আমেরিকার ডায়রী। ২০১৫।
১।
আমাদের শৈশব থেকে যৌবনের বহুদিনাবধি
এমেরিকা, প্যারীস, লন্ডন
সবই ছিল মানচিত্রে তবু
আমাদের যাপন ভূগোলে
বিলেতেই থিতু হওয়া মামার পত্রাদি ভিন্ন
বিদেশের অন্য কোনো প্রবেশ ছিলনা।
তিন নম্বর মহাযুদ্ধ যদিওবা হয়নি এখনো
তবুও হঠাৎই সব আগাগোড়া উল্টে পাল্টে গেল।
বন্যার্তের মতো লোক কাতারে কাতারে
জটায়ুর পাখা ছেঁটে নিয়ে
উড়ে উড়ে যেতে লাগলো
শিকাগো, টেক্সাস্ কিংবা ক্যালিফোর্নিয়াতে।
ডলারে ইন্কাম আর রুপি’তে ইন্ভেস্ট করে দেখো
কোটিপতি হলো কতো আদার ব্যাপারী!
ডলার কুবের হওয়া ভাগ্যে নেই, তবু
সামান্য পেটের দায়ে আমিও পাখির ডানা ধার করে এনে
এসেছি কয়েকবার এবং আরও আসবো
চাকরি বাঁচাতে আসব
শিকাগো, টেক্সাস্ কিংবা ক্যালিফোর্নিয়াতে।
অতএব জন্মাবধি আমার সন্ততি
“বাই ডিফ্ল্ট” বেড়ে উঠছে “গ্লোবাল কাল্চারে”!!
সে খুবই আনন্দের কথা, সে অতি গর্বকথা বটে।
তবু আমি অদ্যাবধি – ভয়ে ভয়ে – মনে মনে বলি –
“হে ঈশ্বর, এরা যেন থাকে পেটেভাতে”
২।
আমার শৈশব থেকে যৌবন ও লায়েকত্বের বহুদিনাবধি
আমার বাবা ও মা’র কোনোরূপ ভ্রমণের পিপাসা দেখিনি।
হয়তো অতলে ছিল – তবু দুই পুং সন্ততিকে
পেটে ভাতে দেখে যেতে চেয়ে, ভবিষ্যতে,
সুতরাং সেইসব ইচ্ছা, সুখ, অথবা বিলাস
ভাবনাতেও আনা পাপ ভেবে
ছুটিতে সপ্তাহ দুই হাইলাকান্দি পিসীদের বাড়ি-
শিলচরে কাকা আর ঠাকুমা ও পিসী
-এতদ্ভিন্ন আমাদের ভ্রমণের কোনো
দিগ্বিজয়ী কাহিনী ছিলনা।
আমাদের শৈশব থেকে যৌবনের বহুদিনাবধি
কলিকাতা, পুরী, রাঁচি, জয়পুর, জয়সলমীর
সবই ছিল এ দেশেই তবু
কলকাতায় “স্টাগ্ল্” ও “সেটেল্” করা
ঘাড়ে খাটো কাকাটির এই অজ গ্রামে এসে
‘হাম্বরা’ চাল চলন ছাড়া
আমাদের যাপন পুঁথিতে
কলিকাতার অন্য কোনো সুরভী ছিলনা।
৩।
এখন বাবা ও মা’র দ্বিতীয় শৈশব।
দুজনেরি বহু বন্ধু, বহু সমপাঠী, সহকর্মী, বহু চেনা মুখ
বিহুদিন ইহলোকে নেই।
এখন তাঁদের মর্মে, তাঁদের এই দ্বিতীয় শৈশবে,
টের পাই, বন্যার্তের মতো করে
কাতারে কাতারে উড়ে শিকাগো, টেক্সাস্ নয় –
যাপন পরিধিটিকে আরো একটু ব্যাস দিতে
এখানে ওখানে যেতে, এটা দেখতে, ওটা শুনতে
চুপে সাধ হয় ...।
তারা জানে, আমরাও জানি
মুহুর্মুহু শেষ হয়ে আসে
জীবনের ভাগে পাওয়া এই অতি সামান্য সময়।
...আমি তাই প্রত্যাখান করি
শস্তা বিমানে উড়ে সেন্ট্ লুইস্ থেকে
“গ্রান্ড ক্যানিয়ন” হয়ে বেড়িয়ে আসার মতো
বোদ্ধা সহকর্মীদের “হ্যাভ্ক” প্রস্তাব –
...আমি তাই শিকাগোতে গিয়ে স্ব ইচ্ছায় দলছুট।
ফাঁক পেলে বসে থাকি ডেট্রয়েট্ লেকের কিনারে।
নিগ্রো বেশ্যা সেই কৃষ্ণকলি
ইথিয়োপিয়ায় তার ফেরার স্বপ্নের কথা বলে ...
সান্ ফ্রান্সিস্কোতে আমি বহুবার এসেছি, তথাপি
দেখিনি “গোল্ডেন গেট্”, শস্তা টুরিস্ট বাসে, ইচ্ছাকৃত
যাইনি সফরে।
কখনো বিমর্ষ লাগলে এসেফো’র জাহাজঘাটাতে
বসে থেকে ভাগ করি সময় আর দিশী সিগারেট
আঘাটায় বসে থাকা কলম্বিয়ার পাগলের সাথে...
সন্ধ্যা হলে মদ খাই অন্ধকার ম্যাক্সিকান্ বারে।
৪।
আমাদের শৈশব থেকে যৌবনের বহুদিনাবধি
আমরা “গ্লোবাল্” নয় – “ল্যোকাল” মাছের মতো করে
বেড়েছি রৌদ্রে,জলে, নদীতীরে, পাড়ার পুকুরে ...
চারখন্ড বিশ্বকোষ কিনে দিয়ে বাবা
কলেজে গেছেন হেঁটে – দুটাকা বাঁচাতে –
অনার্সের ক্লাস নিতে – জুলাই দুপুরে ...
জেনেছি সামান্য সোনা – যা ছিল মা’য়ের –
জমি কিনতে গিয়ে তা’ও বন্ধক দিয়েছে ...
প্রোভিডেন্ড ফান্ড থেকে লোন্ করে শেষে
আমাদের ভিত্ আর বারান্দা হয়েছে ...
এখন তাঁদের এই দ্বিতীয় শৈশবে
ওষুধ, পথ্য আর “ব্যাঙ্গালোর” এ “অত্যুন্নত” চিকিৎসার নামে
তাদের ভুলিয়ে রেখে – “জন্মঋণ” শোধ করছি – এমন তৃপ্তিতে –
যদি ফিরে এসে বলি – ক্যামেরা দেখিয়ে – “ এই দেখো ডিজ্নীল্যান্ড,
এই দেখো গ্রান্ড ক্যানিয়নে কি ক্লিয়ার সেল্ফি তুলেছি...”
তাহলে তাঁরাতো ভুলবে। সন্ততির কৃতিত্বে ও স্নেহে –
কিন্তু আমার ফাঁকি, এই ভেল্কিবাজি, এই “গ্লোব” টিকে বয়ে
আমি যাবো কোন্ গৃহে? কোন্ পথ দিয়ে?
যদি “গ্রান্ড ক্যানিয়ন” এ যাই – যাবো এই বাবা আর মা’র হাত
ধরে
যেভাবে আমার হাত ধরেছিল তারা – নেতাজী মেলার মাঠে – হৈহৈ ভিড়ে
...