটি বঙ্গসন্তানে পরিণত। বৌ ইস্কুলে পড়ায়। আশু ঝোর তোলে বিভুদার চা’র দোকানে। চুলে, দাড়িতে কড়া কলপ আর জামায় কাপড়ে কড়া মাঞ্জা দিয়ে কোর্টে যায় রতন উকিল। তবে মুখ থেকে ভকভিকানো মদের গন্ধে – শ্যামাদার ভাষায় “নো ক্লায়েন্ট। ইভেন নট এফিডেভিট”। বাপের সম্পত্তি যা ছিল, গেছে দু নম্বর ডিভোর্সের জের ঠেলে। “নিবিড় রমণী তার জ্ঞানময় প্রেমিকের খোজে। অনেক মলিন যুগ–অনেক রক্তাক্ত যুগ সমুত্তীর্ণ ক’রে, আজ এই সময়ের পারে এসে পনরায় দেখে আবহমানের ভাঁড় এসেছে গাধার পিঠে চ’ড়ে।” নাকি “এই সব বধির নিশ্চল সোনার পিত্তল মূর্তি: তবু, আহা, ইহাদেরি কানে, অনেক ঐশ্বর্য ঢেলে চলে গেলো যুবকের দল” ? – পৌষ-মাঘের আকাশে, উঠে আসা আদমসুরতের মতো, এই দুই গুচ্ছ পংক্তির নিচে দাঁড়িয়ে দিশাহারা বোধ করে সুভদ্র। 

“নে, তোর রিসিট বই বার কর” – হাতব্যাগ খোলে মিঠুমিস। হাতব্যাগের অন্দরে হাতের কবজি অব্দি ডুবিয়ে রেখে বলেঃ “তুই নাটক করিস? তোদের এই ফেস্টিভ্যালে করবি?”  হাতব্যাগ খুলেছে মিঠুমিস। হাতব্যাগের অন্দরে হাতের কবজি অব্দি ডুবিয়ে রেখেছে। “Small boxes, chests, cupboards, and ovens correspond to the female organ; also cavities, ships, and all kinds of vessels. … Smooth-walled shafts, water-mains, and the like are the symbolic equivalents of the vagina. … Tables, books, and writing materials represent the male organ.” - উফ্‌। মনে থাকে, যা পড়ে, যা দেখে তা’ই মনে থেকে যায় বলে, বন্ধু বৃত্তে, দাদা বৃত্তে সুনাম তার খুব। কিন্তু কেন এতো মনে থাকে? কেন মনে পড়েযায়? হেলেন থেকে এল্যান পো কীটস, জীবনানন্দ মনে থাকা, মনেপড়া কি ছিলনা যথেষ্ট যে এবার উদয় হয়েছে ফ্রয়েড? “করি, তবে এই ফেস্টিভ্যাসে আমরা চাইছি বাইরের, বিশেষ করে মার্জিনেল কম্যুনিটি’র যারা, যেসব দল নাটক করে তাদের …”। – ব্যাগ থেকে হাত বার করে আনো মিঠু। মিঠুমিস। আমাকে বাঁচাও স্মৃতি থেকে, স্মৃতি-প্রতিভা থেকে। মিঠু, মিঠুমিস, তোমরা ইভা, ইভা ব্রাউন, তারাশংকরের ইভা ব্রাউন আর উত্তমের ইভা ব্রাউনের মাঝামাঝি। তোমরা উপনিবেশ। প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ উপনিবেশ। তোমাদের অন্দরের আগুন মফস্বলের অচেনা। অথচ মফস্বলেই তোমরা গাও  ‘Que sera, sera , Whatever will be, will be’, মফস্বলেই তোমরা নাভিনিম্নে শাড়ি পরো, চুল ফুলিয়ে তোলো শ্যাম্পু দিয়ে, সুডোল বাহু দেখাতে হাতকাটা ব্লাউজ। এক রকমের প্রতিবাদ। এক রকমের উচ্চাশাও। আর ওই উচ্চাশার ফাঁকফোঁকড় দিয়েই ‘আবহমানের ভাঁড়’ গুলি – স্বপন ভট, আশু ইংলিশম্যান, রতন উকিলেরা ঢুকেপড়ে ‘জ্ঞানময় প্রেমিক’ সেজে। তারাও উপনিবেশ। তাদের উপনিবেশ তোমরা। ঠিক যেমন এই সকল মফস্বল গুলি, উপনিবেশ রাষ্ট্রের। নিজের মাটি, মাটর তেল, শষ্য উজাড় করে দেয় রাষ্ট্রকে। যে রাষ্ট্র  সমূহ  কেনাবেচার অধিকার বেচে দিয়েছে কয়েকজন পুঁজিপ্রভুকে। পক্ষান্তরে পতিত গ্রামগুলি উপনিবেশ এই সকল মফস্বলের। দেখোনা, গ্রাম উজাড় করে লোক আসে তোমার এই তেলচুরা’র মতো শহরে কাজের বেটি হ’তে, মুর্গীগাড়ির পাইলট হতে, রুজ-কাম্‌লা হতে? আসে রাতুল, সুবীর, কৃষ্ণেন্দুদের সঙ্গে ম্যাটিনি দেখতে? জানোই তো, এদের পেটের থেকে ‘পাপ’ খালাস করে’করেই নার্সিং হোম খুলে ফেল্লো মোহন্ত ডাক্তার, পদ্য বই ছাপালো লস্কর হাতুড়ে। তাহলে? তাহলে, আর হাত রেখোনা ব্যাগের অন্দরে। বার করে আনো। আমার চাঁদা চাইনা। দরকার নেই রসিদ বই ভর্তি করবার। এর চেয়ে গান হোক। নাচ হোক সেই প্রান্তিক-দিনের মতো। হোক  ‘Que sera, sera , Whatever will be, will be’ …। ছন্দে না মিল্লে হোক না “নায়ক নেহি, খলনায়ক হুঁ মে” কিংবা “তু চীজ বড়ি হ্যায় মস্ত্‌ মস্ত্‌”। হতে পারে “চোলি কে পিছে ক্যায়া হ্যায়” ও। গান হোক, নাচ হোক। আসো হাত ধরো, মিঠুমিস, মিঠি, পেনজিবাল মেডাম, অন্নপূর্ণা, লক্ষী, সরস্বতী, ইভা, অরুণিমা সান্যাল, বনলতা সেন, শেফালিকা ঘোষ। আসুক স্বপ্ন ভট, আশু ইংলিশম্যান, রতন উকিল। আসুক আরো যাদের নাম জানিনা, আরো যারা তোমার কাছে, তোমাদের কাছে কখনো ‘জ্ঞানময় প্রেমিক’ ভূমিকাত্রে অবতীর্ণ হয়ে, অন্তিমে প্রমাণিত হয়েছে, চিহ্নিত হয়েছে ‘আবহমানের ভাঁড়” ব’লে। আসুক তারাও, যারা তোমাদের “কানে অনেক ঐশ্বর্য ঢেলে চলে গেলো” অন্তিমে এই জেনে যে, তোমরাও “বধির নিশ্চল, সোনার পিত্তল মূর্তি”। ব্যাগ, ব্যাগের গহ্বর থেকে হাত, আঙ্গুল বার করে আনো মিঠুমিস। দেখো, আমি নতজানু। নতজানু তোমার নাভির সামনে। নাচের ভঙ্গিতে। এসো।  ‘Que sera, sera , Whatever will be, will be’ …। এইতো নড়ছে তোমার ঠোঁট। এইতো উঠছে গান। তবে নাচহোক এইবার। এইবার “মাঠের নিস্তেজ রোদে নাচ হবে। … হাতে হাত ধ’রে-ধ’রে গোল হ’য়ে ঘুরে-ঘুরে-ঘুরে, রাগ কেহ করিবে না—আমাদের দেখে হিংসা করিবে না কেহ”। কারণ আমরা তো উপনিবেশ। আমাদের রক্ত, ক্লেদ, উৎসাহ, ক্লান্তি, উদ্যম সমস্ত বিক্রি হয়। বিক্রি হয় রাষ্টের, বিশ্বের বাজারে। তাই “আমাদের অবসর বেশি নয়—ভালোবাসা আহ্লাদের অলস সময়, আমাদের সকলের আগে শেষ হয় …”। ব্যাগের গহ্বর থেকে হাত বার করে আনো মিঠুমিস। বরং নির্ভয়ে এখানে হাত রাখো …।

একটি দিনের, একটি দিনের পেটের অন্দরে একটি রাস্তার, ঘাটের, পুকুরের, কোঠার – কোঠাটির অন্দরের আলোর, অন্ধকারের ছবি হয়না তুলিতে, হয়না কালিতে। হয়না কারণ না’ত আলো, না’ত অন্ধকার থাকে স্থির হয়ে। স্থির থাকে হয়তো আলো মাপবার যন্ত্রের, বাতাস মাপবার যন্ত্রের নিরিখে। ঠিক যেমন জ্যোতির্বিদের আকাশ। কিন্তু যে দেখে, কেবল দেখেই, তার নিরিখে? তুমি আঁকতে, তুমি লিখতে পারো একটি পলক। কিন্তু পরের পলকে এই ছবিই যে আমূল গেলো বদলে। আদতে তুমিই দিলে, তোমার দেখা দিয়েই, দিলে বদলে। যখন এখানে, এই তেলচুরা মফস্বলে ঘটনাটি ঘটবে, সেই আরো প্রায় দেড় দশক পরে, যখন, তুমু মিঠুমিস চল্লিশ নাকি পঁইয়লাল্লিশ পেরিয়ে গিয়েছো, তখন, তখনো, প্রায় দেড় হাজার মাইল দূরে, সুভদ্র’র  জন্য, খামে বন্দী অবস্থায়, আক্ষরিকই অপেক্ষমান, নিমন্ত্রণ চিঠি।   তখন সন্ধ্যা নামছে টাটাবাবার রাজত্বে। টাটাবাবার গোটা শহরটিই যে কারখানাটিকে ঘিরে, তার “বি” গেটের দিকে, তখন আস্তে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে সুভদ্র। আস্তে ধীরে, কেননা সে চায় তার সঙ্গের লোকগুলি থেকে আলগা থাকতে। শুধু এখনই নয়, সব সময়। “বি” গেটের বদলে “এ” আর “সি” গেট দিয়েও যাওয়া আসা করা যায়। দুই দিন তা করেও দেখেছে সুকুমার। কিন্তু দুটি গেটই তার বসত থেকে দূরে। সব মিলিয়ে মাইল দুই ঘুরে যেতে হয়। নিতে হয় অটো রিক্সা। কোম্পানী বাড়ি ভাড়া নিয়েছে এই “বি” গেটের কাছেই – যাতে হেঁটে আসা-যাওয়া, সম্ভব হয়, কেরানী, ওভারসীয়ার  এবং সুভদ্র-হেন “ইঞ্জিনীয়ার” দেরও।  মজুরদের জন্য বাসা নেওয়া হয় ওই গেটেরই নিকটতম বস্তিতে। সন্ধ্যা যে নামছে, নামে – তা এখানে জানা যায় টাটাবাবা-চত্বর জোড়া সংখ্যার অতীত “ভোঁ”র ঘোষনায়। এই “ভোঁ” যতোটা ছুটির ঘোষণা, তার চেয়ে বেশী পরের শিফ্‌টের, রাতের শিফ্‌টের আরম্ভের হুংকার অথবা হুমকি। ভোঁ-বাজা আর ক্রমে ক্রমে বাতিগুলির জ্বলেওঠা। নিওন, আর্গন, ক্রিপ্টন, জেনন্‌ – সম্ভবত যতো রকমের গ্যাসে বাতি জ্বলা সম্ভব, সবই জ্বলে এখানে। জ্বালানো হয় এখানে। সারারাত ধরে। জ্বলে, কিন্তু আলো কি দেয়? যদি আলো দিতো, এই সহস্র বাতি, তাহলে টাটাবাবার প্রতিটি গেটের অদূরেই, কি করে এরা দাঁড়িয়ে থাকতো, থাকতে পারতো, অন্ধকারে? মোটর বাইক, স্কুটার থেকে শস্তা মোটর হয়ে হাল ফ্যাশনের মোটর অব্দি দাঁড়িয়ে যেতে থাকে লাইন দিয়ে। বিকাল না গড়াতেই। সূর্য নিবে যাওয়ার পরে এরাও দেয় নিজ নিজ বাহনের হেডলাইট বন্ধ করে। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। তাদেরও না। যারা তাদের কিনার দিয়ে পার হয়ে যায়, এদেরও না। আর যারা গিয়ে উঠেপড়ে ওই সকল বাহনে? – তাদের কিছু আসে-যায় কি’না, এ নিয়ে তারা নিজেরাও আর মাথা ঘামায় কি’না কেজানে।  – এই সন্ধ্যাটির, রাত্রিটির অন্তর্গত আলোর, অন্ধকারের ছবি’র যে বদল, সুভদ্র’র অন্দরে, বিয়ার নিমন্ত্রণ-চিঠিটি খোলামাত্র, তাকে কি যায়, যাবে – আঁকা, যাবে লেখা?

চিঠিটি হাতে নিয়ে সিগারেট ধরায় সুভদ্র। 

তবে মিঠু মিস ছিলনা ততো বড় ঘরনী  ঘর না পাওয়ার মতো। ছিল না অতো বড় সুন্দরী বর  না পাওয়ার মতো। হোক না মধ্যবয়স তবু তো, রাজকুমার না হোক রিটায়ার্ড পশু ডাক্তার খুঁজে পেয়েছে, অন্তিমে সিন্ডারেলাকে। 

হঠাৎই জ্বালা করে সুভদ্র’র চোখে।

জ্বালা করে, শুধু কি চোখে?

—--


[ উৎসর্গঃ মিঠুমিস, দেবাশিসদা, জুবিন]










ঘুম ঘর