টার্গেট
সপ্তর্ষি বিশ্বাস
[প্রথম মুদ্রণঃ 'সাহিত্য' সাহিত্যপত্র, হাইলাকান্দি]
পুলিশের ফোন পাওয়ার প্রায় দেড় ঘন্টা পরে, রাত-কাঁটা এগারোটা পেরোনোর পর, গাড়ি নিয়ে ইমলি বাজার পৌঁছলো মৃন্ময় ডাক্তার। সঙ্গে বুদ্ধ, সঙ্গে সুকুমার।
থানাবাড়ি, ইমলি বাজারের, মৃন্ময় ডাক্তারের চেনা। তবু ডবল শিওর হতে জিগিয়ে নিলো “বুদ্ধ, বামদিকেই ত”? “ অয় অয়”। বলে বুদ্ধ।
“তুই অ পরে আবার ইমলি বাজার আইসস”? সুকুমার বলে।
“পরে” অর্থাৎ সেই পড়াশোনা আমলে, দুজনেই এসেছিল ইমলি বাজার। বন্যায়। ত্রাণ নিয়ে।
“হ্যাঁ, একবার ত মৃন্ময়দার সঙ্গেই। আরেকবার নাটক করতে। তবে এখন ফ্লাডের এরিয়া এর পরে। অনেকেই ভিটা উঁঁচা করেছে”।
গাড়ি নিয়ে মৃন্ময় ডাক্তার ঢুকে পড়ে থানা চৌহদ্দি তে। থানাবাড়িটি, পার হয়ে আসা টিনচালের বাড়িগুলির মতোই, আরেকটি বসত বাড়ি। তফাৎ এই, যে, আব্রু নেই। সামনে নেই তরজার বেড়া। উঠান মিলে গেছে রাস্তায় অথবা রাস্তা ঢুকে পড়েছে উঠানে। উঠান পার হরে বারিন্দা। পার হয়ে ষাট পাওয়ার, আশি পাওয়ার বাল্ব-জ্বলা কোঠা গুলি। পদুম নামের এক কনেস্টবল দাঁড়িয়েছিল বারান্দাতে। মৃন্ময় ডাক্তারের অপেক্ষাতেই ছিল পদুম।
আবার গাড়ি চল্লো। এবার গন্তব্যের মালিক এই পদুম কনেস্টবলই। অন্ধকারের গাইড। উচ্চারণে বোঝা যায় তার বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী যদিও সচরাচর ‘পদুম’ নাম অসমীয়াতেই হয়। হয়ে থাকে। তার বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরি উচ্চারণে সে জানায়, যে, সদর ইমলি বাজারে নয়। “কেইস” “গ্রামে”। ভিকটিম লেডি। ইয়ং লেডি। পসিবলি সু'সাইড কেস। পরাণ দাসের মেয়ে। বিয়া হয়েছিল লক্ষীপুর গ্রামে। এডুকেডেট। স্পোর্ট করতো। যদিও চাকরি হয়ে যাওয়ার কথাও ছিল স্পোর্টে, তবু শ্বশুরবাড়ি লাইক করেনা স্পোর্ট। ফলে চলে আসে বাপের বাড়ি। আর বাপের বাড়িতেই …। কিন্তু..”।
কুয়াশা তাঁবু ফেলেছিল। কুয়াশা ঝুলছিল। যে সব পোস্টে ছিল বাল্ব, জ্বলন্ত, সেই প্রত্যেকটি বাল্ব ঘিরে দুলছে কুয়াশা। যে সকল বাইর-লাইট জ্বলছিল বারান্দায়, তারাও কুয়াশার বাসা। কুয়াশার সঙ্গে মিশে আছে আক আজব থমথম। ছমছম। কুয়াশার সঙ্গে মিশে আছে? নাকি তার অন্দরের ছম ছম’ই অবয়ব নিচ্ছে বাইরের দেখায়? ভাবতে চেষ্টা নেয় সুকুমার। দু'টি তিনটি পরপর। পরে-পরেই খালি জমি। এখন কুয়াশা-জমি। কুয়াশা-মানুষও আছে। দুজন তিনজনে জটলা। বিড়ি-সিগারেটের আগুন বিন্দু। কোনো কোনো ঝোপে, খালি জমিতে জোনাকি। বেড়া অন্দরে, বারিন্দায় চোখেপড়ে মহিলা, বালিকাও – দৃষ্টি রাস্তায়। কেমন যেন এক উৎসব-ভাব। যেন দশমীর, ভাসানের, অনেক রাত। বেশী রাইত। সেই কলেজ কালে। ভাসান দেখে ফিরে আসা বুদ্ধ-সুকুমারের। রাত্রি, তবু রাত্রিও নয়। অনেক বারিন্দায় লাইট জ্বলে, অনেক বারিন্দায় একজন, দুইজন। এমনি, ছোটো ছোটো দল। জটলা। সেসব ভেঙ্গে চলেযায় ভাসান ফিরতি ট্রাক, মাতাল ট্রাক। এ’ও যেন এমনই। – এদের ডোবাখানা যাপনে, এইরূপ ঘটনাও তাহলে আনে উদযাপনের অভিলাস? পদুম কনেস্টবলের বর্ণন থেকে “ইয়ং লেডি”, “স্পোর্ট” — শব্দগুলি এই অন্ধকার, এই কুয়াশার সঙ্গে মিলেমিশে গাঢ় করে তোলে সুকুমারের ছম ছম কে।
গাড়ি এখন যেখানে, সেখানে লোক ‘অরণ্য’ নয়, লোক ‘ঝোপ’, মানুষের ঝোপঝাড় – যেন ছোটো ছোটো দলে কলাগাছ, বাঁশঝাড় অন্ধকারে। উদযাপন এই রাত্রেও। এই শীতের রাত্রেও – “ইমলি বাজার সদর” থেকেও দূরে, এই “গ্রামে”ও — অন্তত ত্রিশ খানেক লোক হাজির। হাজির-দিগের মধ্যে রয়েছে মহিলাও। এই সকল থাকাতেই যেন আরো বেশী টের পাওয়া যায় অঘটন, দুর্ঘটনা, দুর্ভাগ্যের হাজিরা।
গাড়ি আরো একটু এগোতে উড়ে এলো রোদন। যেন এরই ছিল অভাব, এতোক্ষন। দৃশ্যটি স্পষ্ট না হলেও দৃশ্যেটির আদলের বিষাদ, শূন্য, হাহাকার স্পষ্টই ছিল। এই রোদন তাকে দিলো কাঙ্ক্ষিত মাত্রা। সম্ভবত এই বিষাদ, শূন্য, হাহাকার এড়াতেই সিগারেট জ্বালায় মৃন্ময় ডাক্তার। জ্বালাতে গিয়ে আঙ্গুল কাঁপে অভিজ্ঞ চিকিৎসকজনেরো।
ভিড়ের মুখগুলি এখন কাছে। স্পষ্ট। চেনা সম্ভব। চেনা সম্ভব ভিড়ে আর বারান্দায় অন্দরে কয়েকটি পুলিশ উর্দিও। দৃষ্টিসীমায় গাড়ি আসতেই মুহুর্তে ভিড়ের উৎসাহ বেড়ে যায়, বেড়ে যায় উৎসাহি-সংখ্যাও। যেন অন্ধকার ছিঁড়ে জন্মায় মুখ গুলি, অবয়ব গুলি। চোখের সামনেই, ভিড়ের হঠাৎ-উৎসাহে, ধূলিসাৎ হলো তরজার বেড়া।
পিচ ওঠা তবু পাকা রাস্তা আর বাসাবাড়ির মাঝামাঝি নালা। শীতের কল্যাণে শুকনো। উত্তেজনার বশে, আরেকটু ভালো করে দেখতে, তাতেই নেমে ছিল কেউ কেউ। সাপোর্ট নিয়েছিল তরজা বেড়ার। দেখাদেখি আরো কয়েকজন বেড়া-সাপোর্টে ভরসা করতেই গড়িয়ে পরেছিল তরজা বেড়া। বাইর-ঘরের খোলা জানলা থেকে উপচানো বাল্ব-বাতির আলোয় দেখা গেলো…।
“পুলিশের ফোন”। রিসিভার নামিয়ে রেখে বলেছিল মৃন্ময় ডাক্তার আর শব্দ দুটি উচ্চারণ করতে গিয়ে মৃন্ময় ডাক্তারের মতো সজ্জনের স্বরও স্পষ্ট তিক্ত। গ্রামগঞ্জের কল এলে মৃন্ময় ডাক্তার যায়। নিজের পকেট-টাকার তেল জ্বালিয়ে,নিজে গাড়ি চালিয়ে যায়। আর সেই কারনেই গ্রামগঞ্জ থেকে কল, অদ্যাপি, আসে মৃন্ময় ডাক্তারের কাছেই। কিন্তু অনেক রাত্রে গ্রামগঞ্জের কল এলেও মৃন্ময় ডাক্তারকে বিরক্ত দেখেনি বুদ্ধ, দেখেনি সুকুমার — যে বিরক্তি “পুলিশের ফোন” বলার মধ্যে প্রতিভাত।
“চলো, যাবে নাকি” — বল্লো মৃন্ময় ডাক্তার।
সুকুমার টের পায়, মৃন্ময় ডাক্তারের সঙ্গে এই রকমের যাওয়াতে, বুদ্ধ অভ্যস্ত। সুকুমার নিজে অনেক বচ্ছর ধরে, বছরে একবার আসা'র টুরিস্ট’’। অতএব তার অনুপস্থিতিতে ঘটবে, ঘটে যাবে, গড়ে উঠবে, ভেঙ্গে যাবে অনেক কিছুই সেই তো স্বাভাবিক।
“বুদ্ধ, তোমার মোটরসাইকেল এখানে রেখে দাও। আমি তোমাদের নামিয়ে দেবো”। – অপেক্ষায় আরো দুইজন রোগী। বেরোতে হবে এদের সেড়ে। সঙ্গে যাওয়ার সম্মতি মাথা নেড়ে জানিয়ে দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায় বুদ্ধ, সুকুমার।
সিগারেট ধরায়।
শীতকালের রাত সাড়ে আটটার কাঁটা পার হয়েছে সদ্য। রাত্রি বছরে বছরে, একটু একটু করে ছোট হয়ে আসছে, অন্তত চেষ্টা করছে, ছোট হয়ে আসবার। কলেজ আমলের পরে, পাশ-শহরে হোস্টেল আমলে, হপ্তা দুই হপ্তায়, আদতে সুযোগ পেলেই, দেড় দুদিনের নিমিত্ত বাড়ি আসবার চার বছরে আমলেও, শীতরাত, আটটা তেই ঝাঁপ ফেলে দিতো। ক্রমে, পরের এক দশকে এসেছে সাড়ে আটটায়। আর গত বছর তিনে এক এক লাফে ছঁয়ে দিলো দশটার কাঁটা। এর হেতু কি অনতি বছর আগে ঘোষিত এই দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি? বাজার শব্দকে প্রত্যেকের শিরায়, শোণিতে লোহিত কণিকা করে নেওয়ার আহ্বান? চেষ্টা?
“পুলিশের ফোন কেস টা কি?” সুকুমার প্রশ্ন করে।
“আরে, ও কিছু না। আশেপাশের কোনো থানায় কোনো লাশ এসেছে। দেখে, বলে দিতে হবে ডেড”।
“ নেচারেল…”
“নেচারেল হওয়ার চান্স কম”।
“ তুই গেছিস আগে মৃন্ময়দার সঙ্গে?”
“দু তিনবার গেছি। আসলে সদর থানার হলে এরা সামলে। আশেপাশের থানায় হলেই তলব পরে মৃন্ময়দার”।
“ হুঁ, ভালোমানুষ হওয়ার মুশকিল। আমাদের কি কম্পাউন্ডার কেমোফ্লেজ নিয়ে যেতে হবে?”
“না না। আমরা বাইরে থাকব। লাস্ট কেসটাতে আমাকে তো বডি দেখালো মৃন্ময়দা।”
“হুঁ, তোর তো ভালই হলো। শালা, আমাদের পেটখারাপের দাবাই দেওয়া সেমি ডাক্তার থেকে একেবারে ফরেনসিক। কোনদিন দেবে বাঁশ পুলিশ”।
“ডাক্তারের সঙ্গে তো। ঘাঁটায় না। আফটার অল সরকারি ডাক্তার”।
“ সরকারি তো আমাদের স্বরূপ দাসও। ওকে ডাকে?”
“স্বরূপ তো এখনকার দোকান কবেই উঠিয়ে দিয়েছে। গাইনি ছেড়ে চোখের ডাক্তার হয়েছে নর্থ বেঙ্গল”।
ফার্মেসি থেকে বার হয়ে এসেছে মৃন্ময় ডাক্তার। সিগারেট জ্বালিয়ে বলেঃ
“যেতে হবে ইমলি বাজার। ইমলি বাজার থানায়”।
“ মানে, নাই-নাই করে বারোটা” —- বুদ্ধ বলে।
ভুতুর দোকান ঘুরে এসেছে মৃন্ময় ডাক্তার। “ তোমার ব্র্যান্ড ও এক প্যাকেট নিয়ে নিলাম। সাড়ে এগারোটা যদি সাড়ে বারোটা … বারোটাও হয়, তাহলে পরীর দোকানও খোলা পাওয়ার চান্স কম”।
এখানে রাত্রি ছোটো হ'য়ে এখনো সাড়ে এগারোটায় পৌঁছায়নি।
তিন সিগারেটধারী গাড়িতে ওঠে। বুদ্ধ বসে সামনে। মৃন্ময় ডাক্তারের পাশের সীটে। সুকুমার পিছন সিটে।
“আমি ফার্মেসির সঞ্জয় কে বলে দিয়েছি। বাড়িতে জানিয়ে দেবে”।
গাড়ি চলতে আরম্ভ করলো।
রাত্রি, সতত আর সর্বত্রই সুকুমারের প্রিয় ঋতু। সব অন্ধকারই তার কাছে সম্ভাবনা। তবু এই অন্ধকার অভিযানের কোথাও যেন সাইরেন বাজছে। বাজছে বিপদ সঙ্কেত। একটা মৃত্যু মিশে আছে বলেই হয়তো। কেজানে মৃত্যু না আত্মহনন, নাকি হত্যা …।
“ কেসটা কি মৃন্ময়দা?” — সুকুমার।
মিশনের মোড়ে এসে বাঁ দিকে বাঁক নেয় মৃন্ময় ডাক্তার।
তার নিজের চল্লিশের বাঁক পেরোনোর হয়েছে চার পাঁচ বচ্ছর। সুকুমার, বুদ্ধ — তিরিশের পরে চার-পাঁচটি বাঁক পেরোনো।
“বুঝতে পারিনি। এরা ফোনে খুব পরিস্কার বলেনা। এক্সিডেন্ট বা… হ'তে পারে সু'সাইড।” ফিমেল”। —মৃন্ময় ডাক্তার।
মৃন্ময় ডাক্তার আদতে এখানকার হলেও এমবিবিএস করেছে উজানে। চাকরিও। কয়েক বচ্ছর হলো বদলী নিয়ে ফিরতে পেরেছে দেশগ্রামে। বুদ্ধর সঙ্গে পরিচয় এক স্যুভেনির বার করবার সূত্রে। বুদ্ধ’র সঙ্গে ঘনিষ্টতার সূতো ধরেই যোগাযোগ সুকুমারের সঙ্গে।
“ফিমেল”। —মৃন্ময় ডাক্তার।
শব্দটি, কেন কেজানে, সুকুমারের মগজে নিয়ে আসে জীবনানন্দ দাশের একটি গল্প।
“জীবনানন্দের ‘বিস্ময়’’ গল্পটা …?”
“আজকাল পত্রিকার পূজা সংখ্যায় হ'লে পড়েছি। কিন্তু নামে কিছুই মনে আসছে না”। —- মৃন্ময় ডাক্তার।
“আমি ত গল্প সমগ্রে পড়েছি। ইন্টারেস্টিং। আরেকটা গল্প, জীবনানন্দের, রিয়েল ভূতের, ‘পারিজাত’...”। — সুকুমার।
“আমার প্রিয় ‘প্রেতিনীর রূপকথা’”। — বুদ্ধ।
শহরসীমার পার হতে সময় লাগলো না। গ্রামগঞ্জ শব্দবন্ধ থেকে তাদের এই ভূগোল আদতে তেমন দূরে নয়। তবু, নিম্ন মধ্যবিত্ত যেমন তার নিচের শ্রেণির থেকে সড়ে এসে উচ্চ মধ্যবিত্তের সঙ্গে দোস্তানা দেখিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে চায় উচ্চ মধ্যবিত্ত বলে, উচ্চ মধ্যবিত্ত যেমন ঘেঁষে থাকতে চায় তাদের কোল, যাদের সংজ্ঞায় ‘'মধ্যবিত্ত’ দাগ নেই, তেমনি, মফস্বল নিজেকে গঞ্জ নয়, শহরের দিকে ঝুঁকে থাকে, শহর নগরের দিকে। ইমলি বাজার তার থেকেও দূরে। এখনো।
“এই তিন, সাড়ে তিন মাইল রাস্তা জলদি পেরোতে হবে। কয়লা ট্রাক ঢুকতে আরম্ভ হওয়ার আগে”। — মৃন্ময় ডাক্তার।
কুয়াশা তাঁবু টাঙ্গাতে আরম্ভ করেছে। পুলা-মারা ব্রীজ পার হ'তে পার হওয়া গেলো কয়লা-ট্রাকের ভয়। সুকুমার দেখলো, এখানে কুয়াশারা চলমান। রাস্তার এক দিকের ধুধু মাঠ থেকে উঠে, বন্য হাতীদলের মতো, চলে যাচ্ছে আর দিকের ধুধুমাঠে। গাড়ি-জানলার কাঁচ প্রায় পুরোই দিতে হলো উঠিয়ে। চুপ পর্বের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে সুকুমারের চিন্তায় ফিরে আসে “ফিমেল” আর “সু'সাইড” শব্দ দুটি।
“মৃন্ময়দা, সু-সাইড কেস বা মার্ডার হ'লে আপনার ঝামেলা কি বেশি?”
“সমান। এক্সিডেন্ট বা নেচারেল হলে যেমন। আমার দায়িত্ব শুধু মৃত বলে ঘোষণা দেওয়া। আর মোটামোটি টাইম, মৃত্যুর কারন। — আসলে এসবও পুলিশের ডাক্তারের কাজ…”।
“তা'ও রক্ষা। দেরি হলেও রাতেই ফিরে আসতে হবে”।
“ আমারো। কালও ত’ আবার ছুটতে হবে আমার হাসপাতালে।”
“আরে, রাতবিরাতে এরকম ডাকলে, পরের দিন ছুটি দেওয়া উচিত”।
“আর ছুটি! এরা দেবে ছুটি। ছুটি দিলেও ওদের কি? আমার গ্রামের রুগীরা একদিন ডাক্তার পাবেনা। ব্যস।”
সিগারেট ফুরালেও জানলা কাঁচ তোলে না সুকুমার। ‘সু'সাইড’, ‘ফিমেল’’ শব্দদুটির সঙ্গে একা, একা একা, বসতে গা ছম ছম করে সুকুমারের। অনুসরণ করলো নাকি ছুটে গেলো সবগুলি চোখ? ছুটে গিয়ে, দেখে না-দেখে, কিছু একটা বুঝে নিয়েই আবার ফিরে এলো। ওই পলকের মধ্যেই বোঝা গেলো ইস্কুল ছুটি। মেয়ে ইস্কুল। এম-এম-সি ইস্কুল। ক্লাশ টেন-বি কোঠার জানলা থেকে সক্কলে দেখলো। দেখলো সুকুমারও। ঘাড় ঘুড়িয়েই দেখলো। পরিতোষ স্যারের চোখ এখন বোর্ডে। তবে কখন যে ঘুরে তাকাবেন, কেউ জানেনা। এইভাবে, ঘাড় ঘুরিয়ে, জানলা দিয়ে এম-এম-সি বালিকা বিদ্যালয়ের বালিকা দেখতে গিয়ে, পরিতোষবাবুর হাতে যে তিনটি থাপ্পড় হজম করে নিতে পেরেছে মদন, তা হয়তো মদন স্পোর্টসম্যান বলেই। এই থাপ্পড় হজম করবার কথা সুকুমার সহ ক্লাসের অনেকেই পারেনা কল্পনা করতেও।
আদতে এই সাত নম্বর পিরিয়ড টাই ঝামেলা। এম-এম-সি বালিকা বিদ্যালয়ে ছয় পিরিয়ড। আর ওই ইস্কুল বসে ১০টা ১৫ তে। গভর্নমেন্ট বয়েস্ বসে ঠিক আধঘন্টা পরে। সাত পিরিয়ড না হলে, এম-এম-সি একটু আগে ছুটি হলেও, সামান্য জোরে হাঁটা দিলেই ধরে ফেলা যায়। ধরে ফেলা যায় যার যার পাড়ার কিংবা বেপাড়ার নিজ নিজ “টার্গেট” দিগকে। কিশোরী-বালিকা দল গুলিকে। সাইকেলে হ'লে ত কথাই নেই। সাইকেলে হ'লে অবশ্য পরিতোষ স্যারের সেভেন্থ পিরিয়ড করেও যায় ধরে ফেলা। কিন্তু সাত পিরিয়ড ক'রে তারপর হেঁটে বালিকা বিদ্যালয়ের বালিকাদের লগ-ধরা, অসম্ভব।
মজা এই ‘লগ-ধরা’ তেই। “টার্গেট” থাকুক আর না'ই থাকুক। এমনি লগ-ধরতে ধরতেও অনেকের টার্গেট হয়ে যায়। বন্ধু, পার্টনারের টার্গেটের লগ-ধরা'য় লগ দিতে দিতেও, টার্গেট ফিক্স হয় অনেকের। হয়েছে। তবে সুমন দত্ত টাইপ লাক সবার হয়না।
সুমন দত্ত যেতো সপ্তর্ষির “টার্গেট” এর লগ-ধরায় ওকে সাপোর্ট দিতে। সপ্তর্ষির এখনো কিছু হয়নি। লাইন লাগেনি। পটেওনি বোধহয়। তবে ‘তিড়িং ঝুমা’ নিজে থেকে প্রপোজ করিয়ে দিয়েছে সুমন দত্তকে। বান্ধবী মারফত। এখন সুমনের উদাম লাইন। টার্গেট সুকুমারেরও স্পষ্ট কেউ নেই। তবে লগ-ধরতে ধরতে হয়তো হয়ে যাবে – এই আশা, এই ভরসাতেই যাওয়া।
কিন্তু হেঁটে, সাত পিরিয়ডের পরে, সেদিন আর গেলোনা লগ-ধরা। মেয়েগুলিও জানে গফ্ট্ বয়েসের ১০:৪৫ আর ক্লাস নাইন-টেনের সেভেন্থ পিরিয়ডের গল্প। “টুনিং” থাকলে মেয়েরাও আস্তে হাঁটে। থামে। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে পিছনে তাকিয়েও দেখে। আসতে চান্স দেয় “হিরো” দের। কিন্তু তেমন “টুনিং” সুকুমারের সঙ্গে কারোর নেই, এখনো নেই। সেভেন্থ পিরিয়ড ভাঙ্গতেই দ্রুত পা চালিয়ে, থানা, এরপরে গীর্জা, গীর্জা রোড পার হয়ে সুকুমার আন্দাজ করেছিল এ যাত্রা লগ-ধরা হলোনা। তবু পা চালালো সুকুমার। একা একাই পার হলো জোড়া বটগাছ, রজনী শা'র বাগান, মালীপাড়া। এই সেভেন্থ পিরিয়ড শুধু এড্ভান্সড ম্যাথ যাদের, তাদের, এডভান্সড ম্যাথ দলে তার দিকের কেউ নেই। ফলে একলাই চলতে হয় ওই দিনগুলিতে। – নাহ, একটা দলও নেই এম-এম-সি বালিকা বিদ্যালয়ের। রাস্তা সুনশান। রাস্তা ফাঁকা। এই ফাঁকাত্ব আজ তার বাসা-পৌঁছা অব্দি সঙ্গী। এই ফাঁকাত্বে হতাশ বোধ করবার দিকে এগোতেই নামলো জোয়ার। ঘিরে ফেল্লো সুকুমারকে।
ঘিরে ফেল্লো সুকুমারকে। ঘিরে ফেল্লো গাছ-সবুজ স্কার্ট। শাদা শার্ট। গাছ-সবুজ শাড়ি, শাদা ব্লাউজ। বালিকা, কিশোরী। সেই কল্লোল। সেই হাসাহাসি। এরা কোথায় ছিল এতোক্ষণ? তবে কি তার অজান্তে সে, সুকুমার, নিজেই হয়ে গিয়েছে কারোর টার্গেট? সুমন দত্ত’র মতো লাক খুলে গেছে তারও? সেই “টার্গেট”ই সদলে লুকিয়েছিল তার জন্য? এই গলীতে? কিন্তু এতো বড়ো দল? গলী থেকে বার হয়ে আসছে – মিছিল? নদী? শিউরে ওঠে সুকুমার। গা ছমছম করে।
এরাও বালিকা। কিশোরী। কিন্তু এরা এম-এম-সি বালিকা নয়। এম-এম-সি’দের ড্রেস অন্য। কালার অন্য। অন্য চেহারাও, গড়নও। তাহলে? তাহলে এরা কারা? কয়েক পলক পরে সুকুমার বুঝলো এরা আসলেই নয় এম-এম-সি গার্লস। এরা নীরজাসুন্দরী-মেয়েরা। নীরজাসুন্দরী মেয়ে।
নীরজাসুন্দরী বালিকা বিদ্যালয় । কখনো ‘যুগশক্তি’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল এর ইতিহাস। ১৯৫০ এর আশেপাশে প্রতিষ্ঠিত। কোনো নারী শিক্ষা উৎসাহী জমিদারনির করা। জমিদারনি, তবে দ্বিতীয় পক্ষের। এই ইস্কুলের অবস্থান শহরের নাভিতে নয়, এম-এম-সি যেমন। এই ইস্কুল শহরতলীর কাছাকাছি। ফলে শহরতলীর মেয়েরাই আসে এই ইস্কুলে। হয়তো এদের কথা ভেবেই ইস্কুল খুলেছিল জমিদারনি। এরা, এই নীরজাসুন্দরীরা, শহরের চোখে পড়েনা। এরা শহরতলীর থেকে বার হয়ে এসে আবার ঢুকে যায় শহরতলীরতেই। যেন ইন্দুর। আছে। সকলে জানে। বধ করতে বিষ দিয়ে রাখে। বসিরে রাখে ফাঁদ। কিন্তু জ্যান্ত ইন্দুরের সঙ্গে সাক্ষাত নয় সচরাচর ঘটনা।
শহরেএম-এম-সি তে পাঠ নিতে আসে সেইসব তল্লাটের মেয়েরাও যাদের বসবাস শহরের ঠিক নাভিতে নয়। আসে শহরতলীরও যারা উচ্চঘর, তাদের মেয়েরা, নাতনিরা। শহরতলীর উচ্চ পরিবারের মেয়েদের কেউ কেউ আসে যায় মাসকাবারি রিক্সায়। কারোর বাপ-কাকা-দাদা দিয়ে যায় স্কুটার চালিয়ে। নিয়েও যায়। এই ‘শহর’ এক্সযদি হয় ‘গ্লোব’, তাহলে এম-এম-সি ‘গ্লোবাল’ ইস্কুল। ঠিক যেমন গফ্ট্ বয়েস্ – ছেলে ইস্কুলের “গ্লোবাল”।
নীরজাসুন্দরী মেয়েদের লগ-ধরতে হলে তল্লাট সীমাবদ্ধ। শহরের উত্তর দিক। উত্তরের শহরতলী। সেটা একটা সুবিধা বটে। ছেলেদের। টার্গেট কনসেট্রেটেড হয়ে আছে। লোকালি। তবে অসুবিধা টার্গেট দিগের নিজেদের। বাইর-বাজারে পৌঁছাতে পারেনা। ফলে ‘কনজিউমার’ লিমিটেড।
চোখে পড়েনা নীরজাসুন্দরীর মেয়েদের, আরো একটি কারণেও। যেমন নীলমণি, শ্যামসুন্দর কিংবা পাব্লিক ইস্কুল, বিপিনপাল ইস্কুল ইত্যাদি শহর-নাভি’র কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও সেই সকল ইস্কুলের ছেল্রা “লোকাল”ই যেন। চোখে পড়েনা কারন মেট্রিকে, দুই বা তিন বছরে, বড়জোর একটি ফাসডিভিশন – যা শ্যামসুন্দর ইস্কুলের হয়ে এনেছিল বিষ্ণু, সুকুমারদের পরীক্ষা-বছরে – তাও লেটারহীন, এই এদের ভাগ্য। এদের দৌড়। মেয়ে ইস্কুল নীরজাসুন্দরীর কপালেও তা'ই। তার হেতুটি যে নিহিত তাদের সিংহ ভাগের ঘরেই যে নুন আনতে পান্তা যায় ফুরিয়ে এই ‘বাজে কথা’টি বাদ দিলে, যা দাঁড়ায় তা এই, যে এরা যেহেতু মেট্রিক ‘পাশ দিতে’ই নাকাল, ফলে আব্বিত্তি, নেত্যটেত্য, ডিবেট — হালে এই বাজারে হিট ‘কুইজ’ —- এই সকল ‘কালচার’ ইত্যাদিতে এরা – নীরজাসুন্দরী বালিকা, নীলমনি-পাব্লিক-বিপিন পাল ছেলেরা অচল। জল-অচলও। সুকুমার নিজে পবেসারের ছেলে,মা ইস্কুলের মাস্টরনি, অতএব সে গভর্নমেন্ট বয়েজের। আর যেহেতু সে গভর্নমেন্ট বয়েজ'এ, সুতরাং তার টার্গেট, হ'লে হবে এম-এম-সি গার্লসই। নিজে তখন না জানলেও, এই কারনেই নীরজাসুন্দরীরা তার দৃষ্টিতে ছিল গরহাজির।
কৌতুহলী অনেকগুলি চোখ অনুসরণ করলো সুকুমারকে। লক্ষ্য করলো সুকুমারও। গাছ-সবুজ শাড়ি আর শাদা ব্লাউজ নীরজাসুন্দরী নাইন-টেন মেয়েদের। লক্ষ্য করলো সেদিন। লক্ষ্য করলো পরদিন। তারও পরদিন। টের পেলো আদতে চোখে পড়বার দম রয়েছে গাছ-সবুজ শাড়ি আর শাদা ব্লাউজ নীরজাসুন্দরীদিগেরও। তাদের লগ-ধরতেও আসে অনেক। তারাও অনেকের টার্গেট।
তাদের জন্য আসে,ওয়েট করে, হেঁটে, সাইকেলে লগ-ধরে যারা তারা শ্যামসুন্দর-নীলমণি-পাব্লিক-বিপিনপাল। কিংবা তাদের বসতে হয় দোকানে, বাবা-কাকা-মামা’র দোকানে। সন্তর বাজার, লঙ্গাই বাজারে। হেল্প দিতে হয় ঠেলা-দোকান, তোলা দোকানে। ‘ভুগনি-পরুটা’র ঠেলায়। – ফাসডিভিশন, লেটার তো নয়ই, সেকেন-থাড্ডিভিশন বা কোনো ডিভিশন ছাড়া, পেডিগ্রি ছাড়া ছেলে ছোকরাদের টার্গেট এরা। তাই এরা এরা প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায়না সুকুমারের উপস্থিতি। সন্দেহ ওড়ে ধূলার মতন। ক্রমে, কয়েকদিনে, সপ্তাহে সন্দেহ থেকে জন্মায় কৌতুহল। টার্গেটদিগের।
টার্গেটদিগের নিমিত্ত আসা ‘হিরো’ দেরও – পবেসারের ছেলে, গফট বয়েসে পড়া সুকুমার, তার টার্গেট আছে নীরজাসুন্দরীর কেউ, তার লগ ধরতে সে আসে — বিশ্বাস হয়না। সন্দেহ হয়। কয়েকদিন। তারপর একদিন, শ্যামসুন্দরের বিষ্ণু ওকে ধরে। বলেই ফেলে “কিতা দোস্ত, কিতা মামলা?”... ।
হাসে সুকুমার।
“ কে তুমার টার্গেট?”
আবারো হাসে সুকুমার।
টার্গেট, তার, তখনো, নীরজাসুন্দরীদিগের মধ্যেও হয়নি তার অথবা এম-এম-সি'র “তিড়িং ঝুমা” হেন কেউ তাকে সুমন দত্ত'র মতো প্রপোজ পাঠায়নি।
“অখন স-অ-ব উ টার্গেট”। হাসে সুকুমার। হাসে বিষ্ণু।
“মৌমিতা কে তোর মনে আছে ত”? সুকুমার বলে। আচমকাই বলেওঠে। চমকে যায় বুদ্ধ।
ঠিক ধরতে পারেনা। বলেঃ “কোন মৌমিতা?” বলতে বলতে যে এক মৌমিতা তার স্মৃতিতে আসে কিছুটা তাকেও এই আবহ, এই চালচিত্রের সঙ্গে । কার না কার সুসাইডের সঙ্গে, মৃত্যু বা হত্যার সঙ্গে সেই মৌমিতার কি যোগ?
হঠাৎই স্নায়ু টান টান হয়ে যায় বুদ্ধর। এই সুসাইড মহিলাই কি সেই মৌমিতা?
সুকুমার কি এই বাড়ি, মৌমিতার, জানে?
এছাড়া আর কিভাবে..?
সুকুমারের প্রশ্নদের মতো বলা বাক্যের উত্তর দিতে ভুলে যায় বুদ্ধ।
ভিকটিমের নাম বলেনি পদুম কনেস্টবল। তাহলে?
ক্রমে মনে যা আসছে তাতে দেখাযাচ্ছে মৌমিতার বাড়ি ছিল সুকুমারের বাড়ি, বুদ্ধদের নিজের বাড়ি – পার হয়ে। কানমধু গ্রামের দিকে। অন্তত তখন। আর এ’তো ইমলি বাজার।
আবছা মনে আসে বুদ্ধর।
মৌমিতা। কালো। লম্বা…।
কালো। রবিদাদুর কৃষ্ণকলি-কালো না হলেও, কালো। লম্বা। দলের অন্যদের চেয়ে তো বটেই, পরে দেখা গেছে, মেয়েটি প্রায় সুকুমারের সমান সমান লম্বা। লম্বা চুল। তেল দিয়ে আঁচড়ানো, মাঝখানে সিঁথি করে। চোখে চশমা। পাওয়ার, এম-এম-সি ফার্স্ট গার্ল অপর্ণার মতো প্রবল না হলেও, নিতান্ত কম নয়। আর যদি তেমন পাওয়ার হতোও চশমার, তবু তাকে দেখে এটা স্পষ্ট বোঝা যেতো, যে, সে ফার্স্ট গার্ল নয়। এমনকি এমন কি “পেডিগ্রী” হীন নীরজাসুন্দরী বালিকা বিদ্যালয়েরও, নয় ফার্স্ট, সেকেন্ড, থাড – কোনো গার্লই। স্পষ্ট এ'ও, সুকুমারের সেই ক্লাস টেন মনেই, যে, এর বাবা, আর যাইহোক —- পবেসার নয়। নয় ডাক্তর, উকিল, ব্যাংক এমপ্লয়ি। নয় “এলুমিনি গফ্ট্ বয়েস’। এর বাবাও নিশ্চয় পড়েছে পাব্লিক-নীলমনি-শ্যামসুন্দরে।
লগ ধরা'র দেড সপ্তাহের মাথায়, এই মেয়েটি, এই নীরজাসুন্দরী ভিড় থেকে, চোখে ধরে গেলো সুকুমারের। তবে “টার্গেট” কি একে বলা চলে? এই মুহুর্তে ভাবে সুকুমার, যে, অনতি বছর আগে ঘোষিত এই দেশের অর্থনৈতিক ‘মুক্তি’,বাজার শব্দকে প্রত্যেকের শিরায়, শোণিতে, লোহিত কণিকা করে নেওয়ার আহ্বান-চেষ্টা’র বীজ, এই প্রনণতার মধ্যে খুঁজলে কি খুব ভুল হবে, যে প্রনণতার নিমিত্ত ব্যাংক-ইন্সিওরেন্স এম্প্লয়ি, গভর্নমেন্ট সার্ভেন্ট, ডাক্তর, পবেসার, কয়লা কারবারে টাকা করা বড়লোক – ইত্যাদিরা তাদের কন্যাদের পাঠাতো এম-এম-সি ইস্কুলে অথবা যে প্রনণতার নিমিত্ত পাঠাতো না নীরজাসুন্দরী ইস্কুলে?
নীরজাসুন্দরীর মেয়েকে “টার্গেট” করা না-করা, নীরজাসুন্দরী তে পড়তে না-পাঠানোর গুঢ় প্রনণতার যে কালে এই নীরজাসুন্দরীজনকে করে নিতে চাউছিল টার্গেট সুকুমার, তখনো
“মল্” আসেনি। দিল্লী, বোম্বের কথা জানেনা সুকুমার। তবে কলকাতায় ডিপার্টমেন্টেল স্টোর, বড়জোর সুপার মার্কেট। তখন ‘পি-ভি-আর, আইনক্স’ — শব্দগুলির ভ্রূণও ছিল কি? তখন ছিল ‘হল্’, ‘সিনেমা হল্’। সিনেমা হলের নাম শ্রীদুর্গা, শ্রীরাধা। শংকুদার বাবা “শ্রীরাধা”র প্রজেক্টার চালাতেন। শংকুদার বদান্যতা ও তাঁর কৃপায় প্রোজেক্টার কুঠুরী ও সেখানে দাঁড়িয়ে পুরো সিনেমা দেখে নেওয়ার সৌভাগ্য সুকুমারের হয়েছে। পেয়েছে কেটে ফেলা রিল – যা চোঙ্গায় ঢোকালে পুরো সিনেমা। তখন শামুদা সিনেমা-টিকিট বেচে ব্ল্যাকে। আবার ইন্টারভ্যালে বেচে বাদভাজাও। ইচ্ছা হলে, লোক পছন্দ হলে, শামুদা টিকিট দিয়ে দেয় ফ্রিতেও। – তখন, তখনো ব্যাংক-ইন্সিওরেন্স-বাবু, ডাক্তর,পবেসার, উকিল, ডিএফও, ‘প্রমিনেন্ট বিজনেসম্যান’ “শ্রীরামকৃষ্ণ কাপড়-দোকানী” হেনরা – তাদের কন্যাদের পাঠায় না নীরজাসুন্দরীতে। ছেলেদের দেয়না শ্যামসুন্দর-পাব্লিক-বিপিনপালে। – এ’ও কি নয় ‘বাজার’? মগজে ছাপ্পা হয়ে যাওয়া ‘বাজার’? তাকেই কি ঢাক-ঢোলে, বিজ্ঞাপনে, বক্তিমায় সাহস জুগিয়ে প্রকাশ্য করেনি ‘নিও লিবারেল’ দল?
নীরজাসুন্দরীর মেয়েরা মেট্রিক অব্দি গেলেই “আর-না” “আর না” রবওঠে তাদের বাসায়-ঘরে। বিয়া দেওয়া হয় তাদের। বিয়ার পরে বিয়োতে গিয়ে টপকে যায় অনেকেই। অতএব শহরে হঠাৎই একদিন নতুন আসা গাইনি ডাক্তরনিকে দেখাতে গিয়ে কেউ বলে ওঠেনা “আরে, তুমি দেবযানী না? তুমি এম-এম-সি'ত পড়তায় না? মেজদির ব্যাচমেইট? মেজদি, মানে সুরঞ্জনা”। মানে, নিজেরা ডাকতর-ইঞ্জিনিয়র হয়ার এবং ডাকতর-ইঞ্জিনিয়রের বৌ, বিবি হওয়ার যে বাজার, তাতে নীরজাসুন্দরীরা ছিলনা।
হবু টার্গেটের নাম সুকুমার একদিন জেনে নিলো বিষ্ণুর কাছ থেকেই।
না, বিষ্ণুর টার্গেট নয় মৌমিতা। অন্য আরো দুয়েকজনের টার্গেট। কিন্তু তারা, সেই ‘হিরো’রা, তার লগ ধরে লঙ্গাই বাজার থেকে আর লঙ্গাই বাজার পাওয়ার অনেক আগেই এসে পড়ে সুকুমারের বাড়ি। অতএব নো কনফ্লিক্ট।
“এনারা আপনার সঙ্গে… আচ্ছা দাঁড়ান”।
অকুস্থল অর্থাৎ যে কোঠায় ঘটেছে ঘটনা,তার দরজায় দারোগা। দারোগা জয়ন্ত দাস। তার পুলিশ-চোখ শনাক্ত করে নেয় বুদ্ধকে। আগে এক আধবার দেখেছে মৃন্ময় ডাক্তারের সঙ্গে। আগে না-দেখা মুখ সুকুমারের দিকে পলকে দেখে, দেখে রাখে।
“পদুম, এরা'রে সাইডের ঘর নিয়া বওয়া”।
মৃন্ময় ডাক্তারকে নিয়ে ঢুকে যায় ঘটনা-কোঠায়।
পদুমও নিশ্চিত অকুস্থলে এই প্রথম। একটু ভড়কে যায়। বারান্দার বাল্বছাড়া প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা বুড়োটে পুলিশজন আসে। ঘটনা-কোঠার কিনারে গলী মতন। সেখানে অন্ধকার। তার পরে একটি কোঠা। বন্ধ। বাইরে থেকে। খিল টানা। তার পরের কোঠাটি খোলা। সেখানেই নিয়ে যায় বুদ্ধ-সুকুমারকে।
কোঠাটি বড়। একটি খাট। মশারি খাটানো। মশারি অন্দরে দলামচা লেপ।দেওয়ালে তিনটি ক্যালেন্ডার। দুটি পুরনো বছরের। একটি চলতি ইংরেজি বছরের। দেওয়ালে, সিমেন্ট তাক। তাকে ট্রাংক। লেপ তোষক। আরেক দেওয়ালে, যে দেওয়ালে জানালা, তাতে “তিন মুর্তি”। “তিন মূর্তি” নামটির সঙ্গেই এসেপড়ে মুখগুলি — মিঠুন-ড্যানি-ধর্মেন্দ্র। বুদ্ধ তাদেরই দেখে রামকৃষ্ণ-সারদা-নরেন দত্ত'র বদলে। বসতে হলে বসতে হয় ওই বিছানাতেই।
“আপনেরা ইখনঅ আরাম করইন” — কোনোমতে বলে নিয়ে পদুম কনেস্টবল হাওয়া হয়ে যায় ওই বুড়োটে পুলিশজনের সঙ্গে। হাওয়া হয়ে যেন স্বস্তি পায় পদুম। টের পায় বুদ্ধ কারন সে নিজে অন্তত স্বস্তি পেয়েছে পদুমের বিদায় হওয়াতে।
ভিড় উঠানে ছিল। এখন ভিড় বাড়ে।
পুলিশ সহ কয়েকজন ছিল বারান্দাতেও। বসেছিল কাঠের বেঞ্চিতেও। এই বেঞ্চি কি ছিল আগেই নাকি এই উৎসাহী ভিড়ের নিমিত্ত আনা হয়েছে তাকে? বারান্দায় এখন অনেকজন। তাদের কে ঘটনা-কোঠা থেকে সড়িয়ে রাখাই এখন কাজ, পদুমের আর বুড়োটে পুলিশজনের।
এই কোঠার দরজায় স্প্রিং এ লটকানো পর্দা। এখন একপাশে সে'ও দলামচা। কয়েকটি উৎসাহী মুখ আসে এই কোঠার সামনেও। উঁকি দেয়। তবে এই কোঠার লোকদুটিও “প্লেইন ড্রেস” পুলিশ কিনা, পুলিশের বড় অফিসার বা সিয়াইডি কিনা, স্থির করতে না পেতে চলে যায়। আবার আসে। আবার যায়। ঘুরঘুর করে। সুকুমার এদের দেখে কিনা ঠিক বোঝেনা বুদ্ধ।
কোঠায় কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে সুকুমার সোজা চলে যায় জানলা-অলা দেওয়ালে। খুলে দেয় জানলা। জানলা দিয়ে পশলা এক হিম হাওয়া উঠে এলে বুদ্ধ টের পায়, তারও দরকার ছিল এই খুলে দেওয়ার। এই হাওয়া ঝলকের। এখানে শুধু মৃত্যু নয়, বুক চাপড়ানো রোদন নয়, আরো কিছু মিশে আছে যা দম আনে বন্ধ করে। ঘাম হয় এই শীতের, এই দেরী-রাত্রেও। সামনে নদী। কিন্তু এখন আর নদী নয়। একটি বিরাট প্রানী। রহস্যবাহী, কুয়াশাবাহী। স্রোত নেই। কখনো কখনো ঢেউ, মৃদু আওয়াজে, জানান দেয় নদীত্বের। অথচ এই নদীই জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় থেকে থেকে নিষ্ঠুর। লাস্যে হেউঢেউ।জানলাধারে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায় সুকুমার। বারান্দা-ভিড়ের দিকে পিছন দিয়ে কিনারে গিয়ে দাঁড়ায় বুদ্ধও। সে-ও জ্বালিয়ে নেয় সিগারেট। এইবার, ক্রমে, তার চোখেও স্পষ্ট হচ্ছে সুকুমারের প্রশ্নের মৌমিতা। কালো। লম্বা…।
কালো। রবিদাদুর কৃষ্ণকলি-কালো না হলেও, কালো। লম্বা। “স্পোট-গার্ল”। সেই স্পোর্ট, যাতে দক্ষ, তা ভলিবল। মাঠে মৌমিতা দেখেই সুকুমারের মনে এলো “স্বর্গদ্বার”। শ্মশান। তার হেড চন্ডাল। তার দক্ষতা। তার কন্ট্রোল — মড়া-পোড়া ব্যবস্থা ও বিষয়ে। তার কন্ট্রোল আর সবার উপরেও। তখন অব্দি, ক্লাস টেন অব্দি জীবনে, একটিই মৃত্য আর একটিই শবযাত্রাই সুকুমামারের বাস্তব অভিজ্ঞতা। তথাপি ঐ হেড চন্ডালকে যে টুকে নিয়েছে মন তা ওই হেড চন্ডালেরই ক্রেডিট। খেলা-মাঠে বল আর দল সামলানো মৌমিতা সুকুমারের মনে নিয়ে এলো সেই দক্ষতার, কন্ট্রোলের ছবি।
এর আগে কখনো মৌমিতার খেলা দেখেনি সুকুমার। খেলা বলতে ইন্টার স্কুল ফুটবল আর ক্রিকেটের সেমি-ফাইন্যাল বা ফাইন্যালে, যদি ফফ্ট্ বয়েস থেকেছে, তো গিয়েছে ময়দানে। চিল্লিয়ে সাপোর্ট দেওয়া ছাড়া বা সাপোর্ট দেওয়ার অছিলায় যথাসম্ভব চিল্লিয়ে নেওয়া ছাড়া খেলাধূলার সঙ্গে সংশ্রব নেই সুকুমারের। – এখনকার এই খেলাও ইন্টার স্কুল, ইন্টার স্কুল ক্রীড়া সাংস্কৃতিক বিনিময়ের টুকরো। অতএব স্রেফ “স্পোর্টস” নয়, আছে “কালচার”ও।
সকালে এক রাউন্ড “কালচার” হয়ে গেছে, দুপুরে খেলা, বিকালে আরেক রাউন্ড “কালচার”। অতঃপর প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন। এরপরে ফেরা। যেমন আসা হয়েছিল। দুই বাস ভর্তি করে। মাধ্যমিকের আগে এই শেষ হুলুস্থুল। টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেছে সদ্য। ইশকুল-যাওয়া পাট শেষ। এখন ঘরে বসে প্রস্তুতি আর মাস তিন পরে পরীক্ষা। — কয়েক দশকের দূরত্বে দাঁড়িয়ে আজ, আজই সুকুমার খেয়াল করে যে, ইন্টারস্কুল স্পোর্টস ডে'র দিনটিও ছিল শীতের। ছিল মেঘলা মেঘলা। সকাল ছিল কুয়াশা কুয়াশা। রাত …। …
“ আরে প্রাইজ ফাইজ গুল্লি মার। — ওই স্পোর্টস ডে'তে শালা আসল প্রাইজ পেয়ে গেছি”। — উত্তেজিত সুকুমার বলেছিল বুদ্ধকে।
বুদ্ধ'র বাড়ি এখানে হলেও, ইস্কুল-পড়া তার শিলচরে। সিক্স অব্দি পড়ার পর তার বাবার বদলি হয়ে গেলেন শিলচরে। আর ফিরতি বদলি, এখানে যখন হলো, তখন এরা ক্লাস নাইন। নাইন-টেন এ ইস্কুল বদলানো অনুচিত।
মাসীবাড়িতে থেকে যেতে হলো বুদ্ধকে। টেস্টের পরের এই সময়টা থাকবে এখানেই। এখানেই পড়বে প্রদীপ স্যার আর লালমোহন স্যারের কাছে।
“পরশু দেখাবো” । বলে সুকুমার। গল্প সে করে আসছে আগে থেকেই।
হপ্তা দু'হপ্তায় আসে বুদ্ধ। সেও বন্ধ-দিনে। অতএব দেখার, দেখানোর চান্স হয়নি।
“মানে, টার্গেটে হিট করে দিয়েছিস”। বলে বুদ্ধ। সে’ও প্রায় সমানই উত্তেজিত।
“আরে হান্ড্রেড পার্সেন্ট। চোখে চোখে ত চেনা আগেই। সেদিন স্টেজে কবিতা বল্লাম। শাল্লা, যা ফাটিয়ে হাততালি দিলো। তখনই বুঝে গেলাম হয়ে। হয়ে যাবে। আর ফেরা তো হলো একই বাসে”।
যাওয়ার সময় যে যার ইস্কুল থেকে বাসে উঠেছে। ফেরার সময় ঠিক হলো এরিয়া-ওয়াইজ, দুই অঞ্চলে যাবে দুই বাস। এক বাস পুব-বাজার যেতে যেতে ওই লাইনে যাদের বাড়ি, তাদের নামাবে। আরেক বাস কর্নমধু। দ্বিতীয় বাসে উঠলো মৌমিতা। উঠলো সুকুমার।
“ওর বন্ধুরা আর শ্যামসুন্দর ইস্কুলের বিষ্ণু — দিলো চান্স করে এক সিটে বসবার”।
“স্যার-ম্যাডাম ছিলনা বাসে?”
“আরে এখানেও, লাক। ফেরার সময় জলিল স্যার উঠলেন পুব-বাজার বাসে, আমাদের বাসে নিবেদিতা ম্যাডাম”।
“ তারপর?”
কি ঘটেছিল, কি কি কথা হয়েছিল, কবে, সবই সুকুমার শুনিয়েছে বুদ্ধকে। আজ তার একটি শব্দ, বাক্যও মনে আসেনা বুদ্ধ'র। পরিবর্তে জলরঙ্গ দিয়ে আঁকবার সময় যেরকম, কাগজে ছড়িয়ে দেওয়া জলে রঙ্গের তুলি ছুঁইয়ে দিলেই কালি, মেঘের মতো রঙ, ছড়ায় – তেমনি কিছু রঙ্গ, কিছু শাদাকালো এখন তার সামনে।
কিছু রঙ কি ভেসেওঠে সামনের কুয়াশা-নদীতে? সুকুমারেরও?
স্পষ্ট ছবি কি ছিল সুকুমারের চোখেও — সেসব লগ-ধরা দিনের, ওই স্পোর্টস ডে'র, আরো বেশ কিছু দিনের, সন্ধ্যার, মেলা-দুপুরের?
কিংবা বুদ্ধর কাছে বলা উত্তেজিত বর্ননার?
“আগে তো বলিসনি” — বলে বুদ্ধ।
“আরে, বলবো কখন? বিষ্ণুর সংগে দেখা হলো কলকাতা এয়ারপোর্টে আর সেখান থেকে আমি বোম্বে হয়ে ওই রাতেই বোম্বে-হিথ্রো ফ্লাইটে। সেখান থেকে শিকাগো। শিকাগো নেমেই দেড় ঘন্টার মধ্যে সেন্ট লুইসের ফ্লাইট। সেবারের মতো জঘন্য জেট লেগ আর জিন্দেগীতে হয়নি। ফলে কথাটা কখন মাথা থেকে” —- থামে সুকুমার। একটানে কথাগুলিবনলে ফেলে, থেমে যায় এখানে এসে। কথাটা মাথা থেকে —- কি হয়েছে? উড়েগেছে? ভুলে গেছে বেমালুম? অবশ্যই। আর এই ভুলে যাওয়ারো প্রায় এক দশক হয়ে গেছে। আরো অনেক দশক ভুলেই থাকতো অথবা বাকি জীবনেও হয়তো আর মনেই পড়তোনা যদিনা আজ, এখানে এসে..। এইবার এ'ও মনে করতে পারে সুকুমার, যে, যে কয়েকটি দিন, দুপুর, সন্ধ্যার কথা সে, সেই কিশোর সুকুমার, গল্প করেছে বুদ্ধকে, সেগুলির অন্দর-কথা মনে নেই। তবে এটা আজ স্পষ্ট মনে পড়ে, প্রথম সপ্তাহ দুয়ের পর, গল্প বলার পরে, একটা খচখচানির আমদানী। “ইশ, জাস্ট নীরজাসুন্দরীর না হয়ে এম-এম-সি'র হলে..”। এইবার সাহস করে নিজেকে প্রশ্নটা করেই বসে সুকুমার “ জাস্ট নীরজাসুন্দরীর না হয়ে এম-এম-সি'র হলে, অন্তত বিষ্ণুর কাছে পাওয়া খবরটা কি এভাবে স্রেফ ভুলে যেতে হে সুকুমার চক্রবর্তী?” – এবার সশরীর হয় সেই বাক্যালাপও, সুকুমারের অন্দরে।
“মৌমিতা কে তোর মনে আছে ত”? বিষ্ণু বলে। আচমকাই বলেওঠে। চমকে যায় সুকুমার।
ঠিক ধরতে পারেনা। বলেঃ “কোন মৌমিতা?” বলেই টের পায়, তার মনে, কোথাও ছিল এই চরিত্র মৌমিতা। জং ধরলেও সেই কোঠার চাবি এখনো কেজো।
“হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে আছে।” – হাসিরেখা টেনে আনে সুকুমার।
“আরে তুই ত … তোর তো টার্গেট …”। – বিষ্ণু।
“ইশ, বিষ্ণু, টাইন ফাইজ …”। – সুকুমার।
“হ্যাঁ। মৌমিতা মারা গেছে”।
“হোয়াট? হুয়েন? হাউ?”
“ তিন বছর মতো আগে। প্রোবাবলি সু-সাইড।”
“কেন?”
“শিওর না। বিয়ে হয়েছিল। এক হাই ইস্কুলের স্পোর্টস ট্রেনারের সঙ্গে বিয়ে হয়। তারপরে কিছু ঝামেলা …।”
“ ওহ, তোর তো পাড়ার মেয়ে । ছিল? তোর সঙ্গে যোগাযোগ” – বলে নিতে গিয়েই সুকুমার বোঝে, ভুল হলো। বিষ্ণু, শ্যামসুন্দর ইস্কুল থেকে ফাসডিভিশন, অংকে লেটার। পরীক্ষা দিয়ে তখুনি চান্স পেয়ে যায় এয়ারফোর্সের কিছু একটাতে। এখন সে রীতিমতো সাহেব। অনেক গফ্ট্ বয়েস্ বয় থেকেই তার যাপন বহুদিন গোছানো, মসৃণ। তার সঙ্গে মৌমিতার যোগাযোগ …। নাহ, ইস্কুলের স্পোর্টস ট্রেনারের সঙ্গে যার বিয়ে হয়েছে, নাহ …।
“নাহ, যোগাযোগ আর কই? বাড়িতেই আসি তিন বছরে একবার। তোর সঙ্গেই দেখ, কতো বছর পরে, তাও এয়ারপোর্টে …”।
বাস্তবিক তা’ই। বেশ ক’টি লেটার সহ ইস্কুল ডিঙ্গিয়ে গিয়েছিল সুকুমার। এবার আবার সবই উল্টো। এবার বুদ্ধ ভর্তি হলো করিমগঞ্জে। কলেজে। সুকুমার গেলো শিলচরে। কাকার বাসায় থেকে পড়বে গরুড় চরণ কলেজে। সঙ্গে নেবে কোচিং। ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ট্রান্সের। একই কারনে গরুড় চরণে পড়তে এসেছিল ঋতব্রতাও। এম-এম-সি’র ঋতব্রতা’ও।
নাহ, ঋতব্রতা’ও কাহনে যাওয়া যাবেনা। অন্তত এখন। এখন, এখানে ঋতব্রতা কেন, তার আবহও যদি আসে তাহলেই, ওই আবহের বাত্তিতে, যে বাত্তি বাল্ববাত্তি নয়, যে বাত্তি হেলোজেন, সোডিয়াম, যে বাত্তি হলিউড সিনেমায় দেখানো অপারেশন থিয়েটারে, অচেতন রোগীর মুখে-চোখে, তা এখানে এসে পড়লে, নগ্ন দেখাবে, লেংটা, উদাম দেখাবে, দেখা যাবে সব্বাইকে। এমনকি তার নিজেকেও। অতএব ঋতব্রতা’ও কাহনের দিকে না গিয়ে অথবা ঋতব্রতা’ও কাহন কে, কাহনের কাল কে, পার হয়ে ফিরে আসে সুকুমার। লক্ষ্য করে, কলেজ-শাড়ি, হায়ার সেকেন্ডারি শাড়ি পরিহিতা মেয়েদের। লক্ষ্য করে একদিন, দুইদিন, তিনদিন। কিন্তু না দেখে মৌমিতাকে, না’ত তার বান্ধবীদের কাউকে। ইতিমধ্যে গরুড় চরণ কলেজের একই ক্লাসে পড়া এক ছোকরার ছোটবোন আরম্ভ করেছে লক্ষ্য করতে সুকুমারকে।
“এখন কি মনেহয় বলতো” – সুকুমার। “মনেহয় নির্ঘাত রাস্তায় ঘাটে দেখেছি। পরেও। চিনতে পারিনি নিশ্চয়”। বলে। বলে ফেলে। মুখে। মন তখন সাহস জোটায়। বলে, সুকুমারকেঃ “না চেনাটাই কি নয় স্বাভাবিক? জাস্ট নীরজাসুন্দরীর না হয়ে এম-এম-সি'র হলে, অন্তত বিষ্ণুর কাছে পাওয়া খবরটা কি এভাবে স্রেফ ভুলে যেতে হে সুকুমার চক্রবর্তী? আসল কথা কি জানো, নীরজাসুন্দরী কোনো ইস্কুল নয়। এম-এম-সি ও না। গফট্ বয়েস্ না। শ্যামসুন্দর,পাব্লিক,বিপিনপাল’ও না।”
– “তাহলে নীরজাসুন্দরী কি?”
– “এগুলি আদতে গ্রহ। ভিন্ন ভিন্ন গ্রহ। নীরজাসুন্দরীরা এভাবেই, গফট বয়েসের গুড স্টুন্ডেন্ট কবে তাদের দুধ টিপেছিল স্মৃতি নিয়ে, কবে পাওয়া এক সার্টিফিকেটের মতো তাকে বাঁধিয়ে, দেওয়ালে ঝুলিয়ে তারপর …”।
“তারপর?”
“তারপর কখনো, সে’ও লক্ষের বা কোটির মধ্যে একজনের, বড়জোর একরাত্রের ঘুম বরবাদ করে দেবে, দিতে পারবে। আদতে, নীরজাসুন্দরী যেমন, কোনো স্কুল নয়, তেমনি এই নীরজাসুন্দরীরাও নয় টার্গেট”।
“কিন্তু …”।
নিজের সঙ্গে বিড়বিড় করবার একটা ইতিহাস রয়েছে সুকুমারের। তাই বুদ্ধ একটু সন্ত্রস্ত হয়েই বলেঃ “এই কি বিড় বিড় করছিস একলা একলা?”
“এখানে যে ভিক্টিম, সে’ও, ওই নীরজাসুন্দরীতেই …”। – বলে সুকুমার। কাকে? বুদ্ধকে? নিজেকে না’কি …।
“চলো হে, এখানের কাজ শেষ”। – মৃন্ময় ডাক্তারের স্বর। এই উচ্চারণে তিক্ততা নেই। আছে ক্লান্তি, আছে বেদনার দাগ।
সুকুমার যা দেখেছিলঃ
জানলা দুটি, রাস্তার দিকের, খুলে দিলো জয়ন্ত দারোগা নিজেই, তখুনি গড়িয়ে পড়লো বাইরের, বাউন্ডারির ওই তরজা বেড়াও। খোলা জানলা দিয়ে লাফ দিলো ঝিমনানো হলেও, আলো, বাল্ব-বাত্তির ভোঁতা বর্শা। দেখা গেলো রাস্তার অন্যপাড়ে দাঁড়ানো পুলিশ জিপ। দেখা গিয়েছিল। সুকুমারের দৃষ্টি, যার অন্দরে সাইরেন বাজছিল বহুক্ষণ ধরেই, যে সাইরেন হয়তো ছিল কোডেড-বার্তা, তা’ই এবার ডিকোডেড হয়ে যায়, পলকে। ডিকোডেড হয়ে আটকে যায়, আটকেই থাকে, সেই ডী-কোডার টিতে, ঠিক যেমন ইলেকট্রিক তারে, ইলেকট্রিক-শক হেতুই মড়ে ঝুলে থাকা বাদুড়, যেন বাল্ব-লাইটের টানে এসে, মরে বাল্বের গায়েই লেগে থাকা পোকা। জানলার মুখামুখি ঝুলন্ত। ঝুলন্ত দেওয়ালে। জানলার মুখামুখি দেওয়ালে। ষাট পাওয়ার বাল্ব-বাত্তিতে। ফ্রেম। একটি বাঁধানো বড় ফ্রেম। একটি প্রমাণ-নথী। ছাপানো। সবচে বড়, সবচে’ মোটা আর তার চে’ সামান্য কম মোটা, কম বড় হরফ যায় পড়ে নেওয়া। সুকুমার পড়লো। “ইন্টারস্কুল স্পোর্টস এন্ড কালচারেল মিট”। উপরে। বাঁকা করে, আর্চের মতো করে। পড়লো কি? আদতে দেখামাত্র বুঝে নিলো। বুঝে নিলো তার নিজেরো ছিল এমনই একটি কাগজ টুকরা, আরো অনেক প্রাইজ, সাট্টিফিকেটের দঙ্গলে। আলগা করে বাঁধানোর, ঝোলানোর নয়। তেমন হলে আরো নামী, আরো দামী প্রমাণ-নথী ছিল। আছে। তাই, এটিকে দেওয়ালে যে রাখে, রেখেছে বাঁধিয়ে, তার কাছে নিশ্চয় এ’ই খুব দামী, হ’তে পারে সবচে দামী – প্রমাণ নথী। সালটা পড়া যায়নি। যদিও হরফের লমাত্ব, মোটাত্ব সমানই তবু তার ফন্ট জটিল। তারপরে নাম। যে পেয়েছে এই সাট্টিফিকেট। তার। হাতে লেখা। কালি কলমে। ফলে সময়ের হাতে, হাতে-হাতে, গিয়েছে ধূসর হয়ে। স্বাভাবিক মলিন হয়ে। অতঃপর যা যার পড়া, তা ইস্কুল-নাম। সেই ইস্কুল-নাম “নীরজাসুন্দরী বালিকা বিদ্যালয়”।
★ ★ ☆ ☆