হে ঈশ্বর, এইসব প্রশ্ন, ইতিহাস –
হে ঈশ্বর, মাঝে মাঝে যখন মদ খেয়ে বেহেড হয়ে যাই
আমার মনেপড়ে চাঁদরাম মুন্সীকে।
মাননীয় ঈশ্বর, আপনি তো জানেন, যে চাঁদরাম মুন্সী
, আমার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা অর্থাৎ আমার অতিবৃদ্ধ পিতামহ, ছিলেন প্রবল মাতাল। সেই
আমলে আটটি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে এবং লিখতে জানলেও প্রতি বৈকালে কাছারি থেকে তিনি
ফিরে আসতেন রাজপথে নয়, নালা নর্দমার ভিতর দিয়ে। তাঁর পেছন পেছন আসতো তাঁর পাল্কীর
বেহারারা রূপার মোহরের অঙ্কে তাঁর দৈনিক উপার্জনের বোঝা বয়ে। শোনাযায় সাত সমুদ্র
তেরো নদী পারের এক শাদা চামড়ার ম্যাজিস্ট্রেট্ মুন্সীর মদের সংগ্রহ দেখে লজ্জা
পেয়ে বলেছিলেন ‘এ সব তো আমার বাড়ির বারে’ও নেই...’ অঞ্চলের ঘাঘু জজ্
ম্যাজিস্ট্রেট্ মক্কেলের নিয়ে আসা মুসাবিদার ধরন দেখেই বলে দিতে পারতেন এই
মুসাবিদা চাঁদরামের কিনা।
চাঁদরামের কোনো বাঁধা মেয়েমানুষ ছিল কি’না আমার
জানানেই, জানানেই তাঁর এই পানদোষ নিয়ে তাঁর পত্নীর কোনো হতাশা ছিল কি’না কিংবা
কেনই বা মুন্সী ছিলেন এমন মাতাল। মুন্সীর পত্নী ছিলেন সুন্দরী, সুশীলা। দুই ছেলে
রত্নসম। তথাপিও তাঁর পাল্কীর বেহারারা রূপার মোহরের বোঝা নিয়ে ফিরে এলেও মুন্সী
একদিন আর কাছারি থেকে বাড়ি ফিরে এলেন না। একদিন, দুইদিন করে মাস গেলো, গেলো বৎসর।
তবুও ফিরলেন না মুন্সী। হে ঈশ্বর,এর গহনে কি ছিল কোনো বাঈজী বেশ্যার টান? গোপন
কোনো মারাত্মক অসুখ না’কি অকস্মাৎ একদিন তিনিও ‘ নারীর হৃদয়, প্রেম শিশু গৃহ’র
অসারতা টের পেয়ে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন এই ‘অর্থ-কীর্তি-সচ্ছলতা’র মানচিত্রকে? আমরা
জানিনা।
কাহিনীর যবনিকা আরেকবার উঠেছিল, বহু বৎসর পর, যখন চাঁদরামের ছেলেরা প্রায়
লায়েক, যখন চাঁদরামের পত্নীর দিনগত স্মৃতির থেকেও তিনি বিস্মৃতপ্রায়, তখন। দূর
মফস্বল থেকে মামলা লড়তে আসা বাদী পক্ষের মুসাবিদার রকম দেখেই সন্দিহান হয়ে ছিলেন ঘাঘু
ম্যাজিস্ট্রেট। বাদীকে চাপ দিলেন সাহেব। বল্লেন সত্য না বল্লে তাকেই পুরে দেবেন হাজতে।
চাপের মুখে মানুষটি বল্লো প্রয়াগের পুণ্য স্নানের মেলায় এক সাধু তার দুরাবস্থার কথা
শুনে দয়া পরবশ হয়ে লিখে দিয়েছেন এই বয়ান।
‘চাঁদরাম সন্ন্যাসী হয়ে গেছে। আছে প্রয়াগের দিকে
কোথাও। খোঁজ করো। আমিও করছি’ –এই মর্মে সাহেব ম্যাজিস্ট্রেট খবর দিলেন চাঁদরামের ছেলেদের।
হে ঈশ্বর, তারপর কে কতোটা সন্ধান নিয়েছিলেন মুন্সীর সে আমার জানা নেই তবে মুন্সী যে
আর ফেরেননি সে’তো আপনি ভালোই জানেন।
মুন্সীর এই শিবের গীতের শেষ আখ্যানটি এ’ই, যে, মুন্সীর
পুত্র শিবেন্দ্র বিশ্বাসের ধর্মপত্নী যখন এই সংসারের কর্ত্রী তখন এক দুপুরে এক সাধু এসে হাজির
হয়েছিলেন বাড়িতে। তিনি শিবেন্দ্র বিশ্বাসের স্ত্রীকে দিয়েছিলেন এক রূপার আধুলি যার
এক পিঠে রাম-সীতা-লক্ষণ পুরীর বাহির হয়ে বনে চলেছেন আর অন্য পিঠে রাম বসেছেন রাজা হয়ে,
হনুমান পায়ের কাছে নতজানু, ভরত চামর দোলাচ্ছে ... ইত্যাদি। বল্লেন এই মুদ্রা, তার রামের
সভাদৃশ্যের ছবিটি নিয়ে যতোদিন আসনে থাকবে এই ভিটের উন্নতি স্থগিত হবেনা। সাধুকে প্রণাম
করে শিবেন্দ্র বিশ্বাসের স্ত্রী ঠাকুর ঘরের দিকে যেতে গিয়েও কি ভেবে ফিরে এলেন সদরে।
কিন্তু সাধু তখন ওধাও। চাঁদরামের মতনই তাঁকেও আর পাওয়া যায়নি অনেক সন্ধানে।
হে ঈশ্বর,
চাঁদরামের ঐ মদ খাওয়ার গুনটি ছাড়া আর কিছুই কি বর্তেছে আমার রক্তে? জানিনা। জানিনা
ঐ মুদ্রাটি বিশ্বাস বাড়ির ঠাকুরঘরে সাধুর উপদেশ মতো স্থাপিত থাকা সত্ত্বেও কেন একান্ন
সালে এই ভিটে ছেড়ে তাদের উদ্বাস্তু হতে হয়েছিল। এও ঠিক বুঝতে পারছিনা যে সাধুটি ‘উন্নতি’
বলতে ঠিক কি বুঝিয়েছিলেন কেননা এখন মুদ্রাটি আছে আমার যে পিসীর হেফাজতে তাঁর টাকা পয়সার
অভাব না থাকলেও তাঁর স্বামীটি ‘নাগাল্যান্ডের চোর’ এই অভিধাটি ছাড়া আর বিশেষ কোনো ‘উন্নতি’
করতে পারেননি।
হে ঈশ্বর, নীল রক্ত কী এভাবেই পঁচে গিয়ে দুর্গন্ধ
ছড়ায় শুধু? হাস্যাস্পদ হয়ে ওঠে কিনারের লাল-রক্তী মানুষের কাছে? হে ঈশ্বর আমার গেলাসে
আরেক পেগ দিশী ঢেলে দয়াকরে আমাকে ভুলিয়ে দিন এইসব প্রশ্ন, ইতিহাস –